দ্বিতীয় পর্ব
প্রাচীন কবি সুবন্ধু বলেছেন –
অস্তি সুধাধবলৈর্বৃ হৎকথারম্ভৈরিব
শালভঞ্জিকোপেতৈর্বেশ্মভিরুপশোভিতম্। ( বাসবদত্তা)
অর্থাৎ , এখানে তিনি ব্যাখ্যা করছেন যে , সেকালে শালভঞ্জিকার অধিষ্ঠানের দ্বারা গৃহের এবং নগরের সৌন্দর্য সম্পন্ন হতো। তিনি বর্ণনা করেছেন যে , কুসুমপুর শালভঞ্জিকাযুক্ত গৃহের দ্বারা উপশোভিত হয়ে ছিল। শালভঞ্জিকার অবলম্বনে #বিদ্ধশালভঞ্জিকা নামক দৃশ্য কাব্যের উৎপত্তি হয়েছিল।
দ্বারবতী পুরীর বর্ণনায় মহাকবি মাঘ লিখেছেন যে , নগরীতে গৃহের কপোতপালী বা পায়রার খোপ স্থিত কৃত্রিম বা কাষ্ঠনির্মিত পক্ষীসমূহকে বাস্তব পক্ষী মনে করে ধরবার অভিপ্রায় আয়তনিশ্চলাঙ্গ মার্জার বা বিড়ালকে মানুষেরা কৃত্রিম বিড়াল বলে মনে করতেন।
চিক্রংসয়া কৃত্রিম – পাত্রি- পঙক্তেঃকপোতপালীষু নিকেতনানাম।মার্জারমপ্যায়তনিশ্চলাঙ্গম্যস্যাং জনঃ কৃত্রিমমেবমেনে।।
বর্তমান সময়ে আমরা জলের কলে ব্যাঘ্র , মকর ইত্যাদি মুখ হতে জল পড়ছে দেখে পাশ্চাত্য শিল্পের নৈপুণ্য অনুভব করি। কিন্তু আজ হতে বহু বহু বহু শতাব্দী পূর্বে আমাদের দেশের সুপ্রসিদ্ধ কবি বাণভট্ট কাদম্বরীর ভবন যেভাবে সাজিয়ে গিয়েছেন, তার প্রতি লক্ষ্য করলে আধুনিক পাশ্চাত্য শিল্পের তুলনায় প্রাচীন প্রাচ্য শিল্পের নূন্যতা অনুভূত হয় না।
” রাজপুত্র চন্দ্রাপীড় কাদম্বরীর ভবনে উপস্থিত হয়ে দেখলেন – কোথাও স্ফটিক নির্মিত বলাকাশ্রেণীর মুখ হতে ঝর ঝর করে জল পড়ছে, কোথাও কলের সাহায্যে কৃত্রিম মেঘমালা ঘুরে বেড়াচ্ছে- তাতে আবার ইন্দ্রধনু বা রামধনু শোভা বিস্তার করছে। স্থানে স্থানে কলের ছোট ছোট গাছ বড় বড় জলবিন্দু বর্ষণ করছে। কোথাও বা উড়ন্ত কলের পাখি পাখা নাড়িয়ে জল মিশ্রিত শীতল বাতাস যোগাচ্ছে।
ক্কচিৎ স্ফটিকবলাকাবলীর্বান্তবারিধারা মিলিতেন্দ্রায়ুধাঃ সঞ্চার্যমানা মায়ামেঘমালাঃ ….. অনবরতস্থূল জলবিন্দুদুর্দিনমুৎ সৃজতঃ যন্ত্রবৃক্ষকান্। ক্কচিদ্বিধূত – পক্ষ – নিঃক্ষিপ্তসীকরানীত নীহারা ভ্রমন্তী যন্ত্রময়ীঃ পত্ৰশকুনি – শ্রেণী। ( কাদম্বরী)“
মূর্তি শিল্প আমাদের ধর্ম-কর্মের একটি প্রধান অঙ্গ। এই যে জগদম্বা সংবৎসরান্তে আসছেন ভক্তের হৃদয়, মন্ডপ বা গৃহ শোভিত করতে, তাঁর মহাপূজায় যে সকল সামগ্রীর প্রয়োজন , তন্মধ্যে অভিরূপ প্রতিমাও একটি অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। শাস্ত্র বলেছেন – পূজকর তপোবল , পুজোউপকরণের আতিশয্য এবং প্রতিমার অভিরূপ্য অর্থাৎ সৌন্দর্য এই কয়টি কারনে দেবতার সান্নিধ্য হয়ে থাকে।
অর্চকস্য তপোযোগাদর্চনস্যাতিশায়নাৎ
আভিরুপ্যাচ্চ বিম্বনাং দেবঃ সান্নিধ্যমিচ্ছতি।।
শুক্রনীতিসারে কথিত হয়েছে যে, প্রতিমাকারক মানব যেরূপ ধ্যানরত হতে পারে ,অন্য কোন উপায় সেরূপ হতে পারে না।
প্রতিমাকারোক মর্ত্যো যথা ধ্যানরতো ভবেৎ।
তথানান্যেন মার্গেণ প্রত্যক্ষেণাপিবাখলু।।
ধ্যানোপযোগিনী প্রতিমা শিল্প শাস্ত্র অনুযায়ী অবয়ব সন্নিবেশানুসারে নির্মিত হলে, মনোহারিণী প্রতিমা পূণ্য প্রদান করেন। অবয়ব- সন্নিবেশের ব্যতিক্রম ঘটলে সাধকের আয়ু , ধন বিনাশ করেন এবং দুঃখ বৃদ্ধি করেন।
যথোক্তাবয়বৈঃ পূর্ণা পূণ্যদা সুমনোহরা।
অন্যথায়ুর্ধনহরা নিত্যং দুঃখ – বিবর্ধিনী।।
প্রতিমার পরিমাণ সম্বন্ধে শাস্ত্রে বিশেষ নিয়ম দেখতে পাওয়া যায়। দেবতা ভেদে প্রতিমার পৃথক পৃথক পরিমাণ বিহিত হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি মাত্র দেবতার পরিমাণ স্থলে প্রদর্শিত হল। যথা – চণ্ডী, ভৈরব ,বেতাল ,নৃসিংহ, বরাহ , এই সকল প্রচণ্ড দেবতার মূর্তি দ্বাদশতাল পরিমিত হবে।
চণ্ডী ভৈরব বেতাল – নরসিংহ – বরাহকাঃ।
ক্রূরা দ্বাদশতালাঃ সু্্যর্হয়শীর্যাদয় স্তথা।।
শাস্ত্রান্তরের দেবতা প্রতিমা দর্শন মাত্রই প্রণামের উপদেশ আছে।
দেবতা – প্রতিমাং দৃষ্টা যতিং দৃষ্টাপ্যদন্ডিনম্।
নমস্কারং নকুর্যাদ্ যঃ প্রায়শ্চিত্তীয়তে ত্বসৌ।।
এবং বিষ্ণুসংহিতায় বলা হয়েছে –
দেবতা – প্রতিমা – ভেদকশ্চোত্তম- সাহসং দণ্ডনীয়ঃ।
অর্থাৎ উক্ত সকল প্রমাণ অনুসারে উপলব্ধি করা যায় যে সুপ্রাচীন ভারতবর্ষে প্রতিমা নতুন পরিচয় বা আগন্তুক নয় । অতি প্রাচীনকাল থেকেই প্রতিমা বা বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক উপাদান ,প্রাকৃতিক দ্রব্য সমূহকে ধরণী মন্ডলের প্রতিস্থাপিত করে তাঁকে উপসনার একটি নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
সুপ্রাচীন কাল হতে মানব সনাতনী। মানব নিরাকার যেকোনো শক্তিকে উপাসনা করে এসেছেন। সেই শক্তি আদি, অন্তত। সেই শক্তি আসে নানারূপে এবং নানা ভাবে মহাশূন্য থেকে। সেই শূন্য এবং শক্তি কল্যাণকামী। তার উপাসনা চিরকাল ছিল। এখনো আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মহামায়ার সংসারে সুখকে খুঁজে নিতে হয়। মৃত্যুময় জগতে মানবকে অমৃতের সন্ধান করতে হয় ।
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে ধামানি দিব্যানি তস্থূ ।।
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তম্
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ ।
তমেব বিদিত্বাতিমৃত্যুমেতি
নান্যঃ পনথা বিদ্যতে অয়নায় ।। (শ্বেতাশ্বতর উপনিষৎ )
শোনো বিশ্বজন ,
শোনো অমৃতের পুত্র যত দেবগণ
দিব্যধামবাসী , আমি জেনেছি তাঁহারে
মহান্ত পুরুষ যিনি আঁধারের পারে
জ্যোতির্ময় । তাঁরে জেনে তাঁর পানে চাহি
মৃত্যুরে লঙ্ঘিতে পারো , অন্য পথ নাহি ।
যা বা যার থেকে মানব খাদ্য, বস্ত্র , বাসস্থান পায় বা উপকৃত হয় তাই পূজ্য। আদিম সনাতনী বিশ্বাস এমনই। প্রতিটি মানবজাতির মধ্যেই সেই ব্রহ্ম ও শক্তির অবস্থান ছিল নানাভাবে , নানা রূপে। সেখানে ব্রহ্মই হলেন রুদ্র , সয়ম্ভূ, আদিম এবং শক্তি হলেন আদি পরাশক্তি। তাঁরা বৃক্ষ, শিলা, জল, বাতাস , আলোক , নদী , ভূমি , সূর্য , চন্দ্র, গ্রহ, তারা সর্বত্র অবস্থান করেন। নিরাকার থেকে তখন তাঁরা সাকার হয়ে ওঠেন।
বিষ্ণু রূপে শালগ্রাম শীলা, শিব রূপে লিঙ্গ , ধর্ম রূপে কুর্ম , দেবী রূপে বিবিধ যন্ত্র এবং ঘট পবিত্র বস্তু। এগুলিই শূন্য ও শক্তি স্বরূপ। তুলসী সহ দেবতার পূজা প্রকৃতি , শূন্য অর্থাৎ পরম ব্রহ্মের পূজার নামান্তর। সকল দেবদেবীর জর উপাসনা করা হয় তা সবই ব্রহ্মের উপাসনা। বিষ্ণু , শিব, দুর্গা , কালী, শ্ৰী, সরস্বতী প্রমুখেরা ব্রহ্ম স্বরূপ। আমরা পরম ব্রহ্মকে যে ভাবে দেখি সেভাবেই তিনি দেখা দেন। সুরেশচন্দ্র বিদ্যানিধি বলেছেন – ” অতএব বিষ্ণু, দুর্গা, কালী প্রভৃতি সমস্ত দেবতাই তাঁদের উপাসকের মধ্যেও উচ্চ নীচ নিরূপন হতে পারে না। “
আমরা দেখিতে পাই , নিরাকার সেই পরম ব্রহ্মের উপাসনা দেহিদের পক্ষে অতি কষ্টকর । এইজন্যই নানা রূপে তাঁহার উপাসনা ব্যবহার দেখা যায়।”
পুতুল বা ছোট মূর্তি ( প্রতিমা বৃহৎ হয় , পুতুল ছোট ) সমগ্র সনাতনী সুপ্রাচীন বিশ্বে প্রজনন বা ফার্টিলিটি কাপার্থক্যেঙ্গে পুতুল অভিন্নভাবে জড়িত ছিল । আজও আছে। ভবিষ্যতেও থাকবে। তাই আজও নানা লৌকিক হোক বা কুলীন দেবতার পূজায় , বার- ব্রতের গাঁ ঘরে মাটির পুতুল , চালের পুতুল #ছলন দেওয়া হয়।
দেশভেদে এবং যুগ ভেদে প্রতিমার পরিমাণের পার্থক্যের পরিচয় পাওয়া যায় । দেশভেদে মূর্তির সপ্ততাল প্রভৃতির উচ্চতা হয়ে থাকে।
সপ্ততালাদু্্যচ্চতা বা মূর্তিনাং দেশভেদতঃ।
সত্যযুগে দশতাল, ত্রেতাযুগে নবতাল , দ্বাপরে অষ্টতাল এবং কলিযুগের সপ্ত তাল পরিমান নির্দিষ্ট হয়েছে।
দশতালা কৃতযুগে ত্রেতায়াং নবতালিকা।
অষ্টতালা দ্বাপরেতু সপ্ততালা কৌলযুগে।।
সুতরাং আমাদের মূর্তির পরিমাণ প্রভৃতির সঙ্গে দেশান্তরে শিল্প শাস্ত্রের কোন সম্বন্ধ নেই । মৎস্যপুরাণ, হয়শীর্ষপঞ্চরাত্র প্রভৃতি গ্রন্থ মূর্তিশিল্পের বিস্তৃত বিবরণ দেখা যায় । এই সকল গ্রন্থের মৌলিকতায় পরবর্তী অনেক গ্রন্থ প্রণীত হয়েছে। কেবলমাত্র দু-চারিটি প্রবন্ধের মাধ্যমে মূর্তি শিল্পের বিবরণ প্রকাশ করা অসম্ভব ।পরবর্তী কোন প্রবন্ধে পুনরায় আমি এ বিষয়ে আলোকপাত করবো । কিন্তু, যেহেতু আমি এর পরবর্তী পর্যায়ে পুতুল নিয়ে বিভিন্ন লেখা লিখব, সেহেতু মূর্তি ,পুতুল ইত্যাদি সম্পর্কে একটি ভূমিকা প্রবন্ধ আলোচনা করে নিলাম।
#সমাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত)
তথ্যঃ প্রাচীন শিল্প পরিচয় : গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ