বিজেপি প্রার্থীদের খরচে লাগাম পড়াতে নতুন করে কড়া বার্তা এল অমিত শাহের কাছ থেকে। বিজেপি সূত্রে খবর, সম্প্রতি প্রার্থীদের খরচ নিয়ন্ত্রণে দলের রাজ্য নেতাদের নির্দেশ দিয়েছেন নীলবাড়ির লড়াইয়ে পদ্মের প্রধান সেনাপতি। শুধু খরচ নিয়ন্ত্রণই নয়, দলের দেওয়া টাকা প্রার্থীরা কে, কতটা, কী ভাবে খরচ করছেন তার হিসেবও রাখতে বলা হয়েছে রাজ্য নেতাদের।
কেন এমন নির্দেশ? বিজেপি সূত্রে একাধিক কারণের কথা শোনা যাচ্ছে। অনেক প্রার্থী অযথা খরচ করছেন বা করেছেন বলে রিপোর্ট রয়েছে দলের অন্দরে। আবার অনেকে দলের দেওয়া টাকা প্রচারে পুরোটা খরচ না করে রেখে দিয়েছেন বলেও অভিযোগ।
অমিতের নির্দেশ, কমিশনের ঠিক করে দেওয়া নিয়মের বাইরে খরচ একেবারেই নয় এবং কোথাও যেন অর্থের অপচয় না হয়। সেই নির্দেশের পরে অনেক জায়গাতেই ভোটের খরচে রাশ টানার হয়েছে বলে বিজেপি সূত্রের খবর। প্রার্থীরা যাতে নিয়ম ভেঙে নগদে লেনদেন না করেন তা নিশ্চিত করতে নজরদারির ব্যবস্থাও করা হয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রেই এর জন্য রাখা হয়েছে কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি। প্রথম ৫ দফার মতো বাকি ৩ দফার ভোটগ্রহণের আগেও যেন দলের বিরুদ্ধে কোনও রকম অভিযোগ না ওঠে সেটাই লক্ষ্য গেরুয়া শিবিরের।
ভোটের মাঝখানে এমন কড়া নির্দেশে অনেকেই বিপাকে পড়েছেন। এক বিজেপি প্রার্থীর ঘনিষ্ঠর বক্তব্য, ‘‘কমিশনের বেঁধে দেওয়া অর্থে ভোটে লড়া যায় না। লুকিয়ে কিছু খরচ করতেই হয়। কিন্তু এখন দলও নজরদারি চালাচ্ছে। ফলে ফ্রিজে খাবার থাকলেও খিদে মেটানো যাচ্ছে না। পাছে কেউ জেনে যায়, সেই ভয় কাজ করছে।’’
নির্বাচনের প্রচারে তৃণমূল প্রথম থেকেই বিজেপি-র বিরুদ্ধে ‘অর্থবল’-এর অভিযোগ তুলছে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বারবার ‘বিজেপি টাকা ছড়াচ্ছে’ বলে অভিযোগ তুলেছেন। জনসভায় লোক জড়ো করতে টাকা খরচ করা হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন। প্রকাশ্য জনসভা থেকে তার জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীও। এর পরেও তৃণমূল যাতে কোনও নির্দিষ্ট অভিযোগ তুলতে না পারে সে ব্যাপারে দলের নেতাদের আলাদা করে অমিত সতর্ক করেছেন বলে জানা গিয়েছে। রাজ্য বিজেপি-র এক নেতার কথায়, ‘‘এটা নতুন কিছু নয়। অমিতজি প্রথম থেকেই এই ব্যাপারে সতর্ক করেছেন। তবে বারবার তৃণমূল একই ধরনের অভিযোগ তুলতে থাকায় বেশি করে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।’’ যদিও রাজ্য বিজেপি-র মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘এমন কোনও নির্দেশের কথা আমার জানা নেই।’’ শমীক আরও বলেন, ‘‘হিসেব রাখার ব্যাপারে আলাদা করে সতর্ক করা বা হওয়ার কিছু নেই। বিজেপি সব সময়েই আর্থিক স্বচ্ছতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। রাজ্য বিজেপি-র সামর্থ জানেন কেন্দ্রীয় নেতারা। সেই সামর্থ মতোই খরচ হচ্ছে।’’
রাজ্যে ৫ দফা নির্বাচন হয়ে গিয়েছে। বাকি আরও ৩ দফার ভোট। এখনও পর্যন্ত বিজেপি-র বিরুদ্ধে কোনও নির্দিষ্ট আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ কমিশনে জমা না পড়লেও ‘অর্থবল’ নিয়ে আক্রমণ চলছেই। এই বিধানসভা নির্বাচনে তেমন কোনও অভিযোগের মুখোমুখি না হলেও রাজ্য বিজেপি-র কাছে গত লোকসভা নির্বাচনের তিক্ত-স্মৃতি এখন জ্বলজ্বলে। ২০১৯ সালে ঘাটাল লোকসভা আসনে বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষের গাড়ি থেকে নগদ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল বিজেপি-কে। পিংলায় ১ লক্ষ ১৩ হাজার ৮৯৫ টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি ভারতীকে আটকও করে পুলিশ। যদিও তাঁকে ফাঁসানোর দাবি করেছিলেন ভারতী। বলেছিলেন, “ভোটের খরচের জন্য ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলেছিলাম। আর এ বিষয়ে সব নথিপত্রই আমার কাছে আছে।” এর পরে পরেই নগদ ১ কোটি টাকা নিয়ে আসানসোল স্টেশনে ধরা পড়েন বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের এক সময়ের আপ্তসহায়ক গৌতম চট্টোপাধ্যায়। সে ক্ষেত্রেও বিজেপি চক্রান্তের অভিযোগ তুলছিল। তবে এটা ঠিক যে, ওই ঘটনায় অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছিল দলকে। এ বার তাই বাড়তি সতর্ক গেরুয়া শিবির।
শুধু সতর্ক থাকাই নয়, বিজেপি সূত্রে খবর, বিধানসভা নির্বাচনে খরচ কমানোর নির্দেশও দিয়েছেন অমিত। এই ব্যাপারে রাজ্য বিজেপি-র এক নেতা বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্পষ্টই বলেছে, যে রাস্তা গাড়িতে যাওয়া সম্ভব সেখানে অযথা হেলিকপ্টার ব্যবহার করা যাবে না। একান্ত হেলিকপ্টার নিলেও এমন জায়গায় নামতে হবে যাতে গাড়িতে করেই সব কর্মসূচি মিটিয়ে ফেলা যায়। অমিত নিজের ক্ষেত্রেও সেই নীতি মানছেন। রবিবার তাঁর শেষ কর্মসূচি রয়েছে হাবড়ায়। কমিশনের নতুন নিয়মে সন্ধ্যা ৭টায় যেহেতু প্রচার শেষ তাই হাবড়া থেকে কলকাতা প্রায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা তিনি গাড়িতেই আসবেন।’’ শুধু অমিত শাহই নন, সব কেন্দ্রীয় ও রাজ্য নেতৃত্বের ক্ষেত্রেও এই নীতি নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওই বিজেপি নেতা। রাজ্য সভাপতি দিলীপও হেলিকপ্টার থেকে নেমে গাড়িতেই ঘুরছেন। কলকাতা না ফিরে রাত্রিবাস করছেন যেখানে দিনের শেষ কর্মসূচি থাকছে সেখানে।
নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ মতো একজন বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী প্রচারে সর্বাধিক ৩০ লাখ ৮৮ হাজার টাকা খরচ করতে পারেন। প্রার্থীরা নিয়ম মেনে খরচ করছেন কিনা তা দেখার জন্য প্রতিটি বিধানসভা আসনের জন্য নির্দিষ্ট ‘এক্সপেন্ডিচার অবজার্ভার’ নিয়োগ করেছে কমিশন। রাজ্য বিজেপি নেতাদের দাবি, কমিশনের পর্যবেক্ষকদের পাশাপাশি দলীয় নেতৃত্বও সে দিকে নজর রাখছে। এ ছাড়াও বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জেলা, রাজ্য বা সর্বভারতীয় হিসেব রাখার জন্য বেসরকারি সংস্থার উপরে নির্ভর করে বিজেপি। দলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু বলেন, ‘‘বিজেপি নগদ টাকায় কোনও কাজ করে না। প্রত্যেক প্রার্থীকে দলের পক্ষে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকেই খরচ হচ্ছে। যাঁরা বিজেপি-র দিকে আঙুল তুলছে তাঁরা বরং নিজেদের হিসেব দেখুন। কোন সংস্থা তাঁদের অডিট করে সেটাও তাঁরা বলতে পারবেন না। আর বিজেপি-র ক্ষেত্রে অডিট করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ‘বিগ ফোর অ্যাকাউন্টিং ফার্মস’। আর্থিক স্বচ্ছতার এমন দাবি আর কোনও রাজনৈতিক দল করতে পারবে না।’’
প্রার্থী পিছু কত টাকা দল দিয়েছে সে ব্যাপারে কেউ মুখ খুলতে না চাইলেও বিজেপি সূত্রে জানা গিয়েছে, ৩টি বিষয় বিবেচনা করে টাকা দিয়েছে দল। যাঁরা পুরনো রাজনীতিক এবং অতীতে বিধায়ক বা সাংসদ থেকেছেন তাঁদের কম টাকা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছেন, যাঁরা দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিন্তু নির্বাচনে অর্থ ব্যয়ের ব্যক্তিগত সামর্থ নেই। তৃতীয় ভাগে রয়েছেন, সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে রাজনীতিতে এসে যাঁরা প্রার্থী হয়েছেন। সাধারণ ভাবে তৃতীয় ভাগের প্রার্থীদেরই সবচেয়ে বেশি টাকা দেওয়া হয়েছে দলের তরফ থেকে। তবে টাকা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বড় মাপকাঠি সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর জয়ের সম্ভবনা।