যে কারণে ৭০ লক্ষ কোরিয়ান ভগবান রামের অযোধ্যাকে তাদের “মাতৃগৃহ” হিসাবে বিবেচনা করেন

অযোধ্যা হিন্দুদের তীর্থস্থান হলেও  ভারতে অযোধ্যা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই।  অযোধ্যায় জন্ম নেয়া ভগবান রাম হিন্দুদের পবিত্র হলেও এই ভারতের বুকে প্রকাশ্যে মিছিল করে রামের ছবিতে জুতাপেটা করা হয় যা অত্যন্ত দুঃখজনক। কিন্তু আপনি  জেনে অবাক হবেন যে কোরিয়া এবং ভারতের অযোধ্যার মধ্যে  একটি ঘনিষ্ট ইতিহাস  আছে।  হ্যাঁ, এটি ধ্রুব  তারার মতো  সত্য। সবচেয়ে অবাক করার বিষয় হ’ল এই সম্পর্ক  দুই সহস্রাব্দ বছর আগের  যা কেবল গত দশকে আবিষ্কার হয়েছে । ভাবছেন সম্পর্ক কী? আমরা সকলেই জানি যে অযোধ্যা নগর যেখানে ভগবান রামের জন্ম হয়েছিল এবং এটি ভারতের অন্যতম পবিত্র শহর হিসাবে বিবেচিত ।

প্রতিবছর শত শত দক্ষিণ কোরিয়ান  পবিত্র অযোধ্যা ভ্রমণে আসেন। তাহলে কি জন্য তারা  ভারতে আসেন ? তারা মূলত আসেন  তাদের কিংবদন্তী   রানী হিও ওয়াং-ওকে (Heo Hwang-ok) কে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। অযোধ্যায় তাদের রানী কী করছিলেন? এটি সমস্ত খুব রহস্যজনক শোনাচ্ছে। তবে এই বাস্তব গল্পটি আপনাকে অবশ্যই চমকে দেবে।

অযোধ্যা শহরকে প্রায়ই পৃথিবীর স্বর্গ বলা হয়ে থাকে। আসলে হাজার হাজার বছর থেকে মানুষ এটি বিশ্বাস করছে। এই স্থানটির কোরিয়ান লিঙ্কটি জানতে হলে হাজার হাজার বছর পিছনে ফিরে যেতে হবে। ধারণা করা হয় যে ৪৮ খ্রিস্টাব্দে ( ১৯৪৮ বা ১৮৪৮ নয় ) রানী সুরো (Suro বা Suriratna, ভারতে তাকে সুরিরত্না হিসেবে জানা যায়। তিনি কোরিয়ায় Heo Hwang-ok   বা  রাজকন্যা হিও ওয়াং-ওকে  (Heo Hwang-ok) নামেও পরিচিত। তিনি অযোধ্যা শহর থেকে কোরিয়া যাত্রা করেছিলেন। ঐতিহাসিকবিদরা বিশ্বাস করেন সুরো একটি পাথর বহন করছিলেন  যা তাদের  ভ্রমণের সময় অশান্ত সমুদ্রকে শান্ত করেছিল।কিংবদন্তিরা আরও বলেছে যে পাথরের কারণে তিনি একটি ছোট্ট নৌকায় নিরাপদে কোরিয়া পৌঁছেছিলেন। তিনি জেমগওয়ান গায়ার (Geumgwan Gaya) রাজার প্রথম রানী হয়েছিলেন।

বাস্তবে সুরো ( সুরিরত্না) যখন বিয়ে করেছিলেন তখন তাঁর বয়স মাত্র ১৬ বছর ছিল। এবং এই সংযোগের কারণে  কোরিয়ার ৭০ লক্ষেরও বেশি লোক পবিত্র অযোধ্যা শহরকে তাদের  “মাতৃগৃহ” হিসাবে বিবেচনা করে।
কোরিয়ানরা বিশ্বাস করে যে রাজকন্যা ৭তম শতাব্দীতে বিভিন্ন কোরিয়ান রাজ্যকে একত্রিত করতে সহায়তা করেছিলেন  এমন বংশধরদের মা ছিলেন সুরো । এবং যখন থেকে এটি ঘটেছে, কারাক (Karak) বংশ কোরিয়ার বৃহত্তম বংশে পরিণত হয়েছে।হানিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের  ইমেরিটাস প্রফেসর বায়ুং মো কিম (Prof Byung Mo Kim) বলেন, “কোরিয়ার সবচেয়ে বড় রাজবংশের রানী হহ (Hoh) ছিলেন অযোধ্যার  কন্যা এবং সেই জন্যই  অযোধ্যা আমাদের মাতৃ নগরের মতো। রাজকন্যা সুরিরত্না সমুদ্রপথে ভ্রমণ করেছিলেন এবং কারা বংশের রাজা  রাজা কিম সুর (Kim Suro ) কে বিয়ে করেছিলেন। কারা  (Kara) রাজবংশের  তিনিই প্রথম রাজা এবং সমগ্র কারা বংশ ছিল  কোরিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ।”
ঐতিহাসিক প্রমাণ অনুসারে, অযোধ্যা থেকে রাজকন্যা সুরিরত্না  কোরিয়া ভ্রমণ করেছিলেন এবং ৪৮ খ্রিস্টাব্দে কারাক বংশের রাজা কিম সুরকে বিয়ে করেছিলেন।

Queen-Heo-2019-stamp-of-India

তারা যে যমজ  মৎসাকৃতির  পাথর বহন করে ছিলেন  মনে করা হয়  তা হ’ল অযোধ্যা রাজ্যের প্রতীক। প্রফেসর বলেছিলেন, “আমার কাছে ছবিযুক্ত  প্রমাণ রয়েছে। যমজ মাছের প্রতীকটি মূলত মেডিটারেনিয়ান রাজ্যের  এবং এটি পৃথিবীর এই অংশে ভ্রমণ করেছিল এবং লখনউয়ের আশেপাশে স্থায়ী হয়েছিল। তবে একই যমজ প্রতীক নেপাল, পাকিস্তান, চীন, জাপান এবং কোরিয়ার কিমহে শহরের রাজা  সুরোর রাজ সমাধির গেটে (gate of royal tomb of King Suro in Kimhae city in Korea) এবং  প্রাচীন ভবনেও দেখা যায় । ““আমি আমার জিন অযোধ্যা রাজ পরিবারের সাথে অঙ্গাঅঙ্গী ভাবে জড়িত। এই উভয় দেশের ভ্রমণকারীরা কেবল পণ্য নয় আদান প্রদান নয়, জিনের সংমিশ্রণও ঘটিয়েছে । এবং আমি কারা রাজবংশের লোক যার প্রথম মহিলা ছিলেন অযোধ্যা রাজকন্যা।  তিনি  প্রথম কারা রাজাকে বিবাহ করেছিলেন। তার ভাইয়েরা অযোধ্যার রাজা  হতে পেরেছিলেন এবং এইভাবেই আমি পবিত্র শহরটির সাথে জেনেটিকভাবে সংযুক্ত আছি, ” প্রফেসর কিম বলছিলেন । জনশ্রুতিতে বলা হয় যে রানী ১৫৭ বছর বয়সে মারা যান।যদিও অনেক প্রাচীন কোরিয়ান রানী রয়েছে যারা স্থানীয়দের দ্বারা শ্রদ্ধেয়, তাদের মধ্যে রানী হুহ (হিও/ Hu Hwang-ok) তার জ্ঞান এবং বুদ্ধিমত্তার  জন্য সর্বাধিক সম্মানিত।
কোরিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি কিম দায়ে-জং, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হিও জিয়ং ও কিম জং-পিলের মতো মানুষ কারা  বংশের লোক । সুরিরত্নার প্রতি তাদের শ্রদ্ধা এত গভীর যে  কোরিয়ান সরকার নৌকা ভারসাম্য বজায় রাখতে সুররিত্ন দ্বারা ব্যবহৃত বড় পাথর সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। রাজধানী শহরের কেন্দ্রীয় স্থানে কিমাহে সুরিরত্ন (কুইন হু) এর বিশাল মূর্তি রয়েছে। এই স্মৃতিসৌধটি কোরিয়ার ভবিষ্যত এবং এর সমৃদ্ধি গঠনের   জন্য রানী হুর প্রতিমায়  হিন্দু ধর্মের ধর্মনিষ্ঠা এবং  শিক্ষাগুলি সবাই শ্রদ্ধা করে।

200১ সালে  উত্তর কোরিয়ার একটি প্রতিনিধি দল (যার মধ্যে ভারতের উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত অন্তর্ভুক্ত ছিল) অযোধ্যায় তাকে উত্সর্গীকৃত একটি স্মৃতিসৌধের উদ্বোধন করেন। কোরিয়া থেকে আনা ৩ মিটার উঁচু এবং৭৫০০কেজি ওজোনের  পাথর ব্যবহার করে এই সৌধটি কোরিয়ান ঐতিহ্যে নির্মিত হয়েছিল।২০১৮ সালের  দীপাবলি উদযাপনের দিন  দক্ষিণ কোরিয়ার ফার্স্ট লেডী  কিম জং-সুক স্মৃতিসৌধের সম্প্রসারণ এবং সৌন্দর্যমণ্ডিতের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন।

sk1

২০১৫-১৬ সালে ভারত এবং দক্ষিণ কোরিয়া একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। ২০১৬ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার একটি প্রতিনিধি দল ইউপি সরকারকে স্মৃতিসৌধ  সুন্দর করার জন্য একটি প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। যোগী আদিত্যনাথ সরকারও ঘোষণা করেছে যে তারা অযোধ্যাতে একটি থিম পার্ক তৈরি করবে।
দেখুন ভিডিওঃ


Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.