“রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে বাংলা। …”
না, রাজ্যের কোনও বিরোধী দলের নেতাকর্মী নয়, খোদ রাজ্যপাল জগদীপ ধনকর প্রকাশ্যে এই অভিযোগ করেছেন। একবার নয়, বারবার। বস্তুত, স্বাধীনতার পর পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আর কোনও রাজ্যপাল এতবার প্রকাশ্যে সরব হননি। দফায় দফায় পালটা প্রতিক্রিয়াও উঠেছে তৃণমূলের তরফে।
সত্যি কি পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলার হাল এতটাই খারাপ? বিরোধীদের অভিযোগ, বাংলায় আইনের শাসন নেই। রাজ্যপাল প্রায়ই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে খোঁচা দেন। অথচ ২০২০-র ২৯ ফেব্রুয়ারি ভুবনেশ্বরের পূর্বাঞ্চলীয় আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকে ‘প্রশংসা’ কুড়োয় পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতেই কেন্দ্রের শীর্ষকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ যথেষ্ট ভাল কাজ করছে। তবে সূত্রের দাবি, কেন্দ্রকে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক তথ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে যে রাজ্যের গাফিলতি ও দীর্ঘসূত্রতা আছে, তা-ও ওই বৈঠকে স্পষ্ট হয়।
ওই বৈঠকে আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ উঠতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যপাল শাহের উদ্দেশে বলেন, ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করায় রাজ্য পুলিশের সাফল্য ৫০ শতাংশের বেশি। কলকাতা পুলিশের সাফল্য ৯০ শতাংশের মতো। নারী এবং শিশুদের উপর কোনও অপরাধের তদন্তে সক্রিয় থাকে রাজ্য প্রশাসন। অতি অল্প সময়ে তদন্তপ্রক্রিয়া শেষ করা হয়। তাঁর দাবি, তিন দিনে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, এমন নজিরও আছে। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে রাজ্য ‘জিরো টলারেন্স’ মনোভাব নিয়ে চলে।
আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রীকে বারবার কটাক্ষ করেছেন বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ। হাতরস কান্ডের পর দিলীপবাবু বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশে একটা ঘটনা ঘটেছে বলে মুখ্যমন্ত্রী সরব হচ্ছেন। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় এ রকম ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। সে সব ক্ষেত্রে তিনি নিষ্ক্রিয়! বোমার কারখানা, জঙ্গি-যোগ, মাওবাদী কার্যকলাপ— সব এ রাজ্যেই পাওয়া যাচ্ছে। তার পরেও বলবেন বাংলায় আইনশৃঙ্খলা ভাল?’’
২০২০-র ১ অক্টোবর শিলিগুড়িতে উত্তরবঙ্গে প্রশাসনিক বৈঠকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি গুজরাত (নরেন্দ্র মোদীর রাজ্য), উত্তরপ্রদেশের (যোগী আদিত্যনাথের রাজ্য) থেকে ভাল। একই সঙ্গে তিনি বিজেপির নাম না করে অভিযোগ করেন, এই পরিবেশ নষ্ট করতে চেষ্টা চালাচ্ছে তারা-ই। মুখ্যমন্ত্রী বলেন, ‘‘বাংলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যাঁরা কথা বলেন, তাঁরা উত্তরপ্রদেশের দিকে তাকান। গুজরাতের দিকে তাকান। বাংলাই একমাত্র ভারতের মধ্যে সব থেকে শান্তিপূর্ণ জায়গা।’’
এই চাপান উতোরের মাঝে আসল ছবিটা খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন। একটু তথ্যের দিকে তাকানো যাক। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বে এলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩-র ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি)-র তথ্য বলছে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের নিরিখে রাজ্যভিত্তিক তালিকায় দেশের মধ্যে চতুর্থ স্থানে পশ্চিমবঙ্গ— শতাংশের হিসাবে ১২,৬৭ শতাংশ। মেট্রোপলিটন শহরগুলোর মধ্যে দিল্লি, বাঙ্গালুরুর পরেই কলকাতা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সমীক্ষায় ২০১৮ সালে প্রতি এক লক্ষ মানুষপিছু হিংসাত্মক অপরাধের নিরিখে অসম, ত্রিপুরা, বিহারের পরে চতুর্থ স্থানে যৌথভাবে পশ্চিমবঙ্গ এবং অরুণাচল প্রদেশ। শতাংশের নিরিখে যথাক্রমে ৮৬-৪, ৬২, ৪৯-৪ এবং ৪৬-১। মামলার সংখ্যার দিক থেকেও পশ্চিমবঙ্গ বেশ ওপরের দিকে। উত্তরপ্রদেশ (১৫-২ শতাংশ), মহারাষ্ট্রের (১০-৭ শতাংশ) পর যৌথভাবে বিহারের সঙ্গে এই রাজ্য তৃতীয় স্থানে (১০-৪ শতাংশ)। এই সব তথ্য কিন্তু স্পষ্টই দেখিয়ে দেয় পশ্চিমবঙ্গের আইনশৃঙ্খলা মোটেই স্বস্তিতে নেই।
নভেম্বর, ২০১১। সবে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শব্দবাজি ফাটিয়ে জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রার দায়ে অভিযুক্ত তৃণমূল সমর্থকদের ছাড়াতে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভবানীপুর থানায় নিজে চলে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, পুলিশকে বাধ্য করেছিলেন আটকদের নিঃশর্তে ছেড়ে দিতে। আবার, ২০১৪-র ১৪ নভেম্বর শাসক দলের কর্মীদের ভয়ে টেবিলের তলায়, আলমারির পিছনে গিয়ে লুকোলেন পুলিশকর্মীরা। ঘটনাটি ঘটে আলিপুর থানায়। ছত্তিশগড়ে মাওবাদী হামলা হলে এমন ছবি দেখা যায়! কিংবা আফগানিস্তানে তালিবান হামলার ক্ষেত্রে! ওই দিন অনুরূপ ছবি দেখেছিল কলকাতা।
আলিপুর থানায় শাসক দলের তাণ্ডবের ঘটনায় অভিযোগের তির ছিল মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা প্রতাপ সাহার দিকে। সেই প্রতাপকে আড়াল করতে উঠেপড়ে লাগেন পুরমন্ত্রী। ঠিক যেমনটি করেছিলেন মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নার ক্ষেত্রে। গার্ডেনরিচে হরিমোহন ঘোষ কলেজের ভোট ঘিরে গোলমালে পুলিশ অফিসার তাপস চৌধুরীর মৃত্যুর পরে নিজের ঘনিষ্ঠ পুর-নেতা মুন্নাকে বাঁচাতে চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। এ রকম আরও অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো গত এক দশকে নেতিবাচক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে আছে।
পুলিশি সূত্রের খবর, শুধু তাণ্ডব নয়, আলিপুর থানায় আটক করে রাখা চার মহিলা-সহ ১৪ জন অভিযুক্তকেও ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল হামলাকারীরা। লালবাজার সরকারি ভাবে থানায় হামলা-মারধরের কথা স্বীকার করতে চায়নি। মুখে কুলুপ আঁটেন কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। টেবিলের তলায় ঢুকে ফাইলের আড়ালে প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত পুলিশকর্মীর ক্যামেরাবন্দি ছবি দেখে রাজ্যবাসী যখন স্তম্ভিত, সেই সময়েই লালবাজারের এক পুলিশকর্তা এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেন, “হামলাকারীদের থেকে বাঁচার জন্য নয়, ক্যামেরায় ধরা না-পড়ার জন্যই উনি ও-ভাবে বসে ছিলেন।”
২০১৮-র ২৯ মে রাজ্য পুলিশের ডিজি হিসাবে অবসর নেন সুরজিৎবাবু। সে দিন সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘রাজ্য পুলিশকে সমৃদ্ধ করবে পুলিশের নিযুক্তিকরণ, আধুনিকীকরণ এবং প্রশিক্ষণ৷’’ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নানা সমালোচনা করেন৷ তা কি পুলিশের মনোবলের বিঘ্ন ঘটায়? সাংবাদিকদের এই প্রশ্নের উত্তরে সুরজিৎবাবু বলেন, ‘‘পুলিশ প্রফেশনাল সংস্থা, প্রফেশনালি নিজের কাজ করে৷’’ জঙ্গলমহলে ও পাহাড়ে রাজ্য পুলিশের ভালো কাজের প্রশংসাও করেন৷ পুলিশ সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে মুখ খোলেন তিনি৷ বলেন, পুলিশের কর্তব্যজ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও কারণ নেই৷ তাঁরা অবগত৷ নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবেই তাঁরা পালন করে৷
কৃতিত্বের পুরস্কার হিসাবে সুরজিৎ করপুরকায়স্থকে পরামর্শদাতা হিসাবে অবসরের পর বছর বছর পুনর্নিয়োগ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। এতে নানা সময়ে ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষোভ জানিয়েছেন একাধিক আইপিএস অফিসার। দীর্ঘদিন ধরে দাম্পত্য অশান্তি ছিল সুরজিৎবাবুর। অভিযোগ, তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী শর্মিষ্ঠা নির্দিষ্ট কিছু কারণে পুলিশ-প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়ে পাননি। ফলে বিজেপি-র কাছে গিয়েও সহযোগিতা চেয়েছিলেন। এরপর ২০২০-র ৭ জুন ছোট্ট একটি সংবাদ প্রকাশিত হল। রাজ্যের নিরাপত্তা উপদেষ্টা সুরজিৎ করপুরকায়স্থর প্রাক্তন স্ত্রী ও তার মায়ের রহস্য মৃত্যু। সল্টলেকের বিই ব্লকের একটি বাড়িতে থাকতেন বছর ৫৯ এর শর্মিষ্ঠা করপুরকায়স্থ ও তার মা পাপিয়া দে (৮০)। শেষোক্ত ঘটনার সঙ্গে অবশ্যই রাজ্যের সার্বিক আইনশৃঙ্খলার সম্পর্ক নেই। তবু আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে চলে আসে এ সব তথ্য।
আসলে বাম আমলের প্রায় গোড়া থেকেই এ রাজ্যে পুলিশে রাজনীতিকরণ শুরু হয়। কালে কালে তা বেড়েছে। তৃণমূল রাজত্বে তা আরও বিকশিত হয়েছে বলে অভিজ্ঞদের অনেকের অভিযোগ। এক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, লোকসভা নির্বাচনের মুখে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশে কলকাতার পুলিশ কমিশনার করা হল সৌমেন মিত্রকে। সুষ্ঠু আইনশৃঙ্খলার স্বার্থে তাঁকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিলেন, এমন কয়েকজন অফিসারকে পরবর্তীকালে চরম কোনঠাসা করে দেওয়া হয়। আইনত, কলকাতার পুলিশে নিযুক্ত কর্মীদের অন্যত্র বদলি করা যায় না। কিন্তু দলদাসের ভূমিকা নেননি, এ রকম বেশ কিছু কর্মী-অফিসারকে রাজ্যে দূরের কোনও জায়গায় সাময়িক দায়িত্বের নামে পাঠানো হয়। চরম হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন ওই অফিসারেরা। স্বামী-সন্তানদের কলকাতায় রেখে এক মহিলা অফিসারকে যেতে হয়েছিল জেলায়। বাড়িতে আসার পথে দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান। তাঁর পরিবার চরম সঙ্কটে পড়ে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে সংঘর্ষে সাব ইন্সপেক্টর অমিতাভ মালিকের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনায় দার্জিলিং সদর থানায় খুনের মামলা রুজু করে পুলিশ। বিমল গুরুং, প্রকাশ গুরুং, প্রবীণ সুব্বা, দীপেন মালে, সুরজ থাপা সহ ২০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করা হয়। খুন ছাড়াও অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এর পর গ্রেফতারি এড়াতে ঘন ঘন জায়গার পরিবর্তন করেন বিমল গুরুং। এর পর মুখ্যমন্ত্রী সমঝোতা করে নেন গুরুংয়ের সঙ্গে। গত দুর্গাপুজোর মুখে কলকাতায় এসে পাঁচতারা হোটেলে সাংবাদিক বৈঠক করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসা করেন বিমল গুরুং। পুলিশ এসকর্ট নিয়ে শিলিগুড়িতে সভা করে বিজেপিকে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন বিমল গুরুং। গোটা ঘটনায় কেবল অমিতাভবাবুর পরিবারের সদস্যরাই নন, হতবাক হন রাজ্যবাসী।
প্রায় একই সঙ্গে প্রতিক্রিয়া হয় ছত্রধর মাহাতোর মুক্তিতে। দীর্ঘ আইনি জটিলতা শেষে প্রায় এক দশক পর ২০২০-র ১ ফেব্রুয়ারি জেল থেকে মুক্তি পান জঙ্গলমহলের একদা অবিসংবাদী নেতা ছত্রধর মাহাতো। ২০০৯ সালের কাঁটাপাহাড়ি বিস্ফোরণ মামলায় ২০১৯-এর ১৯ অগস্ট কলকাতা হাইকোর্ট ছত্রধরের যাবজ্জীবনের সাজা কমিয়ে, ১০ বছর করেছিল। ফলে, কয়েক মাস আগেই জেল থেকে বেরিয়ে আসার কথা ছিল পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটির এই নেতার। কিন্তু, তাঁর মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় ঘাটশিলার অপর এক মামলা। ঘটনাচক্রে ঝাড়খণ্ডে সরকার বদল হওয়ার মাস দেড়েক কাটতে না কাটতেই ওই মামলাতেও মুক্তি পান ছত্রধর।
২০০৮ সালে জঙ্গলমহলে গড়ে ওঠে পুলিশি সন্ত্রাস-বিরোধী জনসাধারণের কমিটি। ওই বছরের নভেম্বরে জিন্দালদের ইস্পাত কারখানার উদ্বোধন করতে ঝাড়গ্রাম গিয়েছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সঙ্গী ছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রী রামবিলাস পাসোয়ান। ফেরার পথে ৬০ নম্বর জাতীয় সড়কে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। কেউ মারা না গেলেও, গুরুতর আহত হন এক পুলিশকর্মী। সেই ঘটনায় রাজ্য-রাজনীতিতে সেসময় তীব্র চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
বিস্ফোরণের তদন্তভার নেয় সিআইডি। মাওবাদী যোগের কারণে গ্রেফতার হন ছত্রধর মাহাতো। বাম নেতাদের অনেকেরই অভিযোগ, সেসময় মাওবাদী নেতা কিষেনজি এবং তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করতেন ছত্রধর। এর পর দীর্ঘ বাম শাসনের পতন হলেও, বন্দিদশা কাটেনি ছত্রধরের। উপরন্তু, ২০১৫ সালে দেশদ্রোহিতার মামলায় মেদিনীপুর আদালত যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেয়। সেই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন ছত্রধর। মেদিনীপুর আদালতের দেওয়া সেই সাজা কমিয়ে, ১০ বছর করে হাইকোর্ট। ততদিনে আরও একাধিক মামলায় জামিন পেয়ে যান জনসাধারণের কমিটির ওই নেতা। শুধু, ঘাটশিলার মামলাটিই ঝুলেছিল। এর পর ছত্রধর মাহাতোর লালগড়ে কেবল ফিরে যাননি।তাঁকে তৃণমূলের জেলার সর্বোময় কর্তার দায়িত্ব দেন নেত্রী। তাঁর স্ত্রী-কে রাজ্য মহিলা কমিশনের সদস্য করা হয়। প্রশ্ন ওঠে, তৃণমূলে সক্রিয় দায়িত্ব নিতে সম্মত হওয়াতেই কি দ্রুত মুক্তি পেলেন ছত্রধর? স্বরাষ্ট্র দফতরের তরফে অবশ্য দাবি করা হয়, এ ব্যাপারে কোনও বেআইনি কিছু করা হয়নি।
অশান্ত জঙ্গলমহলে শান্ত করার কৃতিত্ব দাবি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কিষেণজীর মৃত্যুর প্রশ্ন আজও ধাওয়া করে বেড়ায়। এই
ছত্রধর মাহাতোকেই প্রশ্ন করা হয়েছিল, কিষেণজীর মৃত্যুকে আপনি কীভাবে দেখেন? সাক্ষাৎকারের জবাবে (৮ নভেম্বর, ২০২০, টিভি নাইন) ছত্রধর বলেছেন, “কোনও মৃত্যুই বাঞ্ছনীয় নয়। কোনও ব্যক্তি বা নেতাকে মেরে তার রাজনীতি শেষ করে দেওয়া যায় না। আমি মনে করি, সেই রাজনীতি শেষ করতে হলে রাজনৈতিকভাবেই মোকাবিলা করতে হয়। গুলি, বন্দুক দিয়ে আমার বিপক্ষে যিনি আছেন, তাঁকে মেরে ফেলব! এতে রাজনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায় না।“ কিষেণজীর মত্যুর জন্য একদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাঠগড়ায় দাঁড় করেছিলেন আপনি। আজ কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন? জবাবে ছত্রধর, “একইভাবে বলব। শুনুন, সাদাকে সাদা বলতে হয়, কালোকে কালো। আমার চোখে যেটাকে সাদা মনে করি, সেটাকে সাদাই বলবো। (অত্যন্ত প্রত্যয়ের সুরে) হ্যাঁ, এটা ভুল ছিল। আমি মনে করি এটা ভুল ছিল। এনকাউন্টার করে মানুষকে মেরে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায় না। পরিস্থিতি বরং আরও অশান্তই হয়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আমার হাতে, তা দিয়ে জনগণকে আমার পায়ের তলায় নিয়ে আসব, এটা কখনও সম্ভব নয়। কেউ পারে না। (একটু থেমে) ইতিহাস তো তাই বলে।“
দীর্ঘ জেল জীবনে এমন কোনও স্মৃতি আছে যা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আপনাকে? এর জবাবে ছত্রধর বলেন, “২০০৮-২০০৯ যাঁরা আমার সহকর্মী ছিল, তাঁদের অন্যতম লালমোহন টুডু। তাঁকে এনকাউন্টার করে মেরে দিল ওরা..এই ঘটনা এখনও ভাবায় আমাকে। সত্যি কথা বলতে, লালমোহন টুডু এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সমাজের জন্যই ভাবতেন। নিজের জন্য কোনওদিনই ভাবেননি। আজ যদি তিনি থাকতেন, এই সমাজকে তাঁর চোখ দিয়ে কীভাবে দেখতেন, তা ভীষণ জানতে ইচ্ছে করে…। “
নকশাল আমলে পুলিশি কর্মকান্ডের যতটা সমালোচনা হয়েছে, গত এক দশকের এ রকম গোপন কর্মকান্ড সেভাবে আলোচিত হয়েছে কি? রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার প্রশংসা করতে গিয়ে তাই হয়তো এক পা এগোলে পাঁচ পা পিছিয়ে যেতে হবে।
তাই বলে কি পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আসার পর আইনশৃঙ্খলার কোনও উন্নতি হয়নি? ব্রিটিশদের তৈরি কলকাতার কমিশনারেট পদ্ধতি রূপায়ণের জন্য বিভিন্ন সময়ে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশকর্তারা লালবাজারে এসেছেন। এখান থেকে সব বুঝে সেগুলো রূপায়ণ করেছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ রাজ্যের বিভিন্ন শহুরে অঞ্চলে রূপায়ণ করেছেন কমিশনারেট পদ্ধতি। এতে আমার বিশ্বাস, সুফল মিলেছে।
শাসক দলের দাবি, আগে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তদের ওপর যে নির্যাতন চলত, এখন তা হয়না। পুলিশকর্মীদের বিভিন্ন রকম কল্যাণপ্রকল্প চালু হয়েছে। নানা বিভাগে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার যথেষ্ঠ বেড়েছে। গত কয়েক বছরে প্রকাশ্য স্থানে, রাস্তার গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে প্রচুর সিসি ক্যামেরা বসানোয় পুলিশের দুর্নীতিতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা গিয়েছে। ট্রাফিক আইন ভঙ্গকারীদের কাছ থেকে নগদ জরিমানা নেওয়ার বদলে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সরকারি রসিদ দিয়ে জরিমানা নেওয়ার প্রথা চালু হয়েছে।
সাধারন ভাবে আইপিএস ক্যাডার থেকে পুলিশ এবং আইএএস ক্যাডার থেকেই প্রশাসনিক আমলা বা উচ্চপদে নিয়ে আসা হয় কিন্তু সেই নজির ভেঙে আইপিএস রাজীব কুমারকে নিয়ে আসা হয় একজন উচ্চ পদস্থ আমলা হিসাবে।
ফেসবুকে কলকাতা পুলিশের সাইটে মাঝে মাঝে অনেকে পুলিশের তৎপরতার প্রশংসা করেন। আগের চেয়ে পুলিশ অনেক বেশি সমাজ-বান্ধব হয়েছে। বিশেষ করে করোনার সময়ে পুলিশ নিজের ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন সামাজিক কাজ করেছে। ‘প্রণাম’ গোষ্ঠীর মাধ্যমে অনেক বয়স্ক মানুষের দিশা হয়ে উঠেছে পুলিশ। অন্যথায় ওঁরা আরও অসহায়তার মুখে পড়তেন। লালবাজার সূত্রের খবর, কলকাতা পুলিশ এলাকায় প্রণামের বর্তমান সদস্য-সংখ্যা সাড়ে ১৪ হাজারেরও বেশি। ওই বয়স্কদের নিরাপত্তা দেওয়ার পাশাপাশি কোনও বিপদে তাঁরা যাতে প্রয়োজনীয় সাহায্য পান, তার জন্য প্রতিটি থানার এক জন বা দু’জন করে পুলিশকর্মীকে দায়িত্ব দেওয়া আছে। তাঁদেরই বছরভর ওই একাকী প্রবীণদের দেখভাল করার কথা।
এসবের ভিত্তিতে অভিযোগ এসেছে, প্রবীণেরা অনেক সময়ে পুলিশকে ডেকেও সাহায্য পাচ্ছেন না।
ওই প্রকল্পের কাজকর্মে সন্তুষ্ট নন লালবাজারের শীর্ষ কর্তাদের একাংশ। গত ৬ আগস্ট বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বৈঠকে হয় লালবাজারে। প্রণামের মাধ্যমে পুলিশ কী ভাবে আরও বেশি করে প্রবীণ নাগরিকদের পাশে দাঁড়াতে পারে, তা নিয়েই আলোচনা করেন ওই কর্তারা। শহরের সব ক’টি থানা যাতে ওই প্রকল্পে ঠিক মতো কাজ করে, তার জন্য পুলিশ কমিশনার অনুজ শর্মা বার্তা পাঠান ওসিদের। থানাগুলি সেই কাজ ঠিক মতো করছে কি না, তা নজরে রাখতে বলা হয় ডিসিদের। পুলিশের একটি অংশের আবার দাবি, প্রণামের সদস্যদের দেখভাল করতে গিয়ে তাদের অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তাই একটু সাবধানে এগোতে হচ্ছে।
সব শেষে বলি। পরিচিত দুই প্রাক্তন পুলিশকর্তাকে অনুরোধ করেছিলাম রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে তাঁদের পর্যবেক্ষণ লিখে দিতে। রাজি হননি। তাই নিজের পর্যবেক্ষণই দিলাম। যুক্ত করার মত আরও অনেক কিছু আছে। ভাল-মন্দে মিশিয়ে আছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশি ব্যবস্থা। এটা বিচার করবেন এক একজন এক একরকমভাবে।
অশোক সেনগুপ্ত