পর্ব ৩
বাঁকুড়া- পুরুলিয়ায় গোরু বাঁদনা বা কপিলামঙ্গলের গোরুর পট আঁকেন পটুয়ারা। তারপর গোরুর পট , কপিলামঙ্গল , গো মঙ্গল , গোরুর গান বিভিন্ন নামেই রাঢ়ভূমের পটুয়ারা জড়ানো পটটি দেখিয়ে কপিলামঙ্গল গান গেয়ে বেড়ান। এসব গান দ্বিজ কবিচন্দ্রের কপিলামঙ্গল কাহিনীর মৌখিক রূপান্তর। একটি প্রাচীন গোরু বাঁদনা পট আছে বিষ্ণুপুর যোগেশচন্দ্র পুরাকৃতিভবনে। রাঢ়ভূমে এখনও কিছু কপিলামঙ্গল গায়েন আছেন – যেমন – ছোটুলাল রাজোয়াড় ,বয়স – ৭০ , গ্রাম ও পোষ্ট : ধেলাতবামু , বরাবাজর ,পুরুলিয়া। রবি টুডু , বয়স – ৪৬ , গ্রাম : খড়িকাশুলি, রাইপুর , বাঁকুড়া । দশরথ মাহাতো , বয়স – ৬২ , গ্রাম – ধাদকি , হুড়া , পুরুলিয়া। সৃষ্টিধর বাউড়ি , বয়স -৫০ , গ্রাম- মাইতিদুবরাজপুর , ইন্দপুর, বাঁকুড়া। আনন্দ বাউড়ি , বয়স – ৪০ , মাইতিদুবরাজপুর , ইন্দপুর, বাঁকুড়া। গায়েত্রী বাউড়ি , বয়স – ৬৫ , হাটগ্রাম , ইন্দপুর , বাঁকুড়া।
এছাড়াও আছেন দুলু সরেণ , ফটিকচন্দ্র বাউড়ি প্রমুখরা।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , কপিলামঙ্গলের কাহিনী মনসামঙ্গলেও আছে। অধ্যাপক দেবনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সম্পাদিত #কপিলামঙ্গলে কেতকদাস ক্ষেমানন্দের মনসামঙ্গল কাব্যের কপিলা কাহিনীর পরিচয় দিয়েছেন।
দ্বিজ কবিচন্দ্রের এই কাব্যটি রাঢ়অঞ্চলে #বাঘ_মনুরথ পালা হিসাবেও পরিচিত। কেন ? সেই কথা পরবর্তী পর্বে কপিলামঙ্গল নিয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনায় ব্যাখ্যা করব। ব্যাঘ্রভীতি থেকেই বাঁকুড়া পুরুলিয়ায় একটি সিনি ঠাকুর বা দেবীর প্রতিষ্ঠা। তাঁর নাম বাঘরায়সিনি। প্রায় গ্রামেই আখ্যান দিনে বাঘরায়সিনির পূজা হয়। জঙ্গলের পথে বা মাঠে যাতে গোরু ,মোষ ও রাখাল বা বাঘালকে বাঘের শিকার না হয় সেই কামনা থেকে বাঘরায়সিনির উদ্ভব। উপরকার থেকে যেমন নানা প্রাকৃতিক শক্তি বা পূজার সূচনা , তেমন দু একটি পূজা কিন্তু ভীতি থেকেও হত। যেমন এই ব্যাঘ্র পূজা। এই নিয়ে শরৎচন্দ্র মিত্র অসাধারণ আলোকপাত করেছেন তাঁর , The Indian Flok – Beliefs about the Tiger প্রবন্ধে। সেখানে জানা যায় যে , ছোটনাগপুর এলাকার লোকসমাজে ব্যাঘ্র দানবের পূজা বহুল প্রচলিত। গো পালক বা রাখাল-কৃষাণদের বাঘের হাত থেকে বাচাঁতে বাড়ির লোক বাঘরায়সিনি ব্রত করতেন। রাঢ়ভূমে গৃহস্থবাড়িতে বাগাল – রাখালের দল অর্থাৎ যারা গোরু চরানোর কাজ করেন তাঁরা পরিবারের একজন সদস্য হয়ে যান। গোপালকদের সম্পর্কে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে –
গোপঃ ক্ষীরভৃতো যস্তু স দুহ্যাদ্দশতো বরাম্।
গোস্বাম্যনুতে ভৃত্যঃ সা স্যাৎপালেহভৃতে ভৃতিঃ।।
অর্থাৎ, দুগ্ধদ্বারা পালিত দশটি গোপালকের বার্ষিক বেতন একটি দুগ্ধবতী গাভী।
এইভাবেই লোকধর্ম ও গোভক্তি এখনও রাঢ়ভূমের লোকজীবনে প্রভাবশালী হয়ে রয়েছে। কপিলামঙ্গল কাব্যের মূল বেদ , উপনিষদ ,সংহিতাদি হয়ে লোকবিশ্বাসে গভীরভাবে প্রোথিত হয়েছে। দ্বিজ কবিচন্দ্রের এই কাব্য সৃষ্টি স্বার্থক হয়েছে। রাঢ়ভূমের পাটুয়ারা গাঁয়ে গাঁয়ে গেয়ে বেড়ান-
দুঃখ বিনাশিনী মাতা কোপিলারে বাবুহো
তোঁহি মাঞ গঙ্গাকে সমান।
জীবকে উদ্ধার লাগি তোঁহি মাই কপিলা গো
মরতভূমেতে করহ পয়ান।।
বছর পঁচিশ পূর্বে এসব মঙ্গলগান খঞ্জনি বাজিয়ে গাইত মঙ্গল পটের পটুয়া বা গাইয়েরা। গোয়ালের দরজায় শোলার ফুলঘর বেঁধে দিত। ফুলঘর দেখতে রথের আকৃতির ছোট সাদা শোলার টুকরো বা সাদা কাগজে বানানো একটি ঘর মাত্র। তার মাথায় থাকত সাদা সুতো। সেই সুতো দিয়ে গোলায়ের বাতা বা দরজার মাথায় সেই ফুলঘর ঝুলিয়ে পটুয়া মানুষ গান ধরতেন গৃহস্থের উঠানে দাঁড়িয়ে। সেই মঙ্গল গানে গোয়াল ও গরুর জন্য কি করণীয় বা কি নয় , কি করলে বা না করলে কি কি হয় সেসবও বলা হতো।
ভাদ্র মাসে মাসে যে জন গোয়ালে মাটি দেবে
তার মাঠে মরবে হালের বলদ , গোয়ালে গাই মারা যাবে।
দোভাঁজ তুলট কাগজে রচিত কপিলামঙ্গল কাব্য। দ্বিজ কবিচন্দ্রের এই কাব্য রচনাকাল সঠিকভাবে জানা যায় না। রবীন্দ্রভারতীতে রক্ষিত একটি পুঁথির লিপিকাল ১০৪৪ মল্ল সন অর্থাৎ ১৭৩৮ খ্রীষ্টাব্দ। কবির আবির্ভাব কাল বিচার করে অনুমান করা হয় , কপিলামঙ্গল কাব্যটি অন্ততপক্ষে ১৭০০- ১৭৩৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা। হয়তো তার পূর্বেও হতে পারে। তিনি মল্লরাজ রঘুনাথ সিংহেরও সভাকবি ছিলেন। রবীন্দ্রভারতী ব্যতীত বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় , বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিজ কবিচন্দ্রের কপিলামঙ্গল কাব্যের পুঁথি সংরক্ষিত আছে।
প্রাপ্ত এবং রবীন্দ্রভারতীতে সংরক্ষিত পুঁথিটির রচনার সূচনা হয়েছে #শ্রীশ্রী_রাধাকৃষ্ণ_জিউ স্মরণ করে। তারপর পুষ্পিকায় পাওয়া যায় –
” ইতি সন ১২৪৭ সাল , তাঃ ৩০ ভাদ্র সম্বার দিবা আন্দাজি অএক পহরের উক্তে সাঙ্গ। লিখিতং শ্রী প্রসাদ কর সাঃ মন্ডলকুলি পঃগণে স্যামসুন্দর থানা রাইপুর জেলা পুরূল্যা। পঠিতং শ্রীগৌউর হরি দেব সর্ম্মন হরিবোল হরিবোল…..।” হরিবোল ১২ বার লেখা আছে পংক্তি সজ্জা বিন্যাসের খাতিরে।
অর্থাৎ এই পুঁথির লিপিকর প্রসাদ কর এবং পাঠক গৌরহরি দেবশর্মা । তাঁদের নিবাস মন্ডলকুলিতে। তাঁদের দেশ কালের কিঞ্চিৎ বিবরণ দেওয়া কর্তব্য । তবেই পুষ্পিকাটির স্বার্থকতা।
সেই অনেক কাল আগে মন্ডলকুলি গ্রাম পুরুলিয়ার অন্তর্গত ছিল। ব্রিটিশরা তখনও এসব স্থানে নিজেদের পা , ভিত বা পসার জমাতে পারে নি। সেসময় ভারতীয় উচ্চমার্গীয় শিক্ষার শিক্ষাধারার স্রোত পুরো বঙ্গে তথা রাঢ়ভূমিতে প্রবাহিত হতো। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি , পুরুলিয়া, বীরভূম ইত্যাদি অংশের মানুষজন কেউই ব্রিটিশ শাসন মেনে নেন নি। এসব অঞ্চলের প্রবলপ্রতাপী এবং শক্তিশালী মানুষের ভয়ে ব্রিটিশরা বাঁকুড়ার শহরে ক্যাম্প করে থাকত।
১৮৩২ সালে #গঙ্গানারায়ণী_হাঙ্গামার প্রভাব এসব অঞ্চলে এইসব এলাকাতেও পড়েছিল।প্রতিটি ভূম রাজ্যের জমিদারগণ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সূচিত করেন। মন্ডলকুলি গ্রামটি তুঙ্গভূমের অন্তর্গত ছিল। স্থানীয় শ্যামসুন্দরপুরের জমিদারের প্রভাব তখনও ব্রিটিশরা খর্ব করতে পারে নি। ১৮৩৩ সালে কোম্পানির অনিয়ন্ত্রিত আইন XII অনুসারে মানভূম জেলার সৃষ্টি হয়। তার সদর শহরের নাম হয় মানবাজার। ১৮৩৮ সালে মানভূম জেলার সদর পরিবর্তন করে পুরুলিয়া নামক গ্রামে স্থানান্তরিত করা হয়।
পূর্বোক্ত প্রসাদ কর ১২৪৬ সন অর্থাৎ ১৮৪০ – ৪১ পুঁথিটির অনুলিখন করেন। তখন সদরের নামানুসারে জেলার নাম হয় পুরুলিয়া চালু হয়েছিল। আরও অনেকগুলি পুঁথির পুষ্পিকায় ১৮৪০ – ১৮৪১ সালে পুরুলিয়া নামেই জেলার উল্লেখ পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ১৯৫৬ সালের পূর্বেও একবার পুরুলিয়া জেলার সৃষ্টি হয়েছিল।
এই সময় গঙ্গানারায়ণের একচ্ছত্র অধিকার প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু অচিরেই কোম্পানি তা দমন করে। গঙ্গানারায়ণের বিদ্রোহে শক্তি সঞ্চার করেছিলেন তাঁর সহযোগী সর্দার লালসিংহ। ইংরেজরা একেই গঙ্গানারায়ণী হাঙ্গামা বলে অভিহিত করত। এই হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে জঙ্গলমহল জেলাকে টুকরো টুকরো করা হয় ১৮৩৩ সালে। মানভূমের আয়তন হয় ৭৮৯৬ বর্গমাইল । ৩১ টি জমিদারী এই জেলার অন্তর্গত হয়।
#ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা
২. কপিলামঙ্গল
৩. বাংলার পট ও পটুয়া
৪. ঋগ্বেদ
৫. মনুসংহিতা