ইন্দিরার ‘জরুরী অবস্থা’ ও রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ১৯৭৫ সালের ২৫-২৬ জুন একটি “কালো দিন” হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে।থাকবেও চির কাল।এদিন গণতান্ত্রিক ভারতের আকাশ “এক নায়কতন্ত্র”-র কালোমেঘ ঢেকে দিয়েছিল।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলী আহমেদের উপর অবৈধ, অগণতান্ত্রিক ও অমানবিক চাপ সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশে জাতীয় জরুরী অবস্থা ঘোষণাপত্রে সই করতে বাধ্য করেন।সই করানোর অব্যবহিত পরেই,কেন্দ্র সরকার নিয়ন্ত্রিত “আকাশবানী” বেতারে প্রচার করা হয় যে, “মাননীয় রাষ্ট্রপতি ‘সন্তুষ্টি’-র সহিত দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন।কিন্তু দেশবাসীর ভয়ের কিছু নেই।সব কিছুই স্বাভাবিক থাকবে।”

কিন্তু এটা ছিল দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করা জন্য একটি “পোলাইট ম্যানার!”এমনকি “জরুরী অবস্থা”-টাও ছিল বানানো।তখনকার ইন্দিরা বিরোধীদের যেনতেন ভাবে আটকে রাখাই ছিল শ্রীমতি গান্ধীর মূল উদ্দেশ্য।বিরোধী কন্ঠস্বর রুদ্ধ করাই ছিল ক্ষমতায় টিকে থাকার একমাত্র পথ।এবং তার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে অনৈতিক ভাবে ব্যবহার করা।
১৯৭৫-র ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্ট একটি ঐতিহাসিক রায় দেয়।রায়ে বলা হয় ইন্দিরা দুর্নীতি ও অসৎ উপায়ে লোকসভা ভোটে জয়ী হয়েছেন।তাঁর প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসার নৈতিক অধিকার নেই।
আইনি ভাবে এই রায়ের অন্যথা করার উপায় ইন্দিরায় ছিল না।তিনি প্রমাদ গনলেন যে,এই রায়ের ফলে তাঁর পিতা নেহেরু,তিনি নিজে এবং গান্ধী পরিবারের সমূলে ধ্বংস হবার রাস্তা পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে।তাই তিনি তাঁর কিছু পদলেহী ও বিশ্বাসী সেনা-আধিকারীকদের সাথে শলা পরামর্শ করে “জরুরী অবস্থা” ঘোষণা করানোর সিদ্ধান্ত নেন।

গণতন্ত্রের নামে এটা ছিল ‘এক নায়কতন্ত্র’-র নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।দুর্বৃত্তায়নের এক শ্বাস রুদ্ধকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সকল ভারতবাসীকে চলতে হয়েছে।প্রতি মুহূর্তেই আতঙ্ক-অনিশ্চয়তা আর অনিদ্দেশ্য ভয় মানুষকে তাড়া করে বেড়িয়েছে।স্বাধীনতা-উত্তরকালে দেশবাসী এই প্রথম এক অরাজক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন।এই ভয়ঙ্করতম অভিজ্ঞতাও প্রথম হল।
দেশবাসী উপলব্ধি করলেন সোভিয়েত বা চীনাদের দৈনন্দিন জীবন যাপনের দূরবস্থা।এটাও অনুভব করলেন যে,ব্যক্তি স্বাধীনতা,জীবনের মূল্য,সামাজিক মূল্যবোধের উপকারিতা।দেশবাসী সুস্থির গণতন্ত্রের জন্য লালায়িত হয়ে উঠলেন।
সামগ্রিক ভাবে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার ন্যক্করজনক নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশি ঘটেনি।ইন্দিরা গান্ধীকে এক সময় ভারতীয় কমিউনিস্টরা ‘ডাইনি’ বলত।তারা যে ভুল বলত না,তা জরুরী অবস্থা থেকে বেঁচে ফেরা মানুষরা অনেকেই স্বীকার করেন।
বলা হয়,’বিষে,বিষ ক্ষয় হয়’।ইন্দিরার নিষ্ঠুরতার মধ্যেই হয়ত তাঁর ধ্বংসের বীজ সুপ্তাবস্থায় ছিল।বনের শক্তিশালী গজরাজও এক সময় পতিত হয়।ভারতীয় জনতাও নির্বাচনের মাধ্যমে ইন্দিরাকে যোগ্য জবাব দিয়েছিলেন।তারপর তো আততায়ীর গুলিতে তাঁর ‘পঞ্চত্ব প্রাপ্তী’ ঘটে।ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না।

ভারতে বানানো ‘জরুরী অবস্থা’ চলাকালীন বিশ্ব-রাজনীতিতেও একাধিক সাড়া জাগানো ঘটনা ঘটে।
‘প্রাপ্ত বয়স্ক গণতান্ত্রিক দেশ’ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত হন ১৯৭২ সালে।তাঁকে ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে সে-দেশের জনতা রাষ্ট্রপতির কার্যালয় থেকে নিক্সনকে বের করে দেন।তৎকালীন ‘ওয়াশিংটন পোষ্ট’ সংবাদপত্রের দু’জন সাংবাদিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিক্সনের দুর্নীতিগুলি প্রকাশ্যে আনেন।আমেরিকার ইতিহাসে নিক্সনের দুর্নীতি বিখ্যাত ‘ওয়াটারগেট স্ক্যান্ডাল’ নামে পরিচিত।
কিন্তু ভারতের ‘জরুরী অবস্থা’-র খবর যাতে বাইরে না-যায়,তার জন্য ইন্দিরা গান্ধী সংবাদ প্রকাশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করেন।শুধুমাত্র ইন্দিরার বশংবদ কিছু সংবাদ পত্র-পত্রিকা নির্বাচিত সংবাদগুলিই প্রকাশ করতে পারত।

ভারতে ১৯৬৯,১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে অনাবৃষ্টি দেখা দেয়।ফলে কৃষি উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে কম হয়।সারা দেশে খাদ্যের জন্য হাহাকার ও অস্থিরতা বাড়তে বাড়তে চরম পর্যায়ে পৌঁছয়।সারা দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষের দাম অত্যধিক হারে বৃদ্ধি পায়।সাধারণ মানুষের পক্ষে দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্যদ্রব্য জোগাড় করা সাধ্যাতীত হয়ে পড়ে।দেশে দুর্নীতি লাগামহীন ভাবে বৃদ্ধি পায়।যা ‘জরুরী অবস্থা’ লাগু করেও আয়ত্তে আনতে ব্যর্থ হন ইন্দিরা।তৎকালীন কংগ্রেসের অনেক তাবড় নেতারা দুর্নীতিতে কন্ঠ অবধি ডুব দেন।বাধ্য হয়ে ইন্দিরা এই মন্বন্তর-দুর্নীতিকে আইনি বৈধতা দেন।প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ইন্দিরার দেখানো পথেই দেশে দুর্নীতির প্রবেশ ঘটে।তারপর তো দেশবাসী প্রতিদিনের যাপনেই দুর্নীতিকে চাক্ষুষ করে চলেছেন।
দেশ তখন এক অগ্নিকুন্ডের মধ্য দিয়ে চলছিল।যে-কোনো মুহূর্তে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠার প্রতীক্ষায় যেন!মানুষ মুক্তির জন্য দিশাহারা হয়ে পড়েছিলেন। এই অরাজক পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য জয়প্রকাশ নারায়ন জনতাকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন।তিনি আহ্বান জানান “সম্পূর্ণ কান্তি” বা সার্বিক বিপ্লবের।তাঁর আহ্বানে হাজার হাজার ছাত্র ও জনতা এগিয়ে আসেন।

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আর এস এস) মতো দেশপ্রেমী সংগঠন স্বাভাবিক ভাবেই দেশের এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে চুপচাপ বসে থাকতে পারে না।ছিলও না বসে।তখনকার সঙ্ঘকর্তা দেবরাসজী গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন সব।তিনি বলেছিলেন,”দেশের এই ‘জরুরী অবস্থা’ সঙ্ঘের কাছে সুযোগ এনে দিয়েছে।সঙ্ঘকার্য উল্লম্ফন দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।দেশের এই দমবদ্ধকর পরিস্থিতিকে সঙ্ঘ “স্নায়ু যুদ্ধ” হিসেবে চিহ্নিত করেছিল।সঙ্ঘ সংকল্প গ্রহণ করে যে,দমনমূলক ‘জরুরী অবস্থা’ হয়ত বছর দুই চলবে।এই দু’বছরের মধ্যে সঙ্ঘকাজ কুড়ি বছর এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ইন্দিরা তাঁর পিতার মতোই আর এস এস-এর প্রতি কঠোর মনোভাবী ছিলেন।ব্যাপারটা যেন,সঙ্ঘের নাম শুনলেই ইন্দিরার চোয়াল শক্ত হয়ে যেত।সঙ্ঘ জয়প্রকাশজীর আন্দোলন সমর্থন করে।সেই সাথে লোক সংঘর্ষ সমিতি ও ছাত্র যুব সংঘর্ষ বাহিনীকেও সমর্থন জানায়।এই পরিস্থিতিতে আসে এলাহাবাদ হাইকোর্টের সেই ঐতিহাসিক  ও যুগান্তরকারী রায়।যে-রায় ইন্দিরার সাংসদ পদ খারিজ করে দেয়।শুধু তাই নয়,ইন্দিরা যে দুর্নীতির সাহায্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন তাও রায়ে উল্লেখ করা হয়।এবং তাঁকে অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে সরানোর নির্দেশ দেয়।এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্দিরা আরও হিংস্র হয়ে ওঠেন।যে-কোনো প্রকারে পদ আকড়ে থাকতে তিনি মরিয়া হয়ে ওঠেন।তাছাড়া হাইকোর্ট পরবর্তী ছয় বছরের জন্য যে-কোনো ধরণের নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে বিরত থাকতে ইন্দিরাকে নির্দেশ দেয়।
এই রায় ইন্দিরা ও জাতির জীবনে সব কিছু ক্ষণিকের মধ্যে পরিবর্তন নিয়ে আসে।

ইন্দিরা ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি চাপ সৃষ্টি করে ‘জাতীয় জরুরী অবস্থা’ বিলে সই করতে বাধ্য করেন।১৯৭৫-এর ২৫ জুন মধ্যরাতে সারা দেশে ‘জরুরী অবস্থা’ আইন বলবৎ করেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ,জামাত-ই-ইসলামী-সহ মোট ২৭টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।সঙ্ঘের লক্ষাধিক স্বয়ংসেবককে বিনা অভিযোগে ও বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করা হয়।রাতারাতি অটল বিহারী বাজপেয়ী,লালকৃষ্ণ আদবানী ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের আটক করা হয়।যা “মিড নাইট নক” নামে পরিচিত।তাঁদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একাকি বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়।

“জাতীয় জরুরী অবস্থা”-কে অজুহাত করে দেশের নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেন ইন্দিরা।এমন-কি সংবিধান-প্রদত্ত জীবনের বা বেঁচে থাকার অধিকারও হরণ করা হয়।সংবাদ মাধ্যমের উপরও নিষেধাজ্ঞা চাপানো হয়।যার প্রতিবাদ স্বরূপ ২৬ জুনের সব সংবাদপত্রগুলি সম্পাদকীয় কলাম ফাঁকা রেখেই পত্রিকা প্রকাশ করে।
সঙ্ঘের তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক বালাসাহেব দেবরাসজী দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য তৎপর হন।দেশের উত্তর প্রজন্মের কাছে দেশের কালো অধ্যায় ইতিহাস ঠিক ভাবে তুলে ধরার জন্য উদ্যোগী হন।দেশের সেই কালো অধ্যায়ের পর দেশে দুটি প্রজন্ম এসেছে।আজ সেই ইতিহাসকে পুনরায় সকলের সামনে তথ্যসমৃদ্ধ ভাবে তুলে ধরার সময় হয়েছে।

আজ যদি আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন ভয় মুক্ত হয়েছে মনে হয়,যদি মনে হয় যে,আমরা বাক স্বাধীনতা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারছি,যদি ভাবা যায় যে,আমরা সঙ্ঘের নাম গর্বের সাথে উচ্চস্বরে বলতে পারছি,তবে তা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ও দেবরাসজীর জন্যই সম্ভব হয়েছে।ইন্দিরার মতো একজন “ডাইনি” প্রধানমন্ত্রী সঙ্ঘের আপোসহীন সংগ্রাম-আন্দোলনের জন্যই “জরুরী অবস্থা” প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

সেই কালো অধ্যায়ের পর দুই দশক পেরিয়ে গিয়েছে।দেশের নানা প্রান্তে,নানা ভাবে,নানা জন ও সংগঠন সেই অন্ধকার সময়ের নানা দিক নিয়ে আলোকপাত করছে।কিন্তু সবাই আশ্চর্যজনক ভাবেই তৎসময়কালে সঙ্ঘের কার্যক্রম নিয়ে একটি শব্দও ব্যয় করছেন না!
 সম্প্রতি 'টাইমস অব ইন্ডিয়া" বেঙ্গালুরু থেকে 'জরুরী অবস্থা' নিয়ে প্রতিষ্ঠিত কলামিস্টদের লেখা ১১টি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছে।তার মধ্যে কেউ-ই সঙ্ঘের ভূমিকা নিয়ে একটি লাইনও লেখেন নি!
  রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবকদের আত্ম বলিদান,নিপীড়ন সহ্য করা,লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছে।স্বয়ংসেবক ও সঙ্ঘের ভূমিকা পরিকল্পিত ভাবে এড়িয়ে গিয়ে কোনো ইতিহাসই সম্পূর্ণ নয়।তা খন্ডিত।অন্ধের হস্তি দর্শনের মত হাস্যকর।সঙ্ঘের ভূমিকা বাদ দিয়ে "কালো অধ্যায়" সম্পর্কিত কোনো সত্যই সত্য নয়।

বিদেশের সংবাদপত্রগুলিতেও ইন্দিরার ‘জরুরী অবস্থা’ নিয়ে সংবাদ-প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।লন্ডনের ‘দ্য ইকোনমিস্ট’ ১৯৭৬-এর ৪ ডিসেম্বর লেখে যে,”ইন্দিরার বিরুদ্ধে একটি গোষ্ঠী অতি গোপনের প্রচার কার্য চালাচ্ছে।যারা পৃথিবীতে একমাত্র অ-বাম সংগঠন।যারা রক্তাক্ত বিপ্লব ও শ্রেনি সংগ্রাম বিশ্বাস করে না।” এই ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’-ই জন সঙ্ঘকে “হিন্দু কমিউন্যালিস্ট পার্টি” বলে ওই একই প্রবন্ধ উল্লেখ করে।শুধু তাই নয়,আর এস এস-কে তারা জন সঙ্ঘের সাংস্কৃতিক শাখা বলেও লেখে।এমন-কি আর এস এস-কে ‘প্যারামিলিটারি’ নামে চিহ্নিত করে ‘দ্য ইকোনোমিস্ট’।
বিদেশীরা আর এস এস-কে নিয়ে নানা মন গড়া কথা আগেও বলত।এখনও বলে।এমন-কি দেশের কায়েমী স্বার্থান্বেষীরাও সঙ্ঘ-পরিবার বিষয়ে অনুচিত কথা নিয়মিতই বলে থাকে।দেশের সেই শ্বাসরুদ্ধকর দিনে,দেশবাসীর মনে মুক্তি পিপাসা কিন্তু আর এস এস-ই জাগিয়েছিল।কথায় বলে,’হিন্দুরা ঘুমন্ত প্রজাতির জীব’! অতি সহজে তারা কিছু দেখে না।শোনে না।করেও না। দেশের অন্ধকার দিনগুলিতে সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরাই নির্যাতিত ভারতবাসীকে জেগে ওঠার মন্ত্রধ্বনী জনে জনে শুনিয়েছিলেন।প্রতি গ্রামে গ্রামে চার জন করে নিত্য স্বয়ংসেবকরা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরতেন।গ্রামবাসীদের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের কথা বলতেন।তাঁদের মনের ভয় দূর করার জন্য জাগরণের গান শোনাতেন।ফলত পিতা-মাতারা তাঁদের সন্তানদের সঙ্ঘে যুক্ত হবার জন্য প্রেরণা দিতেন।দলে দলে কিশোর-তরুণরা শাখায় আসতে লাগলেন।তাঁরাও মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে শুরু করলেন।
অন্যদিকে জন সঙ্ঘও তাদের মতো করে মানুষদের জাগাতে লাগলেন।

তৎকালীন রাজনৈতিক দল ও নেতাদের যত না শত্রু ভাবতেন ইন্দিরা,তাদের চেয়ে বড়ো ও ভয়ঙ্কর শত্রু ভাবতেন সঙ্ঘ ও স্বয়ংসেবকদের।ইন্দিরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে,বিহার ও গুজরাটে জয়প্রকাশ নারায়ন আন্দোলনের যতটুকু যা করতে পেরেছেন,তার পিছনে রয়েছে আর এস এস-র মস্তিষ্ক ও লোকবল।ইন্দিরাও তাঁর পিতার মতো সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করার কূ-বুদ্ধিতে শান দিতে থাকলেন।সঙ্ঘের শিরদাড়া ভেঙে দিতে উদ্যোগী হলেন।এ-কাজে রাষ্ট্রশক্তিকে ব্যবহার করলেন নিজের স্বার্থ পূরণের জন্য।১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসে ইন্দিরার বিশ্বস্ত আমলা এস এস রায় সঙ্ঘকে নিষিদ্ধ করার ‘নীল নক্সা’ সাজিয়ে পাঠালেন ইন্দিরার কাছে।কিন্তু ইন্দিরার দুর্ভাগ্যবশতঃ বিষয়টি প্রকাশ্যে জানাজানি হয়ে যায়।ইন্দিরার পরিকল্পনা তখনকার মতো নষ্ট হয়।কিন্তু শঠের ছলের অভাব হয় না।বালাসাহেবকে নাগপুর রেল ষ্টশনে গ্রেপ্তার করা হল।তৎসহ হাজার হাজার স্বয়ংসেবককে ইন্দিয়া গ্রেপ্তার করালেন বিনা কারণে।বালাসাহেবকে পুণের কাছে যরওয়াড়া জেলে বন্দী রাখা হল।পরে ধাপে ধাপে এই জেল স্বয়ংসেবকদের দ্বারা ভর্তি করা হল।দমনমূলক ‘মিসা’ আইনে ২৩০১৫ দেশপ্রেমী স্বয়ংসেবককে কয়েক ঘন্টার মধ্যে ধরা হল।যার মধ্যে ৭৭ জন সেবিকাও ছিলেন। ‘সত্যাগ্রহ’ করার অপরাধে আরও ৪৪৯৬৫ জন স্বয়ংসেবককে গ্রেপ্তার করা হয়।ওই একই সত্যাগ্রহে অংশ নেওয়ার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মোট ৯৬৫৫ জন কর্মীকে কারা বন্ধ করা হয়।

ইন্দিরা সঙ্ঘের শক্তি ও কার্যকারিতার সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছিলেন।তিনি অকপটে স্বীকার করেছিলেন, “আমরা ১০ শতাংশের বেশি স্বয়ংসেবকদের গ্রেপ্তার করতে পারি নি।তাঁরা আত্মগোপন করে রয়েছেন।নিষেধাজ্ঞা না-ওঠা পর্যন্ত তাঁদের দেখা পাওয়া যাবে না।তাঁরা এলাকা ছেড়ে কেরালায় গিয়ে অন্য কাজ করছেন”!
ভাবুন একবার।কেরালা যেন ‘জরুরী অবস্থা’-র সময় ভারতের বাইরে ছিল!সেখানে বোধহয় ইন্দিরার ‘ডাইনি শক্তি’ কার্যকারী হত না! আসলে ইন্দিরা ইচ্ছে মতো স্বয়ংসেবকদের গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।কঠোরতম অত্যাচার করেও স্বয়ংসেবকদের মনোবল তিনি ভাঙতে পারেন নি।তাঁর সুযোগ্য পিতা নেহেরুও পারেন নি।

‘মডার্ন রিভিউ’ সংবাদপত্রের সম্পাদক এম.সি.সুব্রামানিয়াম ‘জরুরী অবস্থা’-র বিরুদ্ধে আর এস এস-এর নায়কোচিত ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।তিনি সঙ্ঘের সর্ব ভারতীয় যোগাযোগ ব্যবস্থা,তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি,তথ্যের গুণগত মান,অর্থ সংগ্রহ ও তার বন্টন প্রণালী,জেল বন্দী সহযোগীদের সাহায্য দান,এমন-কি অন্যান্য দলের কর্মীদের প্রতি সঙ্ঘের সহমর্মীতা ইত্যাদি সুব্রামানিয়ামের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।তিনি আরও স্বীকার করেন যে,সঙ্ঘ দেশ গঠনমূলক মানসিকতার বিরোধীদের প্রতিও সম্মান জানায়।

ড. শিবরাম কারান্থ জানাচ্ছেন, “যখন দেশে নির্বাচনের দিন ঘোষিত হল,তখন আমি খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম।একটাই বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল যে,মানুষের কাছে স্বাধীনতার মর্মকথা কে বা কারা পৌঁছে দেবে!তখনই সঙ্ঘ ও হাজার হাজার স্বয়ংসেবকের মুখ মনে পড়ল।মনে শান্তি এলো।আমি তাঁদের ব্যক্তিগত ভাবেই দেখেছি দেশের জন্য তাঁরা আত্ম বলিদান দিতে সর্বদা প্রস্তুত।তাঁদের আত্মত্যাগকে আমি প্রণাম জানাই।

পরিতাপের বিষয় এই যে,মহাত্মা গান্ধীর দেখানো সত্যাগ্রহ আন্দোলনই আরেক গান্ধী পদবীধারীর অপশাসনের বিরুদ্ধে সঙ্ঘকে সত্যাগ্রহ করতে হয়েছিল।প্রথম সত্যাগ্রহ ছিল বিদেশী শাসকের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর সত্যাগ্রহ।দ্বিতীয়টা ছিল স্বাধীন ভারতের দেশীয় শাসকের বিরুদ্ধে!দ্বিতীয় সত্যাগ্রহে স্বয়ংসেবকদের যে-সকল পরিবার আর্থিক-মানসিক ভাবে সাহায্য করেছিল ইন্দিরার পুলিশ সে-সব পরিবারের সকলকে কারারুদ্ধ করেছিল।

আর এস এস পরিকল্পনা করেছিল যে একাধিক দাবী নিয়ে সত্যাগ্রহ করবে।’জরুরী অবস্থা’ প্রত্যাহার,গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা,বন্দী স্বয়ংসেবক-কার্যকর্তাদের নিঃশর্ত মুক্তি,সংবাদ মাধ্যমের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলা ইত্যাদি দাবী নিয়ে ১৪ নভেম্বর,১৯৭৫ থেকে ১৪ জানুয়ারি ১৯৭৬ সময়কালে সত্যাগ্রহ করা হবে।
বিস্ময়কর ব্যাপার হল সঙ্ঘের স্বয়ংসেবকরা বাদ দিয়েও সঙ্ঘের আহ্বানে দেড় লক্ষাধিক সাধারণ মানুষ দেশের পাঁচ হাজার তিন শত ঊনপঞ্চাশটি স্থানে সত্যাগ্রহ করে।স্বয়ংসেবকদের ধরলে সংখ্যাটি আরও ৮০ হাজার বৃদ্ধি পায়।এই দু’মাসে ২৪২৪ জন মহিলা সত্যাগ্রহীকে গ্রেপ্তার করা হয়।৮৭ জন স্বয়ংসেবক স্বাধীন দেশের মুক্তির জন্য আত্মবলিদান দিয়ে শহীদ হন।ইন্দিরা সত্যাগ্রহের চাপে পড়ে সঙ্ঘের উপর থেকে শর্ত সাপেক্ষ নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার প্রস্তাব দেন।সঙ্ঘ তা ফিরিয়ে দেয়।সঙ্ঘের কাছে দেশবাসীর মুক্তিই প্রধান ছিল।অবশেষে ১৯৭৭-এ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।প্রত্যাশা মতোই ইন্দিরা সমূলে পরাজিত হন।দেশের অ-কংগ্রেসী দলগুলি জনতা পার্টির নেতৃত্বে সরকার গঠন করে।আর এস এস তার চাপ সরিয়ে নেয়।
দেশে স্থিতাবস্থা ফিরে আসে।সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

https://www.newsbharati.com/Encyc/2021/6/25/But-for-the-RSS-India-wouldn-t-have-been-a-thriving-democracy.html

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.