জ্যোতি বসু (Jyoti Basu) নিজের জীবনে অনেক কুকীর্তি করেছেন। মারিচঝাপি থেকে শুরু করে অনেক ঘটনাই আমরা জানি। আজ তার অনেক পাপের মধ্যে একটি পাপের কথা জানাই আপনাদের। এই জঘন্য পাপ করেছিলেন বিশ্ব বিখ্যাত সন্তরণবিদ মিহির সেনের (Mihir Sen) সাথে। সেই মিহির সেন যিনি প্রথম ভারতীয় হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করেছিলেন।
১৯৫৮ এ ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করার পর আরো বেশ কয়েকবছর ভারতসরকারের সহায়তায় আরো ৭ টা সমুদ্র পার করে বিশেষ পারদর্শিতা দেখান। ফলস্বরুপ ১৯৫৯ এ তিনি পদ্মশ্রী ও ১৯৬৭ এ পদ্মভূষণ সম্মানপ্রাপ্ত হন। শুধু তাই নয় তাঁর এই অসামান্য কীর্তির জন্য তাঁকে ব্লিট্জ নেহেরু ট্রফি দিয়েও সম্মানিত করা হয়।
মিহির সেন (Mihir Sen) যেমন দক্ষ সন্তরণবিদ ছিলেন তেমনি লন্ডনের লিংকন কলেজ থেকে পাশ করা ব্যারিস্টারও ছিলেন, কলকাতা হাইকোর্টে প্রতিষ্ঠিত ফৌজদারি উকিল। বাঙালি নাকি ব্যবসা করতে জানেন না? মিহির সেন নামলেন ব্যবসায়ে। রেশম রপ্তানি করতে শুরু করেন। অতি শীঘ্র উৎকৃষ্টমানের রেশম রপ্তানীর কারনে ভারত সরকারের অনুমোদন পায় এবং দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেশম রপ্তানীকারক কোম্পানি হয়ে ওঠে।
কিন্তু বিধি বাম। বাম শুধু না, পুরো জ্যোতি বসু! ১৯৭৭ সাল, বিধানসভা নির্বাচন একদম দোরগোড়ায়। এই সময় মিহির সেনকে জ্যোতিবাবুর প্রচারকার্যের জন্য নির্দেশ আসে। সাথে সরকারি আমলা পদের লোভও। কিন্তু মিহির সেন তো সেরকম মানুষ ছিলেন না, তখনকার দিনে “কমিউনিজম মানি না” গুটিকয়েক বাঙালিদের মধ্যে একজন ছিলেন মিহির সেন (Mihir Sen)। মুখের ওপর না বলে নির্দলীয় প্রার্থি হিসেবে পরের দিনই নিজের নথিপত্র জমা দিলেন। সাহস কম না মিহির সেনের, না?
জ্যোতিবাবু ততদিনে রাজ্যকে এবং রাজ্যবাসিকে লুটেপটে নিজের দাসদাসি বানাবার পুরো ছক কষে ফেলেছেন। তিনি কেন সহ্য করবেন মিহির সেনের এই সাহস? তক্কে তক্কে থাকলেন সুযোগের অপেক্ষায়। নির্বাচনে সেবার বিপুল ভোটে জয়ী হলেন কম্রেড জ্যোতি বসু। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রিত্বের সাথে সাথে বিপুল ক্ষমতাও তাঁর হাতে এলো। মিহির সেনকে কিন্তু তিনি ভোলেন নি। দিলেন নিজের পোষা গুন্ডাদের লেলিয়ে। খিদিরপুরে মিহির সেনের প্রতিষ্ঠানে গঠিত হল বামফ্রন্ট পরিচালিত CITU, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে বাধ্য হলেন মিহির সেন। লেবার ল’য়ের বিরুদ্ধে যাননি তিনি। যথারীতি এর ফলে নিত্য অশান্তি ও ধর্মঘট শুরু হয়। ট্রেড ইউনিয়ানের মনোমত কাজ না হলেই গ্রাফিটি আর স্লোগানে ভরে যেত মিহির সেনের অফিসের চত্ত্বর, দোকান আর কারখানা। রাসেল স্ট্রীটের সুপ্রিয়া নামের দোকানটা মাঝেমাঝেই অশান্তির কবলে পড়ত। রাস্তায় বসে দোকান অবরোধ করে দিনের পর দিন চলত সিটুর ধর্মঘট। ধীরে ধীরে এই ধর্মঘটের আঁচ লাগলো মিহির সেনের রেশম কারখানাতেও। খিদিরপুরের জামাকাপড়ের কারখানা আর কারখানা রইলো না, চায়ের দোকান হয়ে গেল রাতারাতি। পুলিশকে মুক দর্শক থাকতে বলা হল আলিমুদ্দিন থেকে। মিহির সেনের আরো দুটো কারখানা ছিল খিদিরপুরে, সিল্ক স্ক্রীনিং ও সিল্ক ব্লক প্রিন্টের, কারখানা দুটো দুর্দশার মুখে পড়ল। ট্রাক ভর্তি মাল রপ্তানির জন্য প্রস্তুত কিন্তু সিটুর ধর্মঘটের জেরে রপ্তানি করা গেল না। সিটু পুড়িয়ে দিল সেই ট্রাক সমেত লক্ষাধিক টাকার মাল। পুলিশ শুধু দাঁড়িয়ে দেখলো সব, হস্তক্ষেপ করা তো দুরের কথা, বাধা দিতেও এগিয়ে গেল না পুলিশ। CITUর তাড়নায় ঋদ্ধ ব্যবসা লাটে উঠলো। কমরেড জ্যোতি বসুর প্রতিশোধ কি পূরণ হল?
না, এই তো সবে শুরু! একের পর এক সাজানো কেসে ফাঁসানো হল মিহির সেনকে। পুলিশ অতর্কিতে এসে হানা দিত তাঁর বাসস্থানে, সংস্থায়, কারখানায়, সর্বত্র। নগদ টাকা পয়সা, সম্পত্তি সব বাজেয়াপ্ত করে ফেলে রেখে গেল এক ভেঙ্গে পড়া, হতাশাগ্রস্থ পরিবারকে। দেউলিয়া হয়ে যাওয়া ওই মানুষটি নিজের পরিবারকে সামান্য গ্রাসাচ্ছদনের ক্ষমতা পর্যন্ত ছিল না। স্ট্রোক হলো মিহির সেনের। স্মৃতিলুপ্ত হলো তাঁর। বয়স ছিল তখন মাত্র ৫০।
কেসের জন্য কোর্টে হাজিরা দিতে যেতে হত নিয়মিত মিহির সেনকে, সঙ্গে থাকতেন তাঁর বৃটিশ সহধর্মিনি বেলা। কোর্টে যাওয়ার পথে বামপন্থি উকিলরা টিটকারি মারতেও ছাড়তো না দম্পতিকে। তাঁর স্মৃতিলোপ, খ্যাতি, সুনাম… সবই উপহাস ও বিদ্রুপের কবলে পড়লো। ভাবছেন এই বোধহয় শেষ অধ্যায়, এর পর কি আর কারুর দরকার থাকতে পারে ওনাকে, ভুল, এখানেই শেষ না।
জ্যোতিবাবু একটু খেলাতে চাইলেন মানুষটাকে। ১৯৮৮ সাল, আবার ডেকে পাঠালেন হতভাগ্য মিহির সেনকে। বললেন বামফ্রন্টে যোগ দিলে তাঁর সব কষ্ট দুঃখের অবসান হবে। মিহির সেন ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন সেই প্রস্তাব। ফলে বাম গুন্ডারা তাঁর জীবন আরো দুর্বিসহ করে দিল। কেসের নিষ্পত্তি হতে হতেও হতো না।
১৯৯৩ সাল, কেন্দ্রে তখন নরসিম্হা রাও সরকার, ক্রীড়া মন্ত্রি ছিলেন আজকের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রি মমতা বন্দ্যপাধ্যায়। দেখা করলেন কিংবদন্তি মানুষটার সাথে। সামান্য পেনশনের প্রতিশ্রুতি দিলেন মমতা। কোনমতে জীবনধারণের জন্য তা কি যথেষ্ট ছিল? চার বছর পর ১৯৯৭ এ মিহির সেন যখন মারা যান তখন তিনি ছিলেন নিঃস্ব! আলিপুরের ফ্ল্যাটটা ছাড়া আর কোন সম্পত্তি তাঁর ছিল না। তাও ফ্ল্যাটটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কর্পোরেশনের অ্যালট করা মিহির সেনের নামে!
ভাবছেন মৃত্যুতে তো শেষ হবে মিহির সেনের জীবনের পীড়া? না, না আরো আছে, বলি শুনুন। মিহির সেনের এক কন্যা আছেন, সুপ্রিয়া, তিনি লন্ডনে থাকতেন। পিতার মৃত্যুর কয়েকবছর পর আলিপুরের ফ্যাটে ঢুকতে গিয়ে দেখেন সব তছনছ, বাড়ি লন্ডভন্ড, কে বা কারা মিহির সেনের পদ্মশ্রী ও পন্মভূষণ মেডেল দুটি সমেত বেশ কিছু মেডেল চুরি করেছে। ফোনে হুমকি পেতেন ফ্ল্যাট খালি করার।
আশে পাশের থানা, কলকাতা পুলিশ কমিশনারকে জানিয়েও যখন কোনো লাভ হল না তখন মিহির কন্যা সুপ্রিয়া দারস্থ হলেন মাননীয়া মমতার। সেখানেও তেমন সুবিধা করে উঠতে পারলেন না তিনি। ফলে আজ স্বনামধন্য জগৎবিখ্যাত এই সন্তরণবিদ বাঙালি মিহির সেন লোকচক্ষুর আড়ালে বিস্মৃতপ্রায় হয়েই রয়ে গেলেন।
আমরা এই প্রজন্মের বাঙালিরা শুধু তাঁর কীর্তির কথাই শুনে এসেছি এযাবৎ, কিন্তু জানতেও পারিনি কিভাবে এই এককালের সফল ক্রীড়াবিদ ও ব্যবসায়ী জীবনের শেষপ্রান্তে নিঃস্ব কপর্দকহীন হয়ে গেলেন। জ্যোতি বসুর লোভ, অহংকার ও ক্ররতা একজন সফল মানুষকে কি ভাবে পদে পদে হেনস্থা করে অসহায় করে দিয়েছিল তা কি আমরা জানতাম? বামফ্রন্ট এই রাজ্যের একটা বিষবৃক্ষ পুঁতে দিয়ে গেছিল। সেই বিষবৃক্ষের বিষফলে সাধারন মানুষ থেকে কিংবদন্তি মানুষেরা কেউ রেহাই পায় নি। সেই বিষবৃক্ষ কি বামেদের সাথে ৩৪ বছর পর শেষ হয়ে গেছে? সমূলে উৎপাটিত হয়েছে এ রাজ্যে? নাকি এখনো সযত্নে লালিত হচ্ছে অন্য কোথাও অন্য কোন নামে? ভেবে দেখার জন্য বলছি আপনাদের, ভেবে দেখুন, লোককেও ভাবান নিজেও ভাবুন।