বাংলার শৈব মত :- সাধক ও রাজন্যবর্গ

সকলকে শ্রী শ্রী মহাশিবরাত্রি র আন্তরিক শুভেচ্ছা..বাংলা ও বাঙ্গালীর অত্যন্ত কাছের অত্যন্ত প্রিয় অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় প্রভু মহাদেব। তিনি জগদীশ্বর, শূন্য থেকে অসীম অবধি তিনিই সর্বত্র বিরাজমান; তাঁর আশীর্বাদ ধন্য এই বাংলার পূণ্যভূমি। বাংলায় যেমন প্রচুর সংখ্যক প্রাচীন শিব মন্দির আছে, বহু সংখ্যক শৈব রাজন্য আছেন ঠিক তেমনই বাংলার লৌকিক ক্ষেত্রেও মহাদেব অত্যন্ত প্রসিদ্ধ।. এই প্রবন্ধে বাংলার শৈবধারা, এবং শৈব রাজন্য ও সাধকদের দিয়ে আলোচনা থাকবে।

প্রভু রুদ্রেশ্বর মহাদেব এর চরণে শতকোটি নমন জানিয়ে এই লেখা তাঁর চরণে নিবেদন করলাম।

রামায়ণ মহাভারত হরিবংশ এবং বিভিন্ন পুরাণে আমরা বাঙ্গালীদের বীরত্ব এর উল্লেখ পাই; ঠিক তেমনি রাঢ়, বরেন্দ্র ও বঙ্গভূম এর তিনটি প্রাচীন শৈব আরাধনা ক্ষেত্রের উল্লেখ পাই স্কন্দপুরাণে।

পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম বর্ধমান জেলার আসানসোল এর নিকটবর্তী বরাকর অঞ্চলে অবস্থিত সিদ্ধেশ্বর বা বেগুনিয়া দেউল পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীনতম শৈব মন্দির এর মধ্যে অন্যতম। এখানে মোট পাঁচটি রেখ দেউল দেখা যায় প্রকৃতপক্ষে এই মন্দিরটি মহাভারত সময়কালে তৈরি হয়েছিল বলে উল্লেখ আছে “স্কন্দপুরাণ” গ্রন্থে। শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধর স্ত্রী তথা বাণাসুরের কন্যা উষার বান্ধবী চিত্রলেখা এই মন্দিরটি স্থাপন করেন বলে জানা যায়। মন্দির টি “বরাকেশ্বর” বলে পরিচিত এবং ধারণা করা হয় বরাকেশ্বর থেকেই বরাকর নাম এসেছে। স্কন্দপুরাণে এই স্থানটিকে অত্যন্ত পবিত্র রূপে গণ্য করা হয়েছে এবং এই পবিত্র মন্দিরে পূজা দিলে স্বয়ং মহাদেবের অনুগ্রহ লাভ হবে বলা হয়েছে।

পাল সাম্রাজ্যের আমলে অর্থাৎ অষ্টম শতাব্দী তে বর্তমান মন্দিরটি পুনর্নির্মাণ করা হয় বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা। এছাড়াও এই মন্দিরটি জনৈক মহারাজা হরিশ্চন্দ্র(সম্ভবত শিখরভূমের মহারাজা প্রথম হরিশচন্দ্র শেখর) কর্তৃক তাঁর স্ত্রী হরিপ্রিয়া দেবীর ইচ্ছায় পুননির্মিত হয়েছিল পঞ্চদশ শতাব্দীতে।

[বরাকেশ্বর মন্দির বা বরাকর সিদ্ধেশ্বর মন্দির]

অধুনা বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার কদম শহর অঞ্চলে একটি অতি প্রাচীন শিবমন্দির ছিল বলে জানা যায়, ঐ অঞ্চলে এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল। এই মন্দিরটির প্রকৃত নাম প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দির। “স্কন্দপুরাণ” ও “হরিবংশম” থেকে আমরা জানতে পারি শ্রীকৃষ্ণের জেষ্ঠ্য পুত্র প্রদ্যুম্ন এই মন্দির তৈরি করেছিলেন বঙ্গে তাঁর অবস্থান কালে।

গৌড়েশ্বর বিজয় সেনের দেওপাড়া শিলালিপি থেকে জানা যায় তিনি প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত লক্ষ্মীবল্লভ ও শৈলজাদায়িত্ব নামক হরিহর মূর্তি ছিল। মন্দিরটি অত্যন্ত সুন্দর ছিল এবং তাঁর সামনে একটি হ্রদ ছিল বলে জানা যায়। মন্দিরের শিলালিপি টি কিছু টা এই রকম:- ” লক্ষ্মীবল্লভ-শৈলজাদয়িতয়োর অদ্বৈত-লীলাগৃহম্ প্রদ্যুম্নিভরা-দাভদা (বিদিএ)-ল-ফিচনাম অধীস্থানম নমস্কল্মহে / যত্র ইফিংগানা-ভাইগা-কাতরতায় স্থিতভ অন্তরে কান্তয়র দদেবীভ্যম্ অপি অভিন্ন-তনুতা শিল্পে ‘নতরয়ঃ কৃতঃ ”

যবন আক্রমণ কালে এই মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, কিছু ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছিল যেখান থেকে এই সমস্ত তথ্য জানা যায়। এই মন্দিরের শিলালিপিতে শ্রী উমাপতি ধর কর্তৃক লিখিত ব্যজস্তুতি পদ থেকেই আমরা গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের বখতিয়ারকে পরাজিত করার ঘটনা জানতে পারি। বর্তমানে মন্দির বলে কিছু নেই, কেবল একটি স্তম্ভ পাওয়া গিয়েছিল। প্রদ্যুম্নেশ্বর থেকে অপভ্রংশ হয়েই বর্তমান কদম শহর নামটি এসেছে।

[ প্রদ্যুম্নেশ্বর ]

অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের উপর অবস্থিত মহাতীর্থ সীতাকুণ্ড চন্দ্রনাথ ধাম বাংলার এক অতি প্রাচীন ও অত্যন্ত জাগ্রত সতীপিঠ তথা শিবমন্দির। দেবী মাহাত্ম্য, শিব গীতা, স্কন্দপুরাণ এই তিনটি গ্রন্থে এই স্থানের মাহাত্ম্যের কথা উল্লিখিত আছে। দেবী সতীর দক্ষিণ হস্ত এই স্থানে পড়েছিল। গন্ধমাদন পর্বতের নিকটবর্তী সীতাকুণ্ডে স্নান করে এবং চন্দ্রনাথ শিবমন্দিরে সদাশিবের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করে ও পূজা দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র নিজের পাপ থেকে মুক্তি লাভ করেন।

এই স্থানে প্রতি বছর প্রচুর ভক্ত গমন করেন এবং ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা দেন। শিবরাত্রির সময় বিশেষ ট্রেনেরও ব্যবস্থা করা হয়।

[ চন্দ্রনাথ শিবমন্দির ]

বাংলায় যেমন কয়েক হাজার শিবমন্দির রয়েছে, যেমন বাংলায় শিব আরাধনার উল্লেখ আমরা পুরাণে পাই ঠিক তেমনি বাংলার বুকে জন্ম নিয়েছেন বহু প্রখ্যাত শৈব সাধক, যাঁরা নিজেদের জীবন দিয়ে শিব তত্ত্ব বুঝিয়েছেন এবং মানুষকে শিখিয়েছেন। এই রকম কিছু মহান সাধকের কথা নীচে বলা হলো:-

বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রখ্যাত এবং মহান শৈব সাধক ছিলেন মহাগুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ। তিনি নাথপন্থার তথা কৌলমতের প্রবর্তক, মহাকৌল। বিখ্যাত কাশ্মীরি তন্ত্রসাধক পণ্ডিত আচার্য অভিনব গুপ্তর মতে মৎস্যেন্দ্রনাথ হলেন কলিযুগের ঋষি, স্বয়ং আদিনাথ মহাদেবের কাছ থেকে কৌলতন্ত্র জ্ঞান নিয়ে তিনি তা মানুষের মধ্যে প্রচার করেন।

গুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ মীননাথ মচ্ছিন্দ্র ইত্যাদি নামেও পরিচিত। তাঁর জন্ম অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল চন্দ্রদ্বীপ অঞ্চলে হয়েছিল। তাঁর কৌলজ্ঞাননির্ণয় গ্রন্থে তিনি নিজেকে ” চন্দ্রদ্বীপ বিনির্গত ” বলেছেন। চন্দ্রদ্বীপের এক কৈবর্ত পরিবারে সম্ভবত সপ্তম শতাব্দীতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনের অধিকাংশই রহস্যাবৃত এবং কিংবদন্তিপূর্ণ। মাছ ধরার সময় এক বিশাল মৎস্য একবার তাঁকে গিলে নেয়, মৎস্যের গর্ভে থাকাকালীন তিনি সমুদ্রতলে উপবিষ্ট মহাদেব যিনি দেবী দুর্গাকে কৌল তন্ত্র সম্বন্ধে জ্ঞান প্রদান করছিলেন সব শুনে নেন। বারো বৎসর মৎস্যের গর্ভে সাধনার পর তিনি মহাদেবের আশীর্বাদপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে আসেন এবং কৌলধর্মের প্রচার করতে থাকেন। তাঁকে হঠযোগের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও ধরা হয়। এমনকি মৎস্যেন্দ্রাসন নামক একটি আসন আজও আছে। তিনি দক্ষিণাচার ও বামাচারের মধ্যবর্তী শাবর তন্ত্র বা নাথপন্থার জন্ম দেন।

গোরক্ষনাথ,কাহ্নপা, চৌরঙ্গীনাথ তাঁর প্রখ্যাত শিষ্য। চর্যাপদ ও এই নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীদেরই লেখা। প্রভু আদিনাথ মহাদেবের অনুসারী গুরূ মৎস্যেন্দ্রনাথ নেপালও যান। পরবর্তীকালে দীর্ঘকাল সহাবস্থানের জন্য সহজযানী বৌদ্ধ ও নাথপন্থী শৈবদের মধ্যে এক বন্ধন সৃষ্টি হয় এবং মহাগুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ বৌদ্ধধর্মে জীবন্ত অবলোকিতেশ্বর রূপে পূজিত হতে থাকেন।

তাঁকে বাংলা ভাষার আদিকবিদের মধ্যে একজন বলেও ধরা হয়। তাঁর লেখা কৌলজ্ঞাননির্ণয়, মৎস্যেন্দ্রসংহিতা, অকুল বীরতন্ত্র ইত্যাদি গ্রন্থ পাওয়া যায়।

মৎস্যেন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব যাঁকে নিয়ে বেশি আলোচনা হয়না।

[মহাগুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ]

চৌরঙ্গীনাথ হলেন বাংলার নাথ সম্প্রদায়ের অপর এক বিখ্যাত নাম। তিনি প্রকৃত অর্থে ছিলেন পাল সাম্রাজ্যের যুবরাজ। সম্ভবত গৌড়েশ্বর দেবপাল দেবের জেষ্ঠ্য পুত্র তথা যুবরাজ ছিলেন রাজ্যপাল। রাজ্যপাল তাঁর যুবরাজ্যাভিষেকের পর সন্ন্যাস জীবন ও ধর্মের প্রতি অত্যন্ত আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শেষে গৃহত্যাগ করেন।

তিনি মহাগুরু মৎস্যেন্দ্রনাথ এবং অচিন্ত্যের দীক্ষা গ্রহণ করেন, নতুন নামকরণ হয় চৌরঙ্গীনাথ। চৌরঙ্গীনাথের জীবন সম্বন্ধে অধিক তথ্য তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে তিনি সিদ্ধিলাভ এর পর সারা ভারত ভ্রমণ করেন। রাজসুখ ত্যাগ করে যোগী হবার জন্য তিনি যোগীপাল নামেও পরিচিত। বৃন্দাবন দাস রচিত বৈষ্ণব সাহিত্যে আমরা পাই:-

” যোগীপাল ভোগীপাল মহীপাল এর গীত
ইহা শুনিবারে সর্ব্ব লোক আনন্দিত “

কালীঘাট পীঠের সঙ্গেও তাঁর নাম জড়িয়ে আছে। এখানে আসার সুপ্রাচীন পথের ধারেই ছিল তাঁর সাধনক্ষেত্র; আজকের চৌরঙ্গী। শোনা যায় কালীঘাটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করা তীর্থযাত্রীদের তিনি আশ্রয় দিতেন এখানে। বর্তমানে কলকাতার এক্সাইড মোড়ের কাছে নন্দনের পাশে চৌরঙ্গীনাথের সমাধি অবস্থিত, তাঁর সমাধির উপর একটি শিবমন্দির নির্মিত হয়েছে।

[ চৌরঙ্গীনাথের সমাধি মন্দির ]

ঊনবিংশ শতকের বাংলা তথা পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত যোগী, সাধক এবং গুরু ছিলেন বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। ধর্ম জগতে, শ্রীশ্রী লোকনাথ ব্রহ্মচারী বাবার নাম সেই সাধকদের মধ্যে শীর্ষ স্থানে ধ্বণিত আছে যাঁরা জীবনের মোক্ষলাভের জন্য পরম অধ্যবসায়ে দেহ ও মন উৎসর্গ করেছিলেন। তিনি শিবমন্ত্রে দীক্ষা নেন এবং ভক্তদের কাছে মহাদেবের অবতার বলে পরিচিত।

১৭৩০ সালের ৬ই আগস্ট জন্মাষ্টমীর দিন দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার চাকলা গ্রামে রামনারায়ণ ঘোষাল ও কমলা দেবীর গৃহে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। দশ বছর বয়সে তিনি গুরু ভগবান গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। আট দশকব্যাপী সাধনার পর ৯০ বছর বয়সে তিনি হিমালয়ে সিদ্ধিলাভ করেন। এরপর প্রায় ৪০ বছর সমগ্র দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে তিনি ভ্রমণ করেন।

বাবা লোকনাথ ১৮৬৬ সালে বাংলায় ফিরে আসেন এবং ঢাকার (বর্তমান বাংলাদেশ) কাছে বারদীতে বসতি স্থাপন করেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে কাদা এবং বাঁশ দিয়ে একটি ছোট কুঁড়ে তৈরি করেছিলেন, এটি পরবর্তীতে বাকি জীবনের জন্য তাঁর আশ্রমে পরিণত হবে। তাঁর সময়ের অন্যান্য অনেক ঋষি এবং যোগীদের থেকে তিনি ছিলেন ভিন্ন, বাবা সব ধরনের প্রচার এড়িয়ে যেতেন। তা সত্ত্বেও, তিনি জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে যে কেউ তাঁকে দেখতে আসলে তিনি তাকে সাহায্য করতেন। তাঁর খ্যাতি অনিবার্যভাবে বহুদূরে ছড়িয়ে পড়ে এবং বারদীর আশ্রম ধীরে ধীরে সারা বিশ্ব থেকে ভক্তদের আকর্ষণ করতে শুরু করে।

বাবা লোকনাথের জীবন সম্বন্ধে তেমন কিছু জানা যায় না। তিনি ১৬০ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ১৮৯০ সালের ১লা জুন সমাধি লাভ করেন। তিনি বলেছিলেন:- ” রণে বনে জলে জঙ্গলে, যখনই যেখানে বিপদে পড়িবে, আমাকে স্মরণ করিবে আমি তোমাদের রক্ষা করিব। “

দেহত্যাগের ১৩০ বছর পরেও বাবা লোকনাথ আজও সমান সম্মান ও শ্রদ্ধার পাত্র।

[ বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী ]

ডাবুকের উন্মত্তেশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা, প্রখ্যাত শৈব সাধক এবং মহাতান্ত্রিক বামাক্ষ্যাপার গুরুস্থানীয় সাধক শ্রী কৈলাসপতি মহারাজ বাংলার এক অতি বিখ্যাত শৈবসাধক।

১১৪৪ বঙ্গাব্দে তিনি নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পূর্বনাম ছিল ভবানীমোহন মুখোপাধ্যায়। তিরিশ বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত ধারণ করেন। কাশীতে মহাসাধক ব্রহ্মানন্দের কাছে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন তীর্থস্থান, শৈব ও সতীপীঠ ভ্রমণ করে ১২৬১ সালে প্রায় ১১৭ বছর বয়সে বীরভূম আসেন।

কৈলাসপতি মহারাজ অত্যন্ত তেজস্বী সাধক ছিলেন। দীর্ঘ বলিষ্ঠদেহী সুপুরুষ, তিনি ভৈরবসাধনায় অতীব উচ্চস্তরের সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। যোগ ও তন্ত্রে মহাসিদ্ধি তাঁর করায়ত্ত ছিল। সাধক বামাক্ষ্যাপাকে তিনি শৈবদীক্ষা দেন বলে মনে করা হয়, বামাক্ষ্যাপা তাঁকে রাজা গোঁসাই বলে ডাকতেন। বীরভূমে তাঁর বহু শিষ্য ছিল।

তারাপীঠ এর তিন ক্রোশ দক্ষিণে ডাবুক এ তিনি উন্মত্তেশ্বর(বর্তমানে ডাবুকেশ্বর নামে পরিচিত) মহাদেবের মন্দির স্থাপন করেন ১২৭২ বঙ্গাব্দে। উন্মত্তেশ্বর প্রকৃত অর্থে মা তারার ভৈরব। এখানে শিবলিঙ্গটি স্বয়ম্ভু। ডাবুকে অবস্থানকালে ঈশান মৈত্র, বিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য, মোক্ষদানন্দ প্রমুখের সাথে তাঁর হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। ডাবুকেশ্বর মন্দির স্থাপনে কাশ্মীরের মহারাজা এক লক্ষ টাকা দান করেন, এর থেকে কৈলাসপতি মহারাজের সর্বভারতীয় সুখ্যাতির কথা জানা যায়।

১৩২৪ সালের ১৭ ই ভাদ্র ডাবুকের কৈলাসপতি ১৮০ বছর বয়সে ইষ্টে লীন হয়ে যান। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহাদেব আজও ডাবুকে আছেন এবং নিত্য পূজিত হন।

[ কৈলাসপতি ও ডাবুকের মন্দির ]

যেকোনো ধর্মমত প্রচার ও প্রসার এর জন্য রাজানুগ্রহ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাংলার বুকে শৈবমতের খ্যাতি এবং কয়েক হাজার শিবমন্দিরের উপস্থিতি এই ঘটনার জানান দেয় যে বাঙ্গালী রাজারা সবসময়েই ত্রিশুলধারী পিণাকপাণি মহেশ্বরের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে এসেছেন। এই সাপেক্ষে বাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত কিছু শৈব রাজন্যবর্গ এর কথা নীচে আলোচনা করা হলো।

।। মহেশ্বরচর্ণপরায়ণয়ঃ গৌড়সাম্রাজ্যবিস্তারকঃ
স্মরামি তং শশাঙ্ক রাজন্ পরমপ্রতাপী শত্রুহন্।।

বাংলার শৈব রাজন্য বলতে প্রথমেই যাঁর নাম মনে আসে তিনি শ্রী পরমমহেশ্বর পরমেশ্বর পরমভট্টারক চন্দ্রহাসাধ্রস্ত গৌড়ভুজঙ্গ গৌড়াধিপতি মহারাজাধিরাজ নরেন্দ্রাদিত্য শশাঙ্ক দেব। গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনকালে তিনি স্বাধীন গৌড় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

গৌড়াধিপ শশাঙ্ক নিঃসন্দেহে বাঙ্গালী জাতির সর্ববৃহৎ নৃপতিদের মধ্যে অগ্রগণ্য। তিনি বঙ্গাব্দের প্রণেতা ; কনৌজের হর্ষবর্ধন ও কামরূপের ভাস্করবর্মণকে বারংবার পরাজিত করে পঁচিশ বছর তিনি গৌড়কে এক উল্লেখযোগ্য শক্তিরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর শিবভক্তি সর্বজনবিদিত। মহেশ্বরের আশীর্বাদ এ তাঁর জীবিতকালে গৌড় দখল করতে পারেনি কেউ। তাঁর রোহতাসগড় থেকে প্রাপ্ত রাজকীয় শিলমোহর ও সমতট থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা এ যথাক্রমে ষাঁড় ও নন্দীর উপর উপবিষ্ট মহাদেবের ছবি উৎকীর্ণ আছে যা তাঁর শিবভক্তির পরিচয় বহন করে।

[ গৌড়াধিপ শশাঙ্ক ও তাঁর নাম মুদ্রা ]

পালবংশের শাসনামল নিঃসন্দেহে বাংলার ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গর্বের সময়কাল। এইসময় সমগ্র আর্যাবর্ত তথা অখণ্ড ভারতবর্ষে বাঙ্গালী জাতির শৌর্য ছড়িয়ে পড়ে। শৈব মতের অনুসারী ছিলেন বেশ কিছু পাল সম্রাট। পালযুগের প্রাপ্ত বিভিন্ন মূর্তির মধ্যে মহাদেব এর উমামহেশ্বর, মৃত্যুঞ্জয়, কালভৈরব, নটরাজ ইত্যাদি বিভিন্ন রূপের মূর্তি পাওয়া যায়।

[ পালযুগের মহাদেব মূর্তি ]

পাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা গৌড়েশ্বর গোপালদেবের জেষ্ঠ্য পুত্র ছিলেন শ্রী পরমেশ্বর পরমভট্টারক বিক্রমশীল গৌড়েশ্বর মহারাজাধিরাজ ধর্মপাল দেব। গোপালদেবের পর সিংহাসনে বসে তিনি সমগ্র আর্যাবর্তে পাল সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটান এবং এক উল্লেখযোগ্য শক্তি রূপে প্রতিষ্ঠা করেন।

ধর্মপাল শৈবমতের অনুসারী ছিলেন। মুঙ্গের তাম্রশাসন অনুযায়ী তিনি উত্তর ভারতের কেদারনাথ এবং কর্ণাটকের গোকর্ণ ধাম উভয় বিখ্যাত শিবমন্দিরে পূজা দেন বলে জানা যায়।

কেশব প্রশস্তি অর্থাৎ বোধগয়া তাম্রশাসন থেকে জানা যায় তিনি তাঁর রাজত্বের ২৬ তম বর্ষে মহাবোধি তে একটি চতুর্মুখী শিবমূর্তি স্থাপন করেন।

এছাড়াও তৎকালীন সময়ে তান্ত্রিক বৌদ্ধ মতের প্রসার বাড়তে থাকে। এই মতে ধর্মপালের প্রভাব এতটাই ছিল যে বজ্রযানের মহাকাল (যিনি আদতে হিন্দুদের কালভৈরব) এর নাম ধর্মপাল হয়ে যায়।

[ গৌড়েশ্বর ধর্মপাল ও বৌদ্ধ ধর্মের ধর্মপাল ]

গৌড়েশ্বর মহীপাল ছিলেন পালবংশের একাদশতম শাসক। গৌড়েশ্বর নারায়ণপাল-পরবর্তীকালীন পাল শাসকদের দুর্বলতার প্রভাবে ক্ষয়িষ্ণু পাল সাম্রাজ্যকে তিনি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং বারাণসী থেকে মলয় পর্বত অবধি সাম্রাজ্য বিস্তার করেন।

জানা যায় তিনি শিবশক্তির সমান রূপ (ঈশানচিত্রঘন্টা) -এর উপাসক ছিলেন। তিনি দুবার পবিত্র বারাণসী ধামকে গজনভিদের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেন। ১০২৬ এ মাহমুদ গজনভি ও ১০৩৩ এ মাসুদ গজনভি নিয়ালতিগিন জোট কে পরাজিত করে গৌড়েশ্বর মহীপাল পূণ্যভূমি বারাণসী ধামকে যবনদের হাত থেকে রক্ষা করেন।

গৌড়েশ্বর মহীপাল বারাণসী ধামে ১০০র অধিক শিবশক্তিরূপেণ ‘ঈশান-চিত্রঘন্টা’ মন্দির নির্মাণ করেন। ১০৮৩ বিক্রম সম্বৎ-এ (১০২৬ খ্রি) উৎকীর্ণ তাঁর সারনাথ শিলালিপি অনুসারে থেকে আমরা এই কথা জানতে পারি।

[ মহীপালের সারনাথ শিলালিপি]

গৌড়েশ্বর মহীপালের পুত্র গৌড়েশ্বর নয়পাল ছিলেন তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরি। পিতার সাম্রাজ্যকে তিনি রক্ষা করেন এবং অধুনা নেপাল অবধি বিস্তৃত করেন। তাঁর রাজত্বের শেষদিকে কলচুরি রাজ লক্ষ্মীকর্ণর আক্রমণ তিনি প্রতিহত করেন।

গৌড়েশ্বর নয়পাল শৈবদীক্ষা নিয়েছিলেন আচার্য সর্বৎশিব এর কাছে, এই ঘটনা বাণগড় শিলা প্রশস্তি থেকে জানা যায়।

বীরভূমের সিয়ান গ্রামে মখদুম শাহ জালানেল দরগায় ১৯৭১ সালে প্রাপ্ত গৌড়ীয় লিপিতে লেখা প্রশস্তি শিলালিপি থেকে জানা যায় গৌড়েশ্বর নয়পাল দেবীকোট, ক্ষেমেশ্বর, ধর্মারণ্য, বৈদ্যনাথে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও গঙ্গাসাগরে স্বর্ণ ত্রিশুল, রৌপ্য সদাশিব মূর্তি, শিবের স্বর্ণ প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও শৈব সাধুদের জন্য দ্বিতল মঠ তৈরি করান।

[নয়পালের সিয়ান প্রশস্তি]

অখণ্ড ভারতবর্ষে দিগ্বিজয় করা একমাত্র গৌড়ীয় সম্রাট গৌড়েশ্বর দেবপাল দেবের স্ত্রী তথা পরবর্তী দুই সম্রাট প্রথম মহেন্দ্র পাল ও প্রথম শূরপালের মাতা ছিলেন মহাতা দেবী। জন্মসূত্রে তিনি চাহমানরাজ দুর্লভরাজার কন্যা, যাঁর সাথে যুবরাজ অবস্থায় দেবপালের বিবাহ হয়।

মহাতা দেবী মহাদেবের উপাসিকা ছিলেন। দেবপালের মৃত্যুর পরেও তিনি বেশ কয়েক বছর জীবিত ছিলেন। দ্বিতীয় পুত্র গৌড়েশ্বর শূরপালের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষ অর্থাৎ ৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বারাণসীতে মহাতেশ্বর মহাদেবের মূর্তি স্থাপন করান বলে জানা যায়।

পালবংশের পতনের পর বাংলায় সেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। এই সময়েই বাংলায় প্রথম যবন আক্রমণ হয় এবং সেনবংশীয় শাসকরা অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সেনবংশীয় রাজন্য দের রাজকীয় সিলমোহরে সদাশিব বর্তমান, তাই তাঁকে সেন রাজবংশের অত্যন্ত প্রসিদ্ধ দেবতা বলা চলে। পাল যুগের ন্যায় সেন যুগেও বাংলায় প্রচুর শিবমূর্তি ও শিবমন্দির পাওয়া যায়।

[ সেন রাজবংশের সদাশিব রাজকীয় নামমুদ্রা ]

গৌড়েশ্বর বিজয় সেন ছিলেন সেন বংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। পালবংশের শেষদিকের দুর্বল শাসকদের পরাজিত করে তিনি সমগ্র বাংলা তথা আসাম উড়িষ্যা সহ বিরাট অংশে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর আমলেই প্রথম রাজকার্যে বঙ্গলিপি ব্যবহার শুরু হয়।

বিজয় সেন শৈব ছিলেন, নিঃসন্দেহে।  তাঁর উপাধি ছিল পরমমাহেশ্বর পরমভট্টারক অরিরাজ বৃষভ শঙ্কর মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর বিজয় সেন। তাঁর দেওপাড়া শিলালিপি থেকে তাঁর প্রতিষ্ঠিত প্রদ্যুম্নেশ্বর মন্দির এর কথা জানা যায়। এই মন্দির অত্যন্ত সুন্দর ও বিশাল ছিল এবং এর মধ্যে হরি হর মূর্তি ছিল।

[বিজয়সেনের দেওপাড়া প্রশস্তি]

পরমেশ্বর পরমভট্টারক অরিরাজ নিশঙ্ক শঙ্কর মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর বল্লাল সেন বাংলার ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা প্রখ্যাত ও উল্লেখযোগ্য এক শাসক। পিতৃদত্ত সাম্রাজ্য রক্ষা এবং সাম্রাজ্য বিস্তারের সাথে তিনি কৌলীন্য প্রথার সংস্কার করেন। এছাড়াও ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’ নামক দুটি গ্রন্থ ও রচনা করেন।

বল্লাল সেন নিজস্ব জীবনে শাক্ত হলেও রাজনৈতিক ভাবে শৈব ছিলেন, তাঁকে মহাদেবের বরপুত্র বলা হয়। তিনি দুর্গাপুরের কাছে অবস্থিত বিখ্যাত রাঢ়েশ্বর মন্দির নির্মাণ করান। কথিত আছে অসুস্থ অবস্থায় স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি এই মন্দির নির্মাণ করান। মন্দিরটি সুউচ্চ এবং ল্যাটেরাইট পাথর নির্মিত অতি সুন্দর শিখর দেউল আকৃতির।

[ রাঢ়েশ্বর মন্দির ]

পরমেশ্বর পরমভট্টারক পরমসৌর অরিরাজ বৃষভাঙ্ক শঙ্কর সগর্গযবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্র মহারাজাধিরাজ গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন ছিলেন গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেনের মধ্যম পুত্র। পিতার সাথে বখতিয়ার বিতাড়ন থেকে বঙ্গ ভূমের শাসক হিসেবে দীর্ঘ চার দশক যবন আক্রমণ প্রতিরোধ করেছেন বিশ্বরূপ সেন।

তিনি নিজে পরমসৌর অর্থাৎ সূর্যের উপাসক ছিলেন, কিন্তু বারাণসী ধাম পুনরুদ্ধার তাঁর অন্যতম বৃহৎ কৃতিত্ব। ১২১১ সালে ইলতুতমিশ বারাণসী ধাম দখল করে নিয়ে অত্যাচার করতে থাকে। পবিত্র শৈবক্ষেত্র রক্ষা করতে গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন এক বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে ১২১২ খ্রিস্টাব্দে বারাণসী আক্রমণ করেন এবং যবনদের পরাজিত করে পুনরায় হিন্দু শাসন স্থাপন করেন। এই সময় তিনি কাশী কে ” শিব বিশ্বেশ্বর এর ভূমি ” বলে আখ্যায়িত করেন। এর পর থেকেই আবার ভগবান বিশ্বনাথ কে বিশ্বেশ্বর বলে ডাকা শুরু হয়। বিশ্বরূপ সেন একটি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেন কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বাংলায় ক্রমগত যবন আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তাঁকে ফিরে যেতে হয় এবং বিশ্বনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।

[গৌড়েশ্বর বিশ্বরূপ সেন]

সমতট হরিকেলে নবম থেকে একাদশ শতাব্দী রাজত্ব করে চন্দ্র বংশ। এই বংশের মুদ্রায় ষাঁড়ের ছবি পাওয়া যায় যা থেকে এঁরা শৈব মতের অনুসারী ছিলেন জানা যায়। এই বংশের প্রথম রাজা ছিলেন শ্রীচন্দ্র যিনি বহু বছর রাজত্ব করেন এবং সমগ্র বঙ্গ অঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বে কামরূপ পর্যন্ত চন্দ্রদের ক্ষমতা সম্প্রসারণের কৃতিত্ব তাঁর। দ্বিতীয় গোপালের সময় পালদের ক্ষমতা রক্ষাকল্পে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন। এই বংশের শেষ শাসক ছিলেন গোবিন্দ চন্দ্র। তিনি গৌড়েশ্বর মহীপালের সমসাময়িক এবং রাজেন্দ্র চোলের বাংলা আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। তিনি সেই সময় ওয়াঙ্গল অর্থাৎ বঙ্গালের রাজা ছিলেন, ডিঙ্গি নৌকা দিয়ে চোল যুদ্ধজাহাজ গুলি আটকে দেন।

[চন্দ্র বংশের মুদ্রা]

মহারাজা দেবনারায়ণ রায়মুখুটি ছিলেন ভুরিশ্রেষ্ঠ প্রখ্যাত ব্রাহ্মণ রাজন্য রায়মুখুটি বংশের এক উল্লেখযোগ্য রাজা। তিনি প্রথম জীবনে পিতৃব্য রাজা মহেন্দ্র নারায়ণ রায়ের সেনাপতিত্বে গৌড় নগরী অবরোধ করে অত্যাচারী হাবশী মুজঃফর শাহ কে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে ভ্রাতা যোগেন্দ্র এবং মুকুটরামের সেনাপতিত্বে তিনি হোসেন শাহকে যুদ্ধে পরাজিত করে ভুরিশ্রেষ্ঠর সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে সক্ষম হন।

মহারাজ দেবনারায়ণ রায়মুখুটির শাসনকালে ১৪০৬ শকাব্দের ২১ শ্রাবণ (১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দে) রাজ্যের মণিনাথ শিবমন্দির থেকে বঙ্গলিপিতে খোদিত রাজার নাম উল্লিখিত এক শিলালিপি স্থাপিত হয়।

” শ্রীভগবতঃ বামদেব মণিনাথস্য
দেবনারায়ণ-স্থাপিতমিদং হৈবতম্ ।।
১৪০৬ শকে। ২১ শ্রাবণ (দিনে)”

মণিনাথ-শিবলিঙ্গটি সুপ্রাচীন এবং এই মন্দিরে প্রাপ্ত শিলালিপিতে মহারাজা দেবনারায়ণের নাম সুস্পষ্ট লিখিত আছে, লিপি অনুসারে রাজা দেবনারায়ণ মণিনাথ শিববিগ্রহ ও মন্দিরের আদি ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা।

[ মণিনাথ মন্দির ]

মহারাণী ভবশঙ্করী দেবী ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজবংশের সর্বাপেক্ষা বিখ্যাত শাসিকা। তাঁর পরমপ্রতাপী মহাবলী স্বামী মহারাজা রুদ্রনারায়ণ রায়মুখুটি অকালমৃত্যুর পর ভবশঙ্করী দেবী অত্যন্ত শক্তিশালী হাতে রাজ্যভার গ্রহণ করেন এবং আগ্রাসী পাঠানদের পরপর যুদ্ধে পরাজিত করে রাজ্য রক্ষা করেন। তিনি ইতিহাসে “রায়বাঘিনী” নামে বিখ্যাত।

মহারাণী ভবশঙ্করী শাক্ত রাজবংশের পুত্রবধূ হলেও নিজস্ব জীবনে শৈব ছিলেন। রাজ্য চালনা ছাড়া অধিকাংশ সময় কাটাশাঁকড়ায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত মহাদেবের মন্দিরেই তিনি প্রভুর সেবায় নিয়োজিত করেন।

এছাড়াও তিনি পাঠানদের যুদ্ধে পরাজিত করার পর, তাঁর স্বামীর নামে রুদ্রেশ্বর মহাদেবের মূর্তি স্থাপন করেন এবং প্রভুর চরণবন্দনায় সময় অতিবাহিত করেন। পালযুগের সদাশিব রূপের অনুরূপ ভগবান রুদ্রেশ্বরের এই স্ফটিকের জ্যোতির্লিঙ্গ দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে বিলুপ্ত।

[ রুদ্রেশ্বর ]

রাঢ়ের প্রখ্যাত মল্লভূম রাজ্যের ৩৫ তম শাসক ছিলেন মহারাজা ভীম মল্ল। তিনি ১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে রাজনগর দুর্গ পুনর্দখলের উদ্দেশ্যে তৈরি হওয়া শিখরভূম জোটে যোগ দেন এবং যবনদের পরাজিত করেন। আবার কোটাসুর এর যুদ্ধেও তিনি শিখরভূম তথা সামন্তভূমের সাথে যুদ্ধে যোগ দিয়ে কোটাসুর দুর্গ দখল করেন।

একসময় সামন্তভূম ও মল্লভূমেই দুই পার্শ্ববর্তী হিন্দু শক্তির মধ্যে প্রায়ই সীমান্ত নিয়ে বিবাদ চলতো। ক্রমবর্ধমান যবন আক্রমণ থেকে নিজেদের সুরক্ষিত করতে মহারাজা ভীম মল্ল ও সামন্তভূমের প্রথম হামীর রায় সন্ধি করেন এবং বাঁকুড়ায় দ্বারকেশ্বর নদীর তীরে প্রখ্যাত একতেশ্বর মহাদেবের মন্দির স্থাপন করেন। একতেশ্বর দুই রাজ্যের মধ্যে একতার প্রতীক। আজও এই মন্দিরে নিয়মিত বহু ভক্ত যান ও মহাদেবের আরাধনা করেন।

[ একতেশ্বর ]

বঙ্গাধিপং মহাশৌর্যং প্রতাপাদিত্য বীরেশম্ ।
বীরাষ্টম্যাং নমস্কুর্ম পুষ্পাঞ্জলিং দদাম্যহম্ ।।

বাংলার ইতিহাস, বাঙ্গালীর ইতিহাস অধ্যয়ন করলে যে সমস্ত নৃপতির নাম সর্বাগ্রে আসবে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন রায়শ্রেষ্ঠ মহারাজা প্রতাপাদিত্য। সারা ভারতবর্ষে মোগল সাম্রাজ্যের সময়ে বাংলার বুকে মোগল পাঠান দমন করে তিনি এক হিন্দু সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন যা ইতিহাসে বিরল।

তৎকালীন সময়ে উড়িষ্যা ইশা খান লোহানীর শাসন ছিল। অত্যাচারী ইশা খাঁকে এক ভয়ানক নৌযুদ্ধে পরাজিত করেন মহারাজা প্রতাপাদিত্য। জগন্নাথ মন্দিরে নিত্য পূজা আবার শুরু হয়। উড়িষ্যা জয়ের স্মারক হিসেবে পিতৃব্য বসন্তনারায়ণ রায়ের অনুরোধে প্রতাপাদিত্যে পুরী থেকে উৎকলেশ্বর শিবলিঙ্গ ও গোবিন্দদেব বিগ্রহ আনয়ন করেন । যশোরের গোপালপুরে গোবিন্দবের মূর্তি প্রতিষ্ঠা হয় ও বসন্ত রায়ের উদ্যোগে বেদকাশীতে মন্দির নির্মাণ করে উৎকলেশ্বর মূর্তি স্থাপিত হয় । বেদকাশীস্থিত উৎকলেশ্বর শিবমন্দিরের শিলালিপিতে উল্লিখিত রয়েছে

“নিৰ্ম্মমে বিশ্বকর্ম্মা যৎ পদ্মযোনিপ্রতিষ্ঠিতম্।
উৎকলেশ্বরসংজ্ঞঞ্চ শিবলিঙ্গমনুত্তমম্ ॥ প্রতাপাদিত্যভূপেনানীতমুৎ কলদেশতঃ ।
ততো বসন্তরায়েন স্থাপিতং সেবিতঞ্চ তৎ ॥”

উপরোক্ত রাজন্যবর্গ ছাড়াও বহু বাঙ্গালী রাজারা মহাদেব এর উদ্দেশ্য বহু মন্দির নির্মাণ করেছেন, কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক নাম দেওয়া সম্ভব নয়, তাই প্রধান এবং প্রখ্যাত কিছু নাম সম্বন্ধে আলোচনা করা হলো।

 বাংলার লৌকিক শিব:-

মহাদেব এর ব্যাপ্তি সর্বত্র। দক্ষিণাচার এর সদাশিব মহেশ্বর থেকে তন্ত্রের মহাকালভৈরব হয়ে শাবর এর আদিনাথ আবার লৌকিক ক্ষেত্র সর্বত্র তিনি পূজিত হন ভক্তি ভরে। বাংলায় মহাদেবের বহু লৌকিক রূপ পূজিত হয়, তাদের বিষয়ে নীচে আলোচিত হলো।

 শিবের গাজন ও চড়ক:-

আমরা দুটি ভাই শিবের গাজন গাই
ঠাকুমা গেছেন গয়াকাশী ডুগডুগি বাজাই।

গাজন বাঙালির এক অতি প্রখ্যাত লৌকিক উৎসব। সন্ন্যাসীদের গর্জন থেকে গাজন শব্দের উৎপত্তি। গাজন সন্ন্যাসীরা জোরে জোরে গর্জন করেন। ‘দেবাদিদেব মহাদেবের জয়’, ‘জয় বাবা বুড়ো শিবের জয়’, ‘ভাল বাবা শিবের চরণের সেবা লাগে’ ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে। শিব ঠাকুরের জয়ধ্বনিতে মুখর হয় গ্রামের আকাশ বাতাস। আবার অনেকর মতে গাঁ জন অর্থাৎ গ্রামের মানুষ থেকেই গাজন শব্দ টি এসেছে।

চৈত্র মাসের শেষ পাঁচদিন ধরে গাজন উৎসব এবং পরে চড়ক হয় এবং বছর শেষ হয়। গাজন উৎসবে শৈব সন্ন্যাসীরা যোগ দেন এবং এই উৎসব অনেক জায়গায় একমাস ধরেও চলে। প্রথম দিন নদীর জলে স্নান করে সন্ন্যাসীরা মহাদেবের পূজা করেন। এরপর চলে আগুন ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ, বঁটি ঝাঁপ, বাণ ফোঁড়া এর মতো কর্মকাণ্ড। নীল ব্রতর দিন মূল সন্ন্যাসীর নেতৃত্বে একটি শোভাযাত্রা বের হয়। এলাকার সমস্ত শিবমন্দিরে পূজা দেওয়া হয় এবং অন্যান্য সন্ন্যাসী এবং কিছু সাধারণ মানুষ শিব কালী নন্দী ভৃঙ্গি ইত্যাদি সেজে নাচ করেন ও ঘুরে বেড়ান। এর সাথে সন্ন্যাসীরা হাতে অস্ত্র নিয়েও উল্লাস করেন।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন চড়ক উৎসব হয়। চড়ক পূজার আগের দিন চড়ক গাছকে ভাল করে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। তারপর জলভরা একটি পাত্রে শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা ‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত। পুজোয় শিব পাঁচালী পড়ার রীতি। পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা মহাদেবের নামে ধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নানের পর মাটির কলসিতে করে জল ভরে আনেন তাঁরা। এর পরে চড়ক গাছের গোড়ায় সমবেত হন সন্ন্যাসীরা। শিব পাঁচালী পাঠ চলতে থাকে। ভক্ত ও সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রণাম করে অন্য জায়গায় চলে যান। সেখানেই তাঁদের বাণবিদ্ধ করা হয়।পিঠে বাণ ফুড়িয়ে চড়ক গাছের সঙ্গে বাশঁ দিয়ে তৈরি করা বিশেষ এক ধরনের চড়কায় ঝুলন্ত দড়ির সঙ্গে পিঠের বড়শি বেঁধে দেওয়া হয়, সন্ন্যাসীকে লোহার হুড়কা দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদ ও করেন। এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছেটান এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা। এই ঘটনাকে অনেকে অনার্য বৌদ্ধ সংস্কৃতি বলেন, কিন্তু আসলে তা নয়… শিবভক্ত বাণরাজা বা বানাসুর যুদ্ধের সময় আহত রক্তাক্ত হয়ে মহাদেবের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন, সেই থেকে এই পদ্ধতি এসেছে বলা হয়। সন্ন্যাসীরা কৃচ্ছ্রসাধনের মাধ্যমে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।

[ গাজন চড়ক ]

 বাবা ধর্ম রাজ:

বাবা ধর্ম রাজ বা ধর্ম ঠাকুর বাংলার সবচেয়ে বিখ্যাত লৌকিক দেবতা। লৌকিক মতানুসারে ইনি দেবতাদের প্রধান, মহাদেবের সাথে তুল্য। ধর্মঠাকুরের পূজা পদ্ধতি ও বর্ণনা দেখলে তাঁকে মহাদেব এবং সূর্যদেবের সংমিশ্রণ বলা চলে। শিবের গাজন এর মতো ধর্মরাজের ও গাজন হয় বৈশাখ মাসে। অনুরূপ পদ্ধতিতেই ভক্তরা ধর্মরাজের নামে জয়ধ্বনি দিতে দিতে নাচতে নাচতে যান এবং পূজা দেন। ধর্মমঙ্গল কাব্যে আমরা রঞ্জাবতী কে ধর্মঠাকুরের উদ্দেশ্যে গাজন করেছিলেন বলা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ধর্মরাজের মূর্তি কে মহাদেব এর ন্যায় বৃষবাহন রূপেও দেখা যায়, তবে সমগ্র রাঢ় জুড়ে মূলত ঘোড়া মূর্তি রূপেই ধর্মঠাকুরের থানে তিনি পূজিত হন।

[ ধর্মঠাকুর ]

 পঞ্চানন ঠাকুর :-

রাঢ়ের অতি বিখ্যাত লৌকিক দেবতা পঞ্চানন বা পাঁচু ঠাকুর। লোকবিশ্বাসে ইনি মহাদেব শিবের এক অর্বাচীন রূপ; অন্যমতে, ইনি শিবের পুত্র। মূলত গ্রামরক্ষক, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন পূজিত হন; তবে সন্তানদাতা, শস্যদেবতা হিসাবেও বাঙ্গালী হিন্দু সমাজে তাঁর পূজার প্রচলন আছে। বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ আছে।

পঞ্চাননঠাকুরের গঠন মহাদেবের ভৈরব রূপের ন্যায়। গাত্রবর্ণ লাল এবং চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী; বেশ বড় গোলাকার ও রক্তাভ তিনটি চোখ। দাড়ি নেই, গোঁফ কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং কানে ধুতুরা ফুল। উর্ধাঙ্গ অনাবৃত; নিম্নাঙ্গ বাঘছাল পরিহিত। তবে গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু; পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে। এঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামক দুজন অপদেবতা।

বর্ণনা দেখে সহজেই বলা যায় পঞ্চানন আদতে ভৈরব। ভৈরব যেমন তন্ত্রের রক্ষক তেমনই শিশু রক্ষক গ্রাম রক্ষক রূপে ইনি পূজিত হন।

[ পঞ্চানন ঠাকুর ]

 ক্ষেত্রপাল:-

উত্তর রাঢ়ের এক অনন্য সাধারণ রক্ষক দেবতা হলেন ক্ষেত্রপাল ঠাকুর। পানাগড় মিলিটারি ক্যাম্পে ভগবান ক্ষেত্রপালের একটি বিখ্যাত মন্দির আছে, সেখানে তিনি রক্ষক দেবতা রূপে আছেন।

ক্ষেতরক্ষক, যিনি ক্ষেত রাখেন তিনিই ক্ষেত্রপাল৷ ক্ষেত্রপাল মূলত ভূমিরক্ষক এবং কৃষির লৌকিক দেবতা হিসেবে পূজিত হন, অনেকেই লৌকিক শিবের একটি রুদ্র রূপ হিসেবে কল্পনা করেন৷ ক্ষেত্রপালের একটি ধ্যানমন্ত্রও রয়েছে । বিবরণ অনুধাবন করলে ক্ষেত্রপালকে শিবের রূপান্তর বলে ধারণা হওয়া স্বাভাবিক৷ ক্ষেত্রপাল জটামণ্ডিত , ত্রিনয়ন , দিগম্বর৷ প্রথম বিবরণে বামহস্তে কপাল ও দ্বিতীয় হস্তে শক্তি , দ্বিতীয় বিবরণে তাঁর এক হাতে গদা ও অপর হাতে কপাল৷

বিশ্বকোষে আমরা মোট ৪৯ রকমের ক্ষেত্রপালের নাম পাই। ‘সদূক্তিকর্ণামৃত’ নামক সংস্কৃত কোষগ্রন্থে এবং কোনও কোনও মঙ্গলকাব্যে ক্ষেত্রপালের উল্লেখ পাওয়া যায়৷ কোনও কোনও স্থানে ধর্মরাজের পুজোয় চতুর্দিকের অধিপতি হিসেবে ক্ষেত্রপালের বন্দনা করা হয়। মঙ্গলকাব্যগুলিতে শিব স্বয়ং কৃষিকার্যে নিযুক্ত হয়েছিলেন৷ যজুর্বেদের শতরুদ্রীয় স্তোত্রে রুদ্রকে ক্ষেত্রপতি বলা হয়েছে৷ তন্ত্রশাস্ত্রে শিবের একটি নাম ক্ষেত্রপাল, ভৈরব রূপে তিনি তন্ত্রক্ষেত্র রক্ষা করেন। সুতরাং ক্ষেত্রপাল যে শিবেরই রূপান্তর, তাতে সংশয় নেই৷

[ পানাগড় ক্ষেত্রপাল মন্দির ]

 দক্ষিণ রায়:-

।।চন্দ্রবদন চন্দ্রকায়
ব্যাঘ্র বাহন দক্ষিণ রায়।
ঢাল তরোয়াল টাঙ্গি হস্তে
দক্ষিণ রায় নমোঽস্তুতে।।

বাদাবনের রাজা আঠারো ভাটির অধিপতি রাজা দক্ষিণ রায়। সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চল জুড়ে তিনি পূজিত হন বাঘের দেবতা হিসেবে। অবশ্য দক্ষিণ রায় কেবলমাত্র একজন লৌকিক দেবতা নন, এক ঐতিহাসিক চরিত্র। দক্ষিণবঙ্গে যবন আক্রমণ প্রতিরোধ করে তিনি বড় খান গাজীকে পরাজিত করে নিজভূমি রক্ষা করেন।

রায়মঙ্গল কাব্যে দক্ষিণ রায়কে সদাশিবের অবতার বলা হয়েছে। তিনি নৃপতি প্রভাকর রায়ের পুত্র। তাঁর স্ত্রী নারায়ণী দেবীর সাথে শিব আরাধনা করে দক্ষিণ রায়কে পুত্র হিসেবে পান।

” মুনিমুখে শুনিয়া নৃপতি প্রভাকর
সদাশিব সেবিয়া পাইল পুত্রবর
আপুনি হইনু গিয়া তাহার নন্দন
বসাইল নবরাজ্য কাটিয়া কানন।। “

দক্ষিণ রায় বাদাবন আঠারো ভাটি অঞ্চলে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন, মহাদেবের বরপুত্র হিসেবে স্থানীয় বর্গ ক্ষত্রিয়দের মধ্যে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন তিনি। যবন আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি এক কিংবদন্তিতে পরিণত হন। আজও সুন্দরবনে সাধারণ মানুষের ত্রাতা রূপে তাঁর পূজা হয়।

[ দক্ষিণ রায় ]

 অন্যান্য লৌকিক দেবতা:-

বাংলার অন্যান্য লৌকিক দেবতার মধ্যে উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের মাসান ঠাকুর এবং মালদার সোনারায় বা উত্তর রায়ের সাথেওশিবের সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

একবার দেবী কালী নাচ করতে করতে ঘেমে গিয়েছিলেন। এইসময় ঘামের একেকটি ফোঁটা থেকে জন্ম নেন একেকজন মাসান ঠাকুর। অর্থাৎ, একটা বিষয় স্পষ্ট। মাসান ঠাকুরের মা হলেন দেবী কালী। যদিও মাসানকে দেখলে আবার কালীর স্বামী শিবের কথাই মনে হয়। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন রূপে পূজিত হন মাসান ঠাকুর। তবে প্রায় সর্বত্রই তাঁর রূপ ভয়ঙ্কর। দেখেশুনে মনে হয় যেন তিনি ভোলা মহেশ্বরেরই একটি বিশেষ রূপ। কেবল শিবের সঙ্গে থাকে নন্দী অর্থাৎ ষাঁড়। আর মাসানের সঙ্গে থাকে শূকর। মাসান ঠাকুর ও ক্ষেত্রপাল বা পঞ্চানন ঠাকুরের ন্যায় ক্ষেত্র ও শিশু রক্ষক দেবতা।

উত্তরবঙ্গের ব্যাঘ্র বাহন দেবতা সোনারায় বা উত্তর রায়। এনাকে দক্ষিণ রায়ের বৈমাত্রেয় ভাই বলা হয় অনেক জায়গায়। তাঁকে এবং তাঁর পোষা বাঘ কে ” ভোলানাথ এর সম্পত্তি ” বলে সম্মান করা হয়।

উপরোক্ত পৌরাণিক বিশ্লেষণ, সাধক ও রাজন্যবর্গ এবং মহাদেবের লৌকিক রূপ সমূহের আলোচনা প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি শিব ঠাকুর বাঙ্গালীদের অত্যন্ত আপন, অত্যন্ত প্রিয় এবং শ্রদ্ধার। বাঙ্গালী জাতি ও বাংলার উপর প্রভু মহেশ্বর এর কৃপা দৃষ্টি সর্বদা বহাল থাকুক

।।জটাটবীগলজ্জলপ্রবাহপাবিতস্থলে
গলেবলংব্য লংবিতাং ভুজংগতুংগমালিকাম্ ।
ডমড্ডমড্ডমড্ডমন্নিনাদবড্ডমর্বযং
চকার চংডতাংডবং তনোতু নঃ শিবঃ শিবম্ ।।
।। সদাশিবম ভজাম্যহম।।
।। হর হর মহেশ্বর।।

চিত্র ঋণ:- অর্ঘ্যদীপ সরকার, গণ্ডবেরুণ্ড অ্যানিমেশন, ইন্টারনেট

বিশেষ ধন্যবাদ:- অতনু দাস ( Temples with Atanu), রাজর্ষি নন্দী

তথ্যসূত্র:-

° Asiatic Society Journal XXVI

° The Yoga Tradition: Its History, Literature, Philosophy and Practice

° চৌরঙ্গীনাথ Bartaman Patrika

° Yogis of India: Timeless Stories of Their Lives and Wisdom by Sanjeev Shukla

° The incredible life of Loknath Brahmachari by Suddhananda Maharaj

° মহাপীঠ তারাপীঠ

° 1996 Construction and Reconstruction of Sacred Space in Vārāṇasī.
Hans T Bakker

° মহারাণী ভবশঙ্করী ও ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজকাহিনী, বিধুভূষণ ভট্টাচার্য

° রায়মঙ্গল কাব্য

° ধর্মমঙ্গল কাব্য

° রাঢ়ের সংস্কৃতি ও ধর্মঠাকুর, ডাঃ অমলেন্দু মিত্র

° পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ

° Birbhum District Gazetteers, O Malley

° বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী

° দক্ষিণ রায়, দেবীশঙ্কর মিদ্যা

(লেখক পরিচিতি: পদার্থবিদ্যা স্নাতক, সঠিক ইতিহাস সন্ধানী ও প্রচারক, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী, শক্তিচর্চায় নিবেদিত এক বাঙ্গালী যুবক)

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : কাঞ্জিক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.