তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রকে সাংসদ পদ থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করল লোকসভার এথিক্স কমিটি। বৃহস্পতিবার ৫০০ পাতার খসড়া রিপোর্ট নিয়ে বৈঠকে বসেন কমিটির সদস্যেরা। সেখানেই কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদকে বহিষ্কারের সুপারিশের প্রস্তাব রাখেন কমিটির চেয়ারম্যান তথা বিজেপি সাংসদ বিনোদ সোনকর। সংখ্যা গরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে বহিষ্কারের সুপারিশে অনুমোদন দেয় এথিক্স কমিটি। শুক্রবার সেই রিপোর্ট পাঠানো হবে লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লার কাছে। এথিক্স কমিটির সুপারিশের প্রতিক্রিয়ায় মহুয়া আনন্দবাজার অলনাইনকে বলেন, ‘‘জানাই ছিল।’’
প্রসঙ্গত, কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করলেও তা এখনই সিদ্ধান্ত নয়। স্পিকার এই প্রস্তাব পেশ করবেন সংসদের আগামী অধিবেশনে। বিরোধীরা আলোচনা চাইলে তা আদৌ স্পিকার গ্রহণ করবেন কি না সেটি তাঁর এক্তিয়ারের বিষয়। তবে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে, নিয়ম এমনটাই।
এথিক্স কমিটির সুপারিশ
এথিক্স কমিটি মহুয়াকে বহিষ্কারের পাশাপাশি রিপোর্টে তাঁর বিরুদ্ধে কড়া কথা লিখেছে বলেও খবর। জানা গিয়েছে, এথিক্স কমিটি তাদের রিপোর্টে বলেছে, ‘‘মহুয়া মৈত্র এবং দর্শন হীরানন্দানির মধ্যে যে টাকার লেনদেন হয়েছে, কেন্দ্রের উচিত নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার আইনি এবং প্রাতিষ্ঠানিক তদন্ত করা।’’ প্রসঙ্গত, বুধবারই বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডেলে দাবি করেছিলেন, মহুয়ার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে জাতীয় লোকপাল। এই নিশিকান্তই মহুয়ার বিরুদ্ধে সংসদে ‘ঘুষ নিয়ে প্রশ্ন’ তোলার অভিযোগ তুলে চিঠি লিখেছিলেন স্পিকারকে। সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই এথিক্স কমিটিকে তদন্ত করতে বলেন স্পিকার। প্রসঙ্গত, বুধবারই সংবাদমাধ্যমে ‘ফাঁস’ হয়ে গিয়েছিল এথিক্স কমিটির রিপোর্ট। কী ভাবে গোপন রিপোর্ট ফাঁস হয়ে গেল, সেই প্রশ্ন তুলে বৃহস্পতিবার চিঠি লেখেন মহুয়াও। প্রসঙ্গত এই সুপারিশ নিয়ে এথিক্স কমিটির বৈঠকে ভোটাভুটিও হয়। বহিষ্কারের সুপারিশের পক্ষে ভোট দেন ছ’জন সাংসদ। বিরুদ্ধে মত দেন চার জন।
অভিষেকের প্রতিক্রিয়া
গত ১৫ অক্টোবর মহুয়াকে ঘিরে ‘ঘুষের বিনিময়ে প্রশ্ন’ বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছিল। তার পর থেকে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় কোনও মন্তব্য করেননি। বৃহস্পতিবার নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অভিষেকের হাজিরা ছিল সিজিও কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই বেরিয়ে এসেছিলেন তৃণমূলের ‘সেনাপতি’। মহুয়া প্রসঙ্গে অভিষেকের জবাব ছিল, “মহুয়া নিজের লড়াই নিজেই লড়তে পারেন।” এর পরেই তিনি অভিযোগ তোলেন, বিজেপির এমন অনেক সাংসদ রয়েছেন, যাঁদের বিরুদ্ধে স্বাধিকারভঙ্গের প্রস্তাব আনা হয়েছে, কিন্তু সে সবের এখনও কোনও শুনানিই হয়নি। এ কথা বলতে গিয়ে বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরীর প্রসঙ্গও টেনে এনেছেন অভিষেক। তাঁর কথায়, “নতুন সংসদ ভবনে যখন অধিবেশন ডাকা হয়েছিল তখন বিজেপি সাংসদ রমেশ বিধুরী যে আপত্তিকর ভাষা ব্যবহার করেছেন, তাতে সংসদের গৌরব নষ্ট হয়েছে।” এর আগে তৃণমূলের তরফে ডেরেক ও’ব্রায়েন বলেছিলেন, ‘‘তদন্ত শেষের পরেই দল যা বলার বলবে।’’ আর কুণাল ঘোষের বক্তব্য ছিল, ‘‘মহুয়ার বিষয়ে তৃণমূলের কোনও বক্তব্য নেই। দল এ নিয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাবে না।’’ রাজনৈতিক মহলের অনেকের মতে, অভিষেকের কথার মধ্যেও বৃহস্পতিবার মহুয়ার পাশে দাঁড়ানোর সুর শোনা যায়নি। বিবিধ ক্ষেত্রে পক্ষপাতের অভিযোগ তুললেও তিনি মহুয়ার বিষয়টিকে দল থেকে পৃথক রাখতে চেয়েছেন বলেই মত অনেকের।
মহুয়ার প্রতিক্রিয়া
এথিক্স কমিটির রিপোর্ট বুধবার সংবাদমাধ্যমে ‘ফাঁস’ হয়ে যাওয়ার পরে মহুয়া বলেছিলেন, ‘‘এটা তো প্রথম থেকেই জানা ছিল। যা হবে, দেখা যাবে। ওরা যত বেশি এ সব করবে, আমরা তত বেশি ওদের বিরুদ্ধে লড়ব।’’ বৃহস্পতিবারও একই কথা বলেছেন কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ। কৌতূহল, শুক্রবার এই বিতর্ক, এক্স হ্যান্ডেলে নিশিকান্তের সঙ্গে মহুয়ার বাগ্যুদ্ধ কোন দিকে মোড় নেয়!
দেহাদ্রাইয়ের কুকুর উদ্ধার
তৃণমূল সাংসদ মহুয়ার বিরুদ্ধে রটওয়েলার প্রজাতির পোষ্যকে অপহরণ’-এর অভিযোগ করেছিলেন তাঁর প্রাক্তন বান্ধব দেহাদ্রাই। বৃহস্পতিবার এথিক্স কমিটি মহুয়াকে বহিষ্কারের সুপারিশ করার কিছু ক্ষণ পরেই এক্স (পূর্বতন টুইটার) হ্যান্ডলে পোষ্য হেনরির ফিরে আসার ভিডিয়ো পোস্ট করেন তিনি। দেহাদ্রাই জানান, ঘরে ফিরে হেনরি ‘উত্তেজিত’। ভিডিয়োটি বৃহস্পতিবারের কি না, তার কোনও উল্লেখ অবশ্য জয়ের বক্তব্যে নেই। এক্সে জয় লিখেছেন, ‘‘স্বাগত হেনরি! আপনাদের সমর্থন, প্রার্থনা, শুভেচ্ছার জন্য ধন্যবাদ। ঘরে ফিরে হেনরি উত্তেজিত।’’ ভিডিয়োতে তাঁকে পোষ্যের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়, ‘‘শরীরচর্চা করোনি বলে মোটা হয়ে গেছ!’’
শুভেন্দুর তোপ
মহুয়ার উদ্দেশে বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের সভা থেকে তীব্র আক্রমণ শানান বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে ওই সাংসদ যে ধরনের হঠকারী ও দেশ-বিরোধী কাজ করেছেন, তাতে তাঁর সাংসদ পদ যাওয়াটা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।’’ নন্দীগ্রামের বিধায়ক আরও বলেন, ‘‘সংসদের মেয়াদ আর পাঁচ থেকে ছ’মাস আছে। তাই শুধু সদস্যপদ গেলেই হবে না, রাজ্যের মানুষ চায়, এই ধরনের ফ্রড (প্রতারক) সাংসদ যেন জেলে যায়।’’