OTT র পর্দায় বাবরের জীবনী – সনাতনী আবেগে আঘাত

‘জীবন ও মৃত্যু, এই দুই যুযুধান সত্তা যখনি রণে একে অপরের মুখোমুখি  হবে, বিজয় সর্বদা মৃত্যুর ই হবে ‘ – এরম ই একটি বিদ্ধংসী সংলাপের অতি আড়ম্বরে ২৭ এ আগস্ট আরম্ভ হলো Disney + Hotstar এর নতুন হিন্দি ধারাবাহিক, ‘The Empire’, যার বিষয় বস্তু হলো, ভারতবর্ষে মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা, জহিরুদ্দিন মোহাম্মদ বাবরের জীবন কাহিনী | ইংরেজ উপন্যাসবিদ, Alex Rutherford এর উপন্যাস, ‘The Empire of the Moguls’ অবলম্বনে সৃষ্ট এই ধারাবাহিকটি  কে শুরুতেই বিতর্ক ও জনরোষের সম্মুখীন হতে হলো কারণ বাবরের মতো এক নৃশংস  শাসক, যিনি হিন্দু ও শিখ বিদ্বেষী হিসেবে কুখ্যাত ছিলেন, তাঁকে এই ধারাবাহিকটিতে গৌরবান্বিত করা হয়েছে | দর্শকদের এক বিপুল অংশ  Disney + Hotstar এর কাছে এই বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে ধারাবাহিকটির সম্প্রচার বন্ধ করতে আবেদন করে | কিন্তু Disney + Hotstar তাদের এই অভিযোগ কে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দ্যায় এবং ধারাবাহিকটির সম্প্রচার বন্ধ না করার সিদ্ধান্ত ন্যায় | তাদের এই সিদ্ধান্তে রুষ্ট জনতা সামাজিক মাধ্যমে  ‘Uninstall Hotstar ‘ নামক আন্দোলন শুরু করে যা এখন ‘trending’ এর শীর্ষে রয়েছে |
প্রখ্যাত  চলচ্চিত্র  পরিচালক, নিখিল আদভানি দ্বারা নির্মিত ৮ অধ্যায় বিশিষ্ট এই ধারাবাহিকটি সৃষ্টির পেছনে কি কোনো গোপন উদ্দেশ্য বা দুরভিসন্ধি রয়েছে? তা থাকলে অবাক হবার কিছুই নেই | অযোধ্যায় রাম মন্দির ধ্বংস করে তার ধ্বংসাবশেষের ওপর বাবরি মসজিদ নির্মাণের দেন তীব্র হিন্দু বিদ্বেষী মোঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন বাবর | ওই স্থানে মসজিদ নির্মাণের পূর্বে একটি মন্দিরের উপস্থিতির প্রমাণ দ্যায় আমাদের দেশের পুরাতত্ত্ব বিভাগ | লোক মুখে প্রচলিত যে ওই মসজিদটির বাবরি নামকরণের আসল কারণ হলো যে ওটি বাবরের অত্যন্ত প্রিয় ক্রীতদাস, বাবরি কে তিনি উৎসর্গ করেন, সেই বাবরি যার সাথে বাবরের প্রেম সম্পর্ক ছিল –  উভকামিতা মোঘল ও তাদের পূর্বসূরি ইসলামিক শাসকদের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল | ৪০০ বছরের কঠিন লড়াই ও দেশের বিভিন্ন ন্যায়ালয়ে শক্ত আইনি যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ২০১৯ সালে যখন আমাদের দেশের সর্বোচ্চ ন্যায়ালয় অযোধ্যায় রাম মন্দির পুনর্নির্মাণের সপক্ষে রায় দ্যায়, এই রায়টি আমাদের দেশের বাম মনোভাবাপন্ন প্রগতিবাদীদের মুখে চপেটাঘাতের মতো কাজ করে যা তারা আজ ও মেনে নিতে পারেনি | ভগবান শ্রী রামের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন করা ওই বামপন্থী প্রগতিবাদীদের আত্মাভিমানে ঘা টি লাগে, এই ধারাবাহিকটি মনে হয় তার ই প্রতিশোধ নেবার একটি অস্ত্র বিশেষ |
 
এ ছাড়াও আরও একটি উদ্দেশ্য আছে বৈকি | আমরা প্রত্যেকেই অবগত আছি যে স্বাধীনতা পূর্ব আমল থেকেই ইংরেজ তথা বামপন্থী ইতিহাসবিদগণ আমাদের দেশের ইতিহাসকে বিকৃত রূপে আমাদের কাছে প্রস্তুত করে এসেছেন | ওদের স্বরচিত বিকৃত ইতিহাসে বীর হিন্দু রাজাদের অতিশয় কাপুরুষ এবং সর্বদা পরাজয়প্রবন হিসেবে বর্ণিত করা হয়েছে | প্রবল পরাক্রমশালী হিন্দু রাজা রানীদের সম্পর্কে নয় কিছুই বলা হয় নি, নয় এতোই অল্প বলা হয়েছে যে তাদের প্রকৃত কৃতকর্মের উপর একেবারেই কোনো ন্যায় বিচার হয়নি |  বামপন্থী ইতিহাসবিদ দ্বারা রচিত ভারতের ইতিহাসের বৈশিষ্টই হলো আমাদের দেশের আক্রমণকারী, লুণ্ঠনকারী, স্বৈরাচারী ক্রুর সাম্রাজ্যবাদীদের গৌরবান্বিত করা যার ফলে মোঘ ল ও তাদের পূর্বসূরিগণ, মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়া থেকে আগত ইসলামিক দখলদারদের সর্বদা পরোপকারী, প্রজাপরায়ণ, শিল্পে পারদর্শী ও সুশাসক হিসেবে লক্ষণীয় করা হয়েছে |
বিগত সাত বছর কেন্দ্রে, ভারতের সনাতন সংস্কৃতি সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ সরকার ক্ষমতায় আসীন থাকার ফলে এ দেশের মানুষের মানসিকতায় একটি আমূল পরিবর্তন বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় – দেশের জাতীয়তাবাদী কণ্ঠগুলি সোচ্চার হয়ে, এই অ সৎউদ্দেশ্য প্রনোদিতভাবে আমাদের দেশের ইতিহাস বিকৃতির সত্যতা জন মানসে ছড়াতে শুরু করে | দেশের সঠিক ইতিহাস দেশের মানুষের সম্মুখে আনার জন্য একটি নির্বাক আন্দোলন শুরু হয় সামাজিক মাধ্যম থেকে নিরীহ চায়ের আড্ডায় | এর ফলে বেশ কিছু লেখনী আমরা পেতে শুরু করি যেখানে ইসলামিক তথা ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের আসল দানবিক রূপটা জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় এবং আমাদের দেশের মূল নিবাসী হিন্দু রাজা ও রানীদের বীরত্বের গাথাও সুচারু রূপে পরিবেশন করা হয় | এই সমস্ত লেখনী বামপন্থীদের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে | বিশ্বের সর্ব প্রাচীন সভ্যতাগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ ই এক মাত্র সভ্যতা যে তার পুরাতন সংস্কৃতি ও মৌলিকতার সাথে বিরাজমান | ভারতের স্বর্ণময় ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলা ও সাহিত্যে তার উৎকর্ষের বিষয়ে যদি ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অবগত থাকে তাহলে পাশ্চাত্যের পক্ষে ভারতের ওপর সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ চালানো অসম্ভব হয়ে উঠবে | তাই ভারতের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কে তার শিকড় থেকে বিচ্যুত করার এবং তাদের মননে পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি ও আদর্শ রুপি বীজ বপন করার সর্ব শ্রেষ্ঠ উপায় হলো ভারতের সনাতন সংস্কৃতি ও সনাতনীদের গরিমা কে বিলুপ্ত করা তথা ভারতের আক্রমণকারীদের মহৎ হিসেবে প্রস্তুত করা | এরই বহিঃপ্রকাশ হলো বিপুল অর্থব্যয় করে এক ক্রুর মোঘল সম্রাট বাবর কে গরিমামন্ডিত করে তার ই এক পেশে জীবন কাহিনীর চলচ্চিত্ররূপ,এই ধারাবাহিকটি কে প্রস্তুত করা হয়েছে |
প্রশ্ন হলো এই যে এই ধারাবাহিকটি ধারাবাহিকটির নির্মাতাগণ কোন বাবর কে গরিমামন্ডিত করছে? তৈমুর লং ও চেঙ্গিজ খানের মতো নিষ্ঠুর বর্বর শাসকদের বংশধর বাবর, যে তার এই দুই পূর্বপুরুষদের ক্রুরতা ও নিষ্টুরতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে? হিন্দু, শিখ এবং ভিন্ন সম্প্রদায়ের মুসলমানদের নির্মম হত্যাকারী বাবর, যার পৈশাচিক সেনা ‘কাফেরদের’ হত্যা করে তাদের নরমুন্ড দিয়ে পর্বতের উপর মিনার তৈরী করতো? এ কথা বাবরের আত্মজীবনী, বাবরনামাতেও উল্লেখিত আছে | সেই বাবর, যার অত্যাচারে অতিষ্ট শান্তিকামি শিখ সম্প্রদায় আত্মরক্ষার স্বার্থে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়? চোখের সামনে ঘটে যাওয়া শিখদের উপর বর্বরতার প্রতিবাদে গুরু নানকদেবে চারটি স্তোত্র রচনা করেন | সেই ভীরু, পরাজয়প্রবন বাবর, যে কিনা নিজের জন্মস্থানের সুরক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিল, প্রথমে বিজয়ী হয়েও সেই জয় ধরে রাখতে পারেনি, হারাতে হয়েছিল নিজের জন্মস্থান ফারগনা ও সমরখন্দ কে, শেষমেশ নিজের পরম শত্রু, ক্রুর উজবেক শাসক শৈবানি খানের কাছে পরাজিত হয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে নিজের ভগ্নি, খানজাদার সাথে শৈবানি খানের বিবাহ দিয়ে সে তার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সমরখন্দ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয় | কাবুল থেকে তাশকেন্ট – সব যায়গায় যাকে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয় সেই বাবর? সেই অসহায়, দিকভ্রষ্ট বাবর, যে ভারত দখলের পূর্বে কপোর্দকশূন্য হয়ে কতিপয় মিত্রর গৃহে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল? আর ভারত দখল? পতনমুখী লোধি    সাম্রাজ্যের শেষ সুলতান, দুর্বল, দামভিক, নিজের সেনা, সামন্তের  কাছেই অত্যন্ত অপ্রিয় ইব্রাহিম লোধি কে পানিপতের প্রথম যুদ্ধে হারানো টা বাবরের পক্ষে এমন কিছু কঠিন কাজ ছিল না, বিশেষত যখন লোধির  সামন্তদের সাহায্য ও সেটা পেয়েছিলো  | তাই ভারতে মোঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করায় তার  কোনো মহত্য প্রমান হয় না  |  এ হেনো মেরুদণ্ডহীন অথচ নির্মম, লক্ষহীন অথচ প্রতিহিংসাপরায়ণ, অসহিষ্ণু এবং আদপে দুশ্চরিত্র একটি দানবিক প্রবৃত্তির মানুষ কে গরিমামন্ডিত করার মূল উদ্দেশ্য হলো আমাদের দেশ ও তার সনাতন সাংস্কৃতি কে কালিমালিপ্ত করা |
যে সমস্ত বামপন্থী প্রগতিবাদী বিদ্দ্বৎজন আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎ , বিশেষত চলচ্চিত্র জগতের মধ্যমণি হয়ে এই ধরণের কৃতকর্ম লিপ্ত হয়ে রয়েছেন তাঁদের ও যে সমস্ত মাধ্যম এই কৃত কর্মগুলির প্রচার করতে সাহায্য করছে, যেমন দিসনি + হটস্টার, তাদের সমষ্টিগতভাবে বর্জন করাটাই কাম্য এবং এদের অকৃতকর্মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান ভাষা হওয়া উচিত, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরণের ভুল করা থেকে তারা বিরত হন।  এদের একটি বিষয় স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেওয়া প্রয়োজন যে এতো সহজে ভারতের সনাতনীদের আবেগ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা যায় না।  এই ভাবেই আমরা সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে আমাদের দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কে রক্ষা করতে সক্ষম হবো।বর্তমান যুগের প্রখ্যাত কবি তথা গীতিকার মনোজ মুনতাশির মহাশয় কে সাধুবাদ জানাই – উপরোক্ত সমস্ত সত্য দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার সৎ সাহস  তিনি দেখিয়েছেন যা এরম আরও অনেক জাতীয়তাবাদী কণ্ঠ কে সোচ্চার হবার প্রেরণা যোগাবে |

  • রণিতা চন্দ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.