তৃতীয় অঙ্ক
কার্য্যঃ শৈলগুহাকারো দ্বিতুমির্নাট্যমণ্ডপ।
নাট্য মণ্ডপের আকার পর্বতগুহার মতো হতো। আর দোতলা বা দ্বিভূমি হতো। দ্বিতল হবার স্বার্থকতা এই যে , স্বর্গ বা অন্তরীক্ষের অভিনয় উপরের তলায় এবং মর্ত্যভূমির যা কিছু অভিনয় সকলই নীচের তলায় অভিনীত হতো। রঙ্গপীঠের বাতায়ন ছোট ছোট হত। না হলে বাদ্যযন্ত্র ও অভিনেতার গম্ভীর – স্বরতা নষ্ট হবার সম্ভাবনা। নির্বাত ধীর শব্দ- স্থান হতে স্বর গম্ভীরতর হয়ে বাইরে শোনা যায় । কাজেই পবনদেব যাতে অধিক চলাফেরা না করতে পারে এরূপ করে জানলা তৈরি করা দরকার । প্রাচীর ভিত্তি শেষ হলে ভিত্তিলেপ করা হতো । তারপর চুনকাম , চুনকাম করাকে সুধাকর্ম্ম বলতো। ভিত্তি বেশ সমান ভাবে মাজঘষা হলে তাতে নানা রকমের চিত্র, লতাবন্ধ, স্ত্রীপুরুষ ইত্যাদি রচনা করা হতো ।
নাট্যমন্ডপ নির্মাণে এই হল সাধারণ পদ্ধতি ।
তারপর চতুরঙ্গ মন্ডপের বিশেষ লক্ষণ নাট্যশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। চতুরঙ্গ মন্ডল চারকোণ , আর চারদিকেই ৩২ হাত। বাইরের চারদিকে ইঁটের দেওয়াল রচনা করে, ঘিরে , ভিতরে রঙ্গপীঠ নির্মাণ করা হতো চারিদিকে দর্শকদের জন্য আসন তৈরি করা হতো । রঙ্গপীঠের চারিদিকে দশটা স্তম্ভ থাকত। এই স্তম্ভের বাইরে দর্শকদের বসবার নিমিত্ত আসন নির্মাণ করা হতো। আসনগুলির আকার হতো সিঁড়ির মতো। এগুলি হতো কাঠের বা ইঁটের দ্বারা নির্মিত। এক এক পঙক্তি বা সারি অপর পংক্তির চেয়ে এক হাত নিচু করে সাজানো হতো।
এই দশটি স্তম্ভ ব্যতীত অন্যান্য দিকে আরও দশটি স্তম্ভ নির্মাণ করা হতো । স্তম্ভগুলির উপর ৮ হাত পরিমান পীঠ নির্মাণ করার রীতি ছিল। ঐ স্তম্ভগুলি শালকাঠের তৈরি। সেগুলি স্ত্রীমূর্তি দিয়ে অলংকৃত থাকতো। এর মধ্যে ছয়টি স্তম্ভ দিয়ে নেপথ্যগৃহ নির্মাণ হতো। ছয়টি স্তম্ভের নাম – ধারণী ধারণ। নেপথ্যগৃহে একটি মাত্র দ্বার। এছাড়া রঙ্গের দিকে আর একটা জনপ্রবেশের দ্বার থাকত। এই রঙ্গপীঠ সবসুদ্ধ ৮ হাত , চতুরস্র এবং সমতল। ভিতরে একটি বেদিকা সাজানো থাকত। তার পাশ দিয়ে মত্তবারণী বার করা হতো। মত্তবারণী হল বেশচিত্র করা বারান্দা। বারান্দা ধারণ করার নিমিত্ত চারিটি স্তম্ভের ব্যবস্থা ব্যবস্থা থাকত। এর পর রঙ্গশীর্ষ ।
ত্র্যস্রমণ্ডপ হল ত্রিকোণ। এর মাঝখানে ত্রিকোণ রঙ্গপীঠ। দরজাও ত্রিকোণ। রঙ্গপীঠের পিছনে আর একটি দরজা থাকতো। সম্মুখের ভিত্তির উপর স্তম্ভ।
কিছু পূর্বেই বললাম যে , নাট্যমন্ডপ পর্বত গুহার ন্যায় নির্মাণ করা হতো। প্রাচীন কালে গুহা যে নাট্যশালার জন্য ব্যবহৃত হতো তার বহু প্রমাণ আছে। খৃষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের রায়গড় গুহালিপিতে স্পষ্ট লেখা আছে যে , প্রেক্ষাগৃহ নাট্যাভিনয়ের জন্য নির্মিত হতো। কখনো কখনো নাট্যাভিনয়ের জন্য পৃথক গৃহের বন্দোবস্ত থাকত। এরূপ ঘরের নামই ছিল প্রেক্ষাগৃহ। পালি সাহিত্যগুলিতে এগুলি পেকথ নামে পরিচিত ছিল। সমন্তপাসদিকা , সুমঙ্গল-বিলাসিনী’তে প্রেক্ষাগৃহ সম্পর্কে আলোচনা আছে।
১৭৯২ সালে প্রথম সুরগুজার ঐতিহাসিক প্রমুখের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সেই সময় হতেই উসলী , ডালটন, বল, বেগলার, কানিঙহাম প্রভৃতি অনেকেই সুরগুজার রামগড় পাহাড় দেখে বিবরণ প্রকাশ করেন। পরে ডক্টর ব্লথ সুরগুজার রামগড় পাহাড়ে সীতাবেঙ্গরা ও যোগীমারা নামক দুইটি গুহার ভগ্নাবষেশ আবিষ্কার করেন। এই দুটি যে প্রেক্ষাগৃহ , তা নিঃসন্দেহে বলা যায়। তাছাড়া নাট্যশালা যে পর্বতগুহার আকৃতি বিশিষ্ট হবে তা নাট্যশাস্ত্রে উল্লেখ করা আছে।
গুহা কবেল যোগী, ধ্যানী ,মুনি , ঋষিদের ধ্যানাদির জন্য নির্দিষ্ট ছিল তা নয়। নৃত্য , গীতাদির নিমিত্ত প্রাচীন কালে এগুলির ব্যবহার ছিল কালিদাস প্রভৃতির গ্রন্থে তার সাহিত্যিক প্রমাণও আছে। অধ্যাপক লুডের্স Indian Antiquary – 34 part – এ কতকগুলি এইরূপ প্রমাণের উল্লেখ করেছেন। ঔরঙ্গাবাদে একটি বৌদ্ধগুহাতে একেবারে মন্দিরেই নাচের বন্দোবস্ত ছিল ( Arch . Surv , Western India . Vol. III) ।
নাসিকেও এই রকম নাচগানের জন্য ব্যবহৃত দুইটি গুহা আছে। আজও গুহা দুটি দেখলে দর্শকের চোখে নৃত্য গীতের দৃশ্য জীবন্তভাবে ফুটে ওঠে। জুনাগড়ের উপরকোট গুহার দৃশ্য আমাদের নিকট এই কথাই সপ্রমাণ করে দেয়। কুদা ও মহাড়ের গুহাতেও নাচগানের ব্যবস্থা ছিল। শুধু তাই নয় , এই গুহা দুটির তিনধারে বসবার আসনের যেরূপ বন্দোবস্ত আছে , তাতে উপলব্ধি হয় যে এই গুহাদুটি সম্ভবত অভিনয়াদির নিমিত্ত ব্যবহৃত হতো। ফার্গুসন ও বর্জেস সংকলিত Cave Temples এবং Arch . Surv , Western India – এ এই তথ্য পেয়ে যাবেন।
মথুরার একটি প্রাচীন শিলা শিলালিপিতে একজন গণিকার দানের বিশদ বিবরণ আছে। এই গণিকার নাম নাদা। উক্ত শিলালিপি নাদা শিলালিপি নামে পরিচিত। নাদা শিলালিপিতে নাদা নিজেকে লেনশোভিকাদন্দার কন্যা বলে বর্ণনা করেছেন। লেনশোভিকা অর্থাৎ গৃহাভিনেত্রী।
পতঞ্জলি মহাভাষ্যে কংসবধ ও বলি বধ নাটকাভিনয় প্রসঙ্গে ” যে অভিনয় করে ” এই অর্থে শোভিকা শব্দের উল্লেখ আছে। গুহাতে শুধু মুনি ঋষিরা থাকতেন না । গণিকা , লেনশোভিকারা এবং তাদের প্রণয়াস্পদেরাও থাকত।
রামগড় গুহায় এরূপ নাট্যশালার ব্যবস্থা আছে। একটা রীতি আছে যে , রঙ্গালয়ে যক্ষলিপি থাকবে। সীতাবেঙ্গরা গুহাতেও একটি লিপি আছে। খুব সম্ভব তা যক্ষলিপি।
সীতাবেঙ্গরা গুহার প্রবেশ পথের পার্শ্বে গুহার ছাদের ঠিক নীচেই একটি লিপি খোদিত আছে। কি সেই লিপি ?
সীতাবেঙ্গরা গুহায় যে লিপি খোদিত আছে তার মাত্র দুই ছত্র। প্রতি ছত্র তিন ফুট , আট ইঞ্চি লম্বা। একেকটি অক্ষর প্রায় ২৫ ইঞ্চি। দুইটি ছত্রের শেষের দিকের অক্ষরগুলি নষ্ট হয়ে গেছে।
ব্লথ সাহেবের ধৃতপাঠ এইরূপ –
১. আদিপয়ন্তি হৃদয়ং সভাব- গরু কবয়ো এরা তয়ং…
২. দুলে বসংতিয়া হাসাবানুতুতে কৃদস্ফতং অলং গ (ত)।
এই শ্লোকের তিনি যে তর্জমা করেছেন তা হল – “Poets Venereble by nature Kindle the heart , who -“
“At the swing festival of the vernal full moon, when frolics and music abound , people thus(?) tie ( around their necks garlands) thick with jasmine flowers.”
এর পর যোগীমারা গুহায় যে লিপি আছে ব্লথ তারও পাঠোদ্ধার করেন। তাঁর ধৃত পাঠ এই –
১) শুতনুক নম
২) দেবদাশিক্যি
৩) শুতনুক নম। দেবদাশিক্যি
৪) তং কময়িথ বল না শেষে ।
৫) দেবদিনে নাম । লুপদথে।
এই কথাগুলি ব্লথ সাহেবের অনুবাদ এইরূপ –
1) Sutanuka by name,
2) A Devadashi
3) Sutanuka by name , a Devadasi,
4) The execllent among young men loved her
5) Debodinna by name , skilled in sculpture.’
উপরে ব্লথ সাহেবের গৃহীত এই সকল লিপির প্রতিলিপি দেওয়া হল ।
A.M. Boyer কিন্তু উক্ত লিপিগুলির পাঠোদ্ধার করেছেন।। তাঁর ধৃত পাঠ নিম্নে দেওয়া হল –
১) অদিপয়ন্তি হৃদয়ং । স ( ধা) ব গ র ক (ং) বয়ো এতি তয়ং …দুলে বসং তিরা
হি সাবানুভূতে কুদস্ ততং এব অলং গ ( তা)
২) সুতনুকা নম। দেবদাশিক্যি।
তং কমরিখ বলু ন শেয়ে
দেবদিনে নম। লুপ দখে।
মহামহোপাধ্যায় পন্ডিত শ্রী হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এই দুইটি লিপির পাঠ অনুরূপ করেছেন । তাঁর সেই পাঠের কৃত অনুবাদ উল্লেখ করলাম –
প্রথম লিপি শাস্ত্রী মহাশয়ের ইংরেজি অনুবাদ –
I salute the beautifully – formed one who shows us the gods. I salute the beautiful form that leads us to the gods. He is much in quest at Varanasi. I salute the god- given one for seeing his beautiful form.
দ্বিতীয় লিপির অনুবাদ –
The heart of a lady living at a distance ( from her lover) is set to flames by the following three – sadam , Bagara and the poet . For her this cave is exacavated . Let the God of love look to it.
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. ভারতীয় নাট্যশালার গোড়ার কথা
২. কলকাতার সিনেমা হল