রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি কাকে প্রার্থী করবে তা প্রকাশ্যে আসার আগে ভোটের হিসাব অনুযায়ী দেখা যাচ্ছিল যে কেবলমাত্র NDA’র ভোটে বিজেপি মনোনীত প্রার্থীর জয় সুনিশ্চিত হচ্ছে না, কিন্তু বিজু জনতা দল যদি সেই প্রার্থীকে ভোট দেয় তাহলেই তাঁর জয় সুনিশ্চিত হওয়া আর ঠেকানো যাবে না। বিভিন্ন রাজ্য থেকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের সংখ্যা এবং ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যের প্রতিটি ভোটের পৃথক ভোটমূল্যের নিরিখে ভোটের সামগ্রিক মূল্যায়নের হিসেবটি যাঁরা জানেন, তাঁরা মনে মনে হিসেব কষছিলেন যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থীর জয় বিজেপি আগেভাগেই সুনিশ্চিত করতে পারবে কিভাবে। অতঃপর 21শে জুন তারিখে দ্রৌপদী মূর্মুকে প্রার্থী চয়ন করামাত্র স্পষ্ট হয়ে যায় যে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিজেপি মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দিতে বিজু জনতা দলের যাতে সামান্য সংশয়টুকুমাত্র না থাকে সেইজন্যই দ্রৌপদী মূর্মুকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। দ্রৌপদী মূর্মু ঝাড়খণ্ডের প্রাক্তন গভর্ণর, বনবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, মহিলা তায় ওড়িশার ভূমিপুত্রী। অতএব ওড়িশা যে অন্ততঃ তাঁকে ভোট দেবেই এমন অনুমান অযৌক্তিক ছিল না। অতঃপর প্রত্যাশামতই আসে ওড়িশার তথা বিজু জনতা দলের সমর্থন। প্রার্থী ঘোষণার ঠিক পাঁচ দিনের মাথায় 26শে জুন তারিখে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়েক টুইট করে জানান শ্রীমতী দ্রৌপদী মূর্মুর প্রতি তাঁর দলের অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা এবং সঙ্গে সঙ্গেই দ্রৌপদী মূর্মুর জয় হয়ে পড়ে সুনিশ্চিত এবং বিরোধীপক্ষ পড়ে যায় অস্বস্তিতে। বিরোধীপক্ষকে তেমন অস্বস্তিতে পড়তে হত না যদি না বিজেপি তাদের প্রার্থী ঘোষণা করার সপ্তাহখানেক আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তড়িঘড়ি দিল্লি গিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে অযথা ঘোঁট পাকানোর চেষ্টাটি না করতেন। কিন্তু এমন নির্বুদ্ধিতাটি না করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও বোধ করি উপায় ছিল না কারণ ওঁর আদত উদ্দেশ্য যেহেতু কখনওই বিরোধীঐক্য নয়, বরং বিরোধীঐক্যের হাওয়া নিজের পালে লাগিয়ে নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রয়াস করা, ফলে এমত স্বার্থান্বেষণ হেতু তাঁর সেলফ-মটিভেশনই যে বারংবার তাঁকে এইপ্রকার নির্বুদ্ধিতা প্রদর্শন করার দিকে ঠেলে দেবে তা হলফ করে বলা যায়।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উপলক্ষ করে বিরোধী ঐক্যের ঘুঁটি সাজানোর জন্য স্বঘোষিত নেত্রী হিসেবে 15ই জুন দিল্লি গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিডিয়া হৈ হৈ করে কভার করেছিল সেই মিটিং যাতে শরদ পাওয়ার, ফারুখ আবদুল্লাহ্ এবং গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর নাম বিরোধীপক্ষের তরফ থেকে তিন সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করেছিলেন “দ্য গ্রেট ‘জেহাদী’ ডিক্টেটর অব বেঙ্গল”। মিডিয়া দেখিয়েছিল যে সকল বিরোধীদলের পছন্দসই এক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীকে বিরোধীদের তরফ থেকে তুলে ধরতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় উদ্যোগ নিচ্ছেন যথেষ্ট। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে (নাকি প্রত্যাশামতই?) মমতার সে প্রস্তাব অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হতে রাজী হন না উক্ত তিনজনের কেউই। (ওঁরা তিনজন কি মনে মনে জানেন না যে বাঁধা অবস্থায় যতই করুক লাফালাফি আর যতই ছাড়ুক মুহূর্মুহু হ্রেষাধ্বনি, ঘোড়া ল্যাংড়া হলে সে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরা যায় না?) অথচ পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন গভর্ণর হিসেবে সিপিএমের পতনের এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষমতারোহণের অন্যতম কারণ হয়েছিলেন যে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী, তাঁর নাম বিরোধীদের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতি পদের অন্যতম প্রার্থী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব করা সত্ত্বেও সে প্রস্তাবকে বিপুলভাবে সমর্থন করেন সিপিএমের সীতারাম ইয়েচুরি। পশ্চিমবঙ্গের সিপিএম নেতাদের গোপালকৃষ্ণ গান্ধীতে আপত্তি থাকবে কি না তা পৃথক আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চিত করে নেওয়ার পরোয়া না করেই ‘বহিরাগত’ ইয়েচুরি মমতার প্রস্তাবে ইতিবাচকভাবে সম্মত হলেন। এতে স্পষ্ট হল দুইটি বিষয়। ১. সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটি পশ্চিমবঙ্গের নেতাদের তেমন আমল দেয় না, বরং ‘বহিরাগত’ কেরালার নেতাই সর্বেসর্বা এবং ২. মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সিপিএমের বাঙালী নেতা নয়, ‘বহিরাগত’ নেতার সঙ্গেই জোটটি করছেন। অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন উপলক্ষ্যে বৃহত্তর বিরোধী ঐক্য সংঘটিত না হলেও তৃণমূল-সিপিএমের যে ঐক্য পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের আগে সাধারণ লোকচক্ষুর অন্তরালে চুপিচুপি সংঘটিত হয়েছিল ফুরফুরা শরীফের উঠোনে, সে ঐক্য প্রকাশ্যে এল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে এবং সিপিএমের বহিরাগত নেতার উপস্থিতিতে সিপিএম-তৃণমূল ঐক্যে পড়ল অফিসিয়াল সীলমোহর। অতঃপর বিরোধীদের পরিকল্পনায় একপ্রকার জল ঢেলে দিয়ে এবং তাদের ‘সুবিধাবাদী রাজনীতি’র ছককে উল্টেপাল্টে দিয়ে 21শে জুন নিজেদের তরফ থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে বিজেপি ঘোষণা করল শ্রীমতী দ্রৌপদী মূর্মুর নাম এবং 26শে জুন এসে গেল বিজু জনতা দলের সমর্থন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বুঝতে বিলম্ব হল না যে তাঁর মন্ত্রী (দাবা খেলা) খোওয়া গিয়েছে। অতঃপর 30শে জুন মহাবিকাশ আগাঢ়ী সরকারকে ফেলে দিয়ে একনাথ শিণ্ডেকে মুখ্যমন্ত্রী করে মহারাষ্ট্রে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শিবসেনার শিণ্ডে ফ্যাকশনের ভোটও যখন এনডিএ প্রার্থী দ্রৌপদী মূর্মুর জন্য নিশ্চিত হয়ে গেল, তখন মমতার বুঝতে আর কিছুমাত্র বাকি রইল না যে তাঁর কিস্তি মাত হয়ে গিয়েছে, ফলাফল লোকসম্মুখে প্রকাশিত হওয়া কেবলমাত্র সময়ের অপেক্ষা।
মহারাষ্ট্রে উদ্ধব ঠাকরে সরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মমতা বুঝলেন যে বিরোধী প্রার্থী যিনিই হোন্, জিতবেন যেহেতু দ্রৌপদী মূর্মুই, তখন নিজেদের ভোটের মূল্যকে একেবারে zero করে দেখানোর কোনো অর্থ হয় না। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির নেতা (পূর্বে কংগ্রেসের) সাংবাদিক সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বাংলার বার্তা” নামক ইউটিউব চ্যানেলে মতপ্রকাশ করেছেন যে খুব শীঘ্রই সিবিআইয়ের হাতে গ্রেফতার হতে চলেছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, সে কথা অগ্রিম জানতে পেরে গ্রেফতারির হাত থেকে ভাইপোকে রক্ষা করতেই হয়তবা বিজেপি-বিরোধিতা থেকে আপাততঃ দু’পা পিছিয়ে গিয়েছেন মমতা। কিন্তু এমন বিশ্লেষণ গ্রহনযোগ্য প্রতীত হয় না কারণ যে কোনো মুহূর্তে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রেফতার হওয়ার সম্ভাবনার কথা সন্ময়বাবুর চ্যানেল বলে চলেছে গত বহু মাসকাল যাবৎ। উপরন্তু এ-ও বিবেচ্য যে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক পরিসরটি দুষ্কৃতী, দুর্নীতি ও বেআইনি অস্ত্রসঙ্কুল, সেইসঙ্গে রাজ্যের মুখ্য সচিব ও ডিজিপি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একান্ত অনুগত। এহেন দুর্নীতি ও হিংসাপ্রবণ বিপজ্জনক রাজ্যে সিবিআই যদি ভাইপোকে গ্রেফতার করে, তবে তার কি প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ হিন্দু জনজীবনের উপর পড়তে পারে 2021’এর ভোট-পরবর্তী হিন্দুঘাতী হিংসা প্রত্যক্ষ করার পর সেকথা আন্দাজ করতে না পারার কোনো কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের নেই। অর্থাৎ ভাইপোর গ্রেফতারির ভয় বোধ করি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পাচ্ছেন না। বরং সংখ্যার খেলায় পরাস্ত হয়েছেন বুঝেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। “আপৎকালে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ”।
30শে জুন একনাথ শিণ্ডে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরদিনই অর্থাৎ পয়লা জুলাই তারিখেই মমতা বলে বসেন যে “বিজেপি আগে বললে ভেবে দেখতাম”। অর্থাৎ বার্তা দিলেন যে শ্রীমতী দ্রৌপদী মূর্মুর বিরোধিতা করতে তিনি চাইছেন না। চাইলেও লাভ নেই বুঝেই এমন মন্তব্য করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এবং করার পিছনে ছিল অপর একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। বিজেপি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে অন্য যে সকল তৃণমূল বিরোধী দলগুলি রয়েছে, (অন্ততঃ আপাতদৃষ্টিতে যারা তৃণমূল বিরোধী,) তাদেরকে “মোদী-দিদি সেটিং” তত্ত্বটি আওড়ানোর সুযোগ আর একবার করে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অতঃপর অধীর চৌধুরীও দেরি করলেন না আর। ১লা জুলাই মমতার ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্য আসা মাত্রই ২রা জুলাই অধীর চৌধুরী বলে বসলেন যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে “মোদীর সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেছেন মমতা”। বাস্তব হল— মমতা চান “সেটিং তত্ত্ব” এ রাজ্যের হাওয়ায় ভাসুক, কারণ তার দ্বারা বিজেপি সমর্থকদের এক বড় অংশকে ডিমরালাইজ করা যায়। “সেটিং তত্ত্বে” আরও বেশি করে ধুয়ো দিতেই উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের সদ্যপ্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের এনডিএ প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব শুনেও তার বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ মমতা জানেন তৃণমূলের কেউ ভোট না দিলেও ধনখড় জিতবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের হিসেব পৃথক। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন বিধায়করা নয়, কেবলমাত্র সাংসদরা এবং দেবেন গোপন ব্যালটে। মমতার অজানা নয় যে সংসদের দুই কক্ষে মোট 795টি ভোটের মধ্যে কেবলমাত্র বিজেপি সাংসদদের 402টি ভোট পেলেই জিতে যাবেন জগদীপ ধনখড়। তবে তার অর্থ এই নয় যে ধনখড় পাবেন কেবলমাত্র বিজেপির ভোট। বরং তিনি ভোট পাবেন এনডিএ’র অন্যান্য সাংসদদেরও ভোট, উপরন্তু পাবেন জাঠ ভোট কারণ ইতিমধ্যেই শ্রী জগদীপ ধনখড়ের জন্য সমর্থন ব্যক্ত করেছে জাঠ অ্যাসোসিয়েশন। ধনখড় নিজে একজন কৃষক পুত্র এবং রাজস্থানের এক জাঠ পরিবারের সন্তান। এ হেন জগদীপ ধনখড়ের জয় রুখবার ক্ষমতা যেখানে তাঁর নেই, সেখানে শরদ পওয়ারের নেতৃত্ব স্বীকার করে বিরোধিদের ভিড়ের দলের একজন হওয়ার কোনো ইচ্ছাই মমতার ছিল না। তাই উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মার্গারেট আলভাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করার সময় বারংবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও সাড়া পান নি শরদ পওয়ার। উপরন্তু মমতা এ-ও জানেন যে সাধারণ মানুষ এইসব ভোটের হিসাব সঠিক জানে না। তৃণমূলের তরফ থেকে ধনখড়-বিরোধিতা করা হচ্ছে না দেখাতে পারলেই পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ার মাধ্যমে (যে মিডিয়াকে শুভেন্দু অধিকারী বলেন ‘চটিচাটা’) মমতা আর একবার তুলে দিতে পারবেন “মোদী-দিদি সেটিং” তত্ত্বের ধুয়ো।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে বিজেপির কাছে কিস্তি মাতের চাল হজম করতে বাধ্য হয়ে ধনখড়-বিরোধিতা করা থেকেও বিরত হলেন মমতা যাতে বিজেপি ভিন্ন পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি আরও বেশি করে সুর চড়াতে পারে “সেটিং তত্ত্বে”। মমতা জানেন এই “সেটিং তত্ত্ব” তৃণমূলের পক্ষে লাভজনক আর বিজেপির জন্য ক্ষতিকর। তাই সরাসরি বিজেপিকে ঠেকাতে যদি না-ই পারেন, “সেটিং তত্ত্ব” শুনিয়ে বিজেপির সমর্থকদের ডিমরালাইজ করার কৌশল নেওয়া তাঁর পক্ষে অতি সহজ কারণ পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়া তাঁর হাতের মুঠোয় (পড়ুন চটির তলায়)। উপরন্তু এই কাজে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সাহায্য করতে সদা প্রস্তুত সিপিএম ও কংগ্রেস কারণ পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিসরটি আপাতদৃষ্টিতে বহুদলীয় হলেও আদতে দ্বিপাক্ষিক। একপক্ষে যেমন বিজেপি অন্যপক্ষে অন্য সবকটি দল। বিজেপির পক্ষে হিন্দু ঐক্য ঠেকাতে তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস, ফুরফুরা শরীফ— সকলেই বদ্ধপরিকর ও এককাট্টা। মমতা, অধীর, সেলিম, সূর্যকান্ত, ত্বহা, আব্বাস— খেলাটা সবাই খেলছেন ঐক্যবদ্ধভাবে। প্রকাশ্যে তাঁদের মধ্যে যে ঝগড়া, তা কেবলই মাত্র পরস্পরকে চোখ টিপে কারণ আদত উদ্দেশ্য এঁদের সকলেরই এক। তা হল— এ রাজ্যে আর যা-ই হোক হিন্দুত্ববাদী, ন্যাশনালিস্ট রাজনীতিকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না। এই দলগুলি যাদের প্রতিনিধি, (অর্থাৎ গ্লোবাল ইসলামিক লবি) তারা আতঙ্কে আছে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পুনরুত্থান একবার বিজেপির হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গে হয়ে গেলে আর ঠেকানো যাবে না সে জোয়ারকে। তখন বিজেপি ভিন্ন অন্য আঞ্চলিক দলের উত্থানও ঘটতে পারে কিন্তু হিন্দুত্বের প্রশ্নে সেগুলি সবই হয়ে থাকবে এককাট্টা। এই ঝুঁকি নেওয়া পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত সেক্যুলার দলগুলির পক্ষে সম্ভব নয়। 1953’য় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর মৃত্যুর পর থেকে যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এ রাজ্যে আর কখনওই পা রাখতে দেয় নি কংগ্রেস ও কম্যুনিস্ট পার্টি, আজ এত বছর পর বিজেপির হাত ধরে সেই রাজনীতির পুনরুত্থান হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় সে পুনরুত্থানকে যে কোনো উপায়ে প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত হয়েছে তারা। হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে ঠেকানোর জন্য মূল্যবোধহীন রাজনীতির পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনেও যারা পিছপা হবে না। ফুরফুরা শরীফের উঠোনে চুপিচুপি বসে নেতিবাচক, মূল্যবোধহীন রাজনীতির এমত মরিয়া সর্বদলীয় পরিকল্পনার কারণেই গত বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গিয়েও শেষ পর্যন্ত জিতে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর তার পরেই দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে হিন্দুঘাতী হিংসার নির্দেশ।
অধিকাংশ বিরোধী সাংসদ ও বিধায়করাই দ্রৌপদী মূর্মুকে ভোট দেবেন বলে জানা যেতে যখন আরম্ভমাত্র করেছে তখন, 12ই জুলাই, কংগ্রেস, তৃণমূল আদি বিরোধী দলগুলির তরফ থেকে অভিযোগ ওঠে যে বিরোধীবর্গকে ছোট করে দেখানোর জন্যই এমন রাজনৈতিক চাল চেলেছে বিজেপি। এমন অবিসংবাদিত প্রার্থীই যদি দেওয়ার ছিল, সেক্ষেত্রে দ্রৌপদী মূর্মু সর্বসম্মতিক্রমেই রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হতে পারতেন। বিজেপির উচিত ছিল তাদের মনোনীত প্রার্থী কে হতে চলেছেন সে সম্বন্ধে বিরোধীদের অগ্রিম জানানো। কিন্তু এনডিটিভির বিতর্কের প্যানেলে এ বিষয়ে স্পষ্টই বলেছিলাম যে নিজেদের প্রার্থী চয়ন করা থেকে শুরু করে তাঁর জয় সুনিশ্চিত করার কাজটি এনডিএ নিজেরাই করেছে। কিন্তু তার তাৎপর্য বিরোধীবর্গকে ছোট করে দেখানো, এমন তর্ক অসার। কারণ দ্রৌপদী মূর্মুকে যে প্রায় সকলেই সমর্থন করবেন তা দ্রৌপদী মূর্মুর নাম ঘোষণার পরেও বুঝতে পারা যায় নি, বরং তৃণমূলের তরফ থেকেই এসেছে একের পর এক অস্বস্তিকর নেতিবাচক মন্তব্য। সৌগত রায় লজ্জাজনকভাবে প্রশ্ন তোলেন একজন বিএ পাশ মহিলা রাষ্ট্রপতি হন কি করে? যশবন্ত সিনহা বলে বসেন যে দ্রৌপদী মূর্মু হতে চলেছেন একজন “রাবার স্ট্যাম্প প্রেসিডেন্ট”। অর্থাৎ বিরোধীদেরকে ছোট করে দেখানোর কোনো সুযোগ এনডিএ তথা বিজেপি পায় নি। বরং বিরোধীরা নিজেরাই এমন সব মন্তব্য অনবরত করেছেন যাতে নিজেরাই দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের ছোট করেছেন। টেলিভিশনের প্যানেলে বসে তৃণমূল নেত্রী শশী পাঁজা যতই বলুন যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এমন উপযুক্ত মহিলা প্রার্থী দিতেই পারতেন, বাস্তবে নিজে মহিলা হয়ে বিরোধী ঐক্যের মুখ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরলেও তাঁর মনোনীত সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীদের মধ্যে একজন মহিলাকেও রাখেন নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিজেপির প্রার্থী নির্বাচনের চালেই মাত হলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। চোখে আঙুল দিয়ে তাঁকে দেখিয়ে দেওয়া হল যে বিজেপির মনোনীত প্রার্থীর জয়ের জন্য তৃণমূলের ভোটের কোনো প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ ক্ষমতার লড়াইয়ে রাজনৈতিকভাবে দর কষাকষির জায়গায় তৃণমূল যে কোনোভাবেই নেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি তা দেখিয়ে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। অতএব যতদিন পর্যন্ত না বিরোধী রাজনীতির আঙ্গিনায়ও প্রকৃত ভারতবাদী তথা হিন্দুত্ববাদী কোনো দল উঠে আসছে, ততদিন পর্যন্ত বিরোধীবর্গের নেতিবাচক রাজনৈতিক কৌশলগুলি এমনভাবেই বানচাল হবে বলে আন্দাজ করা দুরূহ নয়।
দেবযানী ভট্টাচার্য্য
Debjani Bhattacharyya