দিদি কাকে বোকা বানাচ্ছেন? নন্দীগ্রাম ক্ষুব্ধ, খুশি নন মুসলমানরাও

২০ শে জানুয়ারী ২০২১

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা নন্দীগ্রাম থেকে বাজিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গত ১৮ই জানুয়ারী। এই নির্বাচন তাঁর কাছে যুদ্ধ। তৃনমূল থেকে শুভেন্দু অধিকারীর বেরিয়ে যাওয়া যে তাঁকে ক্ষুব্ধ, হতাশ এবং উৎক্ষিপ্ত করেছে সে অনুভূতি গোপন করতে পারেন নি মমতা। শুভেন্দুর প্রভাব আছে গোটা দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে—শুধু মেদিনীপুর নয়, দক্ষিণ ২৪ পরগনাতেও তাঁর প্রভাব প্রবল এবং এই দক্ষিণবঙ্গই টিএমসির আদত ঘাঁটি। দক্ষিণবঙ্গের বহু আসন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, দক্ষিণবঙ্গ তৃণমূলের দুর্জয় গড় এবং দক্ষিণবঙ্গের ওপর শুভেন্দু অধিকারীর প্রভাবও রয়েছে পুরোমাত্রায়। দক্ষিণবঙ্গকে শুভেন্দু চেনেনও হাতের তালুর মত। সেই কারণেই কি শুভেন্দুর প্রস্থানে বিচলিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

নন্দীগ্রামে মমতা মানুষকে মনে করিয়ে দিয়েছেন কৃষকদের “জমি-রক্ষা-আন্দোলন”এ তাঁর লড়াইয়ের কথা। অনেকখানি যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের ঢঙে। তবে কি তিনি ভেবেছেন নন্দীগ্রামের লোক তাঁর নন্দীগ্রাম-আন্দোলনের অতীতকে ভুলে গিয়েছে? সেই কারণেই কি আবার সেসব মনে করিয়ে দিয়ে নতুনভাবে শুরু করতে চাইলেন? এবং করতে চাইলেন সেই নন্দীগ্রাম থেকেই যেখান থেকে এককালের অপ্রতিরোধ্য বামদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক উত্থান দুর্বার হয়েছিল তাঁর? জনসাধারণের সহানুভূতি আদায়ের জন্য নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কেন? কারণ সম্ভবতঃ এই যে নন্দীগ্রামও তাঁর ১০ বছরের স্বৈরাচারী শাসনে হতাশ ও ক্ষুব্ধ এবং মমতাও তা জানেন। কিন্তু কেন নন্দীগ্রাম ক্ষুব্ধ? সিপিএমের বিরুদ্ধে জয়ের পরেও ক্ষোভ কেন? কারণ হয়তো এই যে এই জয় নন্দীগ্রামকে দেয় নি তেমন কিছুই। মমতার নন্দীগ্রাম আন্দোলন কেমিক্যাল হাব তৈরির পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ভেস্তে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তারপর গত ১৩ বছরে জায়গাটি যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে গিয়েছে। নন্দীগ্রামে শিল্পায়নও হয়নি, বিকাশ হয় নি বিকল্প কোন পদ্ধতিতেও। নন্দীগ্রামের যুবকেরা লাভদায়ক কর্মসংস্থানের সুযোগ চেয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের খুচরো ভাতা-বিতরণের রাজনীতি তরুণদের সে চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। নন্দীগ্রাম যাওয়ার পথে “গো ব‍্যাক মমতা” পোস্টারগুলি তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভের সাক্ষ্য বহন করেছে।

দীঘা-তমলুক রেলপথ তৈরীর কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে দিলেন। কিন্তু এই কৃতিত্ব কি আদতেই তাঁর প্রাপ্য? মমতা প্রথমবারের জন্য রেলমন্ত্রী হন ১৯৯৯ সালে অটলবিহারী বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় এবং মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করেন ২০০০ সালে। দীর্ঘ ২০ বছর অচলাবস্থায় থাকার পর দীঘা-তমলুক রেলপ্রকল্পটি চালু হয় ২০০৩ সালের নভেম্বর মাসে, অর্থাৎ মমতা মন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার 3 বছরেরও বেশি সময় পরে। রেলমন্ত্রী তখন নীতীশ কুমার এবং প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারি বাজপেয়ী। বাজপেয়ীই আদতে এই প্রকল্পকে কোমা থেকে পুনরুদ্ধার করেন। কোনো প্রজেক্ট শুধু শুরু করলেই যদি সে প্রজেক্ট শেষ হত, তবে পশ্চিমবঙ্গে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান আজও রূপায়িত হল না কেন? অতএব প্রশ্ন, দীঘা-তমলুক রেল লাইন চালুর আদত কৃতিত্ব কার? তবে কি দীঘা-তমলুক রেলপথ চালু করার কৃতিত্ব দাবী করে মেদিনীপুরের জন্য আদতে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে না পারার ব্যর্থতার পরোক্ষ স্বীকারোক্তি দিলেন মমতা? নয়ত যে কাজের কৃতিত্বের সিংহভাগই তাঁর প্রাপ্য নয়, সেই কাজের কৃতিত্ব দাবী করবেন কেন?

নন্দীগ্রাম আন্দোলনে তাঁর সঙ্গী হিসাবে আবু, সুফিয়ান, আনিসুর প্রভৃতি কয়েকটি নামের পুনরাবৃত্তি করছিলেন মমতা। কেবলমাত্র মুসলিম যুবকদের নাম বারংবার উল্লেখ করা কি সচেতন রাজনৈতিক প্রয়াস? নন্দীগ্রামে মুসলিম জনসংখ্যা যথেষ্ট বেশি এবং নন্দীগ্রাম থেকে জিততে হলে মুসলিম সম্প্রদায়কে খুশি রাখতে হবে এমন ভাবনা থেকে? কিন্তু নন্দীগ্রামের সমস্ত মুসলমানই কি মমতার কাজে খুশি? বোধ হয় না। মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অংশ ক্ষুব্ধ যে গত ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম সম্প্রদায়কে প্রায় প্রতিবন্ধী বানিয়ে ফেলেছেন।

নন্দীগ্রামের সভা থেকে পূর্ব মেদিনীপুরের যুবকদের মমতা স্বপ্ন দেখালেন— উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোক নগরে পেট্রোলিয়াম এবং ন‍্যাচারাল গ‍্যাসের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে যা আসবে হলদিয়া শোধনাগারে এবং তার ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে মেদিনীপুরের মানুষদের। কিন্তু এইসব কাজের কৃতিত্ব কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঝুলিতে যাবে? নাকি যাবে কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক এবং ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশনের ঝুলিতে? ইতিহাস বলে নন্দীগ্রামের মানুষ যথেষ্ট সচেতন। তাঁরা যথার্থ বিচার করবেন যে এমত কর্মসংস্থান যদি হয়ও তবে সে কৃতিত্ব আদৌ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাপ‍্য কি না।

তাজপুরে গভীর সমুদ্রবন্দর পশ্চিমবঙ্গ সরকারের একটি প্রস্তাবিত প্রকল্প যার জন্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য কোষাগারে এই বিপুল অর্থের জোগান নেই কারণ এ রাজ্যের কোষাগারের উপর ইতিমধ্যেই চেপে রয়েছে অপরিসীম ধারের বোঝা। তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘাতের রাজনীতি এ রাজ্যের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদানও যথাসময়ে সংগ্ৰহ করতে ব্যর্থ হয়। উপরন্তু, যা অনুদান আসে তা-ও ভাগ-বাঁটোয়ারা ও ভাতা-বিতরণের রাজনীতিতে অপচয় হয়ে যায়। ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৌখিক আশ্বাসে পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষের কি তাজপুর বন্দরের স্বপ্ন দেখার যুক্তিযুক্ত কোনো কারণ আছে?

মমতা ব্যানার্জী এ-ও বলেছেন যে তিনি থাকলে খাদ্য ও চিকিৎসা এ রাজ্যে সকলে পাবে বিনামূল্যে। এই বিবৃতি স্বস্তির চেয়ে সন্দেহের উদ্রেক করেছে বেশি। তবে কি এটি কর্মসংস্থান তৈরী এবং চাকরি দিতে অস্বীকার করার পরোক্ষ বিবৃতি? নাহলে খাদ্য কেন বিনামূল্যে? ‘আপরুচি খানা’ নিজেদের উপার্জনের টাকায় ক্রয় করার ক্ষমতা মানুষের কেন থাকবে না?

নন্দীগ্রাম কৃষিভিত্তিক জায়গা, কৃষকদের জায়গা এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক উত্থানও কৃষকদের “জমি-রক্ষা” আন্দোলনের মধ‍্য দিয়েই। তৎসত্ত্বেও নন্দীগ্রামের ক্ষুদ্র কৃষকদের তথ্য ভারত সরকারের সাথে ভাগ করে না নেওয়ার ওঁর এই অনড় মানসিকতা নন্দীগ্রামের প্রতিটি কৃষক পরিবারকে বার্ষিক ৬ হাজার টাকা অর্থমূল্যের ক্ষতিস্বীকার করতে বাধ্য করছে। নন্দীগ্রামের কৃষকদের কি এতে খুশি হওয়ার কোনো কারণ আছে? নাকি তারা পি এম কিষাণ সম্মান নিধির অর্থমূল্য প্রত্যাশা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী মোদীর তত্ত্বাবধানে উন্নততর কৃষিব্যবস্থার সুযোগ চান? সময় বলবে।

শুভেন্দু অধিকারী যদি তৃণমূলের দক্ষিণবঙ্গ-গড়কে দুর্বল করে দিতে পারেন, যা করার চেষ্টা তিনি করবেন বলে শপথ নিয়েছেন, তাহলে বিধানসভা নির্বাচন শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টিএমসি একটি একক-পারিবারিক দলে পরিনত হবে বলে অনুমান করা যায়।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

https://www.newsbred.com/article/who-is-didi-fooling-nandigram-is-deeply-unhappy-with-mamata-including-its-muslims

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.