বাঘ মনুরোথ বা কপিলামঙ্গল: গোপূজন বেদ হতে লৌকিক সুপ্রাচীন সংস্কার – পর্ব ৪

পর্ব ৪

শ্যামসুন্দরপুর পরগনার অধীন মন্ডলকুলি গ্রামে আছে অতিপ্রাচীন জগন্নাথ বিগ্রহ । সেথায় বলরাম , সুভদ্রা নেই। দারুব্রহ্ম এখানে একাকী অবস্থান করছেন। জগন্নাথের দারুমূর্তিটি তুঙ্গভূম তথা শ্যামসুন্দরপুরের রাজার প্রতিষ্ঠিত। নিকটস্থ একটি মৌজার  নামও জগন্নাথপুর। উক্ত জগন্নাথ মন্দিরের পূজারী #কর পদবির এক ঘর উৎকল ব্রাহ্মণ। তাঁরা পূজার নিমিত্ত রাজার নিকট হতে কিছু দেবত্তোর সম্পত্তিও কিছু পেয়েছেন। প্রসাদ কর এই পরিবারের মানুষ। তিনিও জগন্নাথ পূজারী ব্রাহ্মণ ছিলেন। জগন্নাথ মন্দিরটি উচ্চতায় স্বল্প , চুনসুরকি নির্মিত দ্বিতল কোঠাবাড়ির শৈলী। 

পুষ্পিকাক্ত পাঠক গৌরহরি দেবশর্মাও মন্ডলকুলি গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তবে তাঁর সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। মন্ডলকুলি গ্রামটিতে হাজার হাজার বছর আগে এক উন্নত সভ্যতার বিস্তার ঘটেছিল। অবশ্যই উন্নত সভ্যতা। শুধুমাত্র উন্নত নয় প্রাচীনও বটে। রাঢ়ভূম মহাভারতের অংশ। মন্ডলকুলি গ্রামে অসংখ্য মন্দির ও সনাতনী মূর্তি এবং সনাতন মার্গীয় জৈন মূর্তির ভগ্নাবশেষ যত্রতত্ৰ ছড়িয়ে আছে।  এটি পুরাস্থল হিসাবেও ভারত বিখ্যাত হয়েছে।

তুঙ্গভূম অতীতে উৎকলের অন্তর্গত ছিল। কিন্তু স্বাধীন ভূম রাজ্য ছিল। আসলে প্রাচীনকালে উড়িষ্যার দুই ভাগ ছিল , উত্তরে ঔড্রদেশ এবং দক্ষিণে উৎকল। আরো পূর্বে এর নাম কলিঙ্গ ছিল তা কারো অজানা নয়।  প্রাক্ ইংরেজ সময় পর্যন্ত তুঙ্গভূমে বাঙ্গলা , ওড়িয়া ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ধারা অক্ষুণ্ন ছিল। শ্যামসুন্দরপুর ছিল তুঙ্গভূমের প্রাচীন রাজধানী। পরে বড় তুঙ্গ এবং ছোট তুঙ্গের শরিকি বিবাদ ঘটে।  একপক্ষের নতুন গড় হয় রসপাল , অন্যজনের গড় হয় শ্যামসুন্দরপুর।  এঁরা উৎকল সংস্কৃতির অব্রাহ্মণ ভূম নৃপতি। রাঢ়অঞ্চল এবং উৎকলের প্রাচীন ভূম রাজ্যগুলির সঙ্গে শ্যামসুন্দরের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল। 

মহাভারতের রাজা বলির পাঁচ পুত্র ছিল : অঙ্গ, বঙ্গ, সুব্হ্ম, সমতট, পৌন্ড্র। বলি রাজার মহিষী সুদেষ্ণার গর্ভেপাঁচ পুত্রের জন্ম হয় । তাদের নামে পাঁচটি রাজ্য । মহাভারতে বলা হয়েছে:

অঙ্গবঙ্গঃ কলিঙ্গশ্চ পুণ্ড্রঃ  সুব্হ্ম তে সুতাঃ।

তেষাঃ দেশাঃ সমাখ্যাতাঃ স্বনামনা কথিতা ভুবি।।

 রামায়ণে দশরথের প্রিয় বন্ধু ছিলেন অঙ্গরাজ্যের  রাজা।মহাভারতে  কর্ণ  ছিলেন অঙ্গরাজ। মহাভারতের পৌন্ড্ররাজ বাসুদেবের কথা রয়েছে, ইনি কৌরব পক্ষে ছিলেন। চেদি রাজ ছিলেন শিশুপাল। মহাভারতে অনুযায়ী কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় পৌন্ড্রবর্ধনের রাজা ছিলেন পৌন্ড্র বাসুদেব,  কৌশিকগুচ্ছে মহৌজা, বঙ্গে সমুদ্রসেন রাজত্ব করেছিলেন।


রাঢ় বঙ্গ, রাঢ় অঞ্চলের মালভূমি , সুপ্রাচীন ভারতের এক প্রাচীনতম ভূখন্ড, গন্ডোয়ানা মালভূমির শেষাংশ। সেই ছোটনাগপুর মালভূমি ক্রমশ অবনমিত হয়ে খড়্গপুরের প্রান্তভূমিতে এসে সমতলে মিশেছে। তাই রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পাহাড় , ডুংরি সমন্বিত এবং অবশিষ্ট অংশ সমতল।

বঙ্গ তথা রাঢ় অঞ্চলের কথা আমরা বহু প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে পাই। ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে বলা হয়েছে – 

অঙ্গান বঙ্গান কলিঙ্গাশ্চ শুন্ডিকান্ মিথিলানথ।

মাগধান্ কর্কখণ্ডাংশ্চ নিবেশ্য বিষয়ে হ ত্মনঃ।।

আবশীরংশ্চ যোধ্যাংশ্চ অহিক্ষত্রং চ নির্জয়ৎ।

পূর্বাং দিশং বিনির্জত্য বৎসভূমিং তথাগতম্।।

বঙ্গ , কলিঙ্গাদির সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে #কর্কখণ্ড নামক এক স্থানের কথা। পন্ডিতগণ অনুমান করেন এই অংশটি হল মালভূমি, পাহাড়, অরণ্য বেষ্টিত লাল মাটির রাঢ় অঞ্চল। যা পরবর্তী কালে মার্কন্ডেয় পুরাণে #কর্বটাশন , পরাশর ভূগোল এবং বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় #কর্বট নামে পরিচিত হয়েছিল।  

মার্কণ্ডেয় পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে ভারতবর্ষরূপ কুর্ম্মের মুখদেশে তাম্রলিপ্ত ও একপাদপদেশের  পরই বর্দ্ধমানের উল্লেখ আছে। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতাতেও ভারতের পূর্ব্বদিকে তাম্রলিপ্ত  সহ এই বর্দ্ধমানের উল্লেখ পাওয়া যায়। 

গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ

দামোদরোত্তরে ভাগে  সুহ্মদেশ প্রকীর্ত্তিতঃ।।

মহাভারত  শুরু করে কালিদাসের রঘুবংশ , জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গসূত্ত প্রভৃতি সহ নানা প্রাচীন গ্রন্থে সুহ্মদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রদ্ধেয় গোপালদাস মহাশয় “নানকার মলুটী’তে #দিগ্বিজয়_প্রকাশ নামে একটি সংস্কৃত ভূগোল গ্রন্থ থেকে প্ৰথমোক্ত শ্লোকটি উদ্ধার করেছেন।

আবার গৌরহর মিত্র বীরভূমের ইতিহাস এর প্রথম খন্ডে দিগ্বিজয়_প্রকাশ থেকেই শ্লোকটির একটি অন্য পাঠের উল্লেখ করেছেন । সেটি হল : 

গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ

দামোদরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।।

অবশ্য  দুটির শ্লোকেই সুহ্মদেশ এবং রাঢ়দেশ শব্দ দুটির

অদল বদলে শ্লোকের মূল অর্থ একেবারেই বদলে যায় না। মহাভারতের সভা পর্বে আমরা জানতে পেরেছি যে ,সূক্ষ্ম এবং রাঢ়দেশ একই এলাকার দুটি নাম। 

শ্লোকটির অর্থ হল গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের পূর্বে দামোদর নদের উত্তরভাগে সুহ্মদেশ ( রাঢ়দেশ)  অবস্থিত।

মহাভারতে বারবার অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুন্ড্র সহ সুহ্মের উল্লেখ পাই।  ভীমের পূর্ব্ব দিগ্বিজয় উপলক্ষে সভাপর্বে লিখিত আছে – 

অথ মোদাগিরৌ চৈব রাজানং বলবত্তরম্।

পাণ্ডবো বাহুবীর্য্যেণ নিজযান মহামৃধে।।

ততঃ  পুন্ড্রাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলম্।

কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম্।।

উভৌ বলভৃতৌ বীরাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।

নির্জ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ।।

সমুদ্রসেনং নির্জ্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম্।

তাম্রলিপ্তঞ্চ  রাজনং  কর্ব্বটাধিপতিং তথা।।

সুহ্মানামধিপঞ্চৈব  যে চ সাগরবাসিনঃ।

সর্ব্বান্ গণাংশ্চৈব বিজিগে্্য ভরতর্ষভঃ।।

পাণ্ডববীর ( ভীম ) মোদাগিরিস্থিত অতিবলশালী রাজা , তীব্র পরাক্রমশালী রাজা পুন্ড্রাধীপ বাসুদেব, কৌশিকীকচ্ছ নিবাসী রাজা মহৌজাকে আপন বাহুবল দ্বারা পরাস্ত করলেন। এরপর তিনি বঙ্গরাজের দিকে ধাবিত হলেন। সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন নরপতিকে পরাজিত করে তাম্রলিপ্তরাজ, কর্ব্বটাধিপতি, সুহ্মাধিপতি ও সাগরবাসীগণকে জয় করলেন।

কালিদাসের রঘুবংশে লিখিত আছে – 

পৌরাস্ত‍্য্যানেষমাক্রামং স্তাং স্তান্ জনপদান্ জয়ী।

প্রাপ তালীবনস্যামমুপকন্ঠং মহোদধেঃ।

অনদ্রাণাং সমুদ্ধর্ত্ত স্তস্মা সিন্ধুররাদিব।

আত্মা সংরক্ষিতঃ সুহ্মৈবৃত্তিমাশ্রিত্য বৈতসীম্।।

বঙ্গানুৎখার তরসা নেতা নৌসাধনোদ্যতান্।

নিচথান জয়স্তান্ গঙ্গাস্রোতো হন্তরেষু সঃ।।

জয়ী রঘু পূর্ব্বদিকে সমস্ত জনপদ আক্রমণ করে মহাসাগরের তালীবনশ্যামল উপকূলে উপনীত হলেন। সুহ্মাগণ বেতস লতার ন্যায় তাঁর আধিপত্য মেনে নিলেন। পরে রঘু নৌবলসম্পন্ন বঙ্গদেশীয় ভূপালগণকে বাহুবলে পরাস্ত করে গঙ্গাপ্রবাহ মধ্যবর্তী দ্বীপে জয়স্তম্ভ স্থাপন করলেন। 

পতঞ্জলির মহাভাষ্যে #বিষয় শব্দের জনপদ অর্থপ্রসঙ্গে অঙ্গ , বঙ্গ, কলিঙ্গ ,সুহ্ম এবং পুন্ড্রের একত্র উল্লেখ করেছেন।

বিষয়াভিধানে জনপদে লুব্ বহুবচনবিষয়াবক্তব্যঃ

অঙ্গানাং বিষয়োদেশঃ অঙ্গাঃ। বঙ্গাঃ। সুহ্মাঃ। পুন্ডাঃ।

মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ হতে জানা যায় গৌতম বুদ্ধের সমকালে লাল বা লাঢ়ের রাজধানী সিংহপুর হতে বিজয় লঙ্কা গমন করে সেখানে রাজ্য স্থাপন করেন। তাঁর নামেই লঙ্কা দ্বীপের নব নাম হয় সিংহল।

উত্তরম যৎ শিলাবত্যাঃ 

অজয়াস্যচৈব দক্ষিণম্

 ভাগীরথ্যাঃ পশ্চিমায়াং তু

 দ্বারকেশ্বরম্ চ্ পূর্বস্যাম্

 জনপদং তদ্ বর্দ্ধমান নাম।

 রাঢ়ী যত্র সন্ততিঃ ॥

 জৈন আচারঙ্গ সূত্রের মধ্যে বজ্জভূমির পথে  কুকুরের উৎপাতের উল্লেখ আছে। তার জন্য নাকি হাতে দণ্ডের ব্যবহার করতে হত মহাবীর ও তার অনুগামীদের । তার উল্লেখ পেয়ে অনেকেই এই কথা প্রমাণে ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে , ২৪ তম তীর্থঙ্কর মহাবীর স্বামী সময় বজ্জভূমি তথা রাঢ় অঞ্চল বা বর্দ্ধমান জনপদ বন্যজন্তুর বিহারক্ষেত্র ও সভ্যতা বর্জিত স্থান ছিল। কিন্তু সেখানেই প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে , যে বর্দ্ধমান বা রাঢ় দেশ ভীম , মোদাগিরিস্থিত অতিবলশালী রাজা , তীব্র পরাক্রমশালী রাজা পুন্ড্রাধীপ বাসুদেব, কৌশিকীকচ্ছ নিবাসী রাজা মহৌজা,  সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন , বিজয় সিংহ প্রমুখ দ্বারা শাসিত, প্রশাসিত হয়েছে, যে রাঢ় যুদ্ধের কারণ হয়েছে , সেই অঞ্চলকে কিভাবে অসভ্য বলা সম্ভব ? 

বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার বিস্তৃতি ছিল। তাই আদিদেব পশুপতি শিবের উপাসনা হত এই প্রাচীন বঙ্গে। বৌদ্ধ জাতকের গল্পে বর্ধমান এবং মেদিনীপুর অঞ্চলে শিবি এবং চেত নামক দুই রাষ্ট্রের উল্লেখ আছে। এই দুই রাষ্ট্রেই শিবপূজার প্রচলনের কথা জানা যায়। এই সব পূজাই হতো প্রাচীন বৃক্ষতলে। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে।  রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ‍্য‍শৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ‍্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে আর বক্রেশ্বরে ছিল ঋষি অষ্টবক্রার আশ্রম। এছাড়াও ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রম ছিল এহেন স্থানে। এমন এক সুসভ্য অঞ্চলকে কিভাবে বা কোন প্রমাণে অসভ্য , জংলী ইত্যাদি বলা হয় তা প্রশ্ন চিহ্নের সৃষ্টি করে। 

রাঢ় বন্য ও সভ্যতা বর্জিত অঞ্চল ছিল না। তার বহু বহু পূর্ব হতেই এই অঞ্চলে উচ্চ সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছিল এবং পরাক্রান্ত ক্ষত্রিয়গণের বাস ছিল। কুরুক্ষেত্রের মহাসমরেও যে তাঁরা স্ব স্ব বীর্য্যবত্তার পরিচয় দিয়ে গেছেন। মহাভারতেই তার উল্লেখ আছে। 

মহাবীর এবং শাক্যসিংহ উভয়েই সমসাময়িক ছিলেন। সিংহলের পালি মহাবংশের  প্রকাশ যে, তৎকালে সিংহপুরে রাঢ় অঞ্চলের রাজধানী ছিল এবং মহারাজ সিংহবাহু রাজত্ব করতেন। তাঁরই প্রিয়পুত্র বিজয় সাত শত অনুচর নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে লঙ্কায় গিয়েছিলেন। তৎকালে  রাঢ়ীয়গণ যে, সমুদ্রগামী নৌকা ব্যবহার করতেন এবং মহাসমুদ্রের ঊর্মিমালা ভেদ করে সমুদ্রাস্তরে ভিন্ন দেশে যাতায়াত করতে সমর্থ ছিলেন।

তৎকালে রাঢ় বা সুহ্মদেশের ভূভাগ সমুদ্র তরঙ্গ বিচুম্বিত ছিল। বর্দ্ধমান স্বামীর আগমন কালে যে স্থান বজ্জভূমি নামে পরিচিত ছিল , তাই মার্কণ্ডেয় পুরাণে ও বরাহমিহিরের গ্রন্থে বর্দ্ধমান নামে উল্লিখিত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ৪ র্থ শতাব্দীতে গ্রীক রাজদূত মেগাস্থিনিস #Gangaridae নামক এক বৃহৎ এবং সমৃদ্ধশালী জনপদের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছিলেন , ” যে বিস্তৃত জনপদের রাজধানী পাটলিপুত্র , সেই প্রাচ্য জনপদের পূর্ব্বদিকে উক্ত গঙ্গারিডি জনপদ।” প্রাচীন , পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক দিওদোরস্ মেগাস্থিনিসের এই মতকে উল্লেখ করে বলেছেন , “গঙ্গানদী গঙ্গারিডি পূর্ব্ব সীমা হয়ে সাগরে মিলিত হয়েছে। ” আবার প্রসিদ্ধ পাশ্চাত্য ভৌগলিক টলেমীর মতে , ” গঙ্গার মোহনার অদূরস্থিত প্রদেশে গঙ্গারিডিগণের বাস। এখানকার রাজা গঙ্গৈ নগরে বাস করেন। সুপ্রাচীন পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকগণ ও ভৌগলিকগণের উক্তি থেকে বেশ মনে হবে যে , বর্তমান ভাগীরথীর  পশ্চিম কূল হতে প্রাচীন মগধের  পূর্ব্বসীমা পর্যন্ত রাঢ় দেশই একসময় গঙ্গারিডি নামে সুপরিচিত ছিল। 

প্লিনি লিখেছেন – ” গঙ্গার শেষাংশ গঙ্গারিডি – কলিঙ্গির মধ্যে দিয়ে গিয়েছে । ” প্লিনির এই বর্ণনা থেকে অনুমান হয় , কলিঙ্গের উত্তরাংশ বা উৎকলের কতকটা তৎকালে রাঢ়দেশের অন্তর্গত ছিল। কেউ কেউ বলেন গঙ্গারাঢ়ী বা গঙ্গালী গ্রীক উচ্চারণের ফলে গঙ্গারিডি হয়েছে। 

পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক দিওদোরাস্ বলেছেন -” গঙ্গারিডিগণের নিকট অসংখ্য রণদুর্ম্মদ হস্তী থাকার কারণে কখনো কোনো বিদেশী রাজা তাঁদের পরাস্ত করতে পারে নি। কারণ ভারতবর্ষের বাইরের সকলকেই হস্তী নামক বিশালাকার প্রাণীকে ভয় পেত। ” প্লিনি লিখেছেন – ” সর্বদা ৬০০০০ পদাতি, ১০০০ অশ্বারোহী ও ৭০০ হস্তী সুসজ্জিত থেকে সেই রাজ্যের নরপতির দেহ রক্ষা করছে। সেই রাজ্যের রাজধানীর নাম পর্থলিস বা পরতালিস্।” খ্রিস্টীয় ১ ম শতাব্দীতে পেরিপ্লাস লিখে গিয়েছিলেন -”  গঙ্গৈ বন্দর হতে শ্রেষ্ঠ মসলিন, প্রবাল, ও নানা মূল্যবান দ্রব্য রপ্তানী হতো।”

রোমের মহাকবি ভার্জ্জিল খ্রিস্টপূর্ব ১ ম শতাব্দীতে উজ্জ্বল ভাষায় বর্ণনা করেছেন – ” তিনি জন্মস্থানে ফিরে যাবেন । সেখানে গিয়ে তিনি একটি মর্ম্মর মন্দির প্রতিষ্ঠা করবেন। সেই মন্দিরের দ্বারদেশে স্বর্ণ এবং গজদন্তের মাধ্যমে গঙ্গারিডিগণের যুদ্ধের অপূর্ব চিত্র ও সম্রাট কুইনিশের লাঞ্ছন আঁকবেন। “

সিংহলের কবি ঐতিহাসিকের মহাবংশ এবং গ্রীক ঐতিহাসিকগণের বর্ণনা হতেই আমরা বেশ উপলব্ধি করি যে, খ্রিস্টপূর্ব ৬ ষ্ঠ শতাব্দী হতে খ্রিস্টপূর্ব ১ ম শতাব্দী পর্যন্ত রাঢ় দেশ সভ্যতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত ছিল। 

সিংহলের মহাবংশে পাই যে , খ্রিস্টপূর্ব ৬ ষ্ঠ সিংহপুর নামক স্থানে রাল বা লাল বা লাঢ় বা রাঢ়ের অধীশ্বর সিংহবাহু রাজত্ব করতেন। তৎকালে এই স্থানে সিংহের বড়ই পরাক্রম ছিল। ( কুকুরের নয় ) …তা থেকেই অথবা রাজা সিংহবাহুর বীর্য্যবত্তার পরিচয় দেবার জন্য মহাবংশকার রাঢ়াধীশ্বরকে সিংহী দুগ্ধে প্রতিপালিত বলে প্রকাশ করেছেন। সেরগড়পরগণার সিংহরণ নামে যে নদী আছে , কেউ কেউ মনে করেন যে ওই নদীর তীরেই সিংহবাহুর রাজত্ব ও সিংহপুর রাজধানীর অবস্থান ছিল।সিংহপুর কালের নিয়মে ধ্বংস হলে এই স্থানের নাম হয় সিংহারন্য এবং সেই থেকেই সিংহারণ নদী নাম হয়। 

তৎপরে গ্রীক ও রোমদের বিবরণী হতে প্রাপ্ত হয়, খ্রিস্টপূর্ব ৪ র্থ হতে খ্রিস্টসীয় ১ ম শতাব্দীর মধ্যে বর্দ্ধমানে পরতালিস্ , গঙ্গৈ ও কাটাদপা নামক তিনটি নগর বা বন্দর ছিল। 

ফরাসী পুরাবিদ্ সেল্টমার্টিন বর্তমান বর্দ্ধমান শহরকেই Parthalis বা Portails বলে স্থির করেছেন। এই নামটি দেশীয় #পরতাল শব্দের বিকৃত রূপ। দিগ্বিজয় প্রকাশে সপ্তজাঙ্গলের বিবরণের  #বঙ্গাল_পরতালের উল্লেখ আছে।  এই প্রসঙ্গ অনুসরণ করলে বলতে হয় যে বর্তমান রাঢ় এবং পূর্ববঙ্গের মধ্যস্থলে #পরতাল বলে কোনো প্রসিদ্ধ স্থান ছিল এবং বিক্রমপুর সেই পরতালরাজের প্রমোদভবন ছিল।

বিদ্বজ্জনানাং ধাসশ্চ বিক্রমপূর্ব্যাশ্চ ভূম্মিশঃ।

পরতালভূমিপস্য তোবিস্থলং বিদুর্বুধাঃ।।

যদি দিগ্বিজয়প্রকাশের পরতাল এবং গ্রীক ঐতিহাসিকগণের Parthalis বা Portails যদি এক হয় তাহলে বর্তমান বর্দ্ধমান শহরকে Portails ধরে নিতে সন্দেহ হয়। যা হোক এই  সম্পর্কে আরো অনুসন্ধান আবশ্যক।

 গঙ্গৈ বন্দরটি কোথায় ছিল তা এখনো স্থির করা কঠিন। তৎকালে যেখানে গঙ্গাসাগর সঙ্গম ছিল, সেখানে গঙ্গৈ বন্দর হওয়া সম্ভবপর । তৎকালে কণ্টকদ্বীপ >কাঁটাদিয়া> অপভ্রংশে কাটাদপা হয়ে থাকবে এবং এখন তার নাম কাটোয়া।

 খ্রিস্টীয় ৭ ম শতকে চৈনিক পরিব্রাজক রাঢ় অঞ্চলে আগমন করেন। তিনি এই স্থানের সমৃদ্ধির কথা উজ্জ্বল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তৎকালীন সুহ্ম বা রাঢ় বা বর্দ্ধমান ভুক্তির একবৃহৎ অংশও কর্ণসুবর্ণ নামে পরিচিত ছিল । তৎকালে এই স্থান বহু জনাকীর্ণ , বহু ধনকুবের ও বিদ্যানুরাগী জনগণের বাস ছিল। তৎকালে এস্থলে ৫০ টি মন্দির এবং ১০ টি বৌদ্ধ বিহার ছিল। 

তবে এই কর্ণসুবর্ণ নিয়ে বিভিন্ন মতভেদ আছে।  কেউ বলেন বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার  রাঙ্গামাটি বা কানসোনা নামক স্থানে এই কর্ণসুবর্ণের অবস্থান ছিল।  কেউ বলেন বর্ধমানের নিকটবর্তী কাঞ্চন নগরই কর্ণসুবর্ণে নামক প্রাচীন রাজধানী ছিল।

 বলা বাহুল্য এই দুইটি স্থানই এক সময়ে বিশেষ সমৃদ্ধশালী ও রাঢ়ীয় সভ্যতার কেন্দ্র বলে পরিচিত ছিল এবং এখনো উভয়স্থানে সেই অতীত কীর্তির নিদর্শন বিদ্যমান। 

যাক , ওই শ্যামসুন্দরপুর , কলিঙ্গ বা উৎকল এসব ভৌগলিক ব্যাখ্যা এবং ভাষাগত ব্যাখ্যা দেবার নিমিত্ত আমি এত কথা বললাম । 

রূপরামের কাব্য ১৬৫০ – ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে লিখিত। তিনি ” আদ্য ঢেকুর পালায় ” লিখেছেন –

পশ্চিম দিগের রাজা সিংহ গজপতি।

ধলরাজা মল্লরাজা যাহার সংহতি।।

অর্থাৎ , এই সময় পশ্চিম  রাঢ়ের মধ্যবর্তী এলাকা পর্যন্ত ছিল উড়িষ্যার রাজা গজপতির সীমা। ধলরাজা অর্থাৎ ধলভূম ( অধুনা ঘাটশীলা থেকে খাতড়া ) এবং মল্লভূমের রাজার তার সঙতি বা স্যাঙাত বা সঙ্গী বা বন্ধু ছিলেন। তুঙ্গভূম ছিল উড়িষ্যার গজপতি বংশের আত্মীয়ের শাসনাধীন। রাণীরা ছিলেন কলিঙ্গের নানা রাজবংশের কন্যা। উনিশ শতক পর্যন্ত তুঙ্গভূমের রাণীরা উচ্চমার্গীয় সাহিত্য ,কাব্য চর্চা করতেন। 

রাজা “তুঙ্গ অবনীনাথ” এবং রাণীরা “পট্টমহাদেবী” , “শিরোমণিদেবী ” ইত্যাদি আখ্যায় নিজেদের পরিচয় দিতেন। রাণীরা ও রাজকন্যারা উচ্চশিক্ষিতা এবং রণকৌশলে পারদর্শিনী ছিলেন। 

উড়িষ্যারাজ #গজপতি প্রতাপরুদ্রের অগ্রজ নকুড়দেব  ১৪৭৩ খ্রিস্টাব্দের পর তুঙ্গভূমের প্রথম রাজা হন এবং #তুঙ্গঅবনীনাথ আখ্যা ধারণ করেন। রাজবংশ সূত্রে এ তথ্য প্রাপ্ত হয় । মাদলা পাঁজি অনুসারে প্রতাপরুদ্র ১৪৫৮ শকাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। 

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা

২. কপিলামঙ্গল

৩. বাংলার পট ও পটুয়া

৪. ঋগ্বেদ

৫. মনুসংহিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.