সেপ্টেম্বরে নিজের রিটায়ারমেন্ট, এখন কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের কঠোর প্রশ্নের মুখে পশ্চিমবঙ্গের চীফ সেক্রেটারি: সামলাবেন কিভাবে?

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিক থেকে রাজ্যের কোভিড সংক্রান্ত তথ্যের ভুল পরিবেশন কেবলমাত্র ভারতবর্ষে নয়, বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের একটি অংশের কাছেও একটি সুবিদিত সংবাদ। গত এপ্রিল মাসে রাজ্যে কেন্দ্রীয় পরিদর্শক দলের (IMCT) পরিদর্শনের পর কোভিড তথ্য-পরিবেশনের ফর্ম্যাট বদলালেও নতুন ফর্ম্যাটেও রয়ে গিয়েছে প্রচুর ভুলভ্রান্তি এবং অসাযুজ্য, যা থেকে প্রতীত হয় যে রাজ্যের বর্তমান কোভিড রিপোর্টিংও অসত্য এবং তথ্য বহুলাংশে চেপে রাখা। এ নিয়ে রাজনীতির নানা মহলে তরজাও কম হয় নি। তথ্য পরিবেশনের ভুলভ্রান্তি নিয়ে আগেও একবার সবিশ্লেষণ লিখেছি। কিন্তু পরিস্থিতি তাতে বদলায় নি। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দিক থেকে কোভিড তথ্য চেপে রাখার প্রবণতা একই রয়ে গিয়েছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে যে চল্লিশ হাজারেরও বেশি কোভিড পরীক্ষার রিপোর্ট পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশ করে নি। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল মাননীয় শ্রী জগদীপ ধনকড় এ নিয়ে বার বার রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল সাংসদদের কাছে তথ্য প্রকাশের অনুরোধ করা ও পরামর্শ দেওয়া সত্ত্বেও ফল হয় নি। এই মুহূর্তে নতুন কোভিড কেস রেজিস্ট্রেশনে দেশের মধ্যে এক নম্বরে রয়েছে দিল্লি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অপ্রকাশিত কোভিড পরীক্ষার রিপোর্টগুলি প্রকাশিত হলে নতুন কোভিড কেস রেজিস্ট্রেশনে পশ্চিমবঙ্গ যে দিল্লিকে টপকে যাবে না বা এ বিষয়ে দিল্লির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবে না, তা বলা যায় না

এমত পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট দিল্লি, পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট ও তামিলনাড়ু, এই পাঁচটি রাজ্যের রাজ্য সরকারের চীফ সেক্রেটারিদের কাছ থেকে রাজ্যগুলির কোভিড পরিস্থিতি সংক্রান্ত রিপোর্ট তলব করেছেন। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট জানতে চেয়েছেন উক্ত রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে রুগীর যত্ন কেমন হচ্ছে, হাসপাতালগুলিতে স্টাফসংখ্যা কত এবং অন্যান্য পরিকাঠামো কেমন ইত্যাদি বিষয়ে। সুপ্রিম কোর্ট এ-ও বলেছেন যে প্রতিটি রাজ্যে সরকারি ও বেসরকারি ডায়াগনস্টিক ল্যাবগুলিতে যেন কোভিড পরীক্ষার যথেষ্ট ব্যবস্থা থাকে যাতে যে কোনো লোক চাইলেই কোভিড পরীক্ষা করাতে পারেন। অর্থাৎ অবাধ ও পর্যাপ্ত কোভিড পরীক্ষার ব্যবস্থা রাজ্যগুলিতে রাখার ওপর জোর দিয়েছেন মহামান্য উচ্চতম আদালত।

পশ্চিমবঙ্গের চীফ সেক্রেটারি রাজীব সিনহাকেও এই প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে হবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে। এই পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নগুলি উঠে আসে, তা হল, রাজীব সিনহা কি পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যব্যবস্থার বেহাল পরিস্থিতি সংক্রান্ত সঠিক তথ্য সুপ্রিম কোর্টকে দেবেন? যে প্রশ্নগুলি উঠছে সেগুলি নিম্নরূপ:

—পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও পর্যন্ত ৪০,০০০ এরও বেশি কোভিড টেস্টের রিপোর্ট প্রকাশ না করে চেপে রেখেছে, তা কি সুপ্রিম কোর্টের কাছে রিপোর্টেড হবে?

—পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ হাসপাতাল মানে যে শুধু হাসপাতাল বিল্ডিং, তাতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরিকাঠামো, যন্ত্রপাতি, সেগুলির নিয়মিত মেইনটেনেন্স ও মেইনটেনেন্স টেকনিশিয়ান, ওষুধপত্র, স্বাস্থ্যকর্মী ইত্যাদি যে নিতান্তই অপ্রতুল বা কোনো কোনো জায়গায় একেবারেই নেই, জোড়াতালি দিয়ে কাজ চালানো হয় মাত্র, তা কি চীফ সেক্রেটারি উচ্চতম আদালতকে জানাবেন?

—পশ্চিমবঙ্গের যে পরিমান জনসংখ্যা সেই তুলনায় ডাক্তার, নার্স, প্যারামেডিক স্টাফ ইত্যাদি স্বাস্থ্যকর্মী যে নেই কারণ পশ্চিমবঙ্গ সরকার সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রায় বন্ধ করে রেখেছে, এমন একটি ভয়াবহ সরকারি গাফিলতির খবর কি পৌঁছবে সুপ্রিম কোর্টের কাছে?

https://www.bloombergquint.com/coronavirus-outbreak/supreme-court-poses-hard-questions-to-delhi-four-other-states-on-handling-of-covid-19-cases

—পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে সরকারি চাকুরে (অর্থাৎ ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও) DA না দিয়ে underpay করে রেখেছে, ফলে সরকার নিয়োগ করতে চাইলেও ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে যে কেউ যোগ দিতে চায় না এবং সে বিষয়টি যে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যক্ষেত্রটিকেই অসুস্থ করে তুলেছে, সে সংবাদ কি আদালতের কাছে যথাযথভাবে পরিবেশিত হবে?

পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে সিভিক ডাক্তার বা হাতুড়ে দিয়ে কাজ চালাতে চায় এবং কোথাও কোথাও চালায়, সে তথ্যও কি পৌঁছবে?

—পশ্চিমবঙ্গের বেসরকারি হাসপাতালগুলির ৮৫% নার্সই যে ভিন রাজ্য থেকে আসেন, এবং এ রাজ্যে কোভিডের আবহে সঠিক পরিকাঠামোর অভাবে তাঁদের অধিকাংশই যে চাকুরিস্থল থেকে যে যাঁর নিজ রাজ্য ফিরে গিয়েছেন, এবং তার ফলে বর্তমানে রাজ্যের হাসপাতালগুলিতে নার্সিং পরিষেবার যে নিতান্তই অভাব সৃষ্টি হয়েছে, সে তথ্য কি রাজীব সিনহা (Rajiv Sinha) জানাবেন আদালতকে?

—পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে তাঁর অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ মিটিং এ নার্সিং শিক্ষার তিন বছরের কোর্স বাদ দিয়ে ৭ দিনের নার্সিং ট্রেনিং চালু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, অর্থাৎ কার্যতঃ হাতুড়ে নার্স দিয়ে কাজ তুলতে চেয়ে রাজ্যের মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, সে কথা কি উঠবে আদালতের কানে?

—রাজীব সিনহা কি বলবেন যে পশ্চিমবঙ্গের নানা জেলায় কোভিড রোগীর চিকিৎসা ও শেষকৃত্য সঠিকভাবে হচ্ছে না এবং সেই অভিযোগে নানা জেলায় জমে উঠছে অশান্তি ও ক্ষোভের মেঘ?

—উত্তরবঙ্গে কোভিড রোগীর সংখ্যা যে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সেই সুযোগে কনটেইনমেন্ট জোনগুলিতে রাজ্যের শাসক দলের নেতাকর্মীরা যে সিণ্ডিকেট ব্যবস্থা চালু করে ফেলছেন যাতে কনটেইনমেন্ট জোনের মানুষদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র তাদের মাধ্যমেই এবং তাদের দামেই কিনতে বাধ্য হতে হয়, মাটির কাছ থেকে তুলে আনা এইসব গুরুত্বপূর্ণ খবরাখবর আদালতের কাছে পৌঁছে দেবেন কি রাজ্যের চীফ সেক্রেটারি?

উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যে রুগী ভর্তি করা বন্ধ হয়ে রয়েছে, সে বিষয়ক তথ্যও মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের কানে তোলা হবে কি না, প্রশ্ন উঠেছে সে বিষয়েও।

—রাজ্যের চীফ সেক্রেটারি রাজীব সিনহা কি সুপ্রিম কোর্টকে বলবেন যে এ রাজ্যে কোভিড পরীক্ষা হলেও পরীক্ষার রেজাল্ট কবে পাওয়া যাবে বা আদৌ পাওয়া যাবে কি না তা জানতে পারা সুনিশ্চিত নয়? হাসপাতালে রুগী ভর্তি করার দুঃসাধ্য প্রক্রিয়াটির সত্যও কি সুপ্রিম কোর্টের কাছে উন্মোচন করবেন রাজীব সিনহা?

শ্রী সিনহার রিটায়ারমেন্টের দেরি নেই। এ বছর সেপ্টেম্বরে রিটায়ার করার কথা তাঁর। এই সময় আদালতে তিনি নিশ্চয় এমন কিছু ম্যানিপুলেটিভ তথ্য দেবেন না যা দিলে চাকরি জীবনের শেষে এসে তাঁকে বিপদে পড়তে হয়? আবার সমস্ত তথ্য সঠিক পরিবেশন করলেও রাজ্যের মুখ্য আমলা হিসেবে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হতে পারে তাঁকেই। এমত উভয় সঙ্কটের মুখে সুপ্রিম কোর্টের মুখোমুখি তিনি কিভাবে হবেন, তা জানার জন্য উৎসুক হয়ে রয়েছে রাজনৈতিক মহল।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.