এবারে বিধানসভা জুড়ে শাসক দলে আরও বেশি অর্ধেক আকাশ

বিধানসভায় একটি ব্লকে প্রেস গ্যালারির চার সারি সামনে নির্দিষ্ট আসনে পাশাপাশি বসতেন ওঁরা তিন কন্যা। কথোপকথন হত মূলত নিজেদের মধ্যেই। পারতপক্ষে অন্যদের সঙ্গে কথা হত খুব কমই। ওই তিনজনের, মানে তৃণমূলের তিন তারকা প্রার্থী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবশ্রী রায় ও বৈশালী ডালমিয়ার জুটি এবার ভেঙে গেল। নয়না জিতেছেন চৌরঙ্গী কেন্দ্র থেকে। দেবশ্রী বিতর্কে পড়ে এবার আর টিকিট পাননি। বৈশালী বিজেপি-তে গিয়ে টিকিট পেলেও জিততে পারেননি। 
মহিলা বিধায়কদের মধ্যে গতবারের মত এবারও তৃণমূলের জয়জয়কার। পুরনো অনেক মুখ এবার আর বিধানসভায় দেখা যাবে না। পরিবর্তে আসবে বেশ কিছু নতুন মুখ। ভোটের সার্বিক ফলাফলে তৃণমূল ২১৩, বিজেপি ৭৭, আইএসএফ ১। ২০১৬-তে মোট মহিলা বিধায়ক ছিলেন ৪০। এর মধ্যে তৃণমূলের ২৯, সিপিএম ৬, কংগ্রেস ৪, গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার ১। এবার পশ্চিমবঙ্গে মহিলা বিধায়কের সার্বিক সংখ্যাটি অপরিবর্তিত থাকলেও তৃণমূলের মহিলা বিধায়ক বেড়ে হয়েছে ৩৩। 
গত বিধানসভার মাঝপর্বেই সাংসদ হয়ে বেড়িয়ে যান তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র। এবার ভোটে টিকিট পাননি মালা সাহার মত কিছু মহিলা বিধায়ক। এরকমই একজন সোনালি গুহ। প্রার্থী হতে না পেরে কাঁদতে কাঁদতে যোগ দেন বিজেপি-তে। তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে পুরনোদের স্বাগত জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর তিন দশকের ওপর ছায়াসঙ্গী সোনালি গুহ কি সেই ডাকে সাড়া দেবেন? প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদককে বললেন, “না। সেই প্রশ্নই উঠছে না।“ ২০০১-এ প্রথম বিধায়ক হন সোনালি। দু’দশক বাদে আর বিধায়ক নন। এবার আর বিধানসভায় থাকছেন না। খারাপ লাগছে? সোনালি জানান, “পুরনো আরও কয়েকজনও নেই। ঠিক আছে। আমি এখন বিজেপিরই কাজ করব।“
গত ৫ মার্চ তৃণমূলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, তাঁর দল ৫০টি আসনে মহিলা প্রার্থী দিয়েছে। তাঁদের ৩৩ জন আসন নেবেন বিধানসভায়। বিদায়ী মন্ত্রিসভার তিন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য শশী পাঁজা (শ্যামপুকুর), চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (দমদম উত্তর), অসীমা পাত্র (ধনেখালি) ছাড়াও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী সাবিত্রী মিত্র (মানিকচক) বা সাবিনা ইয়াসমিন (মোথাবাড়ি), শিউলি সাহা (কেশপুর)র মত পুরনো কিছু মুখ এবার পুনর্নবাচিত হয়েছেন। বিজেপি-র মহিলা বিধায়ক থাকবেন ৭ জন। 
নতুন মহিলা মুখের মধ্যে আছেন তৃণমূলের রাজনৈতিক তারকা রত্না চট্টোপাধ্যায় (বেহালা পশ্চিম)। রত্নার কাছে বিধানসভা অবশ্য পারিবারিকভাবে খুবই ঘনিষ্ঠ। তাঁর বাবা দুলাল দাস গতবারের মত এবারেও বিধায়ক হয়েছেন। মা কস্তুরী দাসও বিধায়ক ছিলেন। স্বামী শোভন চ্যাটার্জি অনেক দিনের প্রাক্তন বিধায়ক। তৃণমূলে নয়া বিধায়কদের মধ্যে নজর কাড়বে সেুলয়েডের তারকা জুন মাল্য (মেদিনীপুর), লাভলি মৈত্র (সোনারপুর দক্ষিণ), বীরবাহা হাঁসদা (ঝাড়গ্রাম), শিল্পী অদিতি মুন্সি প্রমুখ। প্রাক্তন অভিনেত্রী নয়না বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এঁদের সকলের উপস্থিতি নজর কাড়বে বিধানসভায়। 
একেবারে নিস্প্রভ নয় বিরোধী মহিলা শিবিরও। বিজেপি-র কোচবিহারের লড়াকু নেত্রী মালতী রাভা (তুফানগঞ্জ), বিজেপি মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী তথা ফ্যাশন ডিাইনার অগ্নিমিত্রা পাল, মন্ত্রী গৌতম দেবকে হারিয়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়া শিখা চট্টোপাধ্যায় (ডাবগ্রাম ফুলবাড়ি), শ্রীরূপা মিত্র (ইংরেজবাজার), সুনীতা সিংহ (কাঁথি উত্তর), চন্দনা বাউরি (শালতোরা)। এবারের ভোটে তৃণমূলের মহিলা প্রার্থী বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ কিছু জেলায় তাঁদের সাফল্য। যেমন,  কলকাতা (২ মহিলা প্রার্থীর ২ জনই জয়ী), পশ্চিম মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণায় (৪-এ ৪), হাওড়ায় (২-এ ২), পুরুলিয়া, পূর্ব বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, পূর্ব বর্ধমানে (১-এ ১)। অর্থাৎ, এই জেলাগুলোয় আসনের নিরিখে মহিলা প্রার্থীদের সাফল্য ১০০ শতাংশ। তৃণমূল সবচেয়ে বেশি মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল উত্তর ২৪ পরগণায় ৭ জন। জিতেছেন ৬ জন। হুগলি ও মালদহে পাঁচ মহিলা প্রার্থীর মধ্যে জিতেছেন যথাক্রমে ৪ ও ৩। 
নির্বাচনে তৃণমূলের মহিলা প্রার্থীদের খারাপ ফল হয়েছে বাঁকুড়ায় (৫-এ ১)। অন্যদিকে, অন্তত পাঁচ জেলায় বিজেপি-র মহিলারা আশানুরূপ ফল করতে পারেননি। মুর্শিদাবাদ, উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পশ্চিম মেদিনীপুর ও কলকাতায় বিজেপি মহিলা প্রার্থী দিয়েছিল যথাক্রমে ৪, ৪, ৩, ৩ ও ২। এগুলোর একটি আসনও বিজেপি-র ঝুলিতে আসেনি। সাংসদ তথা দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক লকেট চট্টোপাধ্যায়, রাজ্য সহ সভাপতি ভারতী ঘোষের মত গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেত্রী হেরে গিয়েছেন। হেরেছেন শ্রাবন্তী-পায়েল-তনুশ্রী-পার্ণো-অঞ্জনার মত অভিনেত্রী প্রার্থীরাও। 
প্রসঙ্গত, এবার চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী বাংলায় পুরুষ ও মহিলার আনুপাতিক হার ১০০০:৯৫৬। অর্থাৎ হাজার জন পুরুষ-পিছু মহিলা ৯৫৬। জনগণনার আনুপাতিক হারকে পিছনে ফেলে দিয়েছে এটা। ২০১১-র জনগণনা অনুযায়ী এই হার ছিল ১০০০:৯৫০। ২০১৯ সালের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী পুরুষ-মহিলার অনুপাত ছিল ১০০০:৯৪৯। ২০১৮-য় ছিল ১০০০:৯৪২। শেষ তিন বছরে এই বৃদ্ধির হার সাত।
সব মিলিয়ে, সপ্তদশ সরকারের বিধানসভা অধিবেশনে নজর কাড়বেন মহিলারা। অর্ধেক আকাশ এবার আরও সম্প্রসারিত, আরও নজরকাড়া। শনিবার বসছে নয়া বিধানসভার প্রথম অধিবেশন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.