সহায়-সম্বলহীন ছিন্নমূল মানুষরা ভারতীয় কমিউনিস্টদের বিশ্বাস করার মূল্য কতটা-কী দিয়েছিল,তার অগ্নিশিখা-সম দৃষ্টান্ত মরিচঝাঁপি!আরও নির্দিষ্ট করে বললে,ভারতের পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) নামক অঙ্গরাজ্যের কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে (Jyoti Basu) বিশ্বাস করে নিরীহ-নিষ্পাপ হিন্দু শরণার্থীরা নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বিশ্বাসের মূল্য মিটিয়েছিলেন!
এতদিনে সারাবিশ্বের মানুষ জেনেছেন কমিউনিস্টদের চরিত্র।বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ-বাসী ৩৫ বছর ধরে চাক্ষুষ করেছেন সিপিআই-এমের অত্যাচার,ভন্ডামি।সর্বহারাদের কথা বলে সর্ব সাধারণের ভোটে জিতে পশ্চিমবঙ্গের শাসন ক্ষমতার আসে সিপিআই-এম।তাদের শাসনকালে পুরুলিয়ায় অস্ত্র বর্ষণ,বিজন সেতু হত্যাকান্ড,সাঁইবাড়ি গণহত্যা,নন্দীগ্রাম,সর্বোপরি মরিচঝাঁপিতে পরিকল্পিত গণহত্যা সবক্ষেত্রেই সর্বহারাদের প্রাণ নিয়েছে সর্বহারাদের গান-গাওয়া ভারতীয় কমিউনিস্টরা!

১৯৪৭ সালে ধর্মের নামে দেশভাগের মধ্য দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তী।পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্ম।কয়েক কোটি হিন্দু জীবন-ধর্ম-সম্ভ্রম রক্ষার জন্য শূন্য হাতে,ছিন্নমূল হয়ে ভারতে আগমন করে শরণার্থী হয়ে।তারপর ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হল ভারতের সাহায্য নিয়ে।এবারও হিন্দুদের একই কারণে ভারতে আসার ঢল নামল।যদিও ১৯৪৭ থেকেই এখনও পর্যন্ত মুসলিম দ্বারা নির্যাতিত হিন্দুদের ভারতে আসা বন্ধ হয় নি

ভারত সরকার এই অসহায় হিন্দুদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে।ত্রিপুরা,অসম,মধ্যপ্রদেশ,আন্দামান নানা স্থানে তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়।বাংলার জল-আবহাওয়াতে বেড়ে ওঠা কৃষিজীবী মানুষদের পাঠানো মধ্যপ্রদেশের পাথুরে অরণ্যাঞ্চল দন্ডাকারণ্যে পুনর্বাসনের নামে!ভাবুন একবার সেখানে রূক্ষ্ম ভূমি।বৃষ্টি নেই।সেখানে সমতলের উর্বর ভূমির কৃষিজীবী মানুষরা জীবিকা নির্বাহ করবেন কীভাবে!বাঁচবেনই-বা কেমন করে!অনাহারে-অর্ধাহারে-নির্জলা হয়ে,রোগে ভুগে শীর্ণ শরীরে তবুও তাঁরা বাঁচার সংগ্রাম করে চললেন!আর স্বপ্ন দেখতে থাকলেন জন্মভূমিতে ফিরে আসার।পারতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গে

১৯৭৯ সালের প্রথম দিকে প্রায় চল্লিশ হাজার ক্ষুধার্ত-শীর্ণ হিন্দু শরণার্থী এলেন দন্ডকারণ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে নতুন ভাবে বাঁচার আশায়।তার দু’বছর আগেই পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় এসেছে ভারতীয় সিপিএম (CPM)।মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু (Jyoti Basu)।শীর্ষস্থানীয় সিপিএম নেতারা নানাবিধ লোভ,সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রদানের ফানুস দেখিয়ে হিন্দু শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে আনার ব্যবস্থা করে।বিনিময়ে শরণার্থীদের সিপিএম-কে ভোটটা দিতে হবে! সমতলের জন্য আকুলিত প্রাণ,সহজ-সরল মানুষগুলো সরকারি ক্ষমতায় থাকাদের অতি অল্পতেই বিশ্বাস করলেন। আগ্রহী পাঠকদের জন্য জানিয়ে রাখা যে,পূর্ব পাকিস্তান থেকে মুসলিমদের দ্বারা অত্যাচারিত-বিতাড়িত হিন্দুদের নিয়ে তৈরি চলচ্চিত্র “জীবন ঢুলি” ও “সীমান্তরেখা-১৯৪৭” দেখে নেওয়া যেতে পারে।পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল

সেই চল্লিশ হাজার হিন্দু শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গের সুন্দর বনাঞ্চলের মরিচঝাঁপি দ্বীপে আশ্রয় নিলেন।তাঁদের এ-রাজ্যে আনার জন্য সিপিএম নেতাদের সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।অথচ তাঁরা যখন এলেন,তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁদের কোনোরূপ দায়দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করে

১৯৭৯ সালের জানুয়ারির শেষ দিকে শরণার্থীরা জলপথে মরিচঝাঁপি দ্বীপে এসে পৌঁছন।এ-সংবাদ পেয়েই তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার পুলিস পাঠাল।পুলিস লঞ্চ ও নৌকা দিয়ে পুরো জলপথ ঘিরে ফেলল।মরিচঝাঁপিতে ঢোকা-বেরনোর রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ করে দিল পুলিস।অবরুদ্ধ-হতভাগা হিন্দু শরণার্থীরা না-পেলেন একফোঁটা জল!না-পেলেন এককণা খাদ্য!না-পেলেন ওষুধ!

৩১-শে জানুয়ারি।ভোর বেলা।শীতের কুয়াশায় চারদিক ঢাকা।নদীর বুকে ঘন কুয়াশার আস্তরণ।দৃষ্টি দূরে যাচ্ছে না।অনাহারক্লিষ্ট হিন্দুরা শীতে জড়োসড়ো হয়ে পড়ে আছেন কোনো মতে।
হঠাৎ চারদিক থেকে গুলির শব্দ শুরু হল!সাথে বারুদের গন্ধ!আর্ত চিৎকার!হাহাকারে ভোরের নিস্তব্ধতা খান‌্খা‌ন‌্ হল!ভয়ার্ত পাখিরা বাসা ছেড়ে আকাশে পাক খেতে লাগল!কিছু বোঝার আগেই অগণিত অভাগা হিন্দু শরণার্থী পুলিসের গুলিতে প্রাণ হারালো।পুলিস সেদিন সরাসরি গুলি চালিয়েছিল তাঁদের লক্ষ্য করে।এ-যেন স্বাধীন ভারতে দ্বিতীয় জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা!সেদিন কত নিরীহ শিশু-নারী-পুরুষ হিন্দুর প্রাণ গিয়েছিল তার সংখ্যা আজ পর্যন্ত জানা যায় নি!কেন না পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনোদিন মৃত বা আহতদের সংখ্যা সরকারি ভাবে প্রকাশ্যে আনেনি।তখন কোন‌্ নরপিশাচ ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ? কার নির্দেশে এই নারকীয় গণহত্যা সংগঠিত হয়েছিল ? “মাননীয়-সম্মানীয়-জননেতা-গরীবের মঁসিয়া” শ্রীযুক্ত বাবু জ্যোতি বসু !বসুর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে,এই আন্দাজ করেই “সৎ বিবেচক” বসু সাহেব মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করলেন!এবং স্বাধীন ভারতে একটি ইতিহাস বানালেন যে,মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন কুর্সি ছাড়লেন! সবই রাজনৈতিক চাল।কারণ বিশ্ববাসী জানেন পরবর্তী সময়ে কত বছর তিনি “ছেড়ে” দেওয়া কুর্সিতে সুখাসিন ছিলেন!

গত ৮ জুলাই ছিল এই “গণহত্যার নায়ক” জ্যোতি বসুর জন্মদিন।ভারত ভুলে গিয়েছে নায়কের কীর্তি-কাহিনি।হিচেন (Hitchens) যথার্থই বলেছেন,”তাঁর মতো নরখাদক আর কেউ নেই”।

জ্যোতি বসুর জন্ম কলকাতায়।৮ জুলাই,১৯১৪ সালে।কমিউনিস্টদের “আইকন” “আদর্শ ব্যক্তিত্ব” তিনি! অন্যান্য সিপিএম নেতার মতো তিনিও উচ্চ বর্ণীয় সুবিধাভোগী ছিলেন।শৈশবে তিনি নামী কিন্ডার গার্টেন স্কুলে পড়েছেন।পরবর্তি কালে লোরেটো ও জেভিয়ার্সে।দুটি স্কুলই চালাত ব্রিটিশ বুরো সাহিবস‌্।ব্রিটিশের তাঁবেদার ও তোষামোদকারিদের সন্তানদেরই এই সব স্কুলে পড়ার সৌভাগ্য হত।তারপর ব্রিটিশ ভারতের এলিট স্কুল।পরে ইংল্যাণ্ডের এলিট কলেজ।সেখান থেকে তিনি ব্যারিস্টার হন।

৪০ হাজার হিন্দু শরণার্থীর জন্য জ্যোতি বসুর এককণাও সহমর্মীতা ছিল না।যাঁরা অধুনা বাংলাদেশ থেকে মুসলমানদের অত্যাচারে মান-সম্ভ্রম ধর্ম রক্ষার্থে, শূন্য হাতে ভারতে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।আমাদের ঐতিহাসিকগণ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন যে,শরণার্থীদের সিংহ ভাগই ছিল পিছড়ে বর্গের হিন্দু।এই কারণেই জ্যোতি বসুর কোনো অনুকম্পা তাঁদের প্রতি ছিল না!

এটাই হল কমিউনিজমের চরিত্র! প্রকাশ্যে সর্বহারাদের জন্য কেঁদে গঙ্গা বানাও!বামপন্থী-কীর্তিধ্বজ ওড়াও!আখেরে নিজের সুবিধা বাড়াও!তাঁবেদার ইতিহাস লেখকগোষ্ঠী তৈরি করো!তাঁরাই মগজধোলাইয়ের কাহিনি ছড়াবে!যেমনটা “হীরক রাজার দেশে” সত্যজিৎ রায় তুলে ধরেছেন।

১৯৬২-র ভারত-চীন যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে।জ্যোতি বসু প্রকাশ্যে একটি জনমিছিল করালেন।তিনি উচ্চকন্ঠে ঘোষণা করলেন,”চীন মোটেই আগে থেকে বিবাদ করেনি”!তাঁর রাজনীতি ছিল দেশদ্রোহীতামূলক ও রক্তলোলুপ!

ঘটনাক্রমে,১৯৯৭ সালে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বিধানসভায় জানান যে,”এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ২৮ হাজার মানুষ রাজনৈতিক কারণে খুন হয়েছেন”।বাম-জমানার ২০ বছরে ২৮ হাজার খুন! প্রতি বছরে গড়ে ১৪০০ জন নিরীহ মানুষ খুন!এবার কল্পনা করা যাক প্রকৃত সংখ্যা কত হতে পারে!২৮ হাজার হল সরকারি হিসেব।এই গণহত্যা নিয়ে রাজ্যে কেউ টু-শব্দটুকুও করেনি।ইতিহাসে লেখা হয় নি।কেন না,রাজ্য-কমিউনিস্টরা নিজস্ব ইতিহাসবিদ ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় বানিয়ে ফেলেছিল।যাঁরা এসব কিছু দেখেও না! শোনেও না!

১৯৯৬ সালের লোকসভা নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না।অন্যান্য দলের সমর্থনে জ্যোতি বসুর সামনে প্রধানমন্ত্রী হবার একটা “সুবর্ণ” সুযোগ এসেছিল।কিন্তু জ্যোতি বসুর নিজেরই দলের মধ্যে হিংসুকদের অভাব ছিল না!এখনও তাই।তাঁরা জ্যোতি বসুর স্বপ্ন পূরণে বাধা দিলেন।অধ্যাত্মবাদী ভারতবাসীর সৌভাগ্য যে,শরণার্থীহত্যার নায়ক প্রধানমন্ত্রীর কুর্সিতে বসতে পারেন নি। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে-কি,চীনের তিয়েন-আন-মিন স্কোয়ারের কথা!যেখানে ১০ হাজার নিরীহ জনগণকে মুহূর্তেই হত্যা করেছিল চীনা কমিউনিস্ট!আরও মনে পড়বে হয়ত,জ্যোতি বসুর অর্থনৈতিক নীতির কারণেই বঙ্গ ছেড়ে শিল্প-কারখানা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।কমিউনিস্টদের সেই “প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি” কোথায় গেল!যা “জনগণের বিপ্লব” আনবে।তাঁদের মুক্তি আনবে! সর্বহারার গণতন্ত্র আনবে!প্রবল ভাবে ব্যক্তি-ক্ষমতালোভীরা আনবে জনগণের গণতন্ত্র!যাঁদের ব্যক্তিস্বার্থের জন্যই জ্যোতি বসু প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন নি।

আসুন,এই অবকাশে জ্যোতি বসুর ছেলে চন্দন বাবুর সাথে পরিচিত হওয়া যাক।শ্রমিক শ্রেনীর হয়ে লড়াই করার জন্য জ্যোতি বসু তাঁর ছেলেকে লড়াই শেখার জন্য কোন‌্ দেশে পাঠিয়ে ছিলেন? ভিয়েতনাম নাকি গুয়াতেমালায়!নৈব নৈব চঃ!একেবারেই নয়!একদমই নয়!বাবার রাজনীতি শিল্পপতিদের বিরুদ্ধে!তাই বলে ছেলেও-কি শ্রমিক শ্রেনীর হয়ে লড়াই করবে! তাই কখনও হয় নাকি কমিউনিস্ট পরিবারে!চন্দন বাবু একজন অন্যতম বড়মাপের শিল্পপতি।পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি ও কর্পোরেট ঋণের হিসেব মতে চন্দন বাবু খুবই বড় মাপের এক শিল্পপতি!
বাবা কমিউনিস্ট পার্টি চালিত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।আর ছেলে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ফাইনানশিয়াল কর্পোরেসনের সুপারিশে ঋণ পাওয়ার জন্য যোগ্যতম ব্যক্তি!পিতা-পুত্রের এই যুগলবন্দি সততার জন্য তাঁরা “পদ্ম বিভূষণ” পাবার যোগ্য! যা দেশ ও জাতির কাছে এক অমলিন দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে!

এসব কীভাবে সম্ভব ? খুব সহজ অঙ্ক।ছেলের পাশে বাবা,স্বয়ং জ্যোতি বসু! সর্বহারার উদ্ধারকর্তা–মঁসিয়া!আর রয়েছে নিজস্ব স্তাবক গোষ্ঠী।যথা–লেখক-কবি-সাংবাদিক-উচ্ছিষ্টভোজী বুদ্ধিজীবী-ইতিহাসবিদ—প্রত্যেকেই আছেন যে !এ তো আর সেই নবি মুম্বাইয়ের ঘটনা নয়।রাতে কে চার্চে পাথর ছুঁড়ল।আর সকালে নিউ ইয়র্ক টাইম ‘অসহিষ্ণুতা’ বলে হুক্কাহুয়া শুরু করবে!এ যে ‘খাঁটি’ কমিউনিজম!

জ্যোতি বাবু বর্তমানে স্বর্গবাসী।যদি কমিউনিস্টা সেটা বিশ্বাস করেন,তবে।তাই তাঁকে নিয়ে অযথা কথা নয়।তবে সেখানেও ২৮ হাজার মানুষদের আর্ত চিৎকার আছে।তাঁদের পরিজনদের দীর্ঘশ্বাস ও অভিশাপ আছে।

সুজিত চক্রবর্তী

ঋণ :- OPINDIA

https://www.opindia.com/2020/07/jyoti-basu-marichjhapi-massacre-bangladesh-refugees-west-bengal/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.