রাষ্ট্রপতি শ্রীমতী মুর্মু : নঃ হিন্দু পতিত ভবেৎ !

“জন্ম হোক যথাতথা,কর্ম নিয়ে কথা” প্রচলিত এই বানী ভারতের ক্ষেত্রে বারংবার প্রমাণিত হয়েছে।তাই রাখাল বালক শ্রীকৃষ্ণও পরবর্তী কালে রাষ্ট্র নিয়ন্তার গুরু দায়িত্ব পেয়েছিলেন।ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকরও স্বাধীন ভারতের সংবিধান-প্রণেতা সমিতির সভাপতির পদ অলঙ্কিত করেছিলেন।শ্রী আম্বেদকরও প্রত্যন্ত পিছিয়ে পড়া বর্গ থেকে উঠে এসেছিলেন।


গতকালই ভারতের পঞ্চদশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ ও রাষ্ট্রচালনার মতো কঠিনতম দায়িত্ব নিয়েছেন শ্রীমতী দ্রৌপদী মুর্মু। দায়িত্ব নেওয়ার চেয়ে বলা শোভনীয় যে একশ তেত্রিশ আপামর ভারতবাসী শ্রীমতী মুর্মুর উপর এই কর্তব্যভার অর্পণ করেছেন!তাঁর নাম রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে সামনে আসার পর থেকেই নানা আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছিল।যা এখনও চলেছে। একটি আলোচ্য বিষয় হল শ্রীমতী মুর্মু আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত।এবং তিনি স্বাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী প্রথম ব্যক্তি,যিনি রাষ্ট্রপতি হলেন।ইতিপূর্বের রাষ্ট্রপতিগণ সকলেই ছিলেন পরাধীন ভারতে জন্মগ্রহণকারী।


ভারিত বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ।যদিও চীন জনসংখ্যায় বিশ্বে বৃহত্তম।তবে চীনে গণতন্ত্র বলে কিছুই নেই।এটা সকলেরই জানা।চীন এক দলীয় এবং “রাজতান্ত্রিক” (!!) বলাই ভাল।কেন-না চীনা কমিউনিস্টরা সেখানে এক দলীয় শাসন ব্যবস্থার নামে “দলীয় রাজতন্ত্র”-ই চালায় ! এবং বিশ্বে যতগুলি দেশে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে রাষ্ট্রপরিচালক নির্বাচিত হন,তাদের মধ্যে ভারতই একমাত্র বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ,যেখানে সাবলীল,সৌজন্য,ঐতিহ্য,পরম্পরা,শান্তি বজায় রেখেই রাষ্ট্রচালক তথা প্রধানমন্ত্রী,রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।পূর্বতন নবীনকে সাম্মানিক ভাবে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে সম্মানের সাথেই প্রস্থান করেন।
গতকাল শ্রীমতী মুর্মুর শপথ গ্রহণ,পূর্বতন শ্রী কোবিন্দের প্রস্থান,রাষ্ট্র কর্তৃক নবীনতমকে বরণ-স্বাগতম জানানো,পূর্বতনকে যথাযোগ্য মর্যাদা-সম্মান দিয়ে বিদায়-সম্ভাষণ জানানো সবই বিশ্ববাসী দূরদর্শনের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ করেছেন।ভারতের রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যম প্রসারভারতী রাষ্ট্রিপতি বরণের অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করেছে।


ভারত সাংবিধানিক ভাবে প্রধানমন্ত্রী পরিচালিত গণতান্ত্রিক দেশ।ভারত বহু দলীয় রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক দেশ।প্রাচীন কাল থেকেই ভারতে বহু মত-পথ-বিশ্বাস চলে আসছে।আবার ভৌগোলিক আয়তনে বিরাট হবার কারণে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি,প্রাকৃতিক সম্পদের মাত্রাও ভিন্ন ভিন্ন।স্বাভাবিক ভাবেই ভারতীয়দের মধ্যে খাদ্যাভ্যাস,পরিচ্ছদ ইত্যাদিও আলাদা আলাদা।তবুও ভারতের আত্মার মধ্যে এক একাত্মতা সর্বদা বহমান।তা হল “বসুধৈবঃ কুটুম্বকম‌্” !


আমরা কয়দিন পরেই ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তীর ৭৫তম দিবস পালন করব।এই সুবর্ণক্ষণের প্রাক্কালে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শ্রীমতীকে ভারতবাসী বরণ করলেন! তিনি আদিবাসী সম্প্রদায় ভুক্ত।প্রশ্ন হল, স্বাধীনতার এত বছর পরে এসে একজন আদিবাসীকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমরা পেলাম কেন !? আরও আগে কেন পেলাম না ? ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে তো আদিবাসীদের ভূমিকা স্বর্ণোজ্জ্বল ভাবেই শোভমান! তাহলে ?
১৯৪৭ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত মাঝের ৫ বছর বাদ দিলে ভারতে ধারাবাহিক ভাবে শাসন করেছে কংগ্রেস নামক অ-সনাতনী-অ-ভারতীয় মানসিকতা সম্পন্ন একটি রাজনৈতিক দল।অথবা তার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা পেঁটোয়া-তাঁবেদারি করা কোনো দল।দেশ চালানোর নামে নিজেদের আখের-ভরার কারণে ভারতের অবস্থা কোথায় গিয়ে পৌঁছেছিল তা গত কয়েক বছর ধরে দেশবাসী উপলব্ধি করতে পারছেন।


ভারতে বর্তমানে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপি।অটল বিহারী বাজপেয়ীও এই দলেরই প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।সকলেই জানেন যে,তাঁর শাসনকালে দেশ কী অতীব সংকটের মধ্যে থেকেও বিশ্বের কাছে পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে সমীহ ও সম্মান আদায় করে নিয়েছিল ! কিন্তু দুর্ভাগ্য ভারতবাসীর যে, অ-ভারতীয় মনোভাবাপন্ন অতিপয় ভারতীয় রাজনৈতিক দলের/ব্যক্তির চক্রান্তে দেশবাসী শ্রী বাজপেয়ীকে তথা বিজেপি-কে দেশ চালনার দায়িত্ব তখনকার মতো আর দিল না !


২০১৪-তে বিজেপি-কে দেশবাসী পুনরায় দেশ চালনার দায়িত্ব দিল।প্রধানমন্ত্রী হলেন নরেন্দ্র মোদী।তিনি-ই প্রথম প্রধানমন্ত্রী, যিনি বলতে পারলেন যে, “সবকা সাথ‌্ সবকা বিকাস”!– সবার সাথে সবার বিকাশ ! সকলের জন্য,সকলের কর্তৃক,সকলের বিকাশ !


এর আগে অবশ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন “গরিবি হঠাও” -এর অর্থ যদি “দেশে কেউ গরীব থাকবে না” — তাহলে সেটা সর্বাঙ্গেই সার্থক হয়েছিল ! কেন-না তৎকালীন সময়ে যে-সব কংগ্রেসী বিধায়ক-সাংসদ-ঝান্ডাবাহী নেতা-কর্মী তুলনামূলক গরীব ছিলেন,তাঁরা সকলেই ধনী হয়ে গিয়েছিলেন ! কিন্তু দেশবাসীর দারিদ্র্য দূর হয় নি।


অনেক “উচ্ছিষ্টভোজী”, “পদলেহী” ব্যক্তি, অ-সনাতনী মনোভাবী রাজনৈতিক দল প্রচার চালাচ্ছে শ্রীমতী মুর্মুকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি-র অনেক রাজনৈতিক অঙ্ক রয়েছে।২০২৪-এর লোকসভার আগেও বিভিন্ন রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন রয়েছে।তাতে আদিবাসী-পিছিয়ে পড়া শ্রীমতী মুর্মু-কে বিজেপি প্রচারে তুলে ধরবে ভোটের জন্য।তা যদিও তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়াও হয়, তাহলেও প্রশ্ন কোবিন্দের আগে আরও তের জন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনেও তো কংগ্রেসীদের সুযোগ ছিল কোনো আদিবাসী-পিছড়ে বর্গের কাউকে রাষ্ট্রপতি করার।তা হয় নি কেন !? তথাকথিত “ভারতীয় কমিউনিস্ট”-দেরও তো এক বার দেশবাসী সুযোগ দিয়েছিল জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হবার ! এতকাল বিশ্ব দেখে এসেছে ভারতের রাষ্ট্রপ্রধানগণ ঝাঁ-চকচকে চেহারার! পোষাক-পরিচ্ছদ মার্জিত।ইংরাজি কথনে দক্ষ ! বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি যাঁদের ভক্তি গদগদ ! দেশের রাজনৈতিক নেতা হয়েও যাঁরা বিদেশী প্রচার মাধ্যমের সামনে ভারতের দুর্নাম করতে ভাবে না।

   যাঁরা বিজেপি-র দলীয় সংগঠন জানেন-বোঝেন, বা এত দিনে  দেশবাসীও জেনেছেন যে, বিজেপি ব্যক্তি কেন্দ্রীক বা কোনো পরিবার কেন্দ্রীক রাজনৈতিক দল নয়।এখানে ব্যক্তি বা পরিবারের প্রতি আনুগত্যের মূল্য নেই।
     প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখনীয় যে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ দীর্ঘ সাতানব্বই বছর ধরেই ভারতীয়দের একত্রীকরণের কাজ নীরবে করে চলেছে।ভারতের অখণ্ডতা রক্ষা,ব্যক্তি নির্মাণ,দেশবাসীর মনে স্বাজাত্য-স্বাভীমান জাগানোর কাজ করে চলেছে।"বনবাসী কল্যাণ আশ্রম"-এর মাধ্যমে দেশের সকল আদিবাসী-বনবাসী ভারতীয়কে সভ্যতার মূল স্রোতে সামিল করার কাজ  করে চলেছে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

আর এই কারণেই সঙ্ঘের সাথে বিজেপি-র একটি আত্মীক ও নৈতিক সম্পর্ক রয়েছে।উভয়েরই উদ্দেশ্য এক।তা হল ” সকলের সাথে,সকলের জন্য,সকলের বিকাশ”!
অনেকেরই মনে আছে যে, ১৯৭৮-৮৯ সালে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সঙ্ঘ বাবু জগজ্জীবন রাম-কে মনোনীত করেছিল।এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বে দেশ অনেকটাই উন্নতির পথে এগিয়ে ছিল।
দ্রৌপদী দেবীর আগেও বিজেপি পিছড়ে বর্গের পূর্ণ আগিতক সাংমাকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী করেছিল।তখন বিজেপি ছিলে সংসদের বিরোধী দল।স্বাভাবিক ভাবেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিধায়ক-সাংসদ না-থাকার কারণে বিজেপি মনোনীত সাংমা রাষ্ট্রপতি হতে পারেন নি।
দ্রৌপদী মুর্মুর রাষ্ট্রপতি হওয়া নিশ্চিত ভাবেই ” নঃ হিন্দু পতিত ভবেৎ ” কোনো হিন্দুই অচ্ছ্যুৎ নয়–এই উপলব্ধিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।হিন্দুর হারানো আত্মবিশ্বাস,গরিমা ফিরে পেতে সাহায্য করবে।
পর দেশ গ্রাসী ও উপনেবেশিক ইংরেজ ভারতীয় আদিবাসী তথা বনবাসীদের সামগ্রিক ভাবেই শেষ করে দিতে চেয়েছিল।তাঁদের বাসস্থান,অরণ্যভিত্তিক জীবিকা থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।কিন্তু কষ্ট সহিষ্ণু,স্বাধীন চেতনা সম্পন্ন অরণ্যবাসীগণ ইংরেজের দাসত্ব স্বীকার করেনি।শ্রীমতী মুর্মু তাঁদেরই উত্তরসূরী।তাঁর পরিচালনায় দেশ আরও বৈভবশালী হবে– এই আশা সব ভারতীয়রাই করছেন।


বহু দেববাদে বিশ্বাসী সনাতনী হিন্দু ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনা “কতটা মধুর হতে পারে” তা বিশ্ববাসী বারংবার দেখেছে।পাশাপাশি এক বাদে বিশ্বাসী ইসলামিক দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলে কী দেখা যায় ? লিবিয়াতে মুয়াম্মর গদ্দাফির কথা চিন্তা করুন ! তাঁরই স্ব-ধর্মী দেশবাসী রাস্তায় রাষ্ট্রপ্রধান থাকাকালীন তাঁকে পিটিয়ে মারছেন! মিশরে হোসনি মুবারকের কথা ভাবুন! আরব দেশগুলির দিকে তাকান একই ধর্ম বিশ্বাসী হয়েও ওখানকার দেশবাসীর ব্যক্তি স্বাধীনতা,মাতৃজাতির দুর্দশার কথা চিন্তনে আনুন ! আর আমাদের নিকটতম পশ্চিমী প্রতিবেশীর দিকে তাকান।তার স্বাধীনতা আমাদের সম বয়সী হলেও,সেখানে কোনো রাষ্ট্রপ্রধানই কার্যকালের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেন না।ক্ষমতা হারানোর পরে তাঁদের স্বদেশচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে হয়।অথবা দেশে ফিরলে গুপ্তঘাতকের হাতে বা বিচারের প্রহসণে প্রাণ দিতে হয়।
ভারত দিন কয়েক পরেই স্বাধীনতার ৭৫ তম বর্ষ উপলক্ষ্যে ” অমৃত মহোৎসব”-এ ব্রতী হবে।বর্ষব্যাপী দেশ জুড়ে নানা কর্মযজ্ঞ পালিত হবে সরকারী ও বে-সরকারী সংগঠনের উদ্যোগে।এই ক্রান্তিলগ্নে শ্রীমতী মুর্মুর উপর রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব অর্পিত হল।সনাতনী হিন্দু ভারতে আবারও প্রমাণিত হল “নঃ হিন্দু পতিত ভবেৎ” !

    :: সুজিত চক্রবর্তী ::

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.