কীভাবে হিংস্রতা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল, অতীত থেকে বর্তমানের সেই পটভূমিতে​ আজ আমরা চোখ রাখবো

যেহেতু রাজনৈতিক সহিংসতার বিষয়টিতে বাংলা অন্য সমস্ত রাজ্যকে ছাপিয়ে গেছে, তাই আজ আর এটা কোনও গোপন বিষয় নয়।

প্রায় ছয় দশক ধরে যেহেতু নকশালরা নিজেদের অধঃপতন শুরু করেছিল এবং তারপরে তাদের ঘনিষ্ঠ আদর্শগত তুতো ভাই – কম্যুনিস্টরা, বাংলার ক্ষতি করা, রাজনৈতিক বিরোধীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রকাশ এবং তাদের উপর সহিংস হামলা এই রাজ্যকে পুরো তছনছ করে দিয়েছিল।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিক থেকে বাংলায় নকশালবাদের অন্ধকার দিনগুলিকে তৎকালীন কংগ্রেস সরকার বর্বরোচিত হামলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসাবে চিহ্নিত করেছিল।

আর এই পরিস্থিতিতে জরুরি অবস্থা চাপিয়ে দেওয়া আসলে বিরোধীদের দমন ও আক্রমণের আরেকটি অন্ধকার অধ্যায় বলে ধরা হয়। ১৯৭৭ সালে কম্যুনিস্টরা ক্ষমতায় আসার পরে বাংলায় সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির​ সৃষ্টি হয়েছিল।

কমিউনিস্টদের ‘পবিত্র‘ লাল বইয়ের ’শ্রেণী শত্রুদের নির্মূল ’(পড়ুন: রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের) নামে স্বীকৃত, বিরোধী দলকে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেওয়ার একটি নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল।

কমিউনিস্টরা ঠিক করেছিল যে তারা তাদের রাজনৈতিক বিরোধীদের সবাইকে হয় নির্মূল করবে বা কোনঠাসা করে দেবে।

গ্রামাঞ্চলে, বিরোধী দলগুলির নেতারা (প্রাথমিকভাবে কংগ্রেস সমর্থক) এবং এমনকি যে পরিবারগুলি কংগ্রেসের সমর্থক বলে মনে হয়েছিল তাদের আক্রমণ করা হয়েছিল এবং নিজেদের বাড়িঘর থেকে, গ্রাম থেকে তাদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর তার সাথে তাদের সম্পত্তি এবং জমি জোর করে দখল করা হয়েছিল।

ভয়াবহ সেনবাড়ী হত্যাকাণ্ড হ’ল এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এইরকম অসমর্থিত মানুষ বা রাজনৈতিক বিরোধীদের অসংখ্য হত্যাকাণ্ড ঘটে চলেছিল একের পর এক। মরিচঝাপি গণহত্যা হ’ল স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে রাজ‍্য সরকার পরিচালিত সবচেয়ে খারাপ হত‍্যাকান্ডের উদাহরণ।

কয়েক হাজার বিরোধী নেতাকর্মী এবং তাদের পরিবার তাদের গ্রাম ও শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে এবং এমনকি রাজ্যের বাইরেও আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিল। এইরকম দুর্দশার অসংখ্য দলিল অনেক রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে।

সিপিআই (এম) যে ‘দলীয় সমাজ’ প্রতিষ্ঠা করেছিল তা বিরোধী এবং রাজনৈতিক অসাম্প্রদায়িকদের জন্য “জিরো টলারেন্স” নিশ্চিত করেছিল। বাংলার অসহায় নাগরিকরা বিনা প্রতিবাদে কম্যুনিস্টদের সমস্ত হুকুম মাথা নিচু করে মানতে বা রাজ্য ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।

২০১১ সালে কমিউনিস্টদের সমূলে ধ্বংস হওয়া বাংলার মানুষের মনে আশা জাগিয়ে তুলেছিল যে এবার হয়তো বাংলায় সন্ত্রাসবাদের রাজত্বের ​শেষ বাজনা বেজে গেছে।

যদিও বাংলায় ২০১১ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে, পরিবর্তনের হাওয়ার গতি বুঝতে পেরে, রাজ‍্যের প্রধান বিরোধী দল তৃণমূলকে, সম্পূর্ণভাবে শেষ করার জন্য কম‍্যুনিস্টদের মোতায়েন করা পেশীশক্তির সামনে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

আশ্চর্যের বিষয় এটাই যে এই বিশেষ শক্তিবাহিনী তৃণমূলের ছত্রছায়ায় এসেও কিন্তু একই ভূমিকা পালন করে চলেছে যা তারা এই ৩৪বছরে বাম শাসিত বাংলায় করে এসেছিল। মানুষের বিশ্বাসকে ভেঙ্গে দিয়ে অরাজকতার ধারা আজও অব‍্যাহত রয়েছে : আক্রমণ ও নীরব বিরোধী দল (কমিউনিস্টদের পাশাপাশি কংগ্রেস এবং বিগত তিন বছরে বিজেপি) এবং তার সাথে সমান্তরালভাবে চলছে অন‍্যায় জুলুম।

বিশেষ করে গ্রাম ও আধা-শহর অঞ্চল গুলোতে​ দলের আধিপত্য বজায় রাখতে তৃণমূল নেতৃত্ব এই পেশীশক্তির উপর অনেক বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

কমিউনিস্টদের​ শাসনামলে এই গুন্ডা বাহিনী গত দশ বছর ধরে বাংলায় কুখ্যাত ‘সিন্ডিকেট’গুলিকে সুরক্ষা দেওয়া এবং তাদের বাড়বাড়ন্তের পিছনে মূল কারিগর হিসাবে কলকাঠি নেড়ে এসেছিল।

রাজনৈতিক সহিংসতার ব‍্যবচ্ছেদ

কিন্তু এই পেশি শক্তি ও গুন্ডাদের অস্তিত্বের মূল কারণ ছিল কমিউনিস্টরা এবং বর্তমানে তৃণমূল। আর এই পেশীশক্তিকে যে বিরোধীদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্যই​ নিযুক্ত করা হয়েছিল বা হয়েছে তা আজ দিনের আলোর মত স্পষ্ট: আর বাংলার কর্মসংস্থানের​ এবং কর্মপ্রচেষ্টার অভাবই গুন্ডা বাহিনী তৈরী হওয়ার অন‍্যতম কারণ বলা যায়।

বাম এবং তৃণমূল বুঝতে পেরেছিল যে বাংলার এই অসংখ্য বেকার, এবং কর্মে নিয়োগের​ অযোগ্য যুবকদের (এমনকি কিছু ক্ষেত্রে মহিলাদের​) মধ্য থেকেই​ এই গুন্ডা বাহিনীতে সহজেই নিয়োগ​ করা যাবে।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে এবং ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিক পর্যন্ত রাজধানী থেকে বাংলার এই অরাজকতা কেবল লক্ষ লক্ষ মানুষকে বেকার করেই রাখেনি, সাথে রাজ্যে কোনও নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হতে দেয়নি।

কমিউনিস্টরা তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য বিশাল সংখ্যক বেকার মানুষদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল। তারা রিকশা ও অটোরিকশা চালানোর অনুমতি, সরকারী বা বেসরকারী জমিতে অবৈধভাবে বস্তি ও দোকান স্থাপন, শ্রমিক, প্লাস্টার, চিত্রশিল্পী, ছোট সব্জী বিক্রেতা বা মাছ বিক্রেতা হিসাবে জীবিকা নির্বাহ করার মতো ছোটো ছোটো চাহিদার অনুমোদন করার আড়ালে নিজেদের আসল উদ্দেশ্য সফল করেছিল।

এইসব মানুষগুলো জীবিকা নির্বাহের এই সামান্য সুযোগটুকু পাওয়ার জন্য কম্যুনিস্টদের কাছে চিরঋনী হয়ে রইল, তা সে যতই স্বল্প ও কষ্টদায়ক হোক না কেন।

তবে সিপিআই (এম) এর পক্ষেও সবার জন্য এধরনের জীবিকার​​ সুযোগ করে দেওয়া অসম্ভব ছিল। সুতরাং যাদের এই স্বল্প আয়ভুক্ত শ্রেণীর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা গেল না তাদের দলের কুখ্যাত হার্মাদ বাহিনী (গুন্ডাদের সেনাবাহিনী)-তে নিয়োগ করা হয়েছিল।

কম্যুনিস্টরা বাঙালিদের মধ্যে থাকা কর্মদক্ষতা এবং কর্মদ্দ‍্যোগকে মেরে ফেলেছিল যাতে তারা পুরোপুরিভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে ক্ষমতাসীন দলের মেয়াদ বেড়েই চললো (মার্কসবাদীদের আত্মকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রকৃতির জন্য দু’দলই আদপে একই হয়ে গিয়েছিল) আর অবশ‍্যম্ভাবীভাবেই কমতে থাকল চাকরি ও জীবিকার সুযোগ।

কর্মসংস্থানের অভাবের ফলে বাংলার মার্কসবাদী শাসকরা বিপুল সংখ্যক তরুণকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উপর হামলা করে, তাদের বাড়িঘর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে এমনকি হত্যা করে বাংলায় নিজেদের রাজত্বের ভীত আরও মজবুত করে তুলেছিল।

রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিনিময়ে তারা সবরকমের বেআইনী কাজে​ জড়িয়ে পড়ল। এই বিশেষ রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকার দরুণ ছোটবড় ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, ডাক্তার ও আইনজীবীর মতো পেশায় যুক্ত থাকা মানুষ, এমনকি সরকারী আধিকারিকদের কাছ থেকেও​ এরা জোর করে টাকা আদায় করতে পারতো।

সিপিআই (এম) দলীয় অনুমতি নিয়ে জীবিকা নির্বাহের পথ অনুসরণকারীরাও মার্কসবাদীদের প্রতি মনোনিবেশ করেছিলেন এবং রাজনৈতিক সমাবেশ ও নির্বাচনের সময় পেশী-শক্তি সরবরাহ করার পাশাপাশি প্রয়োজনের সময় তাদের ক্ষমতা. দ্বিগুণ করতেও সাহায্য করেছিল।

সিপিআই(এম)-এর আমলে বাংলায় রাজনৈতিক সহিংসতার মূল কারণ শুধু বিরোধীদলের অসহিষ্ণুতা ছিল না, বরং সাধারণ মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে বাংলার বুকে জোর করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখাও ছিল এক অন‍্যতম প্রধান কারণ। দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি​ যে বাম আমলের সেই ধারা আজ সসম্মানে বয়ে নিয়ে চলেছে তৃনমূল কংগ্রেস, ফলস্বরূপ, বাংলার অর্থনীতি আজ খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে​ রয়েছে।

অন‍্য আরেকটি প্রধান কারন হিসাবে “দলীয় সমাজ” স্থাপনে​র কথা বলা যায়, যা সিপিআই (এম) প্রতিষ্ঠা করেছিল এবং তৃণমূল তা বজায় রেখেছে। সমস্ত সামাজিক বিষয়ে দলের নিয়ন্ত্রণ ছিল – এমনকি কোনো পরিবারের ছেলে মেয়েদের​ ক্ষেত্রে ম্যাচ-মেকিংয়ে পর্যন্ত হস্তক্ষেপ হয়েছিল – যা পুরো সমাজের উপর ক্ষমতাসীন দলের সম্পূর্ণ অধিকারকে নিশ্চিত করেছিল।

“লোকেরা যদি বেসরকারী ও সরকারী খাতে (নিয়মিত সরকারী চাকুরী সহ) যথাযথ চাকরিতে নিযুক্ত হন এবং ছোট ব্যবসা পরিচালনা করে বা অন্য পেশায় নিযুক্ত হওয়ার জন্য রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর করতে না হয় তবে তারা স্বাভাবিকভাবেই​ আর ক্ষমতাসীন দলের খবরদারি সহ‍্য করবে না বা দলের​ হয়ে কাজও করবে না। যারফলে ক্ষমতাসীন দল আর বিরোধী দলকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার বা নির্মূল করার জন্য পেশি শক্তি ও গুন্ডাদের যোগান পাবে না” —রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ রাহুল শিকদার বলেছেন।

দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক শিকদার বলেছিলেন যে ঠিক এই কারণেই​ আগে মার্কসবাদীরা এবং এখন তৃণমূল, বাংলাকে এবং তার জনগণকে গরীব এবং বেকার করে রাখার জন্য ব‍্যক্তিগতভাবে উদ‍্যোগী হয়েছে।

“উন্নয়ন ও শিল্পায়ন, অর্থ, চাকরি ও জীবিকা নির্বাহের নতুন নতুন পথের সন্ধান দেবে, ফলে জনগণ ক্ষমতাসীন দলের​ ক্ষতিকারক প্রভাব প্রত্যাখ্যান করবে। লোকেরা আর তাদের ক্ষুদ্র পেশার জন্য রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার উপর নির্ভর করবে না এবং ব্যবসায়িক উন্নতি হবে, চাকরির সুযোগ বেড়ে যাবে, কেউই কোনও রাজনৈতিক দলের পেশীশক্তিতে পরিণত হবে না। এটাই মার্কসবাদীরা ভয় পেয়েছিল এবং তৃণমূলও এই একই বিষয় নিয়ে চিন্তিত আছে” —শিকদার বলেছেন।

বাংলায় রাজনৈতিক সহিংসতার মূল কারণ হ’ল মার্কসবাদীদের প্রতিষ্ঠিত “দলীয় সমাজ”, যারজন‍্য আজ রাজ‍্যের অর্থনীতি নিস্তেজ হয়ে পড়েছে।

জয়দীপ মজুমদার “স্বরাজ‍্য”-এর অ‍্যাসোসিয়েট এডিটর

https://swarajyamag.com/politics/explained-how-violence-became-an-integral-feature-of-west-bengals-political-landscape

জয়দীপ মজুমদার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.