বাঙ্গালী আবেগপ্রবণ জাতি। বাঙ্গালী যখন স্বপ্ন দেখে, তখন বড় স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। কিন্তু শেষ চুয়াল্লিশ বছরের অভিজ্ঞতা বাঙ্গালীকে ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখতে ভুলিয়েছে।
তাই, আজ আপনি যদি কাউকে বলেন যে – সোনার বাংলা গড়ে উঠবে, তার মধ্যে কলকাতায় সিলিকন ভ্যালি হতে পারে, আপনাকে কেউ বিশ্বাস করবে না।
আমি আজকে আমার কলম তুলে ধরেছি এটা বিশ্লেষণ করে দেখানো যে কলকাতায় সিলিকোন ভ্যালি তৈরি হওয়া সম্ভব এবং কি করে সম্ভব।
বঙ্গের ক্রমিক পতন এবং বাঙ্গালীর আত্মবিশ্বাসের অবনমন –
১৯৪৭ সালে , স্বাধীনতার সময় বাংলা ভারতের জিডিপি এর ৩৩% ছিল। আজ বাংলা ভারতের জিডিপির পরিমান ৫.৪%। স্বাধীনতার সময় বাংলা ভারতের ইন্ডাস্ট্রিয়াল আউটপুটের ৩০% ছিল। আজ সেখানে বাংলা ২% এরও নিচে। এতো বড় পতন যে কোনো জাতির আত্মবিশ্বাসকে ধ্বংস করতে পারে। বাঙ্গালী কোনো ব্যতিক্রম নয়। আজ আপনি যেখানেই দেখুন, যার সাথেই কথা বলুন, কেউ বলবে না যে বাংলায় নতুন করে কিছু হতে পারে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যারা বিজয়ী হতে চায় , নতুন কিছু তৈরি করতে চায়, তারা জানে কিভাবে ঘুরে দাঁড়াতে হয়।
নতুন বাংলা গড়ে তুলতে গেলে আনতে হবে নতুন চিন্তাধারা –
আমি মনে করি নতুন বাংলা গড়ে তোলা সম্ভব যে বাংলায় একটি সিলিকন ভ্যালি ও আরও অন্যান্য শিল্পের হাব তৈরি হতে পারে। কিন্তু বাঙ্গালীকে মনে রাখতে হবে যে নতুন বাংলা গড়তে গেলে বাঙ্গালীকে নিজেকে বদলাতে হবে।
World does not owe Bengal anything , Bengal needs to create its own place in the world.
নতুন বাংলায় বাঙ্গালীকে নতুন ভাবে ভাবতে হবে।
বাংলার মনোভাবে দুটি মূল পরিবর্তন আনতে হবে ―
১. বাংলার প্রতিচ্ছবি উজ্জ্বল করতে হবে – শিল্প সেখানেই আসে, যেখানে মানুষ থাকতে চায় নিজের পরিবার নিয়ে। যেখানে মানুষ নিজের নতুন জীবন গড়তে পারে। যারা সিলিকন ভ্যালি গেছে তারা জানে যে সিলিকন ভ্যালি কতো সাজানো গোছানো শহর। সেখানে সব রকমের পরিষেবা কত সুন্দর। সেখানে কাউকে যদি কোনো সরকারি কাজে যেতে হয়, কোনো ঘুষ দিতে হয় না / কাউকে যদি কোনো কন্ট্রাক্ট দিতে হয়, কোনো সিন্ডিকেট লাগে না। বাংলার মানুষ এবং পশ্চিমবঙ্গের সরকারকে এতে একসাথে কাজ করতে হবে। যে সরকারি কর্মচারি সকাল ১১ টায় অফিসে ঢুকে ৩ টের সময় বেরিয়ে যান , যার টেবিলে ধুলো পড়া ফাইল এর পাহাড় , তাকে ভাবতে হবে তার আজকের সুখের জন্য তিনি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সম্ভাবনাকে জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। বেসরকারি সমীক্ষা অনুযায়ী ২০১৯ এ ৪৬% বাংলার মানুষ কোনো না কোনো কাজ করতে গিয়ে ঘুষ দিয়েছেন। এই পারফরমেন্স নিয়ে সিলিকন ভ্যালি গড়া যাবে না। বাঙ্গালী অনেক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়েছে। আজকের বাংলার সবচেয়ে বড়ো অন্যায় corruption এবং কর্মসংস্কৃতির অভাব। আমাদের সামাজিক কর্তব্য সবাই মিলে একে বদল করা। এটা না হলে কিছু হবে না।
২. কেন্দ্র – রাজ্য সরকারকে এক সাথে চলতে হবে – এটা সবাই জানায় যে কোনো বিদেশী পুঁজি বাংলায় ইনভেস্ট করে না , ভারতে ইনভেস্ট করে। এটা ভাবা মূর্খামি যে, বিদেশী পুঁজি এমন একটা জায়গায় আসতে চাইবে যেখানে প্রতিনিয়ত কেন্দ্রীয় সরকারের সাথেই রাজ্য সংঘাতে থাকে। এর জন্য আদর্শ পরিস্থিতি যদি কেন্দ্র এবং রাজ্যে এক দলের সরকার থাকা এবং তারা একসাথে রাজ্যকে promote করবে। উত্তর প্রদেশের recent পরিসংখ্যান এর একটা ভালো উদাহরণ। দেশি পুঁজির জন্যও এক ই যুক্তি খাটে।
সিলিকোন ভ্যালি গড়তে গেলে প্রথমেই চাই demand generation ―
বাংলায় সিলিকন ভ্যালি গড়ার সব উপাদান আছে। বেসিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং শিক্ষিত ওয়ার্কফোর্স আছে। নেই ডিমান্ড। বাংলা ভারতে IT Revenue এর ২.৬% contribute করে। ডিমান্ড না তৈরি করলে কিছু হবে না। কাজই কাজ আনে। ভালো কাজ এমন দক্ষতা বাড়ায় যে তা শিল্প চুম্বক হয়ে ওঠে। এই demand তৈরি করতে হবে পাঁচটি উপায়ে –
১. কেন্দ্রীয় সরকারের প্রজেক্ট এবং সার্ভিস সেন্টার পশ্চিমবঙ্গে এনে – আগেকার দিনে আমরা সবাই রেল বাজেট এর দিকে তাকিয়ে থাকতাম এই জানার জন্য যে বাংলা কত কিলোমিটার রেল লাইন পেয়েছে, কটা নতুন ট্রেন পেয়েছে, কত নতুন স্টেশন হয়েছে। আমরা এই এক আইডিয়া প্রয়োগ করতে পারি IT প্রজেক্ট আনার জন্য। কেন্দ্র – রাজ্য সরকার এক সাথে কাজ করলে , একসাথে কেন্দ্রীয় বাজেটের মধ্যে এরকম অনেক প্রজেক্ট আছে যা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডেলিভার করা যায়। পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরাও নিজেদের দপ্তর থেকে এরকম প্রজেক্ট ডেভেলপ করতে পারেন, যা পশ্চিমবঙ্গ থেকে ডেলিভার করা যায়।
২. পশ্চিমবঙ্গ সরকারের IT Service Transformation – ডিজিটাল সার্ভিস ডেলিভারি তে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে। এই পিছিয়ে থাকাটা পশ্চিমবঙ্গের দুর্নীতির , কাটো মানি এর একটা বড়ো কারণ। পশ্চিমবাংলা সরকারের একটা বড়ো লক্ষ্য হওয়া উচিত ডিজিটাল সার্ভিস ডেলিভারি প্ল্যান। এই প্ল্যান যেমন অনেক উঁচু মানের প্রজেক্ট সৃষ্টি করবে , তেমনি এই প্রজেক্টগুলি বাস্তবায়িত হবার পরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও খুব উপকৃত হবে। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক – অস্ট্রেলিয়া দেশে ল্যান্ড রেজিস্ট্রি ট্রানসাকশান বাড়ি বসে পুরো digitally করা যায়। কোথাও কোনো এক পয়সা ঘুষ লাগে না। পশ্চিমবঙ্গে যদি সেরকম কাজ করা যায়, তাহলে কত মানুষ উপকৃত হবে। জমি সংক্রান্ত কাজে যদি স্বচ্ছতা আসে , পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ভাবমূর্তিতে তা প্রভূত সদর্থক ভূমিকা নেবে।
৩. ডাটা ইনফ্রাস্ট্রাকচার হাব – ভারতের ডাটা consumption প্রতি তিন থেকে চার বছরে দ্বিগুন হচ্ছে। এই data এর ৯৫% প্রসেসিং হচ্ছে ভারতের বাইরে। এটা যেমন ভারতের ডাটা স্বয়ম্ভরতার পক্ষে হানিকারক , তেমন উন্নতমানের পরিষেবার পক্ষে বাধা। ভারত সরকারের কাছে আমার অনুরোধ যে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতো ভারতের আজ প্রয়োজন Data Sovereignty Regulation . পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে আনতে হবে নিজস্ব Data Sovereignty Policy . পশ্চিমবঙ্গ পূর্বভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এর গেটওয়ে। Data Center তৈরি করার জন্য লাগে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কন্ডিশন যার প্রতিটি পশ্চিমবঙ্গে আছে, যেমন পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, ভূমিকম্প অপ্রবণ এলাকা, এলাকা যা সাইক্লোন বা বন্যা পথের বাইরে। পশ্চিমবর্ধমান বা পুরুলিয়া এর জন্য আদর্শ এলাকা। এখানে Tier – ৪ ডাটা সেন্টার গড়ে তুলতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের গুরত্ব দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং প্রচুর কর্ম সংস্থান হবে।
৪. Scale Up at West Bengal – স্টার্ট-আপ এর জগতে পশ্চিমবঙ্গ অনেক পিছিয়ে। স্টার্ট-আপ এক-সিস্টেম পশ্চিমবঙ্গে তৈরি হয় নি। পশ্চিমবঙ্গের জন্য চাই নতুন আইডিয়া। পশ্চিমবঙ্গের উচিত নিজেকে ভারতের সেরা স্কেল-আপ লোকেশন হিসেবে তৈরি করা। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সফল স্টার্ট-আপ দের আহবান করতে পারে যাতে তারা পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের অপারেশন্স এক্সপানশন করতে পারে। এর মাধ্যমে যেমন নতুন কর্মসংস্থান হবে, তেমনি প্রতিটি স্টার্ট-আপ এর যে লোকাল এডাপটেশন এর প্রয়োজন পরে, তার মাধ্যমে লোকাল স্কিল ডেভেলপমেন্ট হবে।
৫. সফল NRI বাঙ্গালীদের শিল্পে আমন্ত্রণ – পশ্চিমবঙ্গে যদি প্রকৃত শিল্প বন্ধু সরকার আসে যা পশ্চিমবঙ্গে দুর্নীতি কমাতে পারে, বহু NRI বাঙালি শিল্পপতি পশ্চিবঙ্গে স্কেল-আপ করতে তৈরি। তারা নিজেদের সাথে শিল্পের সাথে সাথে নিয়ে আসবে বিশ্ব মার্কেটের সাথে সংযোগ। আমি নিজে সিলিকন ভ্যালি এর বহু শিল্পপতির সাথে কথা বলেছি। তাদের একটাই কথা – “বাংলায় কেন্দ্রের সাথে সুসম্পর্ক সম্পন্ন সরকার হোক, দুর্নীতি কমুক, আমরা যেতে তৈরি। কিন্তু আমরা শুধু সেই পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করতে যাবোনা যে নিজেকে ভারতের থেকে বিচ্ছিন্ন ভাবে আর যার শিল্প ভাবমূর্তি তলানিতে। ” তারা নিজেদের ইনভেস্টর এবং বোর্ড এর কাছ থেকে সমর্থন পাবেন না তেমন বাংলায় বিনিয়োগ করতে।
কিন্তু নতুন দিন কিভাবে আসবে ?
নতুন দিন আনতে গেলে আমাদের বদলাতে হবে। বাঙ্গালীকে নিজের মানসিকতা বদলাতে হবে। বিদ্যা এবং বুদ্ধির মতো পুঁজি ও জরুরী। পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এমন সরকার আনতে হবে যা শিল্পপতিদের ভরসা দেবে যে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের সাথেই সংযুক্ত। পশ্চিমবঙ্গ উল্টো পথে হাঁটবে না। পশ্চিমবঙ্গে সিলিকোন ভ্যালি এর জন্য মেধা আর বেসিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার আছে, কিন্তু নেই এমন সরকার যাকে শিল্পপতিরা বিশ্বাস করতে পারে আর নেই সেই ভাবমূর্তি যা শিল্প গড়ার অনুকূল।
এই নতুন পথ সম্ভব, কিন্তু সহজ নয়। প্রশ্ন হলো – আমরা কি সেই পথে চলতে তৈরি?
যুধাজিৎ সেন মজুমদার