বর্তমানে জাতীয় রাজনীতিতে তো বটেই, নিজের শক্ত ঘাঁটি পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরাতেই অপ্রাসঙ্গিক। ভবিষ্যৎ নিয়েও আশাবাদী হওয়ার জায়গা অবশিষ্ট নেই। তবু গত শতাব্দীর মধ্যভাগে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় থেকে এই শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী দল, স্বীকার করতেই হয়। আর বর্তমানে জনমত সঙ্গে না থাকলেও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে খোলাখুলি মদত এবং তরুণ প্রজন্মকে অনৈতিক যথেচ্ছাচারে অনুমোদন দিয়ে ভারতের বামপন্থী শক্তি এখনও নিজেদের শক্তি প্রদর্শনে পিছিয়ে নেই। দেশের প্রায় সবকটি মিডিয়া ও সংবাদ সংস্থা পুরোপুরি ওদের দখলে, যারা সংবাদ অনুসন্ধান করার চেয়ে গোপন করে বেশি, সত্য পরিবেশনের চেয়ে গল্প নির্মাণ করে সমধিক।
আজ যে রূপটা দেখছি, তা কি সিপিআই, সিপিআই(এম) ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর আমূম পরিবর্তিত রূপ, নাকি খুব সূক্ষ্মভাবে যে অভিযান চালানো হচ্ছিল, সেটাই আজ সম্পূর্ণ মুখোশ ছিঁড়ে খোলাখুলি সামনে চলে এসেছে? সীতারাম গোয়েলের “The Hindu Society under Seige” বইটি অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলাম, বামেদের জাতীয়তাবোধ ও ভারতের মূল সংস্কৃতির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী কিন্তু আজকের নয়। আর বিধ্বংসী অপশক্তির সঙ্গে তাদের আঁতাতও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর গড়ে ওঠেনি। গাঁটছড়া কতটা পুরোনো, অনুধাবন করতে তাই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির জন্মের দিকেই তাকানো যাক।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (CPI)-র মতে দল প্রতিষ্টিত হয়েছিল ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুর পার্টি কনফারেন্সের সময়। কিন্তু সিপিআই ভেঙে গঠিত দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী) CPI(M) মনে করে ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর Communist International-এর দ্বিতীয় কংগ্রেসের পর Turkestan Autonomous Soviet Socialist Republic-এর তাসখন্দে সিপিআই প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই অনুযায়ী ২০১৯-এই সিপিএম কমিউনিস্ট পার্টির শতবর্ষ পালনের কর্মসূচী নিয়েছে। ২০২০ হল সেই শতবর্ষপুর্তির বছর। মজার কথা ১লা মে আমেরিকার শ্রমিক বিদ্রোহের তারিখটি বিপ্লবগন্ধী হওয়ায় ভারতীয় কমিউনিস্টরা বহুদিন আগেই তাতে নিজেদের কাস্তে হাতুড়ির শীলমোহর বসিয়ে সার্থকভবে বৌদ্ধিক বিপণন চালিয়ে আসছে।
১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাসখন্দে সিপিআই দলের প্রতিষ্ঠাতা-সদস্যরা ছিলেন মানবেন্দ্রনাথ রায় (প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য), ইভলিন ট্রেন্ট রায় (মানবেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী), অবনী মুখোপাধ্যায়, রোজা ফিটিনগফ (অবনী মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী), মহম্মদ আলি (আহমেদ হাসান), মহম্মদ শাফিক সিদ্দিকি, ভোপালের রফিক আহমেদ, এম.পি.বি.টি. আচার্য ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সুলতান আহমেদ খান তারিন। অবশ্য সিপিআই-এর মতে ভারতীয়রা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিদেশীদের সাহায্যে অনেকগুলি কমিউনিস্ট গোষ্ঠী স্থাপন করেছিল; তাসখন্দের গোষ্ঠীটি ছিল তাদেরই অন্যতম। এর মধ্যে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তিক্ততার জেরে অবনী মুখোপাধ্যায় দল থেকে বহিস্কৃত হন। পরে একই পরিণতি হয় মানবেন্দ্ররও, যাঁর সঙ্গে বাংলার অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর গোষ্ঠীর যোগ ছিল। বাংলায় মুজাফ্ফর আহমেদ, বোম্বাইয়ে এস.এ. ডাঙ্গে, মাদ্রাজে সিঙ্গারাভেলু চেত্তিয়ার, যুক্তপ্রদেশে শৌকত উসমানি এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশে গুলাম হুসেনের নেতৃত্বে ছোটো ছোটো কমিউনিস্ট গোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এঁদের মধ্যে একমাত্র উসমানিই সিপিআই-এর দলীয় সদস্য হয়েছিলেন।
দেখা যাচ্ছে কমরেডরা নিজেদেরাই দাবি করেছেন বিদেশী সাহায্যে কমিউনিস্ট ভাবধারার বিভিন্ন গোষ্ঠী গঠনের কথা। মজার কথা দলের প্রধান সংগঠক মানবেন্দ্র রায় সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে ধর্মবিরোধী সাম্যবাদী বলশেভিক যোদ্ধা তৈরির জন্য মূলত খিলাফতের মনোবাঞ্ছা নিয়ে ব্রিটিশ ভারত ত্যাগ করে তুর্কিস্তান পৌঁছানো ও অন্যান্য ধর্মান্ধ ‘মুহাজির’ মুসলিমদেরকেই প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন, যাদের মধ্যে মহম্মদ শাফিক ও মহম্মদ আলি বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়েছিল। এই কারণেই পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও নেতৃত্বস্থানীয় নামগুলো যেন ‘ভারতীয় বৃন্তে আরবী কুসুম’-এর প্রস্ফুটিত বিজ্ঞাপন। আরও লক্ষণীয় ঠিক ঐ সময় ১৯১৯-২৩ সাল পর্যন্ত তুরস্কের আপাদমস্তক সাম্প্রদায়িক সাম্রাজ্যবাদী খিলফত আন্দোলনকে গান্ধীজীও ভারতের জাতীয়তাবাদী অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে জোড়ার ফলে ভারতীয় মুসলিমদের প্রথমবার জাতীয়তাবাদী কর্মসূচীতে খানিকটা উৎসাহ দেখা দিয়েছিল। স্বয়ং নজরুল ইসলামও সোৎসাহে ‘খিলাফতি অসহযোগ’-এ মেতেছিলেন, যিনি পরে মুজাফ্ফর আহমেদের বন্ধুত্ব তথা প্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সেই সময় ভারতের কমিউনিস্টরা সোভিয়েত ইউনিয়ানের অনুপ্রেরণায় পাশ্চাত্য (ভারতে ব্রিটিশ) সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহে অসহিষ্ণু হয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে ঝুঁকেছিল। তবে মুজাফ্ফরের জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের তোলা ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিটিতে প্রবল আপত্তি ছিল। মুসলমান হিসাবে মূর্তিপূজারীর মতো দেশমাতৃকার বন্দনাকে তীব্র নিন্দা জানান। তিনিই ছিলেন বাংলার কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নিতীনির্ধারক। জন্মের ইতিহাস থেকে কর্মের পদ্ধতি বিচার বলাই যায় – ভারতের কমিউনিস্ট তথা বামপন্থী চিন্তাধারার জন্ম বিদেশী মাটি তুর্কিস্তানের গর্ভে ইসলামের ঔরসে।
ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র আন্দোলনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সরকার দ্বারা নিষিদ্ধ করা হয়। লাগু হয় পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা ও কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা, যেখানে রাশিয়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুহাজির কমিউনিস্টদের বিচার হয়। কানপুর মামলার জেরে ১৯২৪ সালের ১৭ মার্চ এই মামলায় মানবেন্দ্রনাথ রায়, এস.এ. ডাঙ্গে, মুজফফর আহমেদ, নলিনী গুপ্ত, শৌকত উসমানি, সিঙ্গারাভেলু চেত্তিয়ার, গুলাম হুসেন ও আর. সি. শর্মা অভিযুক্ত হন ‘একটি সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে ভারতকে ব্রিটেনের সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করে সম্রাটকে ব্রিটিশ ভারতের সার্বভৌমত্ব থেকে বঞ্চিত করার’ চেষ্টা করছেন বলে। দৈনিক সংবাদপত্রে সাম্যবাদী চিন্তাধারার জয়জয়কার। সিঙ্গারাভেলু চেত্তিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কারণে, মানবেন্দ্র জর্মানিতে থাকায়, আর.সি. শর্মা ফরাসী উপনিবেশ পণ্ডিচেরীতে থাকায় ও গুলাম হুসেন কাবুলে রাশিয়ানদের থেকে টাকা নেওয়ার কথা কবুল করে শাস্তি এড়াতে পারলেও বাকি চারজনের কারাদণ্ড হয়। এরপর ১৯২৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর কানপুরে একটি কমিউনিস্ট কনফারেন্স ডাকা হয়। এখানেই ‘ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি’ (Communist Party of India) নামটি গৃহীত হয়। ছোটখাটো বাম গোষ্ঠীগুলো অতঃপর সিপিআই-এর সঙ্গে মিশে যায়। এরপর তো অসংখ্য কমিউনিস্ট দল গড়া ভাঙা সমন্বয় ও পুনর্বিন্যাসের সাক্ষী থেকেছে ভারতের ইতিহাস।
অন্যদিকে ১৯২২-২৪-এর মধ্যে খিলাফত আন্দোলনের শোচনীয় পরাজয় ও অসহযোগ আন্দোলনের হঠাৎ ইতির পর খিলফতি উচ্চাকাঙ্খীদের সাম্যবাদের নামে নতুন করে রাজনৈতিক জমি দখলেরও প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। আমার পাপী মন তো এ কারণেও সিপিআই গড়ে ওঠার পেছনে ১৯২৫ সালটির বিশেষ তাৎপর্য খুঁজে পায়। উল্লেখ্য উক্ত কনফারেন্সের আহ্বায়ক কমরেড সত্যভক্ত Communist International বা কমিনটার্নের অধীনে থাকার পরিবর্তে একটি ‘জাতীয় সাম্যবাদ’-এর পক্ষে মত প্রকাশ করলে সেই প্রস্তাব ভোটে হেরে যায়। তিনিও প্রতিবাদে সমাবেশ পরিত্যাগ করেন। আমার অনুমান সম্ভবত সেই সঙ্গেই দল থেকে ‘জাতীয়তা’-র ভাবনাটিও পরিত্যক্ত হয়, যার ফলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির আর ভারতীয় হওয়া হয়ে উঠল না। বরং ভারতের ইতিহাস বিকৃতি ও অপতত্ত্ব চাষাবাদের উর্বর ভূমি হিসাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। কে জানে এটাই কমিনটার্নের প্রতি আনুগত্য কিনা, যার আওতায় বিদেশী কমিউনিস্ট ও খিলাফতি শক্তিগুলোর কাছে টিকি বাঁধা! দেশভাগের পর মুসলিম লীগ ভারতে হীনবল হয়ে পড়লে তার সদস্যরা তো হয় কংগ্রেস নয় বামপন্থী শিবিরেরই স্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়।
স্বাধীন ভারতে ১৯৬২ সালে চীন ভারত আক্রমণ করলে যে ইন্দো-চীন যুদ্ধ হয়, তাতে স্বদেশের পক্ষে বা বিপক্ষে থাকা নিয়ে তৎকালীন সিপিআই-এর ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। ফলত ১৯৬৪ সালের পার্টি কংগ্রেসে দল দ্বিধা বিভক্ত হয়ে সি.পি.আই(এম) নাম নিয়ে নূতন বিশ্বনাগরিকত্ববাদী সংগঠন গড়ে ওঠে, আর সি.পি.আই. আখ্যায়িত হয় সংশোধনবাদী হিসাবে। তাই জাতীয় ও দেশবাসীর স্বার্থে পদাঘাত করা কট্টর কমিনটার্নপন্থী সি.পি.আই(এম)-এর আজ এই শতবর্ষ পালন প্রহসন ছাড়া কিছুই মনে হয় না। তবে বামপন্থীদের ১০০ বছরের অপকীর্তি ও ভারতীয় ইতিহাস থেকে সংস্কৃতি নিয়ে অমার্জনীয় যথেচ্ছাচার থেকেও শিক্ষা নেওয়ার জন্য গবেষণা হওয়া দরকার।
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়