নরেন্দ্র মোদী ভোট জিততে পারেন, শাসন করতে পারেন কি?

সেই র‌্যাঞ্চোকে মনে পড়ে? থ্রি ইডিয়টস ছবির নায়ক র‌্যাঞ্চো বিপদে পড়লে নিজের বুকে হাত রেখে বন্ধুদের বলত, “আল ইজ় ওয়েল, আল ইজ় ওয়েল।” সব ঠিক হয়ে যাবে। নিছক বন্ধু থেকে কলেজের সহপাঠীদের কাছে র‌্যাঞ্চোর মসিহা বা মুক্তিদাতা হয়ে ওঠা এই ‘আল ইজ় ওয়েল’ মন্ত্রেই। সব ঠিক রয়েছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভরসা রাখো।

নিছক এক জন রাজনীতিক থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তি মসিহা বা জাতির পরিত্রাতা হিসেবে তৈরি করা হলে তাঁর চার পাশেও একই মন্ত্র উচ্চারিত হয়—‘আল ইজ় ওয়েল’। সব ঠিক হয়ে যাবে। পরিত্রাতা বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন।

কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় গোটা দেশে ‘ত্রাহি, ত্রাহি’ রব। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর চার পাশেও এখন মন্ত্রোচ্চারণ চলছে— “তিনি আছেন, তিনিই রক্ষা করবেন।” প্রধানমন্ত্রী অক্সিজেন উৎপাদন ব্যবস্থা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। মন্ত্রীসান্ত্রি সকলে তাঁকে এক সুরে ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানালেন। কেন্দ্রের সলিসিটর জেনারেল সুপ্রিম কোর্টে বললেন— গর্ব করা উচিত যে, প্রধানমন্ত্রী নিজে অক্সিজেনের সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন বললেন, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর এক অন্য রূপ ফুটে উঠছে।

সত্যিই অন্য রূপ! সেখানেই দেশের আর পাঁচ জন রাজনীতিকের থেকে মোদীর ভাবমূর্তি আলাদা।

রাজধানীর শ্মশানঘাটের বাইরে সৎকারের জন্য মৃতদেহের দীর্ঘ লাইন। কেন্দ্রীয় সরকার নিজেই রাজ্যকে বার্তা পাঠিয়ে বলছে, কোভিডের সংক্রমণ যে ভাবে বাড়ছে, তা সামলানোর মতো পরিকাঠামো এ দেশে নেই। আর কোনও প্রধানমন্ত্রী হলে হয়তো ব্যাখ্যা দিতে হত— কেন গত এক বছরে কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কা সামলানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি? কেন প্রধানমন্ত্রী আগেভাগেই কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় ঘোষণা করে দিলেন? কেন বিজেপি তাঁকে কোভিড-জয়ের জন্য ‘বিশ্ব গুরু’র আসনে বসিয়ে ফেলল? কেনই বা প্রধানমন্ত্রী অতিমারির কথা ভুলে ‘সোনার বাংলা’র প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়লেন?

কিন্তু ওই যে, নরেন্দ্র মোদীর পরিত্রাতার ভাবমূর্তি! জীবনে কষ্ট এলে কি ঈশ্বরের উপরে বিশ্বাস চলে যায়? না। বরং আস্থা দ্বিগুণ হয়। মানুষ ভাবে, এই যন্ত্রণা ভোগ নিশ্চয়ই বড় কোনও মোক্ষলাভের আগের পরীক্ষা। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে দেশ জুড়ে প্রতিষেধক ও অক্সিজেনের হাহাকারের মধ্যেই টিভির পর্দায় আবির্ভূত প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় তাই হিন্দু শাস্ত্রের নীতিকথা উঠে আসে। ‘ত্যাজ্যম্ ন ধৈর্যম্, বিধুরে’পি কালে’— কঠিন সময়েও আমাদের ধৈর্য হারানো চলবে না। মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের থেকে শিখতে হবে, সঙ্কটের মধ্যেও কী

ভাবে অনুশাসন মেনে চলতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর ‘মন কি বাত’-এ শোনা যায়, কোভিড অতিমারির দ্বিতীয় ধাক্কা আসলে আমরা কতটা যন্ত্রণা সহ্য করতে পারি, তার পরীক্ষা।

অনেক দিন ধরেই নরেন্দ্র মোদীর বক্তৃতা আর শুধু রাজনৈতিক আহ্বানের গণ্ডিতে বাঁধা থাকে না— তাতে মিশে থাকে শাস্ত্র, ধর্ম, নৈতিকতা, আধ্যাত্মিকতা। থাকে অতীতে ভারতের শ্রেষ্ঠত্বের কথা স্মরণ করিয়ে ভবিষ্যতে শ্রেষ্ঠ ভারতের স্বপ্ন। আমজনতার মন তাই সংশয়ে পড়ে যায়। ভোটে নির্বাচিত সরকারের কাজে ক্ষোভ তৈরি হলেও মনে প্রশ্ন ওঠে, আমি কি ধৈর্য হারাচ্ছি? দেশের স্বার্থে কষ্ট সহ্য করাটাই কি নৈতিক দায়িত্ব? পরিত্রাতার সমালোচনা না করে, তাঁর নেতৃত্বে আস্থা পোষণ করাই মুক্তির উপায়? এই সংশয়ের ফলেই আমজনতা ভোটে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর দায়বদ্ধতা নির্ধারণ করতেও ভুলে যায়। গুলিয়ে যায়, কোনটা সরকারের কাজ, কোনটা আমজনতার।

এক সময় এ ভাবেই ইন্দিরা গাঁধীর ‘আয়রন লেডি’ ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। হালফিলের রাজনীতিতে জয়ললিতার ‘আম্মা’ ভাবমূর্তি তৈরি করা হয়েছিল। গত বছর কোভিডের সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন রাস্তায় নেমেছেন, তখনও তাঁর ‘দিদি’ থেকে ‘বাংলার মা’ ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীকে পরিত্রাতা সাজানোর সুবিধা হল, তিনি স্বঘোষিত ফকির। পারিবারিক টান থেকে মুক্ত। তিনি যেন শুধু দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে আসেননি। সামাজিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক জীবনেও পথ দেখাতে এসেছেন। তাই তাঁর অনুগামীর চেয়ে ভক্তের সংখ্যা বেশি। তাঁর সরকারের কাজের উপরে সেই ভক্তি নির্ভর করে না।

আর কোনও রাজনীতিক হলে তাঁর জনপ্রিয়তা সেই ২০১৬-তে নোট বাতিলের পরেই তলানিতে ঠেকত। কিন্তু মানুষের ভোগান্তিকে মোদী সে সময় ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে যজ্ঞ’ ও ‘দেশপ্রেমের পরীক্ষা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। সেই যজ্ঞে দুর্নীতি বা কালো টাকা দূর হয়নি। কিন্তু, ভুল স্বীকারও হয়নি। গত বছর আচমকা লকডাউনের জেরে পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশাকে তিনি ‘তপস্যা’ আখ্যা দিয়েছিলেন। প্রথমে ২১ দিনেই করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় হবে বললেও, লকডাউনের মেয়াদ আরও বাড়িয়ে মানুষের কাছে ‘ত্যাগ’-এর আহ্বান জানিয়েছিলেন। এখন কোভিডের মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রীর বা সরকারের কেন খামতি থেকে গেল, সে প্রশ্নের উত্তর মিলছে না। কারণ প্রধানমন্ত্রীকে কখনও এ সব প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয় না।

তিন-চার মাস আগে কোভিডের সংক্রমণ কিছুটা কমে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর শ্বেত শ্মশ্রুমণ্ডিত ছবি-সহ তাঁকে ‘বিশ্ব গুরু’ বলে জয়ধ্বনি দিয়ে দিল্লিতে ব্যানার ঝোলানো হয়েছিল। এ বার কোভিডের দ্বিতীয় ধাক্কায় মানুষের জীবন ও জীবিকা যখন ফের প্রশ্নের মুখে, তখন বোঝানো হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রীই ফের উদ্ধার করবেন। এটাই ভাবমূর্তি নির্মাণ। তাই প্রধানমন্ত্রী অক্সিজেনের অভাব নিয়ে বৈঠকে বসলেও মন্ত্রীসান্ত্রিরা তাঁকে ধন্যবাদ জানান। প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন বলে দেশের মানুষকে গর্ব করতে বলা হয়।

ভয় একটাই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই নিজেকে পরিত্রাতা ভেবে বসবেন না তো? তিনি নিজেই এই মসিহার ভাবমূর্তিতে আটকে পড়বেন না তো? তাঁর চার পাশে জয়ধ্বনি দিয়ে চলা ভক্তকুলের ভিড়ে বাস্তব চোখের আড়ালে চলে যাবে না তো?

এক সাম্প্রতিক ওয়েব সিরিজ়ে মুম্বইয়ের গ্যাংস্টার গণেশ গাইতোন্ডে ক্ষমতার নেশায় বুঁদ হয়ে মাঝে মাঝে নিজেই নিজেকে ঈশ্বর ভাবত— “কভি কভি লাগতা হ্যায় আপুন হি ভগবান হ্যায়।” কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতা ও দায়বদ্ধতা এক নয়। নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় আসা যায়। ক্ষমতায় বসে মানুষের হয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। সেই সিদ্ধান্তের জন্য মানুষের ভোটে পুরস্কারও মিলতে পারে। কিংবা শাস্তি। গণতন্ত্রের এই প্রাচীন প্রবাদকে প্রহসনে পরিণত করতেই আরএসএস-বিজেপির এমন এক মোদীকে দরকার, যিনি বার

বার রাজনৈতিক পরিত্রাতা হয়ে উঠবেন। সরকারের ভুল সিদ্ধান্ত বা দলের বেঠিক চালেও যাঁর ভাবমূর্তিতে কোনও টোল পড়বে না। যিনি সব কিছুর ঊর্ধ্বে থাকবেন।

কিন্তু দেশের মানুষের এখন প্রধানমন্ত্রী দরকার, দৈবের ভরসায় থাকা পরিত্রাতা নয়। কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্য প্রস্তুতি নিতে গত ক’মাসে এক জন প্রশাসকের দরকার ছিল। কিন্তু আরএসএস-বিজেপি প্রধানমন্ত্রীকে তারকা প্রচারক করে দ্রাবিড়-অসম-বঙ্গের ভোটযুদ্ধে পাঠিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদী ‘অচ্ছে দিন’ বা ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচন জেতাতে পারেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাফল্য সর্দার পটেলের মূর্তি তৈরি বা নতুন সংসদ ভবন নির্মাণ দিয়ে বিচার হয় না। বিচার হয় দেশের প্রয়োজনে এমস-এর মতো হাসপাতাল, ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি-র মতো গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠায়। যে সব সংস্থা তৈরি করে নেহরু ভারতে ম্যালেরিয়া, প্লেগ থেকে হুপিং কাফ, জলাতঙ্কের মতো রোগকে লাগাম পরিয়েছিলেন।

নরেন্দ্র মোদী আরএসএস-বিজেপির রাজনৈতিক পরিত্রাতা হয়েই থেকে যাবেন, না কি প্রশাসক হিসেবেও মাইলফলক রেখে যাবেন, কোভিড-উত্তর সময়কালই তার বিচার করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.