বাঘ মনুরোথ বা কপিলামঙ্গল: গোপূজন বেদ হতে লৌকিক সুপ্রাচীন সংস্কার – পর্ব ৭

পর্ব ৭

শুন শুন সর্বজন শুন ইতিহাস ।

শুনিলে সকল পাপ হইব বিনাশ।।

কপিলামঙ্গল পুঁথি পৃথিবীর সার।

মহিতে গোধন বিনা সকলি অসার।।

গোধন পালন কীর্তি নাঞি যার ঘরে।

তার সমান পাপী না দেখি সংসারে।।

সংসারের মধ্যে ভাই গরু বড় ধন।

যার সেবা আপুনি করাচ্ছে নারায়ণ।।

ত্রিলোকতারিণী গঙ্গা চারি বেদে কয়।

গঙ্গাসেবা গরু সেবা এক ফল হয়।।

আলোচ্য কপিলামঙ্গল পালা বা কাব্য “শুনিতে রসলো”।  এর কাহিনী চমৎকার । কাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত  – দেবখন্ড এবং মর্ত্যখন্ড।

 স্বর্গের  কল্পতরু বৃক্ষ , তার কাছে অবস্থান করতেন কপিলা গাই। কিন্তু এদিকে মর্ত্যে এক বিপদ। হোমে , যজ্ঞে আহুতি দেবার নিমিত্ত গব্য , ঘৃত এসকল প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। বিপদে পড়ে ঋষি , দেবগণ আদিদেব মহাদেবের স্মরণাপন্ন হলেন।  মহাদেব এই সংকট নিরসনের ভার নিলেন। দেবতাদের অনুরোধ এড়ালেও শিবের নির্দেশে কপিলা পড়লেন সংকটে। স্বর্গ ত্যাগ করে তিনি কিছুতেই যেতে রাজি নন।  অতঃপর কপিলা  কাঁদতে লাগলেন ,  বললেন”  আমি মর্ত্যে গেলে বড় দুঃখ পাবো । সেখানে বারবার নানাভাবে পিরিত লাঞ্ছিত হব। মর্ত্যবাসী কেবল আমাকে দোহন করেই ক্ষান্ত  থাকবেনা ।  আমার সন্তান আমার দুধ পান করলে বা আমার হতে দুগ্ধ না পেলে তারা আমাকে চোরা গাই । তখন আমি , ” আপনার দোষেতে আপুনি চোর হব।” বারোমাস যন্ত্রণা ভোগ করব । বাঘ,  কুমির , কামটের ভয়ে আমার দিন কাটবে।  মানবজাতি আমাকে অতি ভার বহন করাবে এবং না পারলে প্রচন্ড মারধর করবে। কেউ ছাগলের মত আমার দরদাম করবে, ম্লেচ্ছরা আমার চামড়ায় জিন বানাবে,  দুষ্ট , ম্লেচ্ছরা আমার মাংস ভক্ষণ করবে। অতএব আমি মর্ত্যে যেতে রাজি নই । “

তখন মহাকাল সয়ম্ভূ বললেন , ” কপিলা ,  তুমি যদি মর্ত্যে না যাও তবে মর্ত্যভূমি অশুদ্ধ থেকে যাবে। কেউ যদি প্রহার করে তোমায় , তবে আমি নিজেও সেই প্রহারের ভাগী হব। কেউ যদি তোমাকে পদাঘাত করে বা তোমায় হত্যা করে  তবে সে নরকভোগী হবে। “

শিব বলেন শুন আমি করি নিবেদন।

প্রহার করিব মাগো তুমাকে যখন।।

হাত পাত্যে নিব আমি এই সত্য বলি।

প্রহার বেদনা ঘাত লঞিব সকলি।।

পদাঘাত তুমাকে গো কেহ যদি করে।

মস্তক পাতিয়া নিব সকল অমরে।।

পৃথিবী বহিতে শক্তি নাঞিক কাহার।

তুমি তথা গেল‍্য‍ হব সভার নিস্তার।।

মহাদেবের আদেশে কপিলা গাই মর্ত্যে যেতে রাজি হলেন। 

হরিহর নামে এক গোপের বালক।

মথুরা নগরে ঘর ধর্মের পালক।।

আচার – বিচার বিদ্যা সুশীল সুজন।

হরিহরে সদা ভক্তি হরি পরায়ণ।

লীলাবতী নামে সতী তাহার রমণী।

চিরকাল তপস্যা করয়ে একাকিনী।।

এরপর মর্ত্যকথা । মথুরা নগরীতে হরিহর নাম্নী এক গোয়ালার ঘরে বৈশাখ মাসে আবির্ভাব হলো কপিলা গাভীর।  হরিহর পত্নী লীলাবতী সাদরে বরণ করলেন কপিলাকে। দেবলোক , গান্ধর্বলোক ,যক্ষলোক হতে আনন্দে পুষ্পবৃষ্টি হল।  লীলাবতী স্বপ্নাদিষ্ট হলেন , দৈব গাই জানতে পেরে কপিলাকে মার্তন্ড নদীর জলে পদ প্রখালন করিয়ে, ধূপ ,দীপ ,পাদ্য , অর্ঘ্য দান করে ঘরে তুললেন। 

সুবর্ণ শতেক তলা ব্রাহ্মণকে দিয়া।

লীলাবতী কপিলারে নিলাউত্থিয়া।।

 এর কিছুদিনপর কপিলার সন্তান হল , ছয়টি গাই বাছুর এবং একটি এঁড়ে বাছুর। এঁড়ে বা পুত্রটি ছিল সবার কনিষ্ঠ। তাঁর নাম হ মনুরথ বা মনোরথ।  একদিন মনোরথকে বাড়িতে রেখে কপিলা মেয়েদের নিয়ে অরণ্যে চড়তে গেলেন।

 সেখানে তাঁদের বাঘ আক্রমণ করলে সকলে ছুটে পালালেও , কপিলা বাঘের মুখে পড়লেন ।  মৃত্যুমুখে কপিলার শিশুপুত্র মনোরথের কথা মনে পড়তে লাগল। সে শিশু। তার খাদ্যের জন্য মাতৃদুগ্ধ আবশ্যক। শিশুটি তাঁর পিছুটান। ফলে  তাঁকে অন্তত একটি রাতের জন্য বাঁচতে হবে। অসহায় কপিলা শাস্ত্রীয় যুক্তির অবতারণা করে , ব্যাঘ্রের নিকট সত্যবন্দী হলেন এই শর্তে যে সদ্যোজাতকে দুগ্ধ পান করিয়ে পরের দিবস সায়াহ্নে পুনরায় বাঘের খাদ্য হতে ফিরে আসবেন ।  তখন বাঘ তাঁকে নিশ্চিন্তে ভক্ষণ করতে পারবেন। বাঘ কপিলার শাস্ত্রীয় যুক্তির কথা শুনে ভারী অবাক হল। 

গাই হয়্যা কেমনে বেদের কথা কয়।

 কপিলার কথা মেনে ক্ষুধার্ত বাঘ অপেক্ষা করতে লাগল। গৃহে প্রত্যাগমন করে কপিলা আপন শিশু পুত্রকে বিলম্বের কারণ জানালেন। তারপর,  ঠিক সময়মতো সত্য রক্ষা করতে কপিলা বাঘের নিকট  ফিরে এলেন। এদিকে মনোরথ  গোপনে তাঁর মাতাকে অনুসরণ করলে বাঘের মুখোমুখি হলেন। আপন প্রাণের বিনিময়ে মাতাকে মুক্তি দেওয়ার নিমিত্ত বাঘকে অনুরোধ  করলেন। কিন্ত মা কপিলা তাতে সম্মত হলেন না  এমন সময় মনোরথ বাঘকে যুদ্ধের জন্য আহ্বান জানালেন। মনোরথ প্রতিজ্ঞা করলেন  যে , তিনি বেঁচে থাকতে মাতা কপিলাকে বাঘের খাদ্য হতে দেবেন না।তারপর, ভীষণ যুদ্ধ শুরু হলো। 

তবে যদি মায়ে ধর ছাড়িয়ে আমায়।

দোহাই শিবের যদি নাই মারি তোরে।।

সেই সময় আকাশ বাণী হয় , অনেক মতে ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণগোপাল স্বয়ং এসে বাধা প্রদান করলেন। প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ , ক্ষুধার্ত ব্যাঘ্র জানতে পারল যে কপিলা হলেন দৈব গাভী। তৎক্ষণাৎ, বাঘ নিরস্ত হলো আর ক্ষমা প্রার্থনা করল । কপিলা বাঘকে আশীর্বাদ করে বললেন, বাঘ কেবলমাত্র মহাবলশালী নয় বরং সে হবে বনের #ভট্টাচার্য। বারো বৎসর পরে বাঘের ঋতু হবে এবং সন্তান হবে। বর পেয়ে বাঘ চলে গেল। 

এদিকে লীলাবতীর গৃহে সব গাভী ফিরে আসার পরেও কপিলা ও তার পুত্র মনোরথের বিলম্ব দেখে চিন্তিত হয়ে প্রতীক্ষা করছিলেন। কপিলা ও মনোরথকে ফিরতে দেখে তিনি চিন্তা মুক্ত হলেন। কপিলা তারপর থেকে লীলাবতীর গৃহে কালাতিপাত করতে লাগলেন। এদিকে কপিলাকে ছলনা করে নারদ মুনি ব্যাঘ্র রূপ পরিত্যাগ করে স্বর্গে ফিরে গেলেন। 

কপিলারে ছলিয়া নারদমুনি বরে।

বাঘ মূর্ত্তি তেজি গেলা অমর নগর।।

 এছাড়াও রাঢ়ভূমে গোপট বা  কপিলামঙ্গল পথ দেখিয়ে পটুয়ারা আরো একটি গল্প বলে থাকেন।  সেটি হলো এক শাশুড়ি আর তাঁর সাত বৌমার গল্প।  সেই গল্পও তারা গানে গানে বলে। এক গৃহ স্বামিনীর সাত পুত্রবধূ। কিন্তু তারা কেউ সেবা করতে নারাজ। নানা অজুহাতে গোয়ালে চায়না। কোনো কোনো সময় বাড়ির ছোট বৌমাটি গোয়ালের যেতে বাধ্য হয়। ছোট বউ গোয়ালে গিয়ে গোবরের খিঁচ দেখে কপালে ঘা মারে।  নিজের দুর্গতির কথা ব্যক্ত করে। একদিন রেগে দিয়ে পাঁচমাসের গর্ভবতী গাইকে ঝাঁটার বাড়ি মারে। তাতে অপমানিত দেবী ভগবতী গৃহ ত্যাগ করে চলে যান। গৃহের লক্ষ্মীও চঞ্চলা হয়ে গৃহ ত্যাগ করেন। অমঙ্গল, অশুভ নেমে আসে সংসারে। পথে দেবী ভগবতীর দেখা হয় গৃহ স্বামিনীর সঙ্গে। শাশুড়ি অনেক অনুনয় বিনয় করে দেবীকে পুনরায় গৃহে ফিরিয়ে আনেন এবং সাত পুত্রবধূকে উচিৎ শাস্তি দেন। 

#ক্রমশঃ

©দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঋণ স্বীকার : ১. পানুয়ার ইতিকথা

২. কপিলামঙ্গল

৩. বাংলার পট ও পটুয়া

৪. ঋগ্বেদ

৫. মনুসংহিতা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.