এই কলকাতায় অন্য পুজো, ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’ পরিবারের কুলদেবতা ভাগের ঠাকুর হয়ে ঘোরেন সম্বৎসর

গৌরী আসছেন। সারা বাংলার মতো কলকাতা অবশ্য তাঁকে ‘উমা’ রূপেই আবাহন করে। তবে গৌরী দুর্গাকে ঘিরে উৎসবের কলকাতাতেই রয়েছে আর এক বিস্মৃত গৌরীর কাহিনি। তিনি গৌরী সেন। প্রাচীন প্রবাদখ্যাত ‘লাগে টাকা দেবে গৌরী সেন’-এর অনেক বংশধর ছড়িয়ে রয়েছেন কলকাতায়। রবিবার, মহালয়ার সকালে তাঁদের খোঁজ নিয়েছিল আনন্দবাজার অনলাইন।

প্রবাদের গৌরী কোনও দুর্গাপুজোর আয়োজন করতেন কি না তা জানা না গেলেও উত্তর কলকাতায় তাঁর বংশধরের পরিবারের পুজো রয়েছে। তারও বয়স ৯০-এর উপর। ৩ নম্বর আমহার্স্ট স্ট্রিটের সেনবাড়ির দুর্গোৎসবকে সবাই ‘শম্ভু সেনের পুজো’ নামেই চেনে। শম্ভু সেন প্রয়াত হয়েছেন অনেক কাল আগে। এখন তাঁর নাতিরা পুজোর আয়োজন করেন। তবে সে শুধু দুর্গাপুজো নয়, একইসঙ্গে সেন পরিবারের কুলদেবতারও পুজো।

সেই কুলদেবতার পুজো পাওয়ারও এক গল্প রয়েছে। গোটা কলকাতায় গৌরী সেনের যত বংশধর রয়েছেন, তাঁদের বাড়ি বাড়ি সারা বছর ঘোরেন লক্ষ্মী-নারায়ণের বিগ্রহ। বিগ্রহের আসল নাম ‘লক্ষ্মী-জনার্দন’। কারও বাড়ি দশ দিন তো কারও বাড়ি পাঁচ দিন। এমন নির্দিষ্ট নিয়মে ৩৬৫ দিনের সফরে থাকেন ‘ভাগের ঠাকুর’।

প্রবাদের গৌরী সেনের পরিচয় জানতে বিভিন্ন অনেক গবেষণা হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, গৌরী আসলে ছিলেন নারী। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দাবি, গৌরী আসলে গৌরীকান্ত সেন। বাংলা প্রবাদ বিষয়ক বিভিন্ন গবেষণাগ্রন্থ থেকে যা জানা যায়— গৌরী ছিলেন সুবর্ণবণিক সম্প্রদায়ের সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী। বাবা ছিলেন নন্দরাম সেন। ১৫৮০ সালের আশপাশে গৌরীর জন্ম হয়েছিল হুগলিতে। পরে কলকাতার কলুটোলা স্ট্রিটে থাকত সেন পরিবার। বিভিন্ন গবেষণায় এমনও দাবি করা হয়েছে যে, গৌরী আসলে ছিলেন হাওড়ার বালির বাসিন্দা। কেউ আবার বলেন হুগলি বা হাওড়া নয়, গৌরীর আদিবাড়ি ছিল মুর্শিদাবাদের বহরমপুর এলাকায়। জন্মস্থান নিয়ে নানা মত থাকলেও গবেষকরা সকলেই বলেছেন যে, উত্তর কলকাতাতেও থাকতেন গৌরী। পরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন তাঁর বংশধররা। গৌরীর ধনী হয়ে ওঠা নিয়েও অনেক কাহিনি শোনা যায়। সবচেয়ে বেশি প্রচলিত কাহিনিটি হল, ব্যবসার অংশীদার বৈষ্ণবচরণ শেঠের সঙ্গে একটি ডুবন্ত জাহাজে বোঝাই-করা দস্তা কিনেছিলেন গৌরী। কিন্তু পরে দেখেন, দস্তার তলায় লুকিয়ে রুপো পাচার হচ্ছিল ওই জাহাজে। দস্তার দরে রুপো কিনে রাতারাতি ধনী হয়ে যান গৌরীরা। ‘ঈশ্বরের কৃপায়’ পাওয়া সম্পদ শুধুই ভোগ না করে দানধ্যান শুরু করেন। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতামাতার জন্য নাকি তাঁর দরজা সব সময় খোলা থাকত। হাতও থাকত উপুড়-করা। আবার জমিদারের ঋণ শোধ করতে না পেরে জেলে-যাওয়া প্রজাদের রক্ষা করতেও এগিয়ে আসতেন গৌরী। একটা সময়ে লোকমুখে তাঁর দানগৌরব ছড়িয়ে পড়ে গোটা বাংলায়। আস্ত প্রবাদ তৈরি হয়ে যায়— ‘লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন।’

গৌরী সেন পরিবারের কুলদেবতা লক্ষ্মী-জনার্দন।

সেই গৌরীর বর্তমান বংশধর সমর সেন বললেন, ‘‘আমাদের আমর্হাস্ট স্ট্রিটের বাড়িতে দাদু শম্ভু সেনের আমল থেকে পুজো হচ্ছে। ৯০ বছরের মতো হবে। সেই সময় থেকে আমাদের বাড়িতে কুলদেবতার বিগ্রহ আসে ফি-বছর। পঞ্চমীতে এসে দশমীর দিন চলে যান। দেবীর বিসর্জন হয়ে গেলেই পরের সময়টায় যে বাড়িতে থাকার কথা, সেখানে চলে যান কুলদেবতা।’’ এই বাড়িতে দেবতা আবার আসেন লক্ষ্মীপুজোয়। কোজাগরি পূর্ণিমা কাটিয়ে আবার অন্য ঠিকানায়। সেখান থেকে আবার অন্য বাড়িতে। এই ভাবে সারা বছর ঠিকানা বদল করতে করতে চলে। কোনও কোনও পরিবারে গিয়ে আবার শরিক অনুযায়ী ভাগ হয়ে যান বিগ্রহ। সমর বললেন, ‘‘ধরা যাক, ওই পরিবারে দশদিন থাকার কথা। তাঁরা আবার পাঁচ ভাই। সে ক্ষেত্রে প্রতি শরিক দু’দিন করে বিগ্রহ পাবেন। তাঁরা নিত্য পুজো দেবেন।

আমহার্স্ট স্ট্রিটে কুলদেবতা আসবেন বউবাজারের বাবুরাম শীল লেনের একটি বাড়ি থেকে। এখন তিনি রয়েছেন আহিরিটোলার একটি পরিবারের কাছে। সেই পরিবারের সদস্য দিব্যেন্দু সেন আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, ‘‘আমাদের বাড়িতে ২৪ দিনের ভাগ। এখন এখানেই ঠাকুর রয়েছেন। প্রতিদিন পুজো হচ্ছে। এর পরে যাঁদের ভাগ রয়েছে, তাঁরা এসে নির্দিষ্ট দিনে ঠাকুরকে নিয়ে যাবেন।’’ দিব্যেন্দুর থেকেই জানা গিয়েছে, প্রতি পরিবারের কাছেই লক্ষ্মী-নারায়ণের জন্য সিংহাসন রয়েছে। যখন যে পরিবারের ভাগ, তারা নিজেদের সিংহাসন নিয়ে এসে বিগ্রহ নিয়ে যান। বদলাতে থাকে সিংহাসন। বদলায় ঠিকানা।

শম্ভু সেনের বাড়িতে পুরুষানুক্রমে দুর্গাপুজো করে আসছেন পুরোহিত পাঁচুগোপাল চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, ‘‘গৌরী সেনের বংশধরা আহিরিটোলা, বউবাজার থেকে দমদম ক্যান্টনমেন্ট, টালা, আমহার্স্ট স্ট্রিট, আরপুলি লেন, উকিল মিস্ত্রি লেন-সহ অনেক জায়গায় থাকেন। যে বাড়ির যেমন পালা পড়ে, তেমন তেমন করে বিগ্রহ ঘোরে। শম্ভু সেনের বাড়িতে দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজোর মতো দোলের সময়েও বিগ্রহ আসে। আবার নির্দিষ্ট দিনে চলে যায়। দুর্গাপুজোর পরে বিগ্রহ চলে যাবে কেষ্ট সেনের বাড়ি।’’

তবে এই যাওয়া-আসায় অনেক নিয়ম রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিগ্রহ নড়ে না। আবার অমাবস্যাতেও নয়। সেই কারণে আহিরিটোলার পরিবারের পালা এই মহালয়ার শেষ হয়ে গেলেও বিগ্রহ অন্যত্র যাবে না। মহালয়া থাকায় পরের দিন স্থানান্তরিত হবে।

এই বিগ্রহের পুজোর উপাচারেও ফারাক রয়েছে। নৈবেদ্য হিসাবে বিগ্রহের খুব পছন্দের মাখন, মিছরি আর ছোলা। সকালে স্নানের আগে এই ভোগের পর দুপুরে চাল-কলা দেওয়া যাবে। এটা নিত্য পুজোর ক্ষেত্রে। তবে বিশেষ দিনে বিশেষ ভোগ চলতে পারে। পুজোর সময় তাই মালপোয়া, নাড়ু, দই, মিষ্টি চলবে। দুর্গাপুজোর সময় খিচুড়ি অথবা লুচি দেওয়া যায়। তবে সেটাও বানাতে হবে নুন ছাড়া। শম্ভু সেনের বাড়িতে দুর্গাপুজোর সময় ঠাকুরদালানে থাকলেও বিগ্রহ রাতে ফিরে যাবে উপরতলায় নিজের ঘরে। সেখানেই হবে শয়ন। জানালেন পুরোহিত পাঁচুগোপাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.