যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৫৫)-এর নাম হোক ঋষি অরবিন্দ বিশ্ববিদ্যালয়। এই টুকু পাঠ করার পর আমার বামপন্থী বন্ধুরা দাঁত কিড়মিড় করে আমার চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করবেন এবং আমাকে মূর্খ ‘চাড্ডি’ বলে দাগিয়ে দিয়ে আপন আপন আত্মশ্লাঘায় মলম লাগাবেন। আসলে যুক্তির অভাববোধ-ই মানসিক বিকারের জন্ম দেয়! সেই জন্য, কেন ঋষি অরবিন্দের নামে প্রতিষ্ঠানটির নামকরণ করা দরকার সেই যুক্তিনিষ্ঠ তথ্য পরিবেশনের দায় থেকেই এই দায়িত্ব পালনের প্রচেষ্টা।
ইতিহাস কি বলে?
প্রথমেই বামপন্থী ঐতিহাসিক সুমিত সরকারের একটি গ্রন্থ দিয়েই কিছু তথ্য তুলে ধরব। তিনি তাঁর ‘The Swadeshi Movement in Bengal’ , Permanent black, New Delhi, 2011, page no.40 গ্রন্থে লিখেছেন,”Instead of prayers and petitions, self-reliance and constructive work became the new slogans–starting swedeshi enterprises and stores, trying to organise education on autonomous and indigenous lines, emphasising the need for concrete work at the village level.” এই উদ্ধৃতির আগের বাক্যেই তিনি জাতীয় কংগ্রেসের ‘আবেদন-নিবেদন’-এর রাজনীতিকে ‘ভিক্ষাবৃত্তি'(mendicancy)-র রাজনীতি বলে কটাক্ষ-ও করেন। ভারতবর্ষের মতো বিশাল দেশে সংগ্রামের উপযুক্ত মানসিকতা ও প্রস্তুতি নেই অনুধাবন করেও কংগ্রেসের প্রথম যুগ(১৮৮৫-১৯০৫)-এর অনুসৃত পন্থাকে তিনি এভাবেই দেখেছিলেন। উল্লেখ্য, সেই সময় জাতীয় কংগ্রেসে, পরবর্তীকালের বামপন্থী, হিন্দু মহাসভা, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ, জনতা দল প্রভৃতির প্রবাদ প্রতীম নেতৃত্ব সংশ্লিষ্ট ছিলেন; পরে অনেকেই নীতিগত প্রশ্নে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসেন। ধীরে ধীরে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। ‘Dogma’-র প্রতি দায়বদ্ধতায় তন্নিষ্ঠ হলেও এই সুমিত সরকার-ই বিশ শতকের সূচনালগ্নে জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানগুলির উচ্চগ্রাম প্রশংসায় দ্বিধান্বিত ছিলেন না। বাঙ্গালী তথা ভারতীয়দের আত্মনির্ভরশীল হয়ে ওঠার বিবরণ উক্ত গ্রন্থে বিশদভাবে বর্ণনা করেছেন। সুমিত সরকার তাঁর ঐ গ্রন্থের ৩৯ পৃষ্ঠায় ‘The Gospel of Atmasakti– Constructive Swadeshi’ অনুচ্ছেদে ঋষি অরবিন্দের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন এবং সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের বিকাশে তাঁর অবদানের কথা বিশদে তুলে ধরেছেন।
ঋষি অরবিন্দ
সুমিত সরকার উক্ত গ্রন্থে অরবিন্দের এগারোটি প্রবন্ধের সমন্বয়ে যে ‘New Lamps for Old'(1893-’94) গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, তাকে ‘classical criticism of the Congress’ বলেও অভিমত প্রকাশ করেন। সবথেকে বড় কথা হোল, তিনি ঋষি অরবিন্দের গ্রন্থ সম্পর্কে বলেন,” ‘New Lamps for Old’ is predominantly secular in tone…” কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই বিষয়গুলিকে এড়িয়ে অরবিন্দ সম্পর্কে যে ধারণার নির্মিতি হয়েছে, তাতে ইতিহাসের মূল দাবিই উপেক্ষিত থেকে গেছে। বলা ভাল, গা জোয়ারি মনোভাব দেখানো হয়েছে। ভারতের সংগ্রামশীল জাতীয়তাবাদের সলতে-তে অরবিন্দই অগ্নি সঞ্চার করেন। আর তারই পরিণামে মহারাষ্ট্রে, পাঞ্জাবে এবং অপরাপর প্রদেশে সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল, যা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের রাতের সুখ- নিদ্রা হরণের পক্ষে যথেষ্ট ছিল।
জাতীয় শিক্ষা ও ঋষি অরবিন্দ
শিক্ষাব্যবস্থা, বিজ্ঞান চর্চা, কারিগরি কৌশল, যুগান্তকারী আবিষ্কার সমূহে বাঙ্গালী মেধা যে বৃটিশদের পাল্লা দিতে পারে, তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন হোল, বাংলার ‘National Council for Education in Bengal’। সাম্রাজ্যবাদী প্রশাসক লর্ড কার্জনের দ্বারা ‘Universities Act,1904’ পাশ হলে বাংলার ক্রমবর্ধমান জাতীয় আবেগে এক নতুন গতিধারার সঞ্চার হয়। ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে একেবারে পশ্চিমা ধাঁচে ফেলে শাসকের নির্লজ্জ ইচ্ছাকে চরিতার্থ করেছিলে লর্ড কার্জনের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আইন। এরই বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন ঋষি অরবিন্দ। সেই সময় তিনি যোগ্য সঙ্গত পেয়েছিলেন দক্ষিণ কোলকাতার ভবানীপুরের শিক্ষক সতীশ চন্দ্র মুখার্জীর, যিনি ১৮৯৫ সালেই ‘ভগবত চতুষ্পাটি’ খুলে ভারতীয় ছাত্রদের ভারতবর্ষের মাটির আঘ্রাণ দিতে অগ্রনী পথিকৃতের ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। প্রথমে Dawn Magazine(1897), পরে Dawn Society (1902)-র দ্বারা বৃটিশদের চাপিয়ে দেওয়া পাঠক্রমের বিরোধিতায় উচ্চকন্ঠ হন। এরপর তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক ভারতীয় মূল্যবোধভিত্তিক জাতীয় শিক্ষার পত্তনে এগিয়ে আসেন। এরই ফলশ্রুতিতে, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০-ই ডিসেম্বর Landholders Society-র উদ্যোগে কোলকাতার পার্ক স্ট্রিটে ১৫০০ প্রতিনিধির অংশগ্রহনে National Council of Education-এর পথ চলা শুরু হয়। জাতীয় কলেজের প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন ICS পরীক্ষায় পাস করা অরবিন্দ ঘোষ। এই পদে থাকাকালীন তিনি বিভিন্ন পত্রিকার প্রকাশ করেন, এগুলি হোল–যুগান্তর, কর্মযোগী, বন্দেমাতরম। বিপ্লবী অনুশীলন সমিতির প্রসার সাধনে নিজেকে তিনি সঁপে দিয়েছিলেন। দেশমাতৃকার এই সুসন্তানের প্রতি আজও সমান নেতিবাচক মনোভাব একটি বিশেষ পরিমার্গের স্কুল অনুসরণ করে চলেছে। যথাযথ মূল্যায়ণ ও উপযুক্ত সম্মান অরবিন্দের মতো মহামানবের প্রাপ্য।
আবেদন
এমন বিপ্লবী বীরের নামেই তো যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ হওয়া উচিৎ। আজকের যাদবপুর আত্মপ্রকাশ-ই করতো না, যদি ঋষি অরবিন্দের ওই জীবন পণ রেখে দেশীয় শিক্ষার উৎকর্ষ সাধনে আত্মবলিদানের ইতিহাস না থাকতো। যেহেতু হিন্দুত্বের উত্তরণ ও জাগরণে তিনি বঙ্কিমীয় পথের শরিক হয়েছিলেন; অন্য ধর্মকে আঘাত না দিয়েও, এক স্ব-নির্ভরশীল ভারত গঠনের চিন্তায় প্রাণপাত করেছিলেন, তাই পশ্চিমী চিন্তাবিদদের কাছে তিনি অবমূল্যায়ণের শিকার। ভারতীয় বামপন্থীরাও সেই গোলকধাঁধার আবর্তেই ঘূর্ণায়মান, তা সে যতই সুমিত সরকারের চোখে ‘SECULAR’ হন না কেন। তাই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় হোক জাতীয়তাবাদী রোমান্টিকতার দ্যোতক—ঋষি অরবিন্দ বিশ্ববিদ্যালয়। আপনারা কি বলেন?
গৌতম ভরদ্বাজ।