রানী কর্ণাবতী: মহারাজা প্রতাপ সিংহের পিতামহী এবং একজন বীরাঙ্গনা​, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন মাতৃভূমি মেবারের সুরক্ষা এবং নিজের সম্ভ্রম রক্ষার​ জন্য

ভারতীয় নারীদের কি পাশ্চাত্যের অনুপ্রেরণা কোনো প্রয়োজন আছে, যখন তাদের নিজস্ব ইতিহাস মহিলা যোদ্ধাদের শৌর্যে, বীরত্বে, গরীমায় পরিপূর্ণ? যাঁরা নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করেছিলেন, এই অসীম সাহসী বীরাঙ্গনারা ভবিষ্যতের কথা না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশরক্ষায়, লড়াই করেছে প্রতিকূলতা আর শত্রুদের​ বিরুদ্ধে।

এরকমই এক অনন্য অনুপ্রেরণা হলেন মেবারের রানা সঙ্গের স্ত্রী রানী কর্ণাবতী। রানা সঙ্গ ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর শক্তিশালী রাজা তথা এক বীর যোদ্ধা যিনি একটি হাত, একটি চোখ হারিয়ে এবং শরীরে প্রায় ৮০ টির মতো ক্ষত নিয়েও মুসলিম আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে বহু যুদ্ধ করেছিলেন। সাহস ও বীরত্ব ছিল পরিবারের রক্তের মধ্যে। রানা সঙ্গ এবং কর্ণাবতী ছিলেন কিংবদন্তি যোদ্ধা মহারাণা প্রতাপের পিতামহ-পিতামহী।

বুন্দির হদ রাজপুত বংশের, রাজা রাও নির্বুদ্ধের কন‍্যা ছিলেন রানী কর্নাবতী। রানা সংগ্ৰাম সিং সিসোদিয়া, যিনি যুবক অবস্থায় রানা সঙ্গ নামেই বেশী পরিচিত ছিলেন, তাঁর সাথে কর্ণাবতী বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। রানী কর্ণাবতী ছাড়াও রানা সঙ্গের অপর দুই রানী হলেন যথাক্রমে— রানী কানওয়ার বাই সোলাঙ্কি এবং রানী ধন কানওয়ার। তবে সামরিক এবং প্রসাশনিক ক্ষেত্রে রানী কর্ণাবতীর জ্ঞান ছিল অপরিসীম, যা তাঁকে অন্যান্য রানীদের থেকে আলাদা করে তুলেছিল। কর্ণাবতী ছিলেন বিক্রমাদিত্য এবং দ্বিতীয় উদয় সিংহের মা।

পৃথ্বীরাজ চৌহানের মৃত্যুর ৩০০বছর পর,
চিতোরগড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন​ কর্ণাবতীর স্বামী রানা সঙ্গ। অভিষিক্ত হওয়ার পর তিনি রাজপুত রাজ্যের সমস্ত যুদ্ধরত রাজাদের মধ্যে বিবাদ থামিয়ে তাদের একত্রিত করেন। তিনি, ১৫১৮ খ্রীষ্টাব্দে “খাতোলির যুদ্ধে​” এবং ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দে “ধোলপুরের যুদ্ধে​” দিল্লির সুলতান, ইব্রাহিম লোদিকে পর পর দুবার পরাজিত করেছিলেন। একই বছর অর্থাৎ ১৫১৯ খ্রীষ্টাব্দে, রানা সঙ্গ “গাগ্রনের যুদ্ধে মালওয়া সুলতান, মাহমুদ খলজি”-কে পরাজিত করেছিলেন। ১৫২০ সালে রানা সঙ্গ গুজরাট এবং মালওয়ার​ সুলতানি সাম্রাজ্যের যৌথ বাহিনীকে “মান্দাসোরের যুদ্ধে​ পরাজিত করেছিলেন​। তিনি শিবাজীর হিন্দু সম্রাজ্যে গঠনের অনেক আগেই, ইসলামী যুগে, একটি “হিন্দু জাতিগোষ্ঠী” তৈরি করেছিলেন। কিন্তু, রানা সঙ্গ’র গৌরবময় কাহিনী শেষ হয়েছিল, ১৫২৭ সালের মার্চ মাসে “খানুয়ার যুদ্ধে”। এই যুদ্ধে তিনি বাবরের কাছে পরাজিত হন। রানা সঙ্গ চিতোরে পালাতে সক্ষম হলেও ১৫২৮ খ্রীষ্টাব্দের ৩০ শে জানুয়ারি, তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছিল।

কর্ণাবতী স্বামীর মৃত্যুর পর তাঁর সাম্রাজ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। রানী ধন কানুয়ারের পুত্র মহারানা দ্বিতীয় রতন সিংহকে তিনি নিজে পরিচালনা করেছিলেন। যদিও, ১৫৩১ সালে একটি যুদ্ধে রতন সিংহ নিহত হন। কর্ণাবতীর পুত্র, বিক্রমাদিত্যকে তার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের মৃত্যুর পর, মাত্র ১৪বছর বয়সে মেবারের রাজা হিসাবে অভিষিক্ত করা হয়েছিল। রানী তাঁর নাবালক পুত্রের হয়ে পুরো মেবারকে রক্ষা করার দায়িত্ব নিজে গ্ৰহন করেছিলেন। তবে, অপরিণত ও অহঙ্কারী আচরণের জন্য বিক্রমাদিত্য তাঁর পিতার​ প্রতিষ্ঠিত রাজপুত সাম্রাজ্যের মধ্যে ধীরে ধীরে অপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকেন।

মেবারের এইরকম দুর্বল অবস্থার সুযোগ নিয়ে, ১৫৩৪-১৫৩৫ খ্রীষ্টাব্দে গুজরাটের বাহাদুর শাহ মেবার আক্রমণ করে রাজধানী পর্যন্ত পৌঁছে যান। কিন্তু হতাশাগ্রস্থ রাজপুতরা অযোগ্য বিক্রমাদিত্যের পরিচালনায় যুদ্ধ করতে অস্বীকার করলে, রানী কর্ণাবতী রাজপুতদের সিসোদিয়ার সম্মানের জন্য লড়াই করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন এবং তাঁদের এই শর্তে রাজী করিয়েছিলেন যে বিক্রমাদিত্যকে তিনি যুদ্ধ থেকে বহিষ্কার করে তার পিত্রালয় বুন্দিতে পাঠিয়ে দেবেন। রানী কর্ণবতী তাঁর ছোটছেলে উদয় সিংহের সুরক্ষার জন্য নিজের অত‍্যন্ত বিশ্বস্ত দাসী পান্না দাইয়ের সাথে বুন্দিতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

বাহাদুর শাহের বাহিনীতে পরিবেষ্টিত হয়ে, রানী কর্ণবতী তার কূটনীতিক পারিষদের মাধ্যমে হুমায়ূনের​ কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন। তবে, একটি জনপ্রিয় গল্পে বলা হয় যে, রানী হুমায়ূনকে ভাই হিসাবে সম্বোধন করে তাঁর জন্য একটি রাখি পাঠান, আর এইভাবেই​ রানি কর্নাবতীর নাম রাখীবন্ধন উৎসবের সাথে জড়িয়ে গেছে। তবে এই গল্পকে সমসাময়িক কোনো লেখক বা ঐতিহাসিকরা অনুমোদন করেননি, বরং তারা এটিকে কল্পিত কাহিনী বলে আখ্যায়িত করেছে। রানী কর্ণবতী চিতোরগড় দুর্গ থেকেই​ কার্যত মেবারের সেনাবাহিনীকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সিসোদিয়ার অগণিত যোদ্ধারা বীরত্বের সাথে লড়াই করলেও এই যুদ্ধে তারা পরাজিত হয়। রানী কর্ণবতীও জানতেন যে তাদের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী।

১৫৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই মার্চ রানী কর্ণবতী শিশু, বাচ্চা, বালিকা, বৃদ্ধাসহ সমস্ত রাজপুত মহিলাদের “চিতোরগড় দুর্গে” একত্রিত করেছিলেন জহর ব্রত পালনের​ জন্য। পুরুষেরা তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল গেরুয়া পোশাক এবং নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়েও এই বীর যোদ্ধারা​ যুদ্ধ চালিয়ে গিয়েছিলেন। যদিও গুজরাট সুলতানের বিশাল সেনাবাহিনীর​ কাছে তাঁরা শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারেননি, তাদের পরাজয় ঘটেছিল।

বাহাদুর শাহ মেবারে অত‍্যাচার এবং লুটতরাজ করে পালিয়ে যাওয়ার পরে হুমায়ুন সেখানে পৌঁছেছিলেন এবং তিনিও চিতোরকে লুট করে ফিরে আসেন। তবে চিতোরের যে সর্বকালের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হয়েছিল তা বাহাদুর শাহ বা আলাউদ্দিন খিলজির হাতে হয়নি, হয়েছিল হুমায়ুনের পুত্র আকবরের​ হাতে। আকবরই চিতোরের সবচেয়ে বেশী ক্ষতি করেছিলেন। আকবরের চিতোরগড় অবরোধের ফল এতটাই বিধ্বংসী ছিল যে তা এই দুর্গের ইতিহাসে একটা স্থায়ী ক্ষতর সৃষ্টি করেছিল। যারফলে চিতোরগড় আর কখনও মেবারের রাজধানী হয়ে ওঠতে পারেনি।

যখন দেশের সুরক্ষার প্রশ্ন ওঠে ছিল, তখন এই​ বীর নারীদের এবং স্বদেশের মাঝে আর কোনো কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। সেনা প্রধানদের হাতে দুর্গ ছেড়ে রানী কর্ণাবতী চাইলেই তাঁর পুত্রদের সাথে বুন্দিতে পালাতে পারতেন। কিন্তু, তিনি মেবারকে বাঁচাতে, নিজের দুর্গ রক্ষার জন্য মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতেও পিছপা হননি।

যখন নিজের সম্ভ্রম রক্ষার বিষয়টি এসেছিল, তখন তিনি আগুনে নিজেকে উৎসর্গ করতেও দু’বার ভাবেননি, কারণ এই পৈশাচিক মানসিকতার মুসলিম আক্রমনকারীদের হাত থেকে মৃতদেহগুলিও রেহাই পায়নি। চিতোরের ইতিহাসে এটা ছিল সবচেয়ে বড় জহরব্রত। সেদিন ২০,০০০ জন রাজপুত রমনী এই ব্রত পালন করেছিলেন।

এরপর ভনভীর সিং(যাঁকে পৃথ্বীরাজের পুত্র বলা হয়) এবং রানা সঙ্গের বড় ভাই ও এক দাসী মিলে বিক্রমাদিত্যকে হত্যা করেন এবং তারপর ১৫৩৬ সালে মেবারের সিংহাসন দখল করেছিলেন। তিনি উদয় সিংহকেও হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কর্ণাবতীর বিশ্বস্ত দাসী পান্না দাই উদয় সিংহকে বাঁচানোর জন্য নিজের ছেলে চন্দনকে বলি দিয়েছিলেন এবং এই উদয় সিংহই ছিলেন অসীম সাহসী মহারানা প্রতাপের বাবা। এই পান্না দাই ছিলেন আরেক বীরাঙ্গনা।

ভারতের ইতিহাসে যখন রানী কর্ণাবতী এবং পান্না দাইয়ের মতো বীর নারী তথা যোদ্ধারা রয়েছেন, তখন ভারতের মহিলাদের কি অন্য কোথা থেকেও​ অনুপ্রেরণা নেওয়া দরকার রয়েছে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.