সদ্য সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিসি, তৃণমূল কংগ্রেস দলের অবিসংবাদিত নেত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নন্দীগ্রামে একটি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন এবং সেই দুর্ঘটনাকে ষড়যন্ত্র প্রমাণ করার যৎপরোনাস্তি ব্যর্থ প্রচেষ্টা করেছেন। আমাদের বর্তমান প্রবন্ধ সেই বিষয়ে নয়। তথাপি ঘটনাটিকে উল্লেখ করার কারণ তার আগের দিনের অপরাহ্ণের একটি হাস্যকর ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া। এই দুর্ঘটনার আগের দিন বিকালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সভায় শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে কয়েকটি শ্লোক পাঠ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে তিনি হিন্দু। (যদিও শ্লোকগুলি যে শ্রীশ্রীচণ্ডীর শ্লোক সেটি তার পাঠ থেকে উদ্ধার করা যথেষ্ট কষ্টসাধ্য)
মমতা ব্যানার্জীর সেইদিনের বক্তব্যের প্রাসঙ্গিক অংশটি ছিল এইরকম “আমিও হিন্দু ঘরের মেয়ে। আমার সাথে হিন্দু কার্ড খেলতে যাবেন না।… আমি সকালবেলায় চণ্ডীপাঠ করে তবে কিন্তু বাড়ির থেকে বেরোই এটা কিন্তু মনে রাখবেন… বলবেন হিন্দু ধর্ম নিয়ে আমার সাথে কম্পিটিশন করতে…”
কংগ্রেসি পরিবেশে রাজনীতিতে হাতেখড়ি করে এবং পূর্বতন বামফ্রণ্ট সরকারের সঙ্গে লড়াই করে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখল করা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপাদমস্তক ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিতে অভ্যস্ত।
স্বাধীনতার আগে থেকেই সম্প্রদায় বিশেষের তোষণ ভারতীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রূপে উঠে এসেছে। খিলাফত আন্দোলন কিংবা মোপলা দাঙ্গাকে স্বাধীনতা সংগ্রাম রূপে স্বীকৃতি দেওয়ার মত লজ্জাস্পদ ঘটনা স্বাধীনতার পূর্বেই শুরু হয়েছে। সেই পরম্পরাকে বজায় রেখে স্বাধীনতার পরেও কংগ্রেস, কংগ্রেস ভেঙ্গে গঠিত অন্যান্য রাজনৈতিক দল, সাম্যবাদী ও সমাজবাদী দল সমূহ ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতিকেই ক্ষমতা দখলের একমাত্র উপায় রূপে গ্রহণ করে এসেছে।
এক দশক আগে পর্যন্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে সেকুলার প্রতিপন্ন করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করতেন। নিজেদেরকে সেকুলার প্রমাণ করার জন্য সমস্ত হিন্দু নেতাই এটা প্রমাণ করার চেষ্টা করতেন যে, তারা কতটা অধার্মিক। দেখানো হত যে, তাদের হিন্দু হওয়া নিছকই আকস্মিক। হিন্দুত্বের সমস্ত চিহ্নকে নিজেদের সামাজিক জীবন থেকে মুছে ফেলার মাধ্যমেই নিজেদের সেকুলারিজম্-এর পরিচয় দেওয়া একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথায় পর্যবসিত হয়। কিছু নেতৃবৃন্দের মুখে এমন কথাও শোনা গিয়েছে যে, তারা হিন্দু বা মুসলিম নন, বরং তারা নিজেদেরকে হিন্দী বলে পরিচয় দিতেই পছন্দ করেন। বলাই বাহুল্য একটি সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করার এই অপচেষ্টা কখনওই সফল হয়নি।
কিন্তু গত এক দশকে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। পরিস্থিতির চাপে বর্তমানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একাধিকবার ভুল মন্ত্র পাঠ করে নিজেকে হিন্দু প্রমাণ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করছেন। কেবল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আচরণেও এই ধরণের প্রয়াস দেখা যাচ্ছে।
কিছুদিন পূর্বে রাহুল গান্ধী নিজেকে ‘পৈতেধারী’ প্রমাণ করার প্রচেষ্টা করেছে। তার কার্যকলাপ দেখে মনে হয়েছে যে, হিন্দু মাত্রেরই পৈতে ধারণ কর্তব্য। ২০১৭তে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে উত্তর প্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব বলেছিলেন, ‘আমি কি নিজেকে হিন্দু বলে প্রমাণ করার জন্য সকালে মন্দিরে যাওয়ার ছবি টুইট করব?’ তামিলনাড়ুতে DMK দলের মুখিয়া MK Stalin, যিনি একদা নিজের হিন্দু পরিচয় গোপন করাকে রাজনীতির অঙ্গ হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন তিনিও সদ্য বয়ান দিয়েছেন যে তিনি এবং তার দল কখনওই হিন্দুদের বিরোধী নয়। কারণ, তার দলের অনেক নেতাই কপালে কুমকুমের তিলক ধারণ করেন এবং মন্দিরে যান।
এই সমস্ত উক্তি, আচরণ থেকে স্পষ্ট যে, যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতারা একদা নিজেদের হিন্দু পরিচয় গোপন করার যথাসাধ্য চেষ্টা করতেন তারা আজ নিজেদের হিন্দু বলে প্রমাণ করার হাস্যাস্পদ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
বিগত প্রায় এক শতক যাবৎ ভারতবর্ষের রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি বিশেষ সম্প্রদায়কে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে অযৌক্তিক এবং বিপজ্জনক তোষণের রাজনীতি করে গিয়েছেন। ফলস্বরূপ ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে ভারতবর্ষের বিভাজনের পরেও কাশ্মীর থেকে পণ্ডিতদের বিতাড়িত হতে হয়েছে, অকল্পনীয় অনুপ্রবেশের ফলে পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা প্রভৃতি রাজ্যের ডেমোগ্র্যাফিতে বিপজ্জনক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গিয়েছে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে নানাবিধ পাচার সহ অপরাধের অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি ঘটেছে, সীমান্তবর্তী গ্রাম ও শহরগুলিতে মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমশঃ দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু যে সম্প্রদায়কে তুষ্ট করার জন্য এই সমস্ত ভ্রান্ত প্রয়াস হয়েছে সেই সম্প্রদায়কে তুষ্ট করা যায়নি, উপরন্তু, বহু জায়গায় তাদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। এর অত্যন্ত স্বাভাবিক ফলশ্রুতি হল, এই ভ্রান্ত সেকুলারিজম্ এবং ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির বিষয়ে নির্বাচকমণ্ডলী জনতার মোহভঙ্গ।
ভোটব্যাঙ্কের রাজনীতির অঙ্কে পটু রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের হিন্দু সমাজকে খুশি করার এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। এর তিনটি স্পষ্ট কারণ চোখে পড়ে।
প্রথমতঃ, নির্বাচনের প্রাক্কালে চণ্ডীপাঠের গিমিক নির্বাচকমণ্ডলীর মন থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এতদিনের ঘৃণ্য ভোটব্যাঙ্ক ও তোষণমুখী রাজনীতির স্মৃতিকে মোছাতে পারবে না। কেবল সাধারণ জনতাই নয়, আব্বাস সিদ্দিকির মত মুসলিম সমাজের নেতৃবৃন্দও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার মুসলিম সমাজের উন্নতির জন্য কিছু করেনি। ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতি করতে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তর উন্নতিকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন। মজার কথা হল, যিনি ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনিতে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনিই আজ হঠাৎ ভারতীয় জনতা দলের জনপ্রিয়তায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নির্বাচনী সভায় ফলাও করে জানাচ্ছেন যে তিনি প্রতিদিন চণ্ডীপাঠ করেন।
দ্বিতীয়তঃ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সহ পূর্বোক্ত সেকুলার নেতৃবৃন্দ হিন্দুত্বকে কখনও বুঝতে পারেননি। ইসলাম, খ্রীষ্টীয় মত প্রভৃতির মত হিন্দুত্ব কোন সঙ্কীর্ণ উপাসনা সম্প্রদায় নয়। হিন্দুত্বের কোন সুনির্দিষ্ট পরিচায়িকা হয় না। কোন একজন ব্যক্তি হিজাব পরে কিংবা গলায় বা হাতে ক্রস ঝুলিয়ে নিজের মুসলিম বা খ্রীষ্টান পরিচয়কে উজাগর করতে পারেন। কিন্তু পৈতে পরা, মন্দিরে যাওয়া, তিলক কাটা কিংবা চণ্ডীপাঠ করা হিন্দুত্বের পরিচায়ক হতে পারে না। সমস্ত হিন্দুই এর মধ্যে কোন একটিকে নিজের হিন্দু হওয়ার পরিচয় রূপে ধারণ করে এমনটা নয়। এমনকি হিন্দু সমাজও এর মধ্যে কোনটিকেই নিজের ধর্মীয় পরিচয় রূপে স্বীকৃতি দেয় না।
সংবিধান সভার বিতর্কের সময়েে সংবিধানের ১৯তম ধারায় সম্প্রদায় প্রচারের (ধর্মান্তরণ) স্বাধীনতা প্রসঙ্গে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন করার সময়ে শ্রীযুক্ত লোকনাথ মিশ্র বলেছিলেন, “… what can this word ‘propagation’ in article 19 mean? It can only mean paving the way for the complete annihilation of Hindu culture, the Hindu way of life and manners. Islam has declared its hostility to Hindu thought. Christianity has worked out the policy of peaceful penetration by the back-door on the outskirts of our social life. This is because Hinduism did not accept barricades for its protection. Hinduism is just an integrated vision and a philosophy of life and cosmos, expressed in organised society to live that philosophy in peace and amity. But Hindu generosity has been misused and politics has overrun Hindu culture.”
এই বক্তব্যে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় এবং অত্যন্ত সঠিক ভাবে হিন্দুত্বকে বর্ণনা করা হয়েছে। আসলে হিন্দুত্ব হল একটি ব্যাপক ধারণা। হিন্দুত্ব মানে আধ্যাত্মিক গণতন্ত্র– এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে কোন ব্যক্তি নিজের পছন্দের দেবতাকে নিজের রুচির অনুসারী পদ্ধতিতে উপাসনা করতে পারে কিংবা কোন রূপ উপাসনা পদ্ধতি বা দেবতাকে অস্বীকারও করতে পারে। তবে সে কখনওই অন্য কারও উপাসনা পদ্ধতির স্বাধীনতায় কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, ঔরঙ্গজেবের জনৈক হিন্দু সেনাপতি পরম শিবভক্ত ছিলেন। তিনি প্রতিদিন শিবপূজা করতেন। ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে সেই সেনাপতি দাক্ষিণাত্যে হিন্দু পদপাদশাহীর প্রতিষ্ঠাতা শিবাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক অতীতে লোকনায়ক জয়প্রকাশ নারায়ণ ‘সম্পূর্ণ ক্রান্তি’ আন্দোলনের অন্তর্গত একটি আন্দোলন প্রবর্তন করেছিলেন যার পোশাকি নাম ছিল ‘পৈতা ছেঁড়া’। এই দুইটি ঘটনাকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, ঔরঙ্গজেবের সেনাপতি শিবপূজা করলেও হিন্দু স্বার্থ রক্ষার কাজে কোন ভূমিকা পালন করেননি, বরং হিন্দু স্বার্থের বিরোধী কাজ করেছেন। অন্যদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণ পৈতা ছেঁড়া আন্দোলনের প্রবর্তন করলেও হিন্দু সমাজের কোনরূপ ক্ষতিসাধন করেননি।
অর্থাৎ, এই ধরণের আচারনিষ্ঠতার দ্বারা কোন ব্যক্তি নিজেকে হিন্দু সমাজের পক্ষে উপকারী বলে প্রমাণ করতে পারে না।
তৃতীয়তঃ, বিগত দুই দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তৃণমূল সরকারের অপশাসন প্রত্যক্ষ করে চলেছে। তার আগের ৩৪ বছর যে নারকীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অনুভব করেছে সেই নারকীয়তা থেকে মুক্তি পাওয়ার আশাতেই মানুষ তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে পশ্চিমবঙ্গের শাসনভার তুলে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা গেল যে, এই সরকারের আমলে তোলাবাজি আগের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে গেল। অন্যদিকে উন্নয়নের বিষয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
এমতাবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সামনে বিকল্প হল সেই দল যে দলের নেতৃত্বাধীন সরকার বহু রাজ্যে এবং কেন্দ্রে অত্যন্ত কুশলতার সঙ্গে সুশাসন চালিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে।
সুতরাং, চণ্ডীপাঠ থেকে শুরু করে যে কোন ধরণের পূজার্চনাকে ফলাও করে প্রচার করে তৃণমূল নেত্রী তৃণমূল কংগ্রেসের ভরাডুবি আটকাতে পারবেন না।
লেখক– রাকেশ দাশ