বাঘ মনুরোথ বা কপিলামঙ্গল: গোপূজন বেদ হতে লৌকিক সুপ্রাচীন সংস্কার -পর্ব ৬

পর্ব ৬

পানুয়া নিবাসী নিত্যানন্দ চক্রবর্তীর পুত্র মুনিরাম। মুনিরামের পুত্রই হলেন শঙ্কর কবিচন্দ্র বা দ্বিজ কবিচন্দ্র। মাতা চম্পাবতী। পিতৃব্যর নাম শোভারাম। শঙ্কর বা দ্বিজ কবিচন্দ্রের দুই পুত্র – কুঞ্জবিহারী ও লক্ষ্মণ। কবিচন্দ্রের মাতুলালয় ওই একই গ্রামে।  মাতামহ গঙ্গাধর মুখপাধ্যায় পানুয়াবাসী ছিলেন – 

মাতামহ মহাশয় দ্বিজ গঙ্গারাম।

দোর্দণ্ড প্রতাপান্বিত স্বগ্রামেতে ধাম।।

গঙ্গারামের বংশধরগণ আজও পানুয়ায় গঙ্গাধর শিবের পূজা করে আসছেন। জানা যায় – ” প্রতি বৎসর চৈKত্র সংক্রান্তি উপলক্ষে এখানে গাজন ও তদুপলক্ষে মেলা বসে । ওইদিন চিরাচরিত প্রথা অনুসারে পার্শ্ববর্তী ডান্নে ও রামবাখড়া গ্রাম থেকে দুটি গাজন এসে এখানে একত্রে মিলিত হয়। “

কবিচন্দ্রের কুলদেবতা দামোদর বিগ্রহ। কবি বলেছেন – ” পানুয়া ভিতরে বন্ড দেব দামোদরে।”  অর্থাৎ, কবির পিতৃকুল পরম বৈষ্ণব। তবে তাঁরা গ্রামদেবতা যাত্রাসিদ্ধি এবং দেবী মহামায়ার পরম ভক্ত। কবিচন্দ্রের সঠিক আবির্ভাব কাল আজও অজানা। তাঁর দৌহিত্র বংশীয় পন্ডিত মাখনলাল মুখোপাধ্যায় কোনোরূপ প্রমাণ নির্ভর না হয়ে সিদ্ধান্ত করেছেন  – খুব সম্ভবত  ৯০৩ মল্লাব্দ বা বঙ্গীয় ১০০৪ সালে তাঁর পিতৃদেবের মাতামহ ঁঁগোকুলানন্দ চক্রবর্তী মহাশয়ের প্রপিতামহ ঁশঙ্কর কবিচন্দ্র, পানুয়ার সুপ্রসিদ্ধ চক্রবর্তী বংশে জন্মগ্রহণ করেন এবং প্রতিষ্ঠালাভ করেন। 

কবি চন্দ্রের জনপ্রিয়তা বোঝা যায় অন্যান্য উল্লেখ থেকে।  যথা #গৌরীমঙ্গল কাব্যে আছে – 

 ” কবিচন্দ্রের  গোবিন্দমঙ্গল বিরচন।” 

এটি ১৮০৬ সালে পাকুড় রাজ পৃথ্বীচন্দ্র রচনা করেন। কৃষ্ণদাসের “স্বরূপ বর্ণনা”- য় আছে –

” কবিচন্দ্র ঠাকুর সেহ হয় বিদ্যাধাম। ” নরোত্তম দাস লিখেছেন –   ” শ্রীধর পন্ডিত বন্দ দ্বিজ রামচন্দ্র।

                     ” সর্ব্বসুখময় বন্দ দ্বিজ কবিচন্দ্র ।।

তবে একথা উল্লেখযোগ্য যে,  বাংলা সাহিত্যের অনেকগুলি কবিচন্দ্রের আবির্ভাব ঘটেছিল। যেমন –  চক্রবর্তী কবিচন্দ্র , যদুচন্দ্র কবিচন্দ্র,  রামদাস কবিচন্দ্র,  বনমালী কবিচন্দ্র ,  জগন্নাথ কবিচন্দ্র,  অযোধ্যারাম কবিচন্দ্র , রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র,  কবিচন্দ্র মিস্ত্রি প্রমুখ। 

উক্ত মাখনলাল মুখোপাধ্যায় কবিচন্দ্রের দৌহিত্র বংশীয় সে কথা বলেছি । তিনি নিজে একটি বংশ তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন – 

নিত্যানন্দ চক্রবর্তী

         |

মুনিরাম 

        |

     শঙ্কর

         |

___________________________

|                                                |

কুঞ্জবিহারী                            লক্ষ্মীকান্ত

    |

গঙ্গাধর

    |

___________________________

|                                               |

রামহরি                             গোকুলানন্দ

মাখনলাল মহাশয়ের মতে কবির পত্নীর নাম ছিল লীলাবতী। কবিচন্দ্রে পুত্রদের নাম যথাক্রমে পাওয়া যাচ্ছে কুঞ্জলাল বা  কুঞ্জবিহারী এবং লক্ষীকান্ত বা লক্ষ্মণ। কবি প্রার্থনা করছেন – 

” জ্যেষ্ঠপুত্র কুঞ্জলালে রক্ষ ভগবান ।

লক্ষণে সদয় হয়ে করহ কল্যাণ। “

কবির গায়েনের নাম বাসুদেব । 

মাখনলাল মুখোপাধ্যায় বীর হাম্বীরের সময়কালকে কবির আবির্ভাব কাল বলে উল্লেখ করেছেন ,যদিও  প্রাপ্ত পুঁথির পর্যালোচনা করলে সেই ধারণা অমূলক হয়ে যায়। কবির  কাব্যগুলির ভণিতায় যে সমস্ত মল্লরাজার নাম পাওয়া যায় তা হতে প্রমাণিত হয় – 

 অন্তত তিনজন মল্ল রাজাদের রাজত্বকাল জুড়ে তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন। সপ্তদশ- অষ্টাদশ শতক জুড়ে তার ব্যাপ্তি। কবি দীর্ঘজীবী হয়েছিলেন । মুদ্রিত কাব্যগুলি পড়লেই বোঝা যায় ভাষাগত বৈশিষ্ট্যের ঐক্য এক , ফলে এগুলি একই দ্বিজ কবিচন্দ্রের লেখা।

বীর হাম্বীরের নাম তিনি কোথাও বলেননি,  তিনি বীরসিংহের নাম বলেছেন এবং তাঁর মদনমোহন বন্দনাটি বর্গি প্রসঙ্গ নেই। ” 

দ্বিজ কবিচন্দ্রের আবির্ভাব কাল রাজা বীরসিংহের রাজত্বকালে শেষদিকে হতে পারে। বীরসিংহের রাজত্বকাল হলো ১৬৫৬ থেকে ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দ। কবি শিবমঙ্গলকাব্যে তাঁর নাম করেছেন- 

” বীর সিংহ মহারাজা 

অবনীতে মহা তেজা 

সদামতি ইষ্টের চরণে।”

বীরসিংগা গ্রামের কথা আমরা সবাই জানি।  রণিয়াড়া গ্রামে ইনি ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে মদনমোহন মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ।

দ্বিজ কবিচন্দ্রের বিষ্ণুপুরী রামায়ণে রাজা রঘুনাথ সিংহেরও প্রশস্তি করেছেন – 

” দ্বিজ কবিচন্দ্র গায় পান্বায় বসতি।

রঘুনাথ সিংহের জয় কর রঘুপতি।। 

রঘুনাথ সিংহের রাজত্বকাল হল আনুমানিক ১৭০২ থেকে খ্রিস্টাব্দ।  অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে কবি রামায়ণ রচনা করেন।  তবে , কবির পৃষ্ঠপোষক রাজা হিসাবে নাম পাওয়া যাচ্ছে গোপাল সিংহের । পরম বৈষ্ণব রাজা গোপাল সিংহ তাকে সভাকবি করে ছিলেন #বীরবৌলি ভূষণ ও পাটের জোড় দিয়ে। ডক্টর চিত্রা দেব লিখেছেন – ” মল্লরাজ গোপাল সিংহ তাঁকে আটাশ বিঘা জমি ও বীরবৌলি ভূষণ দিয়ে সভাকবিরূপে বরণ করে নিয়ে,  তাঁকে মহাভারত অনুবাদের আদেশ দেন।” গোপাল সিংহের সময়েই  শঙ্করকবিচন্দ্র মহাভারত রচনা করেন। এর ভনিতায় বারবার ওই রাজার উল্লেখ করেছেন ; – 

শ্রীযুত গোপাল সিংহ কৃষ্ণ পরায়ণ।

মল্লবংশে দুর্জন সিংহ নৃপতি নন্দন।।

গোপাল সিংহের রাজসভায় সমৃদ্ধ সাহিত্যচর্চার প্রমাণ রয়েছে । তাঁর আমলে ১৭১২ থেকে ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বহুজ্ঞানী – গুণী প্রতিভার আবির্ভাব ঘটেছিল। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন গোবিন্দরাম বন্দ্যোপাধ্যায়,  রামচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, উত্তম দাস, ধনঞ্জয়, রসিক মিশ্র, সাফল্যরাম, দ্বিজ সীতাসুত প্রমুখ। গোপাল সিংহ নিজেও বৈষ্ণবপদ রচনা করেছিলেন।তাঁর রচিত #রাধাকৃষ্ণমঙ্গল , তাঁর পত্নী অনুলিখিত #প্রেমবিলাস পুঁথি পাওয়া যায়।

দ্বিজ কবিচন্দ্র প্রচুর পুঁথি পালা আকারে প্রাপ্ত হয়েছে। তিনশত ষাটটি দেবালয় সমন্বিত মল্লভূমের দ্বিজ  কবিচন্দ্র তিনশ ষাটটি পালাও রচনা করেছিলেন – 

তিনশয় ষাটি পালা আনন্দিত মনে ।

কবিচন্দ্র চক্রবর্তী করিল রচনে।।

তাঁর  কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে শিবমঙ্গল , অনাদিমঙ্গল , বিষ্ণুপুরী রামায়ণ,  ভাগবতামৃত শ্রী শ্রী গোবিন্দমঙ্গল , মহাভারত, কপিলামঙ্গল, শীতলামঙ্গল ,কাপাসের পালা , জীবিতবাহন উপাখ্যান বা জিতামঙ্গল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রসঙ্গত বলে রাখি,  শিবমঙ্গল পুঁথিটি সম্পূর্ণভাবে প্রাপ্ত হয়নি । কয়েকটি পালা পাওয়া গিয়েছে মাত্র । তার মধ্যে #মৎস্যধরা , #হরগৌরী_সংবাদ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।  মাখনলাল মুখোপাধ্যায়ের সংগ্রহেও এই কিছু পালার সহস্ত – লিখিত অনুলিপি রয়েছে।  শিবমঙ্গলকে গবেষকরা বাংলা সাহিত্যে প্রথম শিবমঙ্গল কাব্য হিসাবে ধরেছেন। এটি বীরসিংহ রাজার আমলে রচিত কবিচন্দ্রের প্রথম কাব্য বলে অনুমিত হয়। 

অনাদিমঙ্গল , এটি ধর্মমঙ্গল । এখানে শিব এবং ধর্ম অভিন্ন । এরও সম্পূর্ণ পালা পাওয়া যায়নি। জাগরন ও পশ্চিমোদয় পালা ছাড়াও  শ্রী অক্ষয়কুমার কয়াল সংগৃহিত কয়েকটি পালা চিত্রাদেবের সংগ্রহে রয়েছে ।#নয়নীপালার কয়েকটি পাতা মাখনলাল মুখোপাধ্যায় সংগ্রহ করেছিলেন । 

চিত্রাদেব আবিষ্কা করেছেন #আদি_ঢেকুর পালায় কবি একাধিকবার গৌড়েশ্বরের নাম উল্লেখ করেছেন । আর কোন ধর্মমঙ্গল কাব্যের কবি ধর্মপালের ছেলের নাম উল্লেখ করেন নি । কিন্তু কোবিচন্দ্র দেবপালের নাম উল্লেখ করেছেন – 

তোমার উপরে সাজ্যা আল্য দেবপাল।

বিপাক হইল বড় বাড়িল জঞ্জাল।।

বিষ্ণুপুরী রামায়ণ নামটি সম্পাদক প্রদত্ত এবং এতে প্রকাশিত।  প্রথম প্রকাশ হয়েছিল ১৩৮৬ তে, অক্ষয় তৃতীয়ার দিন।  তনুশ্রী দেবী ছিলেন প্রকাশিকা জামশেদপুর থেকে পুঁথিটি গ্রন্থাকরে প্রকাশিত হয়। 

ভাগবতামৃত শ্রী শ্রী গোবিন্দমঙ্গল পুঁথিটি গ্রন্থাকারে মাখনলাল মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৩৪১ বঙ্গাব্দে পানুয়া রামকৃষ্ণ সাধারন পাঠাগার থেকে প্রকাশিত হয়।

 মহাভারত,  চিত্রাদেবের সম্পাদনায় সাহিত্যলোক হতে মহালয়ার দিন ১৩৮৯ তে প্রথম প্রকাশ হয়। 

 ১৯৭৯ সালে দেবনাথ বন্দোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কপিলামঙ্গল প্রকাশিত হয়। 

 শীতলামঙ্গল গ্রন্থটি অপ্রকাশিত। মাখনলাল মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত রামকৃষ্ণ সাধারন পাঠাগার প্রকাশিত #শ্রীশ্রীশীতলামঙ্গলটি দ্বিজ কবিচন্দ্রের নয় । এটি অন্য শঙ্করের লেখা। এর ভণিতায় বলা হয়েছে – 

শীতলা পদতলে

কাতর শঙ্কর বলে

আসরেতে হও অধিষ্ঠান।

কাপাসের পালা এবং জীবিতবাহন উপাখ্যান বা জিতামঙ্গল অপ্রকাশিত।

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা

২. কপিলামঙ্গল

৩. বাংলার পট ও পটুয়া

৪. ঋগ্বেদ

৫. মনুসংহিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.