প্রথম পর্ব
রাঢ় বঙ্গ, রাঢ় অঞ্চলের মালভূমি , সুপ্রাচীন ভারতের এক প্রাচীনতম ভূখন্ড, গন্ডোয়ানা মালভূমির শেষাংশ। সেই ছোটনাগপুর মালভূমি ক্রমশ অবনমিত হয়ে খড়্গপুরের প্রান্তভূমিতে এসে সমতলে মিশেছে। তাই রাঢ় অঞ্চলের একাংশ পাহাড় , ডুংরি সমন্বিত এবং অবশিষ্ট অংশ সমতল।
বঙ্গ তথা রাঢ় অঞ্চলের কথা আমরা বহু প্রাচীন গ্রন্থাবলীতে পাই। ব্যাসদেব রচিত মহাভারতে বলা হয়েছে –
অঙ্গান বঙ্গান কলিঙ্গাশ্চ শুন্ডিকান্ মিথিলানথ।
মাগধান্ কর্কখণ্ডাংশ্চ নিবেশ্য বিষয়ে হ ত্মনঃ।।
আবশীরংশ্চ যোধ্যাংশ্চ অহিক্ষত্রং চ নির্জয়ৎ।
পূর্বাং দিশং বিনির্জত্য বৎসভূমিং তথাগতম্।।
বঙ্গ , কলিঙ্গাদির সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে #কর্কখণ্ড নামক এক স্থানের কথা। পন্ডিতগণ অনুমান করেন এই অংশটি হল মালভূমি, পাহাড়, অরণ্য বেষ্টিত লাল মাটির রাঢ় অঞ্চল। যা পরবর্তী কালে মার্কন্ডেয় পুরাণে #কর্বটাশন , পরাশর ভূগোল এবং বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতায় #কর্বট নামে পরিচিত হয়েছিল।
মার্কণ্ডেয় পুরাণে উল্লিখিত হয়েছে ভারতবর্ষরূপ কুর্ম্মের মুখদেশে তাম্রলিপ্ত ও একপাদপদেশের পরই বর্দ্ধমানের উল্লেখ আছে। বরাহমিহিরের বৃহৎসংহিতাতেও ভারতের পূর্ব্বদিকে তাম্রলিপ্ত সহ এই বর্দ্ধমানের উল্লেখ পাওয়া যায়।
গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ
দামোদরোত্তরে ভাগে সুহ্মদেশ প্রকীর্ত্তিতঃ।।
মহাভারত শুরু করে কালিদাসের রঘুবংশ , জৈন ধর্মগ্রন্থ আচারঙ্গসূত্ত প্রভৃতি সহ নানা প্রাচীন গ্রন্থে সুহ্মদেশের উল্লেখ পাওয়া যায়। শ্রদ্ধেয় গোপালদাস মহাশয় “নানকার মলুটী’তে #দিগ্বিজয়_প্রকাশ নামে একটি সংস্কৃত ভূগোল গ্রন্থ থেকে প্ৰথমোক্ত শ্লোকটি উদ্ধার করেছেন।
আবার গৌরহর মিত্র বীরভূমের ইতিহাস এর প্রথম খন্ডে দিগ্বিজয়_প্রকাশ থেকেই শ্লোকটির একটি অন্য পাঠের উল্লেখ করেছেন । সেটি হল :
গৌড়স্য পশ্চিমভাগে বীরদেশস্য পূর্বতঃ
দামোদরোত্তরে ভাগে রাঢ়দেশঃ প্রকীর্ত্তিতঃ।।
অবশ্য দুটির শ্লোকেই সুহ্মদেশ এবং রাঢ়দেশ শব্দ দুটির
অদল বদলে শ্লোকের মূল অর্থ একেবারেই বদলে যায় না। মহাভারতের সভা পর্বে আমরা জানতে পেরেছি যে ,সূক্ষ্ম এবং রাঢ়দেশ একই এলাকার দুটি নাম।
শ্লোকটির অর্থ হল গৌড়ের পশ্চিমে, বীরদেশের পূর্বে দামোদর নদের উত্তরভাগে সুহ্মদেশ ( রাঢ়দেশ) অবস্থিত।
মহাভারতে বারবার অঙ্গ বঙ্গ কলিঙ্গ পুন্ড্র সহ সুহ্মের উল্লেখ পাই। ভীমের পূর্ব্ব দিগ্বিজয় উপলক্ষে সভাপর্বে লিখিত আছে –
অথ মোদাগিরৌ চৈব রাজানং বলবত্তরম্।
পাণ্ডবো বাহুবীর্য্যেণ নিজযান মহামৃধে।।
ততঃ পুন্ড্রাধিপং বীরং বাসুদেবং মহাবলম্।
কৌশিকীকচ্ছনিলয়ং রাজানঞ্চ মহৌজসম্।।
উভৌ বলভৃতৌ বীরাবুভৌ তীব্রপরাক্রমৌ।
নির্জ্জিত্যাজৌ মহারাজ বঙ্গরাজমুপাদ্রবৎ।।
সমুদ্রসেনং নির্জ্জিত্য চন্দ্রসেনঞ্চ পার্থিবম্।
তাম্রলিপ্তঞ্চ রাজনং কর্ব্বটাধিপতিং তথা।।
সুহ্মানামধিপঞ্চৈব যে চ সাগরবাসিনঃ।
সর্ব্বান্ গণাংশ্চৈব বিজিগে্্য ভরতর্ষভঃ।।
পাণ্ডববীর ( ভীম ) মোদাগিরিস্থিত অতিবলশালী রাজা , তীব্র পরাক্রমশালী রাজা পুন্ড্রাধীপ বাসুদেব, কৌশিকীকচ্ছ নিবাসী রাজা মহৌজাকে আপন বাহুবল দ্বারা পরাস্ত করলেন। এরপর তিনি বঙ্গরাজের দিকে ধাবিত হলেন। সমুদ্রসেন, চন্দ্রসেন নরপতিকে পরাজিত করে তাম্রলিপ্তরাজ, কর্ব্বটাধিপতি, সুহ্মাধিপতি ও সাগরবাসীগণকে জয় করলেন।
কালিদাসের রঘুবংশে লিখিত আছে –
পৌরাস্ত্য্যানেষমাক্রামং স্তাং স্তান্ জনপদান্ জয়ী।
প্রাপ তালীবনস্যামমুপকন্ঠং মহোদধেঃ।
অনদ্রাণাং সমুদ্ধর্ত্ত স্তস্মা সিন্ধুররাদিব।
আত্মা সংরক্ষিতঃ সুহ্মৈবৃত্তিমাশ্রিত্য বৈতসীম্।।
বঙ্গানুৎখার তরসা নেতা নৌসাধনোদ্যতান্।
নিচথান জয়স্তান্ গঙ্গাস্রোতো হন্তরেষু সঃ।।
জয়ী রঘু পূর্ব্বদিকে সমস্ত জনপদ আক্রমণ করে মহাসাগরের তালীবনশ্যামল উপকূলে উপনীত হলেন। সুহ্মাগণ বেতস লতার ন্যায় তাঁর আধিপত্য মেনে নিলেন। পরে রঘু নৌবলসম্পন্ন বঙ্গদেশীয় ভূপালগণকে বাহুবলে পরাস্ত করে গঙ্গাপ্রবাহ মধ্যবর্তী দ্বীপে জয়স্তম্ভ স্থাপন করলেন।
পতঞ্জলির মহাভাষ্যে #বিষয় শব্দের জনপদ অর্থপ্রসঙ্গে অঙ্গ , বঙ্গ, কলিঙ্গ ,সুহ্ম এবং পুন্ড্রের একত্র উল্লেখ করেছেন।
বিষয়াভিধানে জনপদে লুব্ বহুবচনবিষয়াবক্তব্যঃ
অঙ্গানাং বিষয়োদেশঃ অঙ্গাঃ। বঙ্গাঃ। সুহ্মাঃ। পুন্ডাঃ।
মহাবংশ এবং দ্বীপবংশ হতে জানা যায় গৌতম বুদ্ধের সমকালে লাল বা লাঢ়ের রাজধানী সিংহপুর হতে বিজয় লঙ্কা গমন করে সেখানে রাজ্য স্থাপন করেন। তাঁর নামেই লঙ্কা দ্বীপের নব নাম হয় সিংহল।
জৈন আচারঙ্গসূত্র থেকে জানা যায় বর্দ্ধমান স্বামী লাঢ়দেশে বজ্জভূমি ও সুম্ভভূমির মধ্যে নাকি অতিকষ্টে ১২ বৎসর অতিক্রম করেছিলেন। তৎকালে বজ্জভূমিতে কুকুরের ভারী উৎপাতছিল। তাই বহু জৈন সন্নাসীকে নাকি দন্ড হাতে করে ভ্রমন করতে হতো। (?)
যাক , জৈন সূত্রাকার লিখেছেন লাঢ়দেশে ভ্রমন করা বড়ই কঠিন। জৈন উপাঙ্গ প্রজ্ঞাপনাসূত্রেও পূণ্যভূমি সমূহের মধ্যে কোটিবর্ষ ও রাঢ়দেশের নাম উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে-
তাম্রলিপ্ত বঙ্গায় , অর্থাৎ বঙ্গের মধ্যে তাম্রলিপ্ত ।
আমাদের সুপ্রাচীন গ্রন্থ , পুরানাদি ইত্যাদিতে উল্লিখিত কব্বর্ট, সুহ্মা, বর্দ্ধমানই জৈন গ্রন্থে বজ্জভূমি ও সুম্ভভূমি এবং বর্দ্ধমান স্বামী ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়েছে। অর্থাৎ, সুপ্রাচীন কাল হতে সুহ্ম এবং বর্দ্ধমান রাঢ়দেশের অংশ ছিল। মহাভারতের টীকাকার নীলকন্ঠ সুহ্মের অপরনাম রাঢ় বলেই নির্দেশ করেছেন। যদি সঠিকভাবে এবং একাগ্র চিত্তে মার্কণ্ডেয় পুরাণ, মহাভারত একত্র পাঠ করা যায় তবে, সুহ্ম ও বর্দ্ধমান অভিন্ন বলেই উপলব্ধি হবে। বরাহমিহিরের সময় রাঢ়ের উল্লেখ একত্রে না হয়ে সুহ্ম ও বর্দ্ধমান পৃথকভাবে পরিচিত হতে বা উচ্চারিত হতো। বৌদ্ধ এবং জৈন গ্রন্থাদিতে উভয় একত্রে রাঢ় বলে উল্লিখিত হয়েছে।
সুতরাং , রাঢ় অঞ্চলের প্রাচীন এবং আদি নাম সুহ্ম এটি সর্বতভাবে প্রমাণিত হয়। পূর্ব্ব সময় সুহ্ম , রাঢ় ও বর্দ্ধমান বলতে একই স্থানকে বোঝানো হত।
সেই মার্কণ্ডেয় পুরাণ, মহাভারতের সময়কাল হতেই বর্দ্ধমান নামটি সুপ্রচলিত ছিল। নামটি নিতান্তই আধুনিক নয়। ঐতিহাসিকগণের অনুমান অনুযায়ী বর্দ্ধমান মহাবীর পরেশনাথ পাহাড় যাওয়ার সময় এই মানভূমের উপর দিয়ে পায়ে হেঁটে গিয়েছিলেন। তাই অনেকের মতে এই ভূখণ্ডটি ব্রজভূমি নামে পরিচিত । তাছাড়াও তিনি প্রতিকূলতা (?) থেকে নিজেকে রক্ষা করে দ্বাদশ বর্ষকাল এই রাঢ় অঞ্চলে অতিবাহিত করেছিলেন তাই জৈন মার্গীয় সমাজে এই স্থান পুণ্যক্ষেত্র বলে অভিহিত হয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে, জৈন মার্গে পূণ্যভূমিকে আর্য্যভূমিও বলা হয়।
পূর্বে যদি কখনও বা বর্দ্ধমান ও সুহ্মদেশ পৃথক ভাবে নির্দেশিত হয়েছিল পরে তা এক হয়ে যায়। আবার গুপ্ত বংশের অবসান হলে , গুপ্ত প্রভাব খর্ব হলে নানা সামন্তগণের স্বাধীনতা গ্রহণের সঙ্গে বর্দ্ধমান ও সুহ্মদেশ খ্রিস্টীয় ৫ ম শতাব্দীর সময় কালে পুনরায় পৃথক হয়ে যায়।
খ্রিস্টীয় ৬ ষ্ঠ শতাব্দী দশকুমারচরিতে দামলিপ্তকে সুহ্মের অন্তর্গত বলা হয়েছে । এ অবস্থায় বর্তমান মেদিনীপুর জেলার কিয়দ্ অংশও এর অন্তর্গত ছিল। গঞ্জাম্ হতে প্রাপ্ত দ্বিতীয় মাধবরাজের তাম্রশাসন থেকে জানা যায় যে, কোদঙ্গপতি মাধবরাজ কর্ণসুবর্ণপতি শশাঙ্করাজকে আপন অধীশ্বর বলে পরিচিত করছেন। সুতরাং , সেই অর্থে বলা যায় শশাঙ্করাজ কেবল কর্ণসুবর্ণ বা গৌড়াধিপ ছিলেন না। বরং , তিনি বর্দ্ধমানপতিও ছিলেন। শশাঙ্ক রাজের সময় সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত এবং উৎকল পর্যন্ত রাঢ়দেশবিস্তার লাভ করে। হয়ত এই কারণেই সম্ভবতঃ দক্ষিণ রাঢ়ের সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত ময়ূরভঞ্জ আজও বহু বহু অধিবাসীদের নিকট রাঢ় বলে পরিচিতি লাভ করে।
খ্রিস্টীয় ৭ ম শতকে বর্দ্ধমানে যে স্থানে ৭০০ গৃহ ব্রাহ্মণের বাস ছিল। তাঁরা এই অঞ্চলের প্রধান ছিলেন। বর্দ্ধমানের যে স্থানে তাঁদের বাস ছিল সেই স্থান #সাতশতকা বা #সাতশইকা পরগনা নামে পরিচিত। বলা বাহুল্য রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণগণ গৌড়াধিপ প্রদত্ত অধিকাংশ শাসন গ্রাম এই বর্দ্ধমান জেলায় লাভ করেন। তাঁরা এসব গাঁয়ের গ্রামীণ বা গ্রামাধিপ ছিলেন। তাই আজ সেই সব ব্রাহ্মণ বংশ তৎগ্রামীণ বা গাঞী নামে পরিচিত।
খ্রিস্টীয় ১১ শতকে এই স্থানে বিভিন্ন রাজবংশের শাসনে ও নানা সামাজিক , মার্গীয় কারণে উত্তর রাঢ় এবং দক্ষিণ রাঢ় দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। উত্তর রাঢ় অঞ্চলে পালবংশের অধিকারে সনাতন হতে উদ্ভূত বৌদ্ধ মার্গীয় প্রভাব , এবং দক্ষিণ রাঢ়ে শূর ও দাস ইত্যাদি বংশের প্রভাবে ও কর্মনিষ্ঠতায় মূল সনাতনী প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এই সকল রাজনৈতিক এবং মার্গীয় কারণেই সম্ভবতঃ রাঢ় অঞ্চলে মানুষের মধ্যে উত্তররাঢ়ীয় এবং দক্ষিণরাঢ়ীয় শ্রেণীবিভাগ ঘটেছিল।
খ্রিস্টীয় ৯ ম থেকে ১১ শতকে উৎকীর্ণ পাল , বর্ম্ম ও চন্দ্রবংশের শাসনে পৌন্ড্রবর্ধন বা পৌন্ড্রভুক্তি , শ্রীনগর ভুক্তি, তীরভুক্তি ইত্যাদি ভুক্তি বা provison- এর উল্লেখ পাই। তবে খ্রিস্টীয় ১২ শতকে উৎকীর্ণ মহারাজ বল্লাল সেনের #সীতাহাটী_তাম্রশাসনে আমরা বর্দ্ধমান ভুক্তির সন্ধান পাই। এখন বর্দ্ধমান বিভাগ বলতে যা বোঝায়, তার অধিকাংশ বর্দ্ধমান ভুক্তি নামে পরিচিত ছিল।
তবে মহাভারত, পুরাণাদি এবং রঘুবংশ রচনার সময়কালে বর্দ্ধমান বিভাগের সর্বনিম্ন দক্ষিণভাগে কতটা অঞ্চল সমুদ্র বিধৌত ছিল বা জঙ্গলাকীর্ণ ছিল ,তা প্রথমেই উদ্ধৃত ভীমের বিজয়ভিজান বা রঘুর বিজয়ভিজান প্রসঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে।
লক্ষ্মণসেনের রাজসভার কবি ছিলেন ধোয়ী। তিনি মেঘদুতের অনুকরণে লিখেছিলেন পবনদূত। সেই গ্রন্থে
সুহ্মের মধ্যে লক্ষ্মণ সেনের রাজধানী বিজয়পুর কীর্তিত হয়েছে। এই অবস্থায় সেনবংশের রাজত্বকালে সুহ্মদেশ বর্দ্ধমানভুক্তির মধ্যেই ছিল বলা চলে।
উপরি উক্ত নানা প্রমাণাদি থেকে উপলব্ধ হয় যে , বর্দ্ধমান নামটি অতি প্রাচীন। সুদূর অতীত হতে এটি একটি স্বতন্ত্র জনপদ বলে গণ্য হয়ে আসছে। তবে রাঢ় অঞ্চল বললে, তার থেকেও বৃহৎ অঞ্চল ও জনপদকে বোঝানো হত। বীরভূম, বর্দ্ধমান , সুবর্ণকুড্য বা ব্রহ্মপুর বা বাগড়ি ( মুর্শিদাবাদ) , বাঁকুড়া, পুরুলিয়া বা আদিবাসী পরগনা , হুগলী , মেদিনীপুরের কিয়দ্ অংশ তৎকালে রাঢ় অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল।
এই যে বর্দ্ধমানের সীমা আলোচিত হল , তা ঠিক কতটা ছিল তা বলা বেশ কঠিন। গঙ্গার পূর্ব দিকে বরেন্দ্র এবং পূর্ব দিক রাঢ় নামে পরিচিত ছিল। ১৭৭৮ সালে রেনেল সাহেব কতৃর্ক বঙ্গের যে মানচিত্র প্রকাশ করেন , সেই মানচিত্রে বর্দ্ধমানের উত্তরে বীরভূম, দক্ষিণে মেদিনীপুর ও হুগলী , পূর্বে হুগলী ,কৃষ্ণনগর ও রাজশাহী এবং পশ্চিমে পঞ্চকোট, বিষ্ণুপুর ও মেদিনীপুরের উল্লেখ ছিল। কিন্তু তারও পূর্বে লিখিত ভবিষ্য ব্রহ্মখণ্ড নামক গ্রন্থে লিখিত আছে –
পুন্ড্রদেশ সপ্তপ্রদেশে বিভক্ত – গৌড়, বরেন্দ্র, নিবৃত্তি, নারীখন্ড, বরাহভূমি, বর্দ্ধমান ও বিন্ধ্যপার্শ্ব। এর মধ্যে বর্দ্ধমান মন্ডল ২০ যোজন ।
খ্রিস্টীয় ১৬ শ শতাব্দীতে রচিত দিগ্বিজয় প্রকাশ নামক সংস্কৃত ভৌগোলিক গ্রন্থের মতে –
অজয় নদের দক্ষিণভাগে , শীলাবতী নদীর উত্তরে , গঙ্গার পশ্চিমপারে এবং দারিকেশী নদের পূর্ব্বে দৈর্ঘ্যৈ ১১ যোজন এবং প্রস্থে ৮ যোজন পরিমিত দেশ বর্দ্ধমান। এর মধ্যভাগে প্রবাহিত হচ্ছে নানা নদী। পূর্ব্বদিকে যে সকল নদী আছে তার মধ্যে মুণ্ডেশ্বরী , বকুলা, ও সরস্বতী নদীই প্রধান। দক্ষিণেও বড় নদী আছে।
ব্রহ্মখণ্ডের মতে-
বর্দ্ধমানের মধ্যে বহুসংখ্যক নগর ও গ্রাম আছে। তন্মধ্যে উক্ত নামগুলি হল প্রধান – খুটুল , দারিকেশী নদের পার্শ্বে মায়াপুর, শঙ্কর – সরিৎ পার্শ্বে গরিষ্ঠ গ্রাম, মুণ্ডেশ্বরীর নিকট শ্ৰীকৃষ্ণনগর ( খানাকুল) এখানে অভিরাম প্রতিষ্ঠিত শ্যামসুন্দর অধিষ্ঠিত , দামোদর পার্শ্বে রাজবল্লভ , ভাগীরথী পার্শ্বে বিদ্যস্থান নবদ্বীপ ( গৌরাঙ্গের জন্ম স্থান) , নালাজোর , একলক্ষক , রাঘববাটিকা, অম্বিকা, বালুগ্রাম, ভূরিশ্রেষ্ঠিক, সেনাপি, জনারি, স্ফুরণ, আঙ্কন, তট, স্বর্ণটীক, বর্দ্ধমানের দক্ষিণে পারুল , কুমারবীথিকা, কুলক্ষিপ্তা, কপল, লৌহপুর, গোবর্ধন, হস্তিক , শ্রীরামপুর, বেলুন, অগ্রদ্বীপ , পাটলি, কর্ণগ্রাম, জোতিবনি, চন্দ্রপুর, বলিহারিপুর, বচ্ছিকবালা, কুশমান, গঙ্গচারি, জাবট, চন্দ্রলেশ ও জাঙ্গলের নিকট রসগ্রাম। এছাড়াও ৮ টি পত্তনের নাম – বৈদ্যপুর, পাটলি, শিলাবতীনদীর পার্শ্বে লোহদা, দামোদরের নিকট চন্দ্রবাটী, বর্দ্ধমানের পশ্চিমাংশে বৃশ্চিকপত্তন, ত্রিবক্রসসরিৎপার্শ্বে হাটকনগর, ভাগীরথীর পশ্চিমে বিধপত্তন এবং বর্দ্ধমানের ত্রিশ ক্রোশ দূরে সামস্তপত্তন।
উদ্ধৃত গ্রাম, নগরাদির অবস্থান প্রমুখ আলোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতাব্দীর পূর্ব্ব পর্যন্ত বর্তমান বর্দ্ধমান ব্যতীত হাওড়া, হুগলী, নদীয়া, পাবনা , মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং মুর্শিদাবাদের বেশ কিছু অংশ বর্দ্ধমানের অন্তর্গত ছিল।
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
(প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় প্রকাশিত)
তথ্যঃ ১) বর্ধমান জেলার ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি
২) বর্দ্ধমানের কথা : বর্দ্ধমানের পুরাকথা ও বর্তমান বর্দ্ধমান