~~~ষষ্ঠ~~~
।।সন্ন্যাসী বিদ্রোহ , জন্মভূমি বঙ্গভূমি, বন্দেমাতরম মহামন্ত্র এবং বঙ্গেশ্বরী।।
বঙ্গেশ্বরী মাতা ঠাকুরানী, মা বঙ্গেশ্বরী নামকরণ আর একদিক থেকে বিশেষভাবে বিশ্লেষণযোগ্য । এই নামকরনের মধ্যে দিয়ে দেশকে মাতৃরূপে বন্দনা ও দেশমাতৃকাকে দেবী রূপে কল্পনা করা হয় । বিদেশি অত্যাচারে জর্জরিত অবিভক্ত বঙ্গে এই প্রবণতা সূত্রপাত সূচিত হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহের সময়কাল থেকে।
১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ্য করা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আনন্দমঠ উপন্যাসে । আনন্দমঠ প্রথম প্রকাশিত হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকায় চৈত্র ১২৮৭ বঙ্গাব্দ থেকে ১২৮৯ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ধারাবাহিক ভাবে। পরে আনন্দমঠ গ্রন্থ আকারে প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ।
এই উপন্যাসের পটভূমির কেন্দ্রে আছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ।বিখ্যাত বন্দেমাতরম গানটি আনন্দমঠ উপন্যাসের অন্তর্গত ।গানটি রচিত হয়েছিল ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের অর্থাৎ আনন্দমঠ উপন্যাস রচনা প্রায় ছয় বছর পূর্বে।
বন্দেমাতরম গানটিতে দেশমাতৃকাকে দেবী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে । গানের একটি অংশে ” ত্বয়ং হি দূর্গা” কথাটি রয়েছে । প্রাথমিক পর্বে গানটিতে সুর দিয়েছিলেন যদু ভট্ট। এই মহামন্ত্র প্রথম গীত হয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে । গেয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর । অনেকে বলেন যে বন্দেমাতরম মন্ত্রটি সন্ন্যাসী বিদ্রোহের নায়করা উদ্ভাবন করেছিলেন । হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই মন্ত্রসংগীতটিকে নিজ নিজ অভিরুচি অনুসারে পরিমার্জিত করে তাদের সাহিত্য গ্রন্থে স্থান দিয়ে অমরত্ব প্রদান করেছেন ।
পরবর্তীকালে গানটির সুর পরিমার্জন এর প্রথম দুই লাইন এর সুরারোপ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বাকি অংশের সুর সৃষ্টি করলেন সরলাদেবীচৌধুরানী । ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের কংগ্রেস বেনারস অধিবেশনে গানটি পরিবেশন করেন রামভুজ দত্ত চৌধুরীর ভারতী পত্রিকার সম্পাদিকা সরলা দেবী চৌধুরানী।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে সরলা দেবী সংকলিত শতগান এ বন্দেমাতরম গানটিকে দেশরাগ ও এক তালে নিবদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত আনন্দমঠ উপন্যাসে গানটিকে মল্লার রাগ ও কাওয়ালী তালে নিবদ্ধ করে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল । যাইহোক অবিভক্ত বঙ্গের প্রায় সর্বত্র সন্ন্যাসী বিদ্রোহের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েছিল। ধর্মকে আশ্রয় করে শক্তি অর্জন , ঐক্যস্থাপন , অখণ্ডতা ধারণ, শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়াস দেখা গিয়েছিল গ্রামবাংলার সর্বত্র । জন্মভূমি বঙ্গভূমিকে বঙ্গজননী রূপে আরাধনা সূত্রপাত ঘটে সেই সময় থেকে।
আঁটপুর এ প্রসিদ্ধ মিত্র বংশ বরাবরই দেশহিতৈষী কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ।ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তাদের প্রতিষ্ঠিত গ্রামদেবীর নামকরন তাই প্রাসঙ্গিক এবং সময়চিত।পরিকর দেবদেবীগন পুত্রকন্যারূপে কল্পিত হয়ে পরে সংযোজিত হয়েছে বলে মনে করা হয় ।
বঙ্গেশ্বরী মাতা ঠাকুরানর থানে বেশ কিছু লৌকিক আচার পালিত হয়। বিবাহ , উপনয়ন,অন্নপ্রাশন এর মত করে শুভ কাজে গ্রামবাসীর মাকে গড় করে যান। পান সুপারি দিয়ে মাকে শুভ সংবাদ প্রদান করা হয় । চৈত্রসংক্রান্তিতে কুলকাঁটা ঝাঁপ হয়। পুরোহিত গৃহ থেকে নিয়ে আসা হয় শিবকে।
পাঁচদিন মন্দিরে বুড়োশিবের এর পর বিবাহ হয় নীলপুজোর দিন। পুরুষ ও নারী সন্ন্যাসীরা বিবাহ যাত্রায় সঙ্গী হন । সন্ন্যাসীরা মন্দির চত্বরে মাথা_চালেন, অর্থাৎ খাটাখাটনি করেন, ঢাকের তালে নৃত্য সংগীত পরিবেশন করেন । ছোটখাটো একটি মেলা বসে ঠাকুর তলায়। ৫ দিনের মেলা ।
বছরের অন্যান্য দিন বাসরাস্তার একপাশে নিতান্ত ঘরোয়া পরিবেশে প্রাচীন বৃক্ষ তলে আধো অন্ধকারে গর্ভগৃহে বঙ্গেশ্বরী মাতা ঠাকুরানী নিভৃতে নিরালায় পরিবারসহ দিন যাপন করেন। তার অঞ্চলতলে গ্রামবাসীরা নির্ভয় বসবাস করেন। পরমপ্রসন্নবদনা সুখশান্তিপ্রদায়িনী এই বিরলদর্শনা দেবী স্বয়ং আদ্যাপ্রকৃতি। তিনি ক্ষত্রিয় বংশের কুলদেবী ,গ্রামস্থ মানুষের লোকদেবী।
।।সমাপ্ত।।
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ হুগলি জেলার লৌকিক দেব দেবী : চতুর্থ খন্ড