অতিমারির কালো ছায়া একটু হলেও কেড়ে নিয়েছে রোশনাই। তার মধ্যেও ঘুরে ফিরে আসছে একটাই প্রশ্ন, নীলবাড়িতে ফের তৃণমূল, নাকি পদ্মের পরশ? আর এই প্রশ্ন নিয়েই রবিবার শুরু হল ২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগণনা।
১০ বছর আগে বামদুর্গ ভেঙে এ রাজ্যে ঘাসফুল ফুটিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৬-তেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। কিন্তু ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশ বুঝিয়ে দেয়, বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ গেরুয়া শিবিরের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে সচেতন বাংলার মানুষের রায় কার পক্ষে যাবে, তার আঁচ পেতে কার্যত খেই হারিয়ে ফেলেছে বুথফেরত সমীক্ষাও। তবে মানুষের রায়ে আগামী পাঁচ বছর নীলবাড়ির শাসন কার হাতে যায়, তার হিসেব নিকেশ হাতে এসে পৌঁছতে আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
করোনা পরিস্থিতিতে ঘটা করে ‘ভোট উৎসব’ পালন করা নিয়ে ইতিমধ্যেই আদালতে তিরস্কৃত হয়েছে নির্বাচন কমিশন। তাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মতো অন্য বারের তুলনায় এ বারের ভোটগণনার নীলনকশাও একেবারে ভিন্ন। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে গণনাকেন্দ্রগুলিতে সতর্কতাবিধি পালন করা হচ্ছে অক্ষরে অক্ষরে। গণনাকেন্দ্রের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে আগের তুলনায়। ২০১৬-য় যেখানে ৯০টি গণনাকেন্দ্র ছিল, এ বার তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১০৮টি।
ভোটগ্রহণের মতো গণনাকেন্দ্রেও সতর্ক প্রহরা। ২৫৬ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে রাজ্যে। এ ছাড়াও রয়েছে রাজ্য পুলিশের সশস্ত্র বাহিনী, র্যাফ, কম্যান্ডো এবং কুইক রেসপন্স টিম। রয়েছেন পুলিশের ডিজি পদমর্যাদার আধিকারিকরা। প্রত্যেক গণনাকেন্দ্রই সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো রয়েছে। তার মাধ্যমে নজরদারি চালাবে কমিশন। গণনাকেন্দ্রে যাতে কোনও রকমের অশান্তি না হয় তার জন্য ১০০ মিটার এলাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। কমিশনের অনুমতিপত্র ছাড়া গণনাকেন্দ্রে ঢোকার অনুমতি নেই রাজ্য পুলিশেরও। গণনা শেষ হলে রিটার্নিং অফিসার, গণনা পর্যবেক্ষক, কাউন্টিং এজেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট আসনের প্রার্থী এবং এজেন্টরা সেখানে প্রবেশ করতে পারবেন।
রবিবার বাংলা ছাড়াও, অসম, তামিলনাড়ু, কেরল এবং পুদুচেরিতেও ভোটগণনা। তবে এ রাজ্যের দিকেই নজর আটকে সকলের। কারণ ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের হাত ধরে হিন্দি জম্মু-কাশ্মীর, হিন্দি বলয়, মহারাষ্ট্র এমনকি দেশের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত গেরুয়া বাহিনী দাপিয়ে বেড়ালেও বছর দুয়েক আগে পর্যন্ত বাংলায় পদ্ম ফোটানো কার্যত অসাধ্যই ছিল বিজেপি-র কাছে। কিন্তু ২০১৯-এ আলগা খুঁটি শক্ত হতেই সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারা। পালা করে ঘন ঘন বাংলা সফরে এসেছেন মোদী-শাহ।
সেই তুলনায় বরং খানিকটা যেন পিছিয়ে ছিল তৃণমূল। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফায় মমতা ক্ষমতায় ফেরার পরের বছরই পদ্মশিবিরে নাম লেখান তৃণমূলের প্রতিষ্ঠাপত্রে স্বাক্ষর করা মুকুল রায়। মমতার ছত্রছায়ায় থেকে কাজ করলেও, হাতের তালুর মতো যিনি তৃণমূলকে চেনেন, সেই মুকুল যে একে একে কাজের লোকজনকে কাছে টানবেন, তেমন ইঙ্গিত আগেই পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল আটকে ছিল সারদার গণ্ডিতেই। রাশ টানার বদলে দুর্নীতির অভিযোগ থেকে বাঁচতে মুকুল পদ্মে আশ্রয় নিয়েছেন বলে কটাক্ষ করেই দায় সেরেছে তারা। তার পর যত সময় এগিয়েছে, একে একে সব্যসাচী দত্ত, শোভন চট্টোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো নেতা, যাঁরা কি না দলের হয়ে ভোট করানোর কাজ সামলেছেন এত বছর ধরে, তাঁরাও পদ্মে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেন। বিরোধী শিবিরে গিয়ে বাকিরা যা-ও বা নরমে-গরমে কাজ সেরেছেন, শুভেন্দু সরাসরি নন্দীগ্রামে মমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন।
নন্দীগ্রামে যদিও জিতেও যান, শুভেন্দুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে নন্দীগ্রামে ছুটে যাওয়া, মমতার কাছে খুব একটা গৌরবের নয় বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তাদের মতে, যে নন্দীগ্রাম তাঁকে জননেত্রী হিসেবে তুলে ধরেছে, আজ সেই নন্দীগ্রামকে নিজের অহংয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ফেললেন তিনি। একের একের পর এক তারকাদের প্রার্থী করাও তৃণমূলের আত্মবিশ্বাসের অভাবকেই তুলে ধরে ছে বলে মত রাজনীতিকদের একাংশের। এর আগে তৃণমূলের হাত ধরে শতাব্দি রায়, তাপস পাল, দেব, মিমি চক্রবর্তী এবং নুসরত জাহানের মতো তারকাদের যখন রাজনীতিতে অভিষেক ঘটেছিল, তখন চিন্তাশীল মানুষদের সমাজকল্যাণে এগিয়ে আসা নিয়ে তেমন আপত্তি ওঠেনি। কিন্তু নীলবাড়ির লড়াইয়ে দলে যোগ দেওয়ার পর সায়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, কৌশানী মুখোপাধ্যায়ের মতো তারকারা যে ভাবে রাতারাতি ভোটের টিকিট হাতে পেয়ে গিয়েছেন, তা নিয়ে দলের অন্দরেও দ্বিমত দেখা দিয়েছে।
কিন্তু দেশে গেরুয়া শক্তির বিরুদ্ধে প্রধান মুখ হয়ে ওঠা মমতার রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সাহস নেই তাঁর অতি বড় সমালোচকদেরও। তাঁদের একাংশের মতে, করোনা সঙ্কট নিয়ে এমনিতেই মোদী সরকারের উপর ক্ষিপ্ত মানুষ। শীতলখুচির ঘটনার পর একটা বড় অংশ বিজেপি-কে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে আর মানতেই চাইছে না। তা ছাড়া, ভোট সমাপ্ত হয়ে গেলেও, এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে কাউকে তুলে ধরতে পারেনি বিজেপি। বরং কখনও দিলীপ ঘোষ, কখনও বাবুল সুপ্রিয়, কখনও স্বপন দাশগুপ্ত,এমনকি হালফিলে অগ্নিমিত্রা পালের নাম নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। সেই তুলনায় তৃণমূলের অবস্থান স্পষ্ট। একাধিক সভায় মমতা সাফ জানিয়েছেন, কোথায় কে প্রার্থী হচ্ছেন, তাতে কিছু যায় আসে না। তিনিই দলের মুখ।
তবে বাংলার রায় কার পক্ষে যায়, তা দিনের শেষে ভোটবাক্সই বলে দেবে।