ছাত্র সংহারলীলার বধ্যভুমি: তিয়েনআনমেন স্কোয়ার- গনহত্যার ৩২ বছর পূর্তি

“রাষ্ট্র বনাম ছাত্র অসম লড়াই – ছাত্র গনহত্যার এক কালো দলিল।”

আন্তর্জাতিক স্তরে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ও শিহরন জাগানো ছাত্রদের গনহত্যার অকুস্থল তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে ঠিক কি হয়েছিল-আজ ঘটনার ৩২ বছর পর তার কালো দলিলটা সামনে আনবার সামান্য একটি প্রয়াস করছি মাত্র।
মুলত ১৯৮০ র দশকে চীন ব্যাপক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। বেসরকারী ও বিদেশী বিনিয়োগের একচেটিয়া ছাড়পত্র দিতে শুরু করলো চীনের তৎকালীন ক্ষমতাসীন কম্যুনিস্ট পার্টি। দো জিয়াও পিং এর আশা ছিল হয়ত এই বেসরকারীকরণের ফলে জীবনযাত্রার মান বাড়বে ও অর্থনৈতিক উন্নতি সুনিশ্চিত করবে। কিন্তু বাস্তবে এর ফলে সমাজে দুর্নীতি বৃদ্ধি পেল ও রাজনৈতিক অস্থিরতা উন্মুক্ত হয়ে পড়লো। চীন সরকারের সংস্কারগুলির কারনে চীনে সীমিত আকারে পুঁজিবাদের সুচনা হয়েছিল। হাত ধরাধরি করে এলো মুদ্রাস্ফীতি এবং সরকারী আমলাদের আর্থিক দুর্নীতি।এর সঙ্গে দরিদ্রতা বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান হ্রাস বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিল।অর্থনৈতিক অসাম্য ও উদরীকরনের ফলে বহু চীন নাগরিকের বিদেশী ধারনা ও উন্নত জীবনযাপনে আসক্তি জন্মালো। বহু নাগরিকের অর্থনৈতিক সুখলাভ হলো। এছাড়া চীনের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে মুক্ত বাজার পুঁজিবাদের উপাদানগুলির সাথে সঠিকভাবে প্রস্তুত করা হয়নি যার দ্বারা অর্থনৈতিক উন্নতির পথ প্রসস্থ করা যেত – এরকমটাই শিক্ষার্থীদের যুক্তি।
৮০’র দশকের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় সরকার কিছু সংখ্যক নাগরিককে (মুলত বিজ্ঞানী ও বুদ্ধিজীবি) রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেন। কিন্তু এইসব নিয়ে স্থানে স্থানে ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হতে থাকে। এছাড়াও ছাত্রদের মুল দাবিই ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা। এসকল ছাত্র অসন্তোষের কারণে ১৯৮৬র শেষের দিকে লাগাতার ছাত্র বিদ্রোহ শুরু হয়। অপরাজেয় জেদে ছাত্রদের চোয়াল শক্ত হতে থাকে। স্লোগান, বক্তৃতা ও বিপ্লবের গানে পরিমন্ডল মুখরিত হয়ে ওঠে।১৯৮৭ র শুরুতে সরকারের কট্টররন্থী নেতৃত্ব ও চীনের কম্যুনিষ্ট পার্টির (CCP) দমন নীতির মাধ্যমে বিক্ষোভরত ছাত্রদের প্রতি অত্যাচার শুরু করলো। এই দমন নীতির মুল ছিলেন হু ইয়াও বাং যিনি CCP র সাধারন সম্পাদক ছিলেন।তাঁরই নির্দেশে ও ইন্ধনে তথাকতিথ গণতান্ত্রিক পুনর্গঠন শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে ছাত্র আন্দলন বৃহত্তর বাপক আকার ধারন করে। এপ্রিলে হু এর মৃত্যুতে বিক্ষোভকারী ছাত্র সমাজ একত্রিক হলো।তাঁর অন্তেষ্টিক্রিয়ায় কাতারে কাতারে ছাত্ররা জয়ায়েত করলেন ও বৃহত্তর বাক স্বাধীনতার পক্ষে ও কঠোর সেন্সরশীপের বিপক্ষে সোচ্চার হলেন।সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবীতে বাতাবরণ অশান্ত হতে থাকে। তিয়েন আন মেন স্কোয়ার প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে ওঠে।পরের সপ্তাহগুলিতে বিপুল সংখ্যায় ছাত্র সমাবেশ হতে থাকে বেজিং-এর অন্যতম প্রধান স্থান তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে।মে মাসে সাধারণ নাগরিকও এই বৃহত্তর ছাত্র আন্দোলনে সামিল হতে থাকেন।Inline image

চীন সরকারের কিছু নেতা যদিও ছাত্রদের প্রতি নরম পন্থার পক্ষপাতী ছিলেন কিন্ত অধিকাংশই ছিলেন আপোষহীন কট্টরবাদী। ১৩ই মে বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র অনশন তিয়েন আন মেন স্কোয়ারে ধর্মঘট শুরু করেছিলেন যা সারা চীনব্যাপী অনুরূপ ধর্মঘট ও বিক্ষোভকে ইন্ধন জুগিয়েছিল ও উদ্বুদ্ধ করেছিল।সেই সময়ে বেজিংএ ৪ দিন ব্যাপী প্রথমবার সোভিয়েট কম্যুনিষ্ট ও চীন কম্যুনিষ্ট নেতৃত্বের মধ্যে Sino-Soviet Summit শুরু হচ্ছিল। যদিও এই Summit ইতি বাচক ভাবেই সুসম্পন্ন হয়েছিল। কিন্তু এই উপলক্ষে বেজিংএ সমবেত হওয়া প্রচুর দেশী, বিদেশী ও পশ্চিমের সংবাদ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের সম্মুখে ক্রমশ অশান্ত ছাত্র আন্দোলনের দরুন চীন সরকারের মুখ কালিমালিপ্ত হয়।আন্দোলনকারীদের কি ভাবে মোকাবিলা করা হবে তা নিয়ে সরকার ও পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে মতান্তর দেখা যায়।
হু ইয়াও বাং এর উত্তরসূরি ঝাও ঝিয়াং বিক্ষোভকারী ছাত্রদের সঙ্গে কিছুটা হলেও মধ্যস্ততা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু লি পেং এবং দেং ঝিয়াওপিং এর মতো কট্টরপন্থীর ছাত্র বিক্ষোভ বলপুর্বক দমনের সমর্থনে সোচ্চার হন।
Inline image

যাইহোক কট্টরপন্থীদের একচেটিয়া ইচ্ছায় মে মাসের শেষ দুই সপ্তাহে চীনে সামরিক আইন বলবৎ হলো।বেজিং শহর ঘিরে সেনা সমাবেশ করানো হলো। যখনই সেনা তিয়েন আন মেন স্কোয়ারেক দিকে এগোতে শুরু করে তখন বেজিংএর নাগরিকসমৃদ্ধ বিপুল জনতা শহরের সকল রাস্তায় সমবেত হয়ে শহর অবরুদ্ধ করে তোলে। বিক্ষোভরত ছাত্ররা তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের উত্তর প্রান্তে Statue of Democracy র কাছে অবস্থান করতে থাকে। বিদেশী সাংবাদিকরাও বিক্ষোভস্থল থেকে live coverage দিচ্ছিলেন।
সব কিছু হতবাক করে আচম্বিতে ৩রা-৪ঠা জুন ট্যাঙ্ক ও বিভিন্ন রণসজ্জায় সজ্জিত সেনাবাহিনী তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের দিকে আগুয়ান হয় এবং গোলাগুলি শুরু হয়।
অগ্রসরমান সেনাবাহিনীর আক্রমণকে রুখতে অস্ত্রহীন সাধারণ নাগরিকগণ বাঁধা দেবার চেষ্টা চালায়। ঐ স্কয়ারেই ছাত্রসহ অন্যান্য প্রতিবাদকারীরা সাত সপ্তাহ অবস্থান করছিল। কয়েকশত থেকে কয়েক হাজার (মতান্তরে) নাগরিককে হত্যা করা হয়।চীন সরকার এ বিক্ষোভকে পাল্টা-বিপ্লব দাঙ্গার কথা বলে প্রচার চালায়।
সরকারী হিসেবে ২৪১ জন মারা যান আর কম বেশী ৭০০০ জন আহত হন বলে প্রচার চালান হয়।রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করে সেনাবাহিনী। এই বিষয়ে কোনরূপ সংবাদ পরিবেশন, আলোচনা ও স্মরণ সভা করাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।বিক্ষোভকারী ও তাদের মদতকারীদের গন হারে গ্রেফতার করা হয়। অনেক বিক্ষোভকারী ছাত্র বিদেশে পালিয়ে বাঁচে। ৫ই জুন সকাল পর্যন্ত সেনা সকল বিক্ষোভের এলাকাগুলিতে অধিকার কায়েম করে। “রাষ্ট্র বনাম ছাত্র”র অসম লড়াইয়ের সাক্ষী হয়ে থাকলো সারা দুনিয়া।অনামী অপরিচিত ব্যক্তি “ট্যাঙ্কম্যান” আমজনতার প্রতিবাদী মুখ হয়ে চীনের সারিবদ্ধ ট্যাঙ্কের অগ্রগতি রুদ্ধ করে আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশ সমালোচনায় মুখর হলো। কিন্তু চীনের নির্লজ্জ সরকার।বিক্ষোভকারীদের প্রতি কোনরূপ নমনীয়তা প্রদর্শন করে নি। ঝাও জিয়াংএর পরিবর্তে জিয়াং জেমিনকে পার্টির নেতৃত্বে আনা হয়। রাজনৈতিক সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়ে। ছাত্র গনহত্যার এক কালো দলিল এই ভাবেই বিশ্বদরবারে পেশ হয়।


সৌমিত্র সেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.