নতুনকে নিতে হবে, দলের পুরনোদেরও মর্যাদা দিতে হবে : কর্ণেল সব্যসাচী বাগচি

“পায়ে পায়ে একটা অনিশ্চয়তার দিকে এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি। বুঝে যন্ত্রণাহত হচ্ছি।“প্রায় দু’দশক দলের সাধারণ সম্পাদক, সহ সভাপতি প্রভৃতি দায়িত্বে ছিলেন কর্ণেল সব্যসাচী বাগচি। এখন বয়স প্রায় ৮০। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে একটা বিশেষ সাক্ষাৎকারে ভালবেসে দলকে সতর্ক করে দিলেন। বললেন, “আমার চেতনার আদিপর্ব থেকে সঙ্ঘের অনুসারি। নতুনকে নিতে হবে, এটা যেমন ঠিক, তেমনই দলের পুরনোদের মর্যাদা দিতে হবে। পরিবারে মা-বাবাকে স্বীকৃতি জানানোটা কিন্তু ভারতের ঐতিহ্য, সনাতনি রীতি। মনে রাখতে হবে বিজেপি একটা পরিবার।“ পুরনোদের মর্যাদা বজায় রাখতে কীভাবে ‘রাঙ্কিং সিস্টেম’ করা দরকার, তার আভাষও দিলেন। 
১৯৬৩-তে ফোর্ট উইলিয়াম আর ইলাহাবাদে জোড়া সাক্ষাৎকারের পর সব্যসাচীবাবু যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। ২৭ বছর বাদে যখন স্বেচ্ছাবসর নিলেন, তখন বাহিনীর কর্ণেল। বললেন, “আরও বছর দশ কাজ ছিল। পুরো মেয়াদ করলে হয়ত মেজর জেনারেল হতাম। ১৯৯০-তে বাহিনী থেকে মুক্তি নিয়েই যোগ দিলাম বিজেপি-তে। তখন রাজ্য সভাপতি সুকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর তপন শিকদার যখন রাজ্য সভাপতি, তাঁকেও সহায়তা করার সুযোগ পেয়েছি। জলুদার ( মুখার্জি) আমলে পুরোটা ছিলাম সহ সভাপতি। তখন এত পদ ছিল না। অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হত।”

আর এখন দল কীভাবে, কতটা বদলেছে? সব্যসাচীবাবুর কথায়, “স্কুল থেকেই আর এসএস করতাম। পরে ফৌজে বেড়িয়ে গেলাম। সেনাবাহিনী থেকে মুক্তির পর প্রায় দু’দশক, ২০০৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্য বিজেপির অন্যতম নীতিনির্ধারক ছিলাম। টাকাপয়সা ছিল না, কষ্ট করে চালাতে হত। তখন ছিল ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। এখন পরিবার অনেক বড় হয়েছে। দলে স্বার্থান্বেষিরা ঢুকছে। দীনদয়াল উপাধ্যায়, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের আদর্শের ভিত্তিতে কাজ করতাম। নানাজী দেশমুখ, অটলবিহারি বাজপেয়ীদের পেয়েছি। ওঁদের পথ থেকে দল বিচ্যুত হয়েছে।“
কিসের বিচ্যুতি? সব্যসাচীবাবুর কথায়, “সেই আন্তরিকতা, পারস্পরিক সম্পর্ক, আদর্শ, নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি, একাত্ম মানববাদ— এসব এখন আর নেই। সব ভুলে যেনতেন প্রকারেন ক্ষমতায় থাকা বা আসাই যেন লক্ষ্য।“ কিন্তু কালের নিয়মে সেটাই কি স্বাভাবিক নয়? প্রাক্তন সেনাকর্তার জবাব, “সেটা ঠিক! পাওয়ার পলিটিকস রাজনীতির চালচিত্র বদলে দিয়েছে। একটা ক্লেদাক্ত পরিবেশ! মূল্যবোধের অভাব। আসল লক্ষ্য গদি। তাহলে তো দ্রুত পায়ে পায়ে এগিয়ে আসবে শেষের সেদিন! এই ভ্যালুলেস পলিটিক্স করেই শেষ হয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। কেরলে মাঝে মাঝে জমানা বদলায় বলে সিপিএম কিছুটা টিঁকে আছে।“
কিন্তু সঙ্ঘের আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে যাওয়ার নজীর কিন্তু তৈরি করেছেন আপনি? হ্যাঁ, ২০১০-এর গোড়ায় আমি তৃণমূলে যোগ দিই। লক্ষ্য ছিল সিপিএমের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান করা। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পর সাত বছর রাজ্য ক্ষুদ্র শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান হিসাবে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। ২০১৮-র মার্চ মাসে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অব্যাহতি নিই। মূলত আমার স্ত্রীর অসুস্থতার জন্য।“ তারপর আর বিজেপি-তে ফেরার চেষ্টা করেননি? “না। তবে, দলের নানা অনুষ্ঠানে যাই।“

সামনে নির্বাচনে তো বিজেপি-র অগ্নিপরীক্ষা! কীভাবে দেখছেন এই মহারণকে? সব্যসাচীবাবু বলেন, “একটা বড় পরিবর্তন দরকার, যাকে বলে প্যারাডাইম শিফট। না হলে ‘সোনার বাংলা’ ফেরানো যাবে না। বিধান রায়ের আমলের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের ক্রমঅবনতি দেখছি। কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যের সমানে সংঘাত। এ জিনিস উন্নত দেশে হয়না। এই ভোটে বিজেপি-র জেতাটা খুব দরকার। অন্যথায় কেবল অনুন্নয়ন নয়, গভীর আঁধারে ডুবে যাবে রাজ্যটা। তৈরি হবে পশ্চিম বাংলাদেশ। ইতিহাসে বিলীন হয়ে যাবে একটা সভ্যতা।“
দল অনেক বড় হয়েছে। কোনও পরামর্শ দেবেন? সব্যসাচীবাবু বলেন, “নতুন অনেকে দলে আসছে। আমি মানছি কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। কিন্তু পরে দুটো কাঁটাকেই সময়মত ফেলে দিতে হবে! না হলেই মুস্কিল! কাজটা খুব কঠিন। ভয় হচ্ছে সেকারণেই। সেদিকে নজর রাখতে হবে। আর ওই যে, বিজেপি কিন্তু একটা পরিবার। এ কথাটা মনে রাখতে হবে। গুরুত্ব দিতে হবে সনাতন মূল্যবোধকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.