যা এখানে লিখবো, তার বিষয়বস্তুর নির্মাণ ও বিনির্মাণ সমপরিমাণে আকর্ষণীয় – জটিল, কুটিল, খুদিত পাষাণের ইতিবৃত্তের মত অধরা। তবে কেন এই প্রয়াস. কারণ অনুসন্ধানী গবেষকের কাজই হল সত্য ইতিহাস নির্মাণের পথকে সুগম করা। এবার ঝুলি থেকে বেড়ালটাকে বের করা যাক। লেখনীর বিষয় – স্বাধীনতা উত্তর পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু দলিত গণহত্যার ইতিবৃত্তে মরিচঝাঁপি। বিষয়টি বাম জমানায় সংঘটিত আর তাদের প্রয়াসে শীত ঘুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয় গোটা বিষয়টিকে। শুধু কয়েকজন গবেষক তাদের নিজেদের জীবনকে বাজি রেখে জন–পরিসরে বিষয়টিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন । কিন্তু তাদের কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে দিয়ে খুদিত পাষাণের সেই উন্মাদের সাবধানী সুতীক্ষ্ণ চিৎকার দীর্ঘ সময়ব্যাপী বাঁচিয়ে রাখে তৎকালীন বামশাসক গোষ্ঠী – “এসব ঝুট হ্যায়”>
গণহত্যা কেন?
প্রথমেই বলা ভালো কেন এই ঘটনাকে গণহত্যা বলব। আমাদের জানতে হবে, হত্যা ও গণহত্যার মধ্যে পার্থক্য কোথায়। পৃথিবীর যে কোন শাসকগোষ্ঠী যখন তাঁর ইতিহাস রচনা করে, তখন সযত্নে কেন গণহত্যার অধ্যায়কে বাদ দিয়ে যায় – তার কারণও লুকিয়ে আছে এর মধ্যে।
জেনোসাইডের অর্থ হিসাবে বাংলায় বলা হয় গণহত্যা। কিন্তু এই শব্দটি আসলে সঠিক নয়, যে কোনো গণহত্যাই জেনোসাইড নয়। জেনোসাইডের আসলে সঠিকভাবে বোঝাতে আমরা গোষ্ঠী ও জাতি নিধন বলতে পারি। যখন কোনো রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী অন্য কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ নির্মূল করে ফেলে তখন তাকে জেনোসাইড বলে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং উগ্র জাতীয়তাবাদ সাধারণত জেনোসাইডের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমি এখানে দেখাতে চেষ্টা করব তথ্য আর তত্ত্বের মাধ্যমে কেন বাম–আমলে সংঘটিত হিন্দু–দলিতদের (নমঃশূদ্র) যেভাবে মরিচঝাঁপিতে গণ–হত্যা করা হয়, তা জেনোসাইডের বৈশিষ্ট্যগুলির ক্ষেত্রে বা সংজ্ঞায়নের ক্ষেত্রে নতুন সংযোজন হিসাবেই গৃহীত হবে ।
প্রতিটি জেনোসাইডের ক্ষেত্রেই ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনকে ব্যবহার করা হয়েছে জেনোসাইডের অস্ত্র হিসাবে। হিসাবটা একদম পরিষ্কার, একটি জাতির মহিলাদের অপমান করতে পারলে, তুলে এনে ধর্ষণ করতে পরলে বা যৌনদাসী বানাতে পারলে সেই জাতির মেরুদণ্ড এবং মনের জোর উভয়েই ভেঙে পড়ে। জেনোসাইড–এর অস্ত্র হিসাবে গুলি, বন্দুক, বোমা ছাড়াও আরেকটা জিনিসকে বারবার কাজে লাগানো হয়েছে, তা হল কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। যে যে অঞ্চলের জনজাতির উপর তোমার রাগ সেখানে খাদ্যের যোগান বন্ধ করে দাও। ধ্বংস করে দাও চাষের জমি ক্ষেতের ফসল।
জেনোসাইডের বিভিন্ন উৎসগুলি হল :
প্রথম ধাপ : সামাজিকভাবে ‘ওরা‘ এবং ‘আমরা‘ নীতির প্রতিষ্ঠা ।
দ্বিতীয় ধাপ : ঘৃণার পরিবেশ সৃষ্টি ও মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ সঞ্চার ।
তৃতীয় ধাপ : এক গোষ্ঠীর অন্য গোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষের কারণে তাদেরকে নির্যাতন করা, এক ঘরে করে দিয়ে তাদের পশুদের সাথে বাস করতে বাধ্য করা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাস করার ফলে বিভিন্ন মরণ মারণ রোগের প্রকোপে পোকামাকড়ের মত মৃত্যু ।
চতুর্থ ধাপ : জেনোসাইড ভীষণ রকম সংগঠিত ।
পঞ্চম ধাপ : মেরুকরণ প্রক্রিয়া নীতির অবসান ।
ষষ্ঠ ধাপ: ধর্মীয় ও সামাজিক অবস্থানের জন্য বিপক্ষীয় জাতিকে পৃথকীকরণ করা ও হিংসা পুষে রাখা তাদের বিরুদ্ধে।
সপ্তম ধাপ : হত্যা করার কারণ হিসাবে প্রচার করা যে বিপক্ষ জাতি মানুষের সমাজে থাকার অযোগ্য । তাই মানবিক কল্যাণের জন্য তাদের মৃত্যুই শ্রেয় ।
অষ্টম ধাপ: অপরাধীরা কখনও একে হত্যাকাণ্ড বলে উল্লেখ করবে না ।
দেশ ও বিভাজন
এ দেশ কথাটি অনুল্লেখিত থাকার কারণে আরো নানান ভাগের ইশারা আমন্ত্রিত । “ভাগ’ কথাটা এখানে সর্বাত্মক : দেশের ভাগ, মানচিত্রের ভাগ, আত্মা, সম্পর্ক, যোগাযোগ – এমন কি আমার লিখিত “আমি’টিরও ভাগ, পার্টিশন আমার সর্বস্ব ; আমার সত্তাকেই বিভক্ত করে রেখেছে। পার্টিশান –এর সর্বাত্মক কথা বলে, সব কিছু ভাগাভাগির কথা বলে । এই অর্থেই শেষ পর্যন্ত একটা তারিখ ( ১৫ আগস্ট ) হয়ে থাকে না, হয়ে ওঠে একটি প্রক্রিয়া । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর–প্রজন্মের বাঙালি পাঠকের কাছে পার্টিশনকে দেখা–জানা–ছোঁয়ার এখন কিন্তু প্রাসঙ্গিক সমস্যা ও বিশেষত্ব তৈরী হয়েছে যা নিয়ে নতুন কথা চালাচালি শুরু হওয়া দরকার । দেশভাগের মোট প্রজন্ম হন্তারক ঐতিহাসিকতা নিয়ে তো এই প্রজন্ম আসেনি । ক্রমাগত ঐতিহাসিক হতে থাকা পার্টিশন ভাবনা থেকে থেকে সমাজতত্বের বিশ্লেষণ জমতে পারে, সাহিত্য নয় । যে বদল পার্টিশনকে আর নির্মিত ঐতিহাসিকতার বয়ানে বোঝে না, বরং উপমহাদেশের মানবিক সঙ্কটের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে সমকালের বিষয় করে তোলে। কখনো সেই বিভাজিত দেশ – সীমানা ভৌগোলিক, কখনো মানবিক, কখনো বা সামাজিকতার বিভিন্ন স্তরে সরে সরে যায় । নিয়ত স্থানাঙ্ক পরিবর্তনশীল এই বিভাজনের সীমান্তই পুরুষ নারী, ক্ষমতা–অক্ষমতা, বর্ণ–পতিত, দলিত–ব্রাহ্মণ, এপার–ওপর ইত্যাদি বিপ্রতীপতায় জায়মান থাকে আজকের সমাজে।
উত্তর–প্রজন্মের দেশভাগের কোনো প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকে বাংলা উপভাষার এমন কিছু চিহ্ন যার সামাজিক পরিচয়ে মিশে থাকে উঁচু / নীচু, গৃহীত/অগৃহীত, সম্মান/অসম্মানের স্বীকৃতি। চারপাশের সামাজিক পরিসরে ক্রমাগত সে চলে যেতে দেখছে এমন এমন ব্যক্তিত্বদের যাদের যে আশ্রয় বলে জেনেছিল। শহরের কলোনি এলাকায় তার অভিজ্ঞতার মধ্যে আসে পাড়া–মহল্লার উত্তেজক সমষ্টিবোধ–যার উত্তেজনায় সে নিজেকে সোঁপে দেয় ফুটবল–ক্রিকেট ম্যাচের আবহে। কলোনির সমষ্টিবদ্ধ জীবন তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ভোটার সময় – সে দেখে কিভাবে প্রতিদিন হাত বদল হয়ে যাচ্ছে তার উন্নয়নের মালিক। গণতন্ত্র তাকে দিয়েছে ভোটার অধিকার, সেই অধিকার ন্যূনতম মূল্যে বিক্রি করে সে হয়ে ওঠে গণতন্ত্রের বিধাতা ।
৪৭–এর দেশভাগ পরবর্তী খুন–ধর্ষণ, ছিন্নমূল মানুষদের পালানোর প্রচেষ্টা ইতিহাস, উদ্বাস্তু মানুষদের মিছিল আর শরীরী ভাষা চারিত্র্যের একেবারেই আলাদা। করাচি–ইসলামাবাদ–পশ্চিম পাঞ্জাবকে দেখতে হয়নি উত্তর–দাঙ্গা, উদ্বাস্তু মিছিল বা ধর্ষিতা নারীর লাশ। বিভাজনের রাজনীতির পিঠোপিঠি এসেছিল বিভাজন–উত্তর রাজনীতি, বিভাজনের পাশাপাশি ঘটেছিল “বিভাজনের মধ্যে বিভাজন“।
পুনর্বাসনের নামে চরম অব্যবস্থা
ডিসেম্বর ১৯৪৯ খুলনা এবং ১৯৫০, ৮ই ফেব্রুয়ারী বরিশাল ও ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবার পর এক লাখের কাছাকাছি মানুষ ভারতে চলে আসেন। এরপর আসেন ব্যবসাদার শ্রেণী। এরফলে ৮ই এপ্রিল ১৯৫০ সালে নেহেরু–লিয়াকৎ চুক্তি সম্পাদিত হয়। ১৯৫২ সালে পাসপোর্ট–ভিসা চালু হবার পর দু–লক্ষ এবং পরবর্তী মাসগুলোতে গড়ে ১০ হাজার করে মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আসেন। ১৯৫৫ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় সীমান্ত পার হতে থাকেন মাসে ৩০ হাজার। ১৯৫৬ সালের থেকে মাইগ্রেসন ছাড়া ভারতে আসার অনুমতি দেওয়া হলো না। ২৬–শে ডিসেম্বর ১৯৬৩ শ্রীনগর হজরতবাল মসজিদ থেকে কেশ চুরি যাবার ঘটনায় সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে দাঙ্গা হয়। তখন বহু হিন্দুরা, বিশেষ করে শ্রমজীবী মানুষেরা ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৬৪ সালে যারা পশ্চিমবঙ্গে এলেন, তাদের জন্য কোনো ক্যাম্প খোলা হল না। রিসিভিং সেন্টার থেকে চিরকুট ধরিয়ে বিভিন্ন স্টেশন থেকে তাদের সরাসরি দণ্ডকারণ্যে পাঠানো হল। এরাই হচ্ছে সরকারের বাড়তি বোঝা এবং তথাকথিত “আপদ“। এই আপদগুলোকে মানুষ ভাবা হয়নি। তাই নানা শিবিরগুলোতে এদের জেল–খানার আসামীদের চেয়েও চরম অব্যবস্থার মধ্যে রাখা হয়েছিল। ৮–১০ বছর নারকীয় ক্যাম্প জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে ফেলা হয়েছিল দণ্ডকারণ্যে।
দণ্ডকারণ্যের মূল যে জায়গা থেকে ব্যাপকহারে মরিচঝাঁপিতে (সুন্দরবনের অন্তর্ভুক্ত) চলে আসে উদ্বাস্তুরা, সেটা ছিল সরকারী উদ্বাস্তু পূর্বাসনের পরিকল্পিত স্থান উড়িষ্যার মালকানগিরি।
ভারতবর্ষে পূর্ববঙ্গের বাঙালি উদ্বাস্তুদের জন্য সব থেকে বড় যে ট্রানজিট ক্যাম্প খোলা হয়েছিল তা তখনকার সময়ের মধ্যপ্রদেশের রায়পুর জেলার “মানা ক্যাম্প“। তার আশেপাশে মানার অন্তর্ভুক্ত আরও কতগুলি ক্যাম্প খোলা হয়েছিল, যেমন – ট্রানজিট ক্যাম্প। এই সমস্ত ক্যাম্পগুলি খোলা হয়েছিল মুরাম বিছানো মরুর বুকে মরুর বুকে দিগন্ত বিস্তৃত খোলা ময়দানে। দুরন্ত তাপদাহে যে লাল কালো লৌহ সদৃশ্য মুরাম খনিতে কোনো উদ্ভিত জন্মাতে সাহস করে না, সেই নিষ্ঠুর বন্ধ্যা জমিতে অসংখ্য তাঁবু ফেলে শস্য–শ্যামল সোনার বাংলার মানুষগুলিকে এনে ছেড়ে দিয়েছিল তৎকালীন সরকারী প্রশাসকরা।
পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের ভাগ্য নিয়ন্তাগণ যেভাবে ভাগ্য নির্ধারণ করেছিলেন, তার মধ্যে দুর্ভাগ্যের অশনি সংকেত পেয়ে ক্যাম্পগুলিতে উঠেছিল প্রবলভাবে প্রতিবাদের ঝড়।এই প্রতিবাদে সমস্ত ক্যাম্পের মানুষগুলি সমস্বরে বলে পিঠেঁ “আমরা বাংলা মায়ের সন্তান। আমাদেরকে আমাদের মাতৃক্রোড়ে বঙ্গভূমিতে পুনর্বাসন দেওয়া হোক।“
এই দাবিতে সমস্ত উদ্বাস্তুদের নিয়ে গড়ে ওঠে “উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতি” এই সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন শ্রী সতীশ মণ্ডল, শ্রী রঙ্গলাল গোলদার, শ্রী রাইচরণ বারুই, শ্রী অরবিন্দ মিস্ত্রী, প্রমুখ ব্যক্তিগণ। তখনকার সময় কর্তা ছিলেন কর্নেল নন্দী সাহেব। সমিতির পক্ষ থেকে নন্দী সাহেবের কাছে বঙ্গভূমিতে পুনর্বাসনের আবেদনপত্র দাখিল করা হয়। শুরু হয় বিশাল বিশাল মিছিল, অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট, আমরণ অনশন।
দণ্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ তৈরী হয়েছিল উড়িষ্যার কোরাপুট জেলা ও মাধ্যপ্রদেশের(বর্তমান ছত্রিশগড়) বস্তার জেলার ২৫০০০ বর্গমাইল অবহেলিত বন নিয়ে ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৮ সালে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্বাস্তুদের এনে প্রথম পুনর্বাসন দেওয়া হয় বস্তার জেলার ফরাসগাঁও অঞ্চলে তিনটি গ্রামে ১৯৫৮ সালে। এখানে কৃষি জমিতে দেওয়া হয় ১০৫টি পরিবার ও ক্ষুদ্রশিল্পে ৪৫টি পরিবার। দ্বিতীয় পত্তন হয় উড়িষ্যার কোরাপুট জেলার উমরকোট অঞ্চলে। ১৪টি গ্রামে ১২৪০টি পরিবার বসানো হয়। রায়পুর অঞ্চলে বসানো হয় ২৪টি গ্রামে ১৫৪৫টি পরিবার। তৃতীয় পাখানজোড় জন্যে বসানো হয় ৪৫টি গ্রামে ২২৩৯টি পরিবার। সবশেষে পত্তন হয় মালকানগিরির ২৩টি গ্রামে ১০২৩টি পরিবার।এখানের এই জোনটি ছিল পরিকল্পনাহীন।
বাম রাজনীতির শিকার
উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির পক্ষ থেকে সতীশবাবু চিঠিপত্রের মাধ্যমে সমস্ত পুনর্বাসন কেন্দ্রের উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এসে সরকার গঠন করেছিল। ১৯৭৮ সালের জানুযারী মাসে বামফ্রন্ট সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী রাম চ্যাটার্জী ও পশ্চিমবঙ্গ ফরওয়ার্ড ব্লকের সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ বহিঃবাংলার উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রে যথা মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর, মধ্যপ্রদেশের পারুলকোট, অন্ধ্রপ্রদেশের কাগজনগর, উড়িষ্যার উমরকোট, মালকানগিরিতে গিয়ে বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দিয়ে বলেন, “কংগ্রেস সরকার আপনাদের দণ্ডকারণ্যে এনে পুনর্বাসিনের নামে যে নির্বাসন দিয়েছে, এটা আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। আপনাদের এই অবর্ণনীয় দঃখদুর্দশা সত্যিই দেখা বা সহ্য করা যায় না। আমি ফিরে গিয়ে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুকে অবশ্য আপনাদের এই চরম দুর্গতির কথা জনাব। আপনারা চিন্তা করবেন না। আপনাদের দাবি মেনে সুন্দরবনে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।“
অশোকবাবুকে বলেন “আপনারা পশ্চিমবাংলায় এলে পশ্চিম বাংলার ৫ কোটি মানুষের দশ কোটি হাত আপনাদের সমর্থনে গর্জে উঠবে। … আমাদের ডাক এলেই, আপনারা সকলে পশ্চিম বাংলায় চলে আসবেন।“
১৯৭৮ সালের ফেব্রুযারী মাস থেকেই শুরু হয়ে গেল সুন্দরবন যাওয়ার প্রস্তুতি । দণ্ডকারণ্য সহ অন্যান্য সকল পুনর্বাসন অঞ্চলে সমিতির পোট্রোনমাধ্যমে খবরাখবর হয়ে গেল, “এবার আমাদের সুন্দরবন রওনা হতে হবে। যেভাবে পারেন সুন্দরবন যাত্রা করুন । “
দিন কয়েকের মধ্যেই তখন মরিচঝাঁপিতে হাজার হাজার পরিবার একত্রিত হয়ে গেল। সমস্যা দেখা দিল পানীয় জল ও খাদ্যে। এখানে প্রশ্নটা আসে – – বামফ্রন্টের নেতাদের ভূমিকা কি ছিল ? C.P.I.(M) এর মদতপুষ্ট উদ্বাস্তু সংগঠন U.C.R.C. – এর ভূমিকা কী ছিল ? সর্বোপরি বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিকা কি ছিল ?
– এই প্রশ্নগুলির মধ্যেই শীতঘুমে চাপা দিয়ে দেওয়া হয় – এই ভারতবর্ষে তথা পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্টদের দ্বারা সংঘটিত মরিচঝাঁপি গণহত্যার নীতিকথার জীবন্ত আর্কাইভাল। শুধু বেঁচে থাকে ক্ষুদিত–পাষাণের সেইসব কন্ঠস্বর – ” তফাৎ যাও – এসব ঝুট হ্যাঁয়,….ঝুট হ্যাঁয় – এর মত পাগল করে দেওয়া অমানবিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মানুষেরা। মরিচঝাঁপিতে নেতাজী বিদ্যাপীঠের প্রধান শিক্ষক নির্মল কান্তি ঢালীর লিখিত বর্ণনা থেকে জানতে পারি – “বেসরকারি কয়েকটি ত্রাণ সংস্থা কিছু কিছু খাদ্যের ব্যবস্থা করতে শুরু করল। কিছু জিনিসপত্র জুগিয়ে দেওয়ায় আমরা পানীয় জলের ব্যবস্থাও করলাম। নলকূপে এত সুন্দর জল উঠল যা পশ্চিমবঙ্গে বিরল। ত্রাণ সংস্থার পক্ষ থেকে এবং অনেক হৃদয়বান ব্যক্তি ঔষধপত্র, খাদ্যবস্ত্র , কম্বল দান করতেন। সকল কর্মীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সরকারি কোনোরূপ সাহায্য ছাড়া গড়ে উঠল একটা সুন্দর পরিবেশ। নতুন নগরীর নামকরণ হল “নেতাজী নগর“। স্কুলের নামকরণ হল নেতাজী নগর উচ্চ বিদ্যাপীঠ। স্কুলের বিদ্যার্থীর সংখ্যা চার হাজার হবে। পরে শিক্ষক–শিক্ষিকার সংখ্যা পঁচিশ হয়েছিল ।
২৪/১/১৯৭৯ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গ বাম সরকারের পুলিশ বাহিনী মরিচঝাঁপিতে আমাদের অবরুদ্ধ করে দেয় খাদ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধ করে আমাদের খাদ্য, পানীয় সবকিছুর যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়, খাদ্যের অভাবে ঘরে ঘরে কান্নার রোল ওঠে, পুলিশ দিনরাত আমাদের চারদিকে টহল দিতে থাকে, খাদ্যের অভাবে মানুষ গাছের পাতা, ঘাস, মাছ সিদ্ধ করে খেতে শুরু করে, ওখানে একপ্রকার লবণ ঘাস জন্মায় – স্থানীয় লোকে বলে যদুঘাস । মহানুভব মুখ্যমন্ত্রীর নাম অনুসারে ঐ ঘাসের নাম আমরা দিয়েছিলাম “জ্যোতি পালং। ”
দলিত উদ্বাস্তুগণ আন্দোলনের নেতা নিরঞ্জন হালদারের লেখনী থেকে জানতে পারি – প্রথম দিকে যুগান্তর ও আনন্দবাজার পত্রিকায় অজিত চক্রবর্তী ও জ্যোতির্ময় দত্তের রিপোর্ট ছাপা হচ্ছিল, পরে তাও বন্ধ হয়ে যায় ।
শৈবাল গুপ্তের মত কিছু ব্যক্তি প্রতিমাসে মরিচঝাঁপিতে কিছু অর্থ সাহায্য পাঠাতেন। জ্যোতির্ময় দত্তের উদ্যোগে দেবব্রত বিশ্বাস, সুচিত্রা মিত্র, গীতা ঘটক, আসক্তরা বান্দ্যেপাধ্যায়, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অর্ঘ সেন একটি অনুষ্ঠানে গান গেয়ে মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের জন্য টাকা তুলতে সাহায্য করেছিলেন। সন্তোষ কুমার মল্লিক কেন্দ্রীয় সরকারের তফসিলি ও আদিবাসী কর্মীদের সংগঠনের মাধ্যমে মরিচঝাঁপিতে বাসিন্দাদের জন্য টাকা তোলা ছাড়া সরকারি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচার শুরু করেন । শক্তি সরকারের চেষ্টায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার তৎকালীন জনতা দলের এম.এল.এ.-রাও কয়েকজন মরিচঝাঁপি যান।
দণ্ডকারণ্য থেকে মরিচঝাঁপিতে এসে তাঁরা সরকারি সাহায্য ছাড়াই নিজেদের পুনর্বাসন দিতে দৃঢ়সংকল্প ছিল। তাঁরা ওই সময়ে “দেড়শত মাইল বাঁধ বেঁধেছেন এবং শরীরের রক্ত জল করে অনাহার ও অর্ধাহারে থেকে নিজেদের চেষ্টায় সমবায় পদ্ধতিতে সাতটি বড় ও অজস্র ছোট ভেড়ি করেছেন। ৭টি ভেড়ির মাছ বিক্রি করে সেইসময় কমপক্ষে ১৪ কোটি টাকা মিলত। কাঠ চেরাই, কাঠের আসবাব এবং নৌকা তৈরির প্রধান কেন্দ্র হল মরিচঝাঁপি। স্কুল এবং হাসপাতাল তো ছিলই, রুটি তৈরী কারখানার রুটি এবং মরিচঝাঁপির বিড়ি সুন্দরবনের অন্যান্য দ্বীপের চাহিদা মেটাতো।
২৪শে জানুযারী অবরোধের পর থেকে অখাদ্য–কুখাদ্য খেয়ে ও বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে ২৩৯ জন, ২৪শে জানুয়ারী থেকে মহিলাদের উপর ধর্ষণ ও পাশবিক অত্যাচার – ২৩ জন, ৩১শে জানুয়ারীর পর থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যা – ১২৮ জন। ৩১শে জানুয়ারী গ্রেফতার হয়ে বসিরহাট ও আলিপুর জেলে আটক – ৫৩ জন, অন্যান্য স্থান থেকে ১৩০ জন মরিচঝাঁপিস্থিত উদ্বাস্তুদের গ্রেপ্তার করা হয়, ২৪শে জানুয়ারী থেকে ২৪শে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে পুলিশ মালপত্র ছিনতাই করেছে ১১৩ জনের কাছ থেকে। (মরিচঝাঁপি : নৈঃশব্দের অন্তরালে – জগদীশ মন্ডল, পৃ : ৯৩–১৩০)
এই গণহত্যার পর্বতীকে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার কীভাবে সংঘটিত করেছিল তা আমরা “উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির একটি প্রচার পত্র” থেকে বুঝে নিতে পারি –
উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতির একটি প্রচারপত্র
পশ্চিমবঙ্গের ভাই ও বোনের কাছে মরিচঝাঁপির অসহায় বাঙালি উদ্বাস্তুদের করুণ আবেদন :-
আমরা মরিচঝাঁপির অবরুদ্ধ অসহায় উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে আপনাদের কাছে আবেদন জানাচ্ছি। বিগত ১৪/১/৭৯ তারিখ থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুলিশ বাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হয়ে আছি। খাদ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধ করে আমাদের খাদ্য ও সবকিছুর যোগাযোগ বন্ধ করে হয়েছে। খাদ্যের অভাবে আমাদের ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছে । পুলিশের লঞ্চ দিনরাত আমাদের চারিদিকে টহল দিয়ে ফিরছে। খাদ্যের অভাবের তাড়নায় মানুষ গাছের পাতা চিবিয়ে খাচ্ছে। ওই অবরোধের ফলে ইতিমধ্যে অনাহারে ৮১ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছে। সরকারের বক্তব্য দণ্ডকারণ্যে ফায়ার না গেলে আমাদের না খাইয়ে শুকিয়ে মারা হবে।
শুধু অবরোধ করেই ওরা ক্ষান্ত হয়নি। ২৮/১/৭৯ তারিখে তৃষ্ণার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে আমাদের মেয়েদের বোঝাই কয়েকটি নৌকা নেতাজীনগর থেকে কুমিরমারীর পারে জল আন্তে যাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের লঞ্চ ধাক্কা মেরে নৌকাগুলি ডুবিয়ে দেয় এবং তাদের উপর চার রাউন্ড টিয়ার গ্যাস বর্ষণ করে। মেয়েদের উপর ওই পাশবিক অত্যাচার দেখে কুমিরমারীর জনসাধারণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে, পুলিশ তাদের উপর পাঁচ রাউন্ড টিয়ার গ্যাস বর্ষণ করে। এই ঘটনায় তিনটি মেয়ে মৃতপ্রায়। ২৯/১/৭৯ তারিখে ওরা আমাদের মাছের ভেরির বাঁধা খাল কেটে দেয়। ফলে, উদ্বাস্তুদের সঙ্গে পুলিশের তর্কের সূত্রপাত হয়। পরে বেলা ২ টো থেকে ৪ টে পর্যন্ত পুলিশের লঞ্চ থেকে অগণিত টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়। এদিন গুরুতরভাবে আহত হন সুনীল, মালোটি পাল এবং অশ্বিনী সরকার শোঃ আরও কয়েকজন। ৩০/১/৭৯ তারিখে একটি লঞ্চ কিনারে এসে জানতে চায়, আমরা দণ্ডকারণ্যে যাব কিনা। উদ্বাস্তুরা সমস্বরে চিৎকার করে বলেন, “আমরা যান দেব কিন্তু দণ্ডকারণ্যে যাব না। ” তখন লঞ্চগুলি আগের চেয়ে সক্রিয় ও তৎপর হয়ে ওঠে এবং রাত একটার সময় বিনা প্ররোচনায় উদ্বাস্তুদের ওপর আবার ১০ রাউন্ড টিয়ার গ্যাস ছোড়ে। অত্যাচার আরও বীভৎস আকার ধারণ করে। ৩১/১/৭৯ তারিখ বুধবার পুলিশ, প্রায় সকাল ১০টা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে আমাদের দিকে টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। এদিকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় অতিষ্ঠ হয়ে কয়েকটি নৌকা নিয়ে আমাদের কিছু ছেলে মেয়ে খাদ্য ও পানীয় জল আনবার জন্য ওপারে যাত্রা করে। কিন্তু পুলিশ মাঝ নদীতে লঞ্চের ধাক্কায় বেশ কয়েকটি নৌকা ভেঙ্গে ডুবিয়ে দেয় এবং সমানে তাদের ওপর টিয়ার গ্যাস বর্ষণ করে চলে। তখন ছেলে মেয়েরা নিরুপায় হয়ে সাঁতার কেটে কুমিরমারীর পারে গিয়ে ওঠে। সেখানেও তাদের উপর একইভাবে টিয়ার গ্যাস ছোড়া চলতে থাকে। ওপারের স্থানীয় জনসাধারণ এই ব্যাপারে যথেষ্ট ভিড় করে এগিয়ে আসে এবং উত্তেজনা ক্রমেই বেড়ে চলে। প্রায় ৩ টার সময় পুলিশ তাদের উপর লঞ্চ এবং স্থল থেকে সমানে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। শুধু গুলিই নয়, তার সঙ্গে বেপরোয়াভাবে টিয়ার গ্যাসও তাদের উপর সমানভাবে বর্ষণ করে চলে। নেতাজীনগরের পারে পুলিশ ২ রাউন্ড গুলি চালায়। কুমিরমারীর পারে চালায় ৩০ রাউন্ড। মোট ৩২ রাউন্ড গুলি চালায়। সঙ্গে সঙ্গে ছেলে, মেয়ে, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে পৈশাচিকভাবে নির্বিচারে লাঠিচার্জ চলতে থাকে।
ওই সময় পুলিশ একজন স্থানীয় লোকের বাড়ি ঢুকে শিশু সন্তান সহ এক মহিলাকে গুলি করে। তারপর টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে আসে। শিশুটির গায়ে গুলি না লাগে সে বেঁচে যায়। সন্তান মায়ের মৃত্যুতে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে পুলিশ তাকে ধরে পেটাতে পেটাতে লঞ্চে নিয়ে যায় এবং তাকে গুলি করে মারতে উদ্যত হয়। কিন্তু অফিসারের নির্দেশে তাকে গুলি না করে লাঠি মেরে লঞ্চ থেকে ফেলে দেওয়া হয়। একই সময় একটি ৫ বৎসরের শিশুকে গলায় পা দিয়ে দম বন্ধ করে মারা হয়। এই নির্মম পৈশাচিক গুলিকাণ্ডে উদ্বাস্তু ও স্থানীয় সহ নিহতদের সংখ্যা মোট ৩০ জনের মত। উক্ত ৩০টি মৃতদেহ ঘটনার দিন সন্দেশখালি থানায় নিয়ে যাওয়া হয় এবং ছোরা দিয়ে প্রত্যেকটি মৃতদেহের পেট কেটে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে আহত অর্ধমৃত কিছু লোক ছিল, তাদেরও বেয়নেট দিয়ে নির্মম ভাবে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়। উক্ত মৃতদেহের একটি গাড়াল নদীতে পাওয়া গেছে। আর বেশ কয়েকটি মৃতদেহ কলাকাছিয়া যদি থেকে তোলা হয়েছে।
পরদিন ১/২/৭৯ তারিখ স্থানীয় জনসাধারণ স্থানীয় লোকের মৃত্যতে এবং উদ্বাস্তুদের উপর সরকারি নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বাগনা পুলিশ ক্যাম্পে মিছিল নিয়ে যান। পুলিশ তাদের ওই মিছিলের উপর ২ রাউন্ড গুলি চালায়। তাতে স্থানীয় একজন আহত হন। সমগ্র ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ মহিলা সহ ৫০০ জনের উপর উদ্বাস্তুকে জেলে আটক করে।
এই শোকাবহ অত্যাচারের ঘটনা আমরা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরার আবেদন জানাচ্ছি, আপনারা জানুন কেন আজ আমাদের এ অবস্থার ভিতর পড়তে হল। দেশ বিভাগের জন্য আমরা দায়ী নই । কিন্তু কেন দেশ বিভাগের ফলে মাতৃভূমি ত্যাগ করে আমরা সাজলাম অভিশপ্ত বাস্তুহারা ? কেন আমাদের দণ্ডকারণ্যে নিয়ে যাওয়া হল ? কোন আমরা দণ্ডকারণ্য ত্যাগ করলাম ? কেন শেষ আশ্রয় হিসাবে সুন্দরবন বেছে নিলাম ? এর জন্য বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃবৃন্দ কতখানি দায়ী তার জন্য কিছু সংক্ষিপ্ত বিবরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরছি –
১। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধান রায়ের আমলে যখন উদ্বাস্তুদের দণ্ডকারণ্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন বামফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ যথা – জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত, রাধিকা ব্যানার্জি প্রমুখ দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁদের দাবি ছিল বাঙালি উদ্বাস্তুদের বাংলাতেই পুনর্বাসন দিতে হবে। তাঁরাও সুন্দরবনের দাবি করেছিলেন, উদ্বাস্তুদের জন্য।
২। প্রফুল্ল সেনের আমলে জ্যোতি বসু একসময় “দণ্ডকের কান্না বন্ধ কর” বলে স্লোগান তুলেছিলেন। ওই সময় তিনি আবার বলেছিলেন, “দণ্ডকারণ্য বাঙালিদের বসবাসের উপযুক্ত জায়গা নয়। ” তিনি এ সম্পর্কে জোরদার আন্দোলনও করেছিলেন।
৩। ১৯৭৩ সালের ২৫ জানুয়ারী ভিলাইয়ের জনসভায় যোগদানের জন্য জ্যোতি বসু পত্র মারফত উদ্বাস্তুদের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ওই জনসভায় তিনি উদ্বাস্তুদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “আমরা ক্ষমতায় না–আসা পর্যন্ত উদ্বাস্তুদের এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। আমরা ক্ষমতায় এলে সুন্দরবনের দাবি অবশ্যই পূরণ করব। “
৪। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে মধ্যপ্রদেশের শহিদভাটাতেও উদ্বাস্তুদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্ত করতে এসেছিলেন প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী, সুহৃদ মল্লিকচৌধুরী ও সময় মুখার্জী। তাঁরা ওই গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করেছিলেন।সমর মুখার্জী দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, “যে সুন্দরবনের দাবি নিয়ে আপনারা আজ গুলি খেলেন, আমরা ক্ষমতা পেলে আপনাদের সুন্দরবনের দাবি আমরা পূরণ করব। “
৫। ১৯৭৫ সালে মে মাসে মানাতে অনুষ্ঠিত তিনদিন ব্যাপী সর্বভারতীয় উদ্বাস্তু সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন শ্রী রাম চ্যাটার্জী, কৃপাসিন্ধু সাহা এবং সারা ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শ্রী জাম্বুবন্ত রাও ধোতে । তাঁরাও সুন্দরবনের দাবিকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেছিলেন।
৬। ১৯৭৫ সালের জুন মাসে কলকাতায় সিপিএমের প্রাদেশিক অফিসে দণ্ডক উদ্বাস্তুদের নিয়ে জ্যোতিবাবুর সভাপতিত্বে অষ্টবামের নেতৃবৃন্দের একটা সভা হয়। উক্ত সভায় এই সুন্দরবনের দাবিকে সমর্থন জানিয়ে পশ্চিমবঙ্গের তদানীন্তন রাজ্যপাল এ এল ডায়াসের কাছে এক স্মারকলিপি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং এই দাবির সমর্থনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলী আহমেদ সাহেবের কাছে এক গনডেপুটেশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
৭। বর্তমান ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকারের মাননীয় মন্ত্রী রাধিকাবাবুর কাছে ১৯৭৭ সালে দণ্ডক উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে এক স্মারকলিপির মাধ্যমে এক আলিমেটাম দেওয়া হয়। তাতে বলা হয় যদি আপনারা দণ্ডক উদ্বাস্তুদের সম্বন্ধে কোনো ব্যবস্থা না করেন, তাহলে তারা পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য হবেন।
৮। এর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকারের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীরাম চ্যাটার্জী, বিধানসভার সদস্য রবিশঙ্কর পান্ডে, কিরণময় নন্দ ২৮/১১/৭৭ তারিখে দণ্ডকারণ্যে সরেজমিন তদন্ত করতে যান । চারদিনের তদন্তে বিভিন্ন জনসভায় রামবাবু বলেন, “সরকার পুনর্বাসনের নামে আপনাদের নির্বাসন দিয়েছেন, তা আমরা তদন্ত করে দেখলাম। আমার সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে একথা জানাবোই, এবং এ সমস্যার সমাধান করতেই হবে।“
৯। রামবাবুদের তদন্তের পর দণ্ডক উদ্বাস্তুদের পক্ষ থেকে এক প্রতিনিধি দল ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭৭ মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতিবাবুর কাছে এক ডেপুটেশনে যান। তাঁর কাছে স্মারকলিপির মাধ্যমে এক আল্টিমেটাম–এ জানানো হয় অতি সত্বর যদি দণ্ডক উদ্বাস্তুদের কোনো ব্যবস্থা না করা হয়, তাহলে তারা অতি সত্বরই পশ্চমবাংলায় চলে আসবেন। তিনি তখন বলেছিলে। “পশ্চিমবঙ্গে ফুটপাথে বহু লোক বাস করে, আপনারা তাদের মত বসবাস করবেন। আমার সরকার কংগ্রেস সরকারের মতো আপনাদের লাঠিপেটা করবে না বা গুলি করবে না। “
১০। জ্যোতিবাবুর পরামর্শ অনুযায়ী পুনরায় রামবাবু ও বামফ্রন্ট কমিটিৰ সম্পাদক অশোক ঘোষ ১৬/১/১৯৭৮ তারিখ থেকে ১৯/১/৭৮ তারিখ পর্যন্ত বাংলার বাইরে উদ্বাস্তুদের অবস্থা তদন্ত করতে যান । বিভিন্ন জনসভায় অশোকবাবু বলেন, “আপনারা যদি পশ্চিমবঙ্গে যান, তাহলে পশ্চিমবঙ্গের ৫ কোটি মানুষের ১০ কোটি হাত আপনাদের সমর্থনে গর্জে উঠবে।” রামবাবু বলেন, “দিন আপনাদের আসবেই, আপনারা এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকুন। আমি অতীতেও সঙ্গে ছিলাম, এখনও আছি, ভবিষ্যতেও থাকবো ।“
আমরা দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি যে, আমাদের সংস্থা কোনো রাজনৈতিক সংস্থা নই । আমরা রাজনীতি করি না বা বুঝি না। আমরা যা করছি বাঁচার জন্য করছি। সুন্দরবনে যে আমরা এসেছি এর জন্য প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে বামফ্রন্ট সরকারই দায়ী। আপনারা আমাদের এই সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে নিজেরাই বিচার করুন এর জন্য কে দায়ী ? এই সঙ্গে আমাদের সকরুণ আবেদন, খাদ্য ও অর্থনৈতিক অবরোধ সহ ১৪৪ ধারা সরকারকে উঠিয়ে নিতে বলুন। আমাদের মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচান এবং এই আবেদন করছি যে, আমাদের উপর এই নারকীয় অত্যাচারের বিচার বিভাগীয় তদন্তের ব্যবস্থা করে, প্রকৃত অপরাধীকে জানুন এবং এ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করতে এগিয়ে আসুন।
“জয় হিন্দ”
রাইচরণ বাড়ৈ
(সাধারণ সম্পাদক)
উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতি(সর্বভারতীয়)
নেতাজীনগর(মরিচঝাঁপি)
পোঃ কুমিরমারী, ২৪ পরগনা (পশ্চিমবঙ্গ)
পুনর্মুদ্রণ
এবং অন্যকথা(পত্রিকা) / ৮৪
মরিচঝাঁপির গণহত্যার পরবর্তী পর্বের দৃশ্য কেমন ছিল তা এখানে তুলে ধরছি ১৯৭৯ সালের জুন মাসে (২৫শে জৈষ্ঠ্য, ১৩৮৬) তারিখে “দেশ” পত্রিকার ৪ ৬ বর্ষ ৩২ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখনীর অংশবিশেষ পুনরায় ফিরে দেখার মধ্যে –
“মরিচঝাঁপি এখন জনশূন্য । কয়েক হাজার উদ্বাস্তু মানুষ, জাত দণ্ডকারণ্য ছেড়ে এসে সুন্দরবনের নিবিড় অভ্যন্তরে ছাউনির ঘর তুলে নিতান্ত রিক্ত চেহারার একটি বে–আইনি উপনবেশ নির্মাণ করেছিল, তারা এখন আর সেখানে নেই। তারা আবার দণ্ডকারণ্যে ফিরে গিয়েছে। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকার এই প্রশস্তি দাবি করতে পারেন যে, তাঁদের ইচ্ছা, উদ্দেশ্য ও চেষ্টা শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে। মরিচঝাঁপিতে উদ্বাস্তুরা যেখানে ঠাইঁ নিয়েছিল সেখানে এখন অঙ্গার ছড়িয়ে রয়েছে বলে প্রচারিত সংবাদে বিবৃত হয়েছে। নিতান্ত দিনতাগ্রস্ত কুটিরগুলিকে কে বা কারা পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করেছে, সেটা দেশবাসীর বেদনাহত চিত্তের একটি বিশেষ জিজ্ঞাসা হলেও প্রশাসনিক প্রবক্তা এবং একাধিক মন্ত্রী মহোদয়ও বলেছেন যে, বাইরে থেকে আগত দুষ্কৃতকারীরা মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু উপনিবেশের ঘর পুড়িয়েছে । কিন্তু কারা এহেন নিতান্ত রাক্ষসীর হিংস্রতার অনুগত দুষ্কৃতকারী যারা রিক্ত–নিঃস্ব উদ্বাস্তুর দীনহীন চেহারার ঘরগুলিকে পুড়িয়ে তৃপ্তি লাভ করবে ? খাঁটি দুষ্কৃতকারী এরকম লাভহীন কাজ করে না। বিশেষ কোন রাজনৈতিক দলীয়তার স্বার্থবাদ অবশ্য মনে করতে পারে যে, উদ্বাস্তুর ঘর পুড়িয়ে দেবার অমানুষিক কৃতিত্বও তাদের পক্ষে লাভজনক । রাজ্য সরকার বলতে পারেন তাদের প্রশাসনিক শৌর্য্য জয়ী হয়েছে কিছু সমালোচক বলবেন, রাজ্য সরকার বাঙালি মেরে কাছারি গরম করেছেন। …….মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু উপনিবেশের যত দগ্ধকুটীরের অঙ্গার আগামী বর্ষার জলে ধুয়ে–মুছে নিশ্চিহ্ন হবে। কিন্তু নির্যাতিত উদ্বাস্তুর শত দুঃখের স্মৃতিচিহ্ন তো জনজীবনের অন্তর্লোকের মধ্যে বামপন্থীর কঠোর হৃদয়বৃত্তির বিরুদ্ধে অনপনেয় এক অভিযোগের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে থেকেই যাবে।”
তথ্যসমূহ ও সহায়ক গ্রন্থ :-
১) পাল কুমার বাবুল ; বরিশাল থেকে দণ্ডকারণ্য ; কে . মিত্র; কলকাতা ; ২০১০ ;
২) ভট্টাচার্য্য তুষার (সংকলন – গ্রন্থনা ) ; অপ্রকাশিত মরিচঝাঁপি ; শিবনাথ চৌধুরী (প্রকাশক) ; নদীয়া ; ২০১০
৩) দাশগুপ্ত অভিজিৎ ; বিস্থাপন ও নির্বাসন ; কে.পি. বাগচী ; কলকাতা ; ২০১৮
৪) মণ্ডল জগদীশ চন্দ্র ; মরিচঝাঁপি ; বঙ্গদর্পন ; কলকাতা ; ২০০৫ ।
৫) পার্টিশন , মানবাধিকার, গণতন্ত্র ; উত্তম পুরকাইত (পত্রিকা–সম্পাদক); ত্রয়োদশ বর্ষ , ১৪২৩, উজাগর হাওড়া
৬) অপদার্থের আদ্যক্ষর ; জেনোসাইড সংখ্যা (পত্রিকা) ; মেঘ, সান্তনু (সম্পাদক) ; কলকাতা ; ২০১৮
৭) অন্য এবং কথা (পত্রিকা) ; বিশ্বজিৎ ঘোষ ; জলটি হালদার (সম্পাদক) ; বনগাঁ ; ২০০৯
৮ ) চক্রবর্তী সৌমেন ; উদ্বাস্তু জীবন ও মানবাধিকার ; মুক্তমন , কলকাতা ; ২০১৩