অতীশের আধ্যাত্মিক যাত্রা: ভারত থেকে সুমাত্রা হয়ে তিব্বত

এ হ’ল বিখ্যাত ইন্দো-তিব্বতীয় বৌদ্ধ পন্ডিত অতীশের জীবনগাথা। যিনি দীর্ঘ নয় সপ্তাহের ধ‍্যানযোগের মাধ‍্যমে মন নিয়ন্ত্রনের কৌশল এবং পরমজ্ঞান করায়ত্ত করেছিলেন। এই আলোচনার​ মধ‍্য দিয়ে তাঁর শৈশব, শিক্ষা, শিক্ষা পরবর্তী জীবনের উপর আলোকপাত করার​ প্রয়াস করা হ’ল।

জীবনের অনেক ধরনের ভ্রমণ হয়ে থাকে। কিছু হয় পরিকল্পিত আবার কিছু অপরিকল্পিত এবং তাই তা নিয়ন্ত্রনের দায়ভার কখনো থাকে মানুষের​ হাতে আবার কখনো নিয়তির​ হাতে। এই যাত্রা কোনো এক বিশেষ ব্যক্তির জন্য নয়, বরং সমগ্ৰ মানব জাতির জন্য, সর্বকালের, চিরন্তন। এই গল্প এমনই এক মানুষের এবং তাঁর যাত্রার, যিনি কালের স্রোতের​ সাথে এগিয়ে গেছেন নিরলসভাবে​ কিন্তু কখনো ভেসে যাননি: তিনি হলেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। এ হ’ল একজন রাজপুত্র, সন্ন্যাসী, গুরু, সর্বোপরি একজন তীর্থযাত্রীর জীবন কাহিনী।

পূর্ব দিকে যাও

হাজার বছর আগে, ১০১১ বা ১০১২ খ্রীষ্টাব্দে(সিই)। বঙ্গোপসাগরের কাছে।

সময়টা ছিল ভোরবেলা, অন্ধকার ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছিল কিন্তু তখনও পুরোপুরি যায় নি, এরপর আস্তে আস্তে চারদিক আলোকিত হয়ে যাবে কিন্তু তখনও হয়নি। রাতের সাথে দিনের মিলন ঘটবে খুব তাড়াতাড়ি, সমুদ্রের​ থেকে আসা তাজা শীতল বাতাস স্পর্শ করছে আত্মাকে… সম্ভবত তখনই দীপঙ্কর প্রথম শুনতে পান কেউ যেন তাঁর কানে ফিসফিসিয়ে​ বলছে, ‘পূর্বে যাও’।

ছোট বড় নদীগুলি এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে সমুদ্রের দিকে। সেই স্রোতের উপর দিয়েই​ নৌকা চালিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মানুষ নিয়ে নয়, একটি প্রার্থনা দিয়ে। অন্য তীরে পৌঁছানোর জন্য এই প্রার্থনা। এ হ’ল সোনার দ্বীপ সুবর্ণদ্বীপ থেকে অনেক দূরে, সমুদ্রের ওপারে, একটি মঠে যাবার পথ।

সেই মঠে এক গুরু থাকতেন। তিনি হলেন শিক্ষকদের শিক্ষক। গুরুর গুরু। ধর্মকীর্তি, ধর্মের কীর্তি।

অতীশকে তাঁর কাছে পৌঁছতে হবে। যেকোনো উপায়েই, যেকোনোভাবেই। ধর্মকীর্তি একটি গোপন চাবির​ অধিকারী হয়েই ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন​। সেটা ছিল একটি ধর্ম-চাবিকাঠি, যাকে পুনরায় আবিষ্কার করে পুনঃস্থাপন করতে হবে। অতীশ জানত যে তাঁকে পূর্ব দিকে যেতে হবে, সেই সূর্যের দিকে যা এখন কোমল ভাবে উদিত হয়েছে।

১২৫ জন যাত্রী নিয়ে সেই​ নৌকা চললো প্রাচীন নৌবন্দরের দিকে – যা পরবর্তীকালে মালাক্কা প্রণালী নামে পরিচিত হয়েছে। মূল্যবান সোনার সন্ধানে ব্যবসায়ীরা চলেছে, আর বৌদ্ধ পণ্ডিত এবং ছাত্ররা চলেছে সেই দুর্লভ,অমূল্য হীরার সন্ধানে: বোধিসত্ত্ব, জ্ঞানের জাগরণে।

সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের বিনিময়

ভারত ও চীনের মধ্যে সমুদ্রপথে সুমাত্রার দ্বীপ সুবর্ণ দ্বীপ ছিল বস্তুগতগত ও আধ্যাত্মিকতা​ – দু’ধরনেরই সাংস্কৃতিক বিলাস বিনিময়ের কেন্দ্র।

সপ্তম শতাব্দীতে, অতীশের প্রায় তিনশো বছর আগে, চিনা তাং রাজবংশের সন্ন্যাসী যিনজিং ভারতে যাওয়ার পথে সুবর্ণদ্বীপ মঠে বেশ কয়েক মাস অতিবাহিত করেছিলেন বিভিন্ন বৌদ্ধ বিদ‍্যালয়ের মহাযান, থেরবাদ ও বজ্রায়ন সম্প্রদায়ের হাজার হাজার বিদ্বান এবং তীর্থযাত্রীর সাথে। তাঁর গল্প ও চর্চার মধ্য দিয়ে এই দ্বীপ পাড়ি দিয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে জাম্বুদ্বীপের বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র এবং আরও অন‍্যান‍্য জায়গায়।

নবম শতাব্দীর শেষ দিকে নালন্দার শৈলেন্দ্র রাজবংশের রাজা বালপুত্রদেব, যিনি একসময় সুবর্ণ দ্বীপে শাসন করেছিলেন এবং সেখানে একটি মঠ এবং মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।

সেই দশম শতাব্দী থেকে নালন্দার মাধ্যমে যে আধ‍্যাত্মিকতা আদান প্রদানের ধারা শুরু হয়েছিল অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের হাত ধরে, সেই ধারা এখনও পর্যন্ত অপরিবর্তিত রয়েছে জাম্বুদ্বীপ এবং সুবর্ণ দ্বীপের মধ্যে।

অতীশ: বহু গুরু, নানান মার্গ, একটি লক্ষ্য

এই যোগীর জন্ম বাংলার সাহোরের রাজবংশে। কিন্তু রাজ বংশের সমস্ত আরাম আমোদ হেলায় ত‍্যাগ করে অতীশ জাম্বুদ্বীপের বহু মহাসিদ্ধের কাছে আধ্যাত্মিকতার পঠনপাঠন করেছিলেন।

তান্ত্রিক যোগীদের মধ‍্যে ছিলেন অবধুতিপ এবং রাহুলগুপ্তবজ্র, পণ্ডিত-সন্ন্যাসী বোধিভদ্র, বিদ্যাকোকিলা, জিতারি। তিনি ছিলেন লোঘুশ্বম্বরা তন্ত্রের মতো একাধিক যোগিনী তন্ত্রের বংশধারক এবং তিনি হেভাজ্র তন্ত্র, ক্রিয়া তন্ত্র এবং এমনকি অনুত্তর যোগ তন্ত্রের উপরের গভীর উপলব্ধি অর্জন করেছিলেন। মাত্র ২৯ বছর বয়সে মহান শীলারক্ষিতের কাছ থেকে মহাসংঘিকা ধর্মানুষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত হন। তারপরে জাম্বুদ্বীপে ১৫৭ জন আধ্যাত্মিক গুরুর কাছ থেকে বৌদ্ধ জ্ঞান লাভ করেন।

এই মহানগুরুর, আধ্যাত্মিক পারদর্শীতা​ এখন ছড়িয়ে পড়েছে জাম্বুদ্বীপ থেকে সমুদ্র পেরিয়ে সেই সুবর্ণ দ্বীপে, যেখানে একদিন এই মহাজ্ঞানী পাড়ি দিয়েছিলেন শিক্ষা এবং জ্ঞান লাভের আশায়।

ধর্মকীর্তি সুবর্ণদ্বীপ: স্বর্ণ দ্বীপের নিয়ন্ত্রনকারী

যার হৃদয় কাননে জ্ঞানের ফুল প্রস্ফুটিত হয়েছিল সেই গুরু হলেন ধর্মকীর্তি, যিনি সেরলিংপা নামেও পরিচিত। শৈলেন্দ্র রাজবংশের পানাংকরন রাজ পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম শতকে জাভার এই মহান জ্ঞানী ব্যক্তি আগুনের পর্বতের পাদদেশ মেরাপি গড়ে তোলার সাহস করেছিলেন। মেরাপী – সংস্কৃত অর্থ মেরু>পর্বত, এপি ফায়ার – জাভার সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেয়গিরি।

রাজা পানাংকরন বোরোবুদুরে অবিশ্বাস্য স্তূপ এবং দুটি মন্দির তৈরি করেছিলেন – ক্যান্ডি কালাসন এবং ক্যান্ডি শাড়ি – এগুলো ছিল দেবী তারার মন্দির। ইনি হলেন সেই দেবী তারা, যাঁর আশীর্বাদ আজীবন অতীশের মাথার উপর ছিল এবং তাঁকে সঠিক পথে চালনা করেছিলেন।
জাম্বুদ্বীপ থেকে তেরো-মাসের বিপজ্জনক সমুদ্র যাত্রার সময় যে মূলমন্ত্র তাকে বেশী শিখতে হয়েছিল তা হ’ল: প্রেম।

অতীশের কথায়, “আমি যে সামান্য উষ্ণ হৃদয়ের অধিকারী হয়েছি তা আমার গুরু সেরলিংপার করুণার কারণে। এজন্যই আমার বংশের উপরেও আশীর্বাদ রয়েছে ”

সেরলিংপা বা ধর্মকীর্তি তাঁদের হৃদয়ে যে জ্ঞানের বীজ ধারণ করেছিলেন, সেই বীজ প্রস্ফুটিত হয়েছিল সুবর্ণদ্বীপে: এ ছিল পদ্মের শিক্ষা।

শুদ্ধ শিক্ষা: বিমলকীর্তি

শুকনো মাটিতে যেমন পদ্ম জন্মে না, প্রয়োজন হয় নোংরা জল, কাদার, বোধিসত্ত্বের জন্যও সেইরকমই দরকার, মনের জাগরণের​ এবং দরকার আবেগ, আকাঙ্ক্ষার এবং আত্ম সংযমের কাদামাটির। দ্বাদশ শতাব্দীর তিব্বতীয় পন্ডিত সে চিল্বুর একটি বিখ্যাত মন্তব্য করেছিলেন, যা ছিল অ-বৌদ্ধ বিদ্যালয়ের মত: স্ব-অভিমান (অহং) বর্জন না করে তাকে প্রশিক্ষণের ভিত্তি হিসাবে ব্যবহার করুন।

শাস্ত্রজ্ঞ ধর্মকীর্তির সংগ্রহ করা সূত্রগুলো এশিয়ায় বৌদ্ধধর্মের ফুল বিকশিত করতে সাহায্য করেছিল। এই সূত্র বুদ্ধ দেননি, দিয়েছিলেন এক গৃহকর্তা: বিমলকীর্তি। তিনি ছিলেন লিচ্ছবি বংশের সমৃদ্ধ বণিক। প্রাচীন ভারতের বৈশালী, বৃজি মহাজনপদে বাস করতেন এবং উনি ছিলেন শাক্যমুনি ও বুদ্ধের সমসাময়িক।

বিমলকীর্তির শিক্ষাগুলো যেখানে সংকলিত হয়েছিল তা হ’ল “বিমালকীর্তি নির্দর্শন সূত্র”। মনে করা হয় যে এই সংকলনটি প্রায় ১০০-২০০ খ্রিস্টাব্দের এবং এটা ছিল মহাযানের প্রারম্ভিক গ্রন্থ। প্রাণবন্ত পর্ব এবং হাস্যকর স্পর্শগুলির মাধ্যমে যা জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে, সবরকম অবস্থার জন্য শিক্ষা দিয়ে গেছে। কখনো দেবদেবীর মাধ্যমে, কখনো খাবার বা পরিবার, আবার কখনো বিশ্বের জীবনের মাধ্যমে।

সূত্রগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ শুধুমাত্র তারা কি বলছে তারমধ্যে নেই বরং তারা কাকে কিভাবে শিক্ষা দান করেছেন সেটার মধ‍্যেই নিহিত রয়েছে। কখনো শিক্ষক এবং শিক্ষা, আবার কখনো তার উল্টোটা হয়েছে। একজন সাধারণ গৃহকর্তা বুদ্ধের মঠের দশজন প্রধান শিষ্যকে শিক্ষা দেন।

এশিয়াকে একসূত্রে গাঁথা: সিল্ক রোড এবং তার বাইরেও

বিমলকীর্তির সূত্রগুলিতে মেলবন্ধন ঘটেছিল কল্পনা এবং বাস্তবের মধ্যে, দূরের থেকে কাছের, চীন থেকে জাপানের সমস্ত পথ তুলে ধরা হয়েছিল। এগুলি বহুবার চীনা ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল। কিন্তু ৪০৬ খ্রীষ্ট্রাব্দে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুবাদটি করেছিলেন সিল্ক রোডের উত্তর শাখায় অবস্থিত প্রাচীন কূচা রাজ্যের বৌদ্ধ ভিক্ষু পন্ডিত কুমারজীব।

অন্যান্য আরও অনেকগুলো ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল যেমন: তিব্বতি, সোগদিয়ান, খোটানিজ, মঙ্গোলিয় এবং মাঞ্চু। চীনা শিল্প, সাহিত্য তাদের মাধ্যমে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। আরও পূর্বদিকে, জাপানে, বিমলকীর্তি’র সূত্রগুলি চ’আন বা জেনের ভিত্তি স্থাপন করেছিল।

এইভাবেই সূত্রের শিক্ষা এবং জ্ঞানের​ ফুল বিকশিত হয়েছিল গুরু ধর্মকীর্তির মনে। সেই ফুলের সৌরভ ছড়িয়ে পড়েছিল জাম্বুদ্বীপে, যেখানে বিমলকীর্তি এই শিক্ষার পাঠ প্রথম দিয়েছিলেন। তিব্বতীয় পণ্ডিত সন্ন্যাসী সে চিল্বু বলেছেন যে ধর্মকীর্তির শিক্ষাগুলি বিমলকীর্তির নিম্নলিখিত বক্তব্যের ভিত্তিতে ছিল:

“যেমন বীজ আকাশে বৃদ্ধি পায় না কিন্তু​ পৃথিবীতে বেড়ে ওঠে, ঠিক তেমন ভাবেই বুদ্ধের​-গুণগুলি পরম সংকল্পের মধ্যে বৃদ্ধি পায় না, বেড়ে ওঠে তাদের মধ্যে যাদের মনে জ্ঞান বোধের জাগরণ ঘটেছে”।

“পদ্ম যেমন একটি সুগভীর মাটি থেকে জন্মায় না, জন্মায় ফাঁক থেকে, একইভাবে শিষ্যদের অন্তরে যদি ভক্তিরস শুকিয়ে যায় তাহলে সেখানে জ্ঞানের বিচ্ছুরণ ঘটতে পারবে না। এই সেইসব সাধারণ সংবেদনশীল প্রাণীদের হৃদয়ে বৃদ্ধি পাবে না, যারা সমস্ত রকম দাসত্বের​ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে”।

বোধিসত্ত্ব: অন্যের জন্য আত্ম নিবেদন

অনুশীলনটি সহজ বলে মনে হলেও আসলে তা ছিল সবচেয়ে গভীর।

“একসাথে দেওয়া এবং নেওয়া দু’এর প্রশিক্ষণ।

সমস্ত মানুষের অন্ধকার শুষে নেওয়ার সাহস। তাদের বেদনা, দুঃখ, ক্রোধ, বিদ্বেষ, দুঃখ, নিজের হৃদয়ে শুষে নেওয়ার সাহস। অন্ধকার মেঘের মধ্যে থাকা​ সবচেয়ে কালো মেঘ। আপনার চেনা-অচেনা উভয়ের মধ‍্যে থেকেই, আপনি যাদের পছন্দ করেন তাদের মধ্যে থেকেও আবার যাদের ঘৃণা করেন তাদেরও, সমস্ত মানুষ, সমস্ত প্রাণী, তাদের সমস্ত পাপ, সমস্ত অজ্ঞতা, নিজের ভিতরে নিতে হবে।

আপনি তাদের প্রেম, আলো, পরমানন্দ নিবেদন করুন। একের বার শ্বাস নেওয়ার সময়, গ্রহণ করুন এবং প্রদান করুন। শুধুমাত্র একটি বিশেষ ব্যক্তির জন্য নয়, কেবল নিজের বংশের জন্য নয়, নিজের লোকদের জন্যও নয়। সবার জন্য।

এই প্রেমের অর্থ হ’ল পুরো বিশ্ব, সমগ্র বিশ্বজগতকে আলিঙ্গন করা। সমস্ত সংবেদনশীল প্রাণীর সাথে একাত্মতা বজায় রাখা। অতীশের গুরু ধর্মকৃতি প্রেমকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন, যা নিজের অহংকার, দাম্ভিকতার যথাযোগ্য প্রতিষেধক।

এই অনুশীলনে রয়েছে শ্বাস ব্যবহার করে ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষা। দক্ষতা, মনকে সংযত করতে পারে: অধ্যবসায়। সমস্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার নকশা তৈরি করে : স্বচ্ছতা। সমস্ত প্রতিকূলতাকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করার ক্ষমতা প্রদান করে: সাহস।

“যখন বিশ্ব এবং তার বাসিন্দারা নেতিবাচক পরিস্থিতির মাঝেও ফুটে উঠবে, প্রতিকূল পরিস্থিতিকে রূপান্তরিত করবে আলোকময় পথে”।

উদ্ভাবন এবং ভাঙন: মানসিক পুনর্বিবেচনা

মৌলিক সৃজনশীলতা, মনের ধ্বংসাত্মক নিদর্শনগুলিকে ব্যাহত করে। বুদ্ধিমানেরা​ মনে করেন, এই মানসিক আদর্শ শুধু একটা জীবন গড়ে তোলে না, গড়ে তোলে আরও অনেক জীবন, বয়ে চলে আবহমান কাল ধরে। কারও অন্তর্নিহিত জ্ঞানের প্রকৃতির​ অনুধাবন করাও একটি সৃজনশীল পদক্ষেপ, যদি আপনি চান তবে এটিকে নিজের মধ্যে জাগ্রত করুন।

এই বোধিসত্ত্বের​ সৃজনশীলতা অতীশের জীবনের ভিত্তি হয়ে ওঠেছিল যখন তিনি আবার জাম্বুদ্বীপে যান। শুধু এখানেই নয় এছাড়াও আরও বিভিন্ন দিকে তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন ।

অনেক দিন পরে, এক রাতে। অতীশ যখন বৌদ্ধ শিক্ষার বিখ্যাত কেন্দ্র বিক্রমাশীলায় শুয়েছিলেন, সেখানে তাঁকে শিক্ষক হিসাবে আমন্ত্রন করা হয়েছিল – তখন আবার অতীশ দেবীর তারার আদেশ বানী শুনেছিলেন, “উত্তরে​ যাও!”

বরফের দেশে

উত্তরের অর্থ ছিল তিব্বতের “দ্য ল্যান্ড অফ স্নোস্”। মহাভারত যুদ্ধের সময় সেখানে প্রথম মানব বসতি গড়ে উঠেছিল। কৌরব সেনার একজন সেনাপতি রুপতি যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে তাঁর সৈন্যদের উত্তর দিকে নিয়ে যান। এইভাবে অনেক দূর যেতে থাকেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা তিব্বতের মালভূমিতে পৌঁছেছিল। এভাবে, অনেক আগের থেকেই, ভারতকে তিব্বতের সাথে সংযুক্ত করার যাত্রা শুরু হয়েছে।

যে তিব্বতীয় অতীশকে নিতে এসেছিলেন তিনি সাথে নিয়ে এসেছিলেন ষোল আউন্স সোনা এবং অফুরন্ত প্রার্থনা ।

“আমি এখানে স্নোস্ ল্যান্ডের একজন তিব্বতীয় রাজা। যদিও অতীতে আমরাই শ্রেষ্ঠ ছিলাম​, কিন্তু বর্তমানে আমাদের মেধা হ্রাস পেয়েছে। আমাদের দয়া করুন। হে রক্ষক, আমরা আপনাকে প্রতিদিন ঠিক সেভাবেই স্মরণ করি, যেমন কেউ মরুভূমিতে থাকাকালীন জলের সম্পর্কে ভাবে”।

অতীশ ছিলেন সংযমী। এমনকি তিব্বতীদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে তাঁর কোন কিছুর প্রতিই মোহ নেই! তবে “স্নোস ল্যান্ডে”র লোকেরাও ছিলেন নাছোড়বান্দা। তারা বারবার তাঁর কাছে পৌঁছানোর জন্য সমস্ত ধরণের সমস্যাকে প্রতিহত করে চলেন। তাঁরা জানতেন, তিব্বতে প্রবাহিত হওয়া ধর্মের নদীকে পুনরুদ্ধার করতে একমাত্র অতীশ’ই পারবে এবং জানতেন যে তিনি আসবেনই।

করুণার দেবী, তারা শুনলেন। এটাই তাঁর আদেশেই ছিল, আমরা সে কথা আগেই বলেছি, আর সেইজন্যই অতীশ উত্তর দিকে এই ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করেছিল। এটা ছিল সেই রকম যাত্রা যার নির্দেশনা মানুষ করেনি, করেছিল ভাগ্য।

তিব্বত: গ্রহণ এবং অর্পণ

অতীশ​ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, সংস্কৃতে তাঁর বেশিরভাগ শিক্ষাদান এবং বক্তব্য হারিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর তিব্বতী শিষ্যরা সেইসব কিছু অনুবাদ ও লিপিবদ্ধ করে রেখেছে, যা আজও আধ্যাত্মিক অনুশীলনের​ জীবন্ত দলিল। ভারত যা হারিয়েছিল, তিব্বত তা রক্ষা করেছে, সারা বিশ্বের কাছে সেগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। এটাও তো একধরনের গ্রহণ এবং অর্পণ।

এটা এক যাত্রার গল্প, সম্ভবত সেই সময়ের জন্য, যখন আমরা সময়ের স্রোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে​ ভেসে চলতে চলতে হঠাৎ নিজেদের খুঁজে পাই। আপাতত অতীশের জীবনের শেষ সাক্ষ‍্য হ’ল “ধর্ম আলোক‍্যম্”, যার মাধ্যমে আমরা ধর্মকে আলোকিত করি। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল এর অর্থ কী, তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, এখন সময় হয়েছে ধর্ম পালনের। এ শুধু কথার ধর্ম নয় বরং তা কর্মজীবনের​, দৈনন্দিন জীবনের।

লেখক হলেন একজন পুরষ্কারপ্রাপ্ত তথ‍্যচিত্র নির্মাতা, সিনেমাটোগ্রাফার, লেখক, কথক এবং মেডিটেশন ফ‍্যাসিলিটেটর্।

আকাঙ্খা দামিনী যোশী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.