হিসেব গুলিয়ে দিল দেবভূমি। অঙ্ক কষা হিসেব। ছকে বাঁধা হিসেবও।
উত্তরাখণ্ডের বিধানসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে দু’টি সম্ভাবনার কথা ভেবে নেওয়া হয়েছিল— এক, কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে না। ফলে উত্তরের এই রাজ্য ত্রিশঙ্কু ফলাফল হতে চলেছে। ক্ষমতার দখল নিতে সেয়ানে সেয়ানে টক্কর হবে দুই প্রধান দল কংগ্রেস এবং বিজেপির। দুই, পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতাবদলের ‘ট্রেন্ড’ বা ধারা মেনে এ বার ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে কংগ্রেস।
প্রথমটি বুথফেরত সমীক্ষার অঙ্ক-কষা হিসেব। দ্বিতীয়টি পুরনো ছকে বাঁধা। দু’টিতেই কিছুটা আশা দেখেছিল কংগ্রেস। কিন্তু বাস্তবে হল উল্টো। দেখা গেল, দেবভূমি এবার দীর্ঘলালিত অভ্যাস এবং ঐতিহ্য বদলে ফেলেছে। তারা আস্থা রেখেছে বিজেপি-তেই। এই প্রথম বিধানসভায় একই রাজনৈতিক দলকে দ্বিতীয়বার বেছে নিয়েছে উত্তরাখণ্ডের আমজনতা। ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সম্ভাবনা উড়িয়ে বিজেপি-ই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরছে গাড়োয়াল-কুমায়ুঁর রাজ্যেরাজ্যে।
উত্তরাখণ্ড বিধানসভায় মোট আসন ৭০টি। একা সরকার গড়তে হলে ৩৬টি আসন নিশ্চিত করতে হত জয়ী রাজনৈতিক দলকে। ৩৬ উত্তরাখণ্ডে সরকার গঠনের ‘জাদু সংখ্যা’। বুথফেরত সমীক্ষা বলেছিল, এ যাত্রায় কোনও দলই সেই সংখ্যা ছুঁতে পারবে না। বাস্তবে যদিও সেই ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি। ২০১৭ সালে উত্তরাখণ্ডে ভোটে জিতেছিল বিজেপি। ৭০টি আসনের ৫৭টিই ছিল তাদের দখলে। কংগ্রেসের ১১টি। এ বছর ভোট কমলেও দুপুরের মধ্যেই দেবভূমিতে ৪৫টিরও বেশি আসন নিশ্চিত করে ফেলে বিজেপি। ভোট এবং আসন বাড়িয়েও শেষ পর্যন্ত কংগ্রেস ৩৬ ছুঁতে পারেনি।
অবস্থানের দিক দিয়ে অনেক অমিল উত্তরাখণ্ড আর কেরলের। তবে এতদিন একটি মিল ছিল। দক্ষিণের ওই রাজ্যে কখনও পর পর একই দল ক্ষমতায় আসেনি। ঠিক যেমন ২০ বছর আগে উত্তরাখণ্ডের জন্ম হওয়ার পর থেকে ‘দেবভূমি’ও কখনও টানা একটি দলে আস্থা রাখেনি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ক্ষমতার হাতবদল হয়েছে উত্তরাখণ্ডে। কিন্তু এ বার বিজেপি সেই ঐতিহ্য পাল্টে দিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশ ভেঙে তৈরি উত্তরাখণ্ডে বরাবরই উত্তরপ্রদেশের মতোই জাতপাতের রাজনীতি গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। উত্তরের এই রাজ্যের জনবসতির ৫০ শতাংশই উচ্চবর্ণের। যাঁদের অধিকাংশই আবার বিজেপি সমর্থক বলে পরিচিত। উত্তরাখণ্ডে বিজেপির জয়ে প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি সেই বিষয়টিই এবারের বিজেপির জয়ের চাবিকাঠি হল!
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, ধারা যে বদলাতে পারে তা লোকসভা ভোটের ফল দেখে আন্দাজ করা গিয়েছিল। ২০১৪ এবং ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে পরপর দু’বার উত্তরাখণ্ডে বিজেপিই বেশি আসন জিতেছিল। তাই ২০২২-এর বিধানসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে সংশয়ে ছিলেন জাতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষকরাও।
তবে এ ছাড়াও উত্তরাখণ্ডের রাজনীতিকে মোদী ফ্যাক্টর কাজ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তরাখণ্ড নিজেও ভারতের একটি সীমান্তবর্তী রাজ্য। নেপাল চিনের সীমানায় অবস্থান দেবভূমির। জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত তাই বরাবরই প্রভাবিত করেছে উত্তরাখণ্ডকে। তার আরও একটি কারণ এই যে, ভারতীয় ফৌজিদের অনেকেই উত্তরাখণ্ডের বাসিন্দা। তাই ফৌজি আবেগ জোরালো এখানে। সেই উত্তরাখণ্ডে ফৌজি আবেগ উসকে দিয়ে প্রচারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেনে এনেছিলেন সার্জিকাল স্ট্রাইক এবং গালোয়ানের যুদ্ধ প্রসঙ্গ। এমনকি, উত্তরাখণ্ডের ভূমিপুত্র জেনারেল বিপিন রাওয়াতের বিমান দুর্ঘটনার কথা মনে করিয়ে দিতেও ভোলেননি। প্রচারে সরাসরি আক্রমণে গিয়ে মোদী বলেছিলেন, ‘‘যে কংগ্রেস রাওয়াতকে রাস্তার গুণ্ডা বলেছিল, তাদের একটাও ভোট দেবেন না।’’
উত্তরাখণ্ডে ক্ষমতায় থাকাকালীন গত পাঁচবছরে বার বার দলীয় অন্তর্কলহের জেরে মুখ্যমন্ত্রী বদলাতে হয়েছে বিজেপি-কে। যে দল পাঁচ বছরের শাসনকালে তিন-তিনবার মুখ্যমন্ত্রী বদলায়, তার উপর সাধারণ মানুষের ভরসা না-থাকলে তাঁদের দোষ দেওয়া যায় না। সম্ভবত সেই আশঙ্কা থেকেই উত্তরাখণ্ড নিয়ে বাড়তি পদক্ষেপ করেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। এই রাজ্য বিজেপি-র কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা মোদী বুঝিয়ে দিয়েছিলেন প্রজাতন্ত্র দিবসে। এক মাস পরে নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে গত ২৬ জানুয়ারি মোদী জাতীয় যুদ্ধস্মারকে পৌঁছন উত্তরাখণ্ডের ঐতিহ্যবাহী টুপি মাথায় দিয়ে।
সমালোচকরা তখন বলেছিলেন, রাজ্যের বেকারত্ব, মৃল্যবৃদ্ধির মতো যে সমস্ত সমস্যা নিয়ে উত্তরাখণ্ডের জনগণের মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে একটি কথাও খরচ করলেন না মোদী! শুধু গিমিক তৈরি করলেন। তবে উত্তরাখণ্ডও যে সেসব নিয়ে ভাবতে রাজি নন, মোদী যা বলেছিলেন, সেটাই যে উত্তরাখণ্ডের জন্য যথেষ্ট, তা ভোটের ফলাফলে প্রমাণ করে দিয়েছে দেবভূমি।
বিজেপি উত্তরাখণ্ডে জিতলেও , একটি ব্যাপারে ধাক্কা খেয়েছে। ভোটে বিজেপির শেষ মুখ্যমনন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামি হেরে গিয়েছেন। অর্থাৎ, উত্তরাখণ্ড বুঝিয়েছে, তারা বিজেপি-কে পছন্দ করতে পারে। তবে তাদের নিযুক্ত শাসককে নয়। ফলে নতুন সরকার গড়ে উত্তরাখণ্ডে বিজেপি-র কাছে নতুন এবং প্রখম চ্যালেঞ্জ নতুন মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচন। যে দিকে তাকিয়ে রয়েছে বিজেপি-কে আরও একবার সুযোগ করে দেওয়া উত্তরাখণ্ডও।