পশ্চিমবঙ্গের আন্তর্জাতিক বানিজ্যে— অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক প্রবীর দে-র সাক্ষাৎকার নিলেন অশোক সেনগুপ্ত।
পশ্চিমবাংলার সার্বিক অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের অংশ কতটুকু?
উত্তর— ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গের ভৌগলিক অবস্থান সবচেয়ে ভালো। বাণিজ্যে বসত লক্ষী। ব্রিটিশরা এমনি এমনি এখানে আসেনি। তার উপর পশ্চিমবঙ্গের মাটি প্রচন্ড উর্বর। জল আবহাওয়া খুবই ভালো। পশ্চিমবঙ্গের সাথে উন্নতর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সাংস্কৃতিক আর বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রাচীনকাল থেকেই। তাইতো বাংলার নামে একটি সমুদ্র রয়েছে (বঙ্গোপসাগর)। রাজ্যের উন্নতিতে আন্তর্জাতিক বানিজ্যের গুরুত্ব অপরিসীম।
আন্তর্জাতিক বানিজ্যের মাধ্যমে পশ্চিমবাংলা কি কোনও দিশা দেখাতে পারে?
উত্তর— অবশ্যই দিশা দেখাতে পারে এবং সেটা ভালো ভাবেই অল্প সময়ের মধ্যেই। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যই পশ্চিমবঙ্গের যুব সমাজের জন্য কাজ তৈরি করতে পারবে। পশ্চিমবঙ্গের মতো ভৌগোলিক আর কৌশলগত অবস্থান অন্য কোনো রাজ্যের নেই। তার সাথে রাজ্যের মানুষের প্রতিভা হলো যুক্ত সুবিধা। তার জন্যে অবশ্যই আমাদের ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার সরকারের উপর কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত।
সমস্যা/সম্ভাবনার পথগুলো কী?
উত্তর— এই রাজ্যের সবই আছে কিন্তু রাজ্য সরকারের অকর্মণ্যতা আর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাবের জন্যই রাজ্যের বৈদেশিক বানিজ্যের সম্ভাবনা আনলক করা যাচ্ছে না। তার উপর বৈদেশিক বানিজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। তাছাড়া বড়ো আর মাঝারি বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো রাজ্য ছেড়ে চলে গেছে।
রাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়াতে গেলে কী করতে হবে?
উত্তর— পশ্চিমবঙ্গের প্রথমেই যেটা করতে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয় বাড়াতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী বা অর্থমন্ত্রীর অধীনে একটা নতুন ডিপার্টমেন্ট খুলতে হবে যার কাজ হবে রাজ্যের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়ানোর নীতি তৈরি করা। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে সমন্বয়ের কাজটা এরাই করবে। তার সাথে সাথে রাজ্যের নিজস্ব নীতি তৈরি করতে হবে। রাজ্যের ব্র্যান্ড Ambassador বিভিন্ন দেশে নিয়োগ করা যেতেই পারে। পশ্চিমবঙ্গ হলো ভারতবর্ষের লুক ইস্ট বা এক্ট ইস্ট নীতির ভিত্তি। পশ্চিমবঙ্গের উৎপাদনের খরচ কমাতে পারলে বিদেশের বাজার আরো বাড়বে। পরিকাঠামো আর দক্ষতার উন্নয়ন খুব দরকার। এই রাজ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ খুবই কম। বানিজ্যের প্রসার হলে, বৈদেশিক বিনিয়োগ বাড়বে রাজ্যে। এতে কোনও সন্দেহ নেই।
অন্য কোন কোন রাজ্য সাফল্য দেখিয়েছে, কীভাবে?
উত্তর— পশ্চিম আর দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো বৈদেশিক বাণিজ্যে অনেক উন্নতি করেছে। এছাড়াও আসাম, ওড়িশা ও দিল্লি বৈদেশিক বাণিজ্যে অনেক এগিয়ে গেছে। তার জন্য নাকি কান্না কেঁদে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর দোষ দিয়ে কোনো লাভ হবে না।
বাংলাদেশের সঙ্গে পঃবঃ-এর মধ্যে দিয়ে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণে বানিজ্যিক লাভ হতে পারে?
উত্তর—অবশ্যই হতে পারে। শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়। পশ্চিমবঙ্গের সাথে পূর্বদিকের সমস্ত দেশের সড়ক, রেল, সামুদ্রিক, বিমান যোগাযোগ বাড়াতে হবে। এক কথায় সামগ্রিক সংযোগ বাড়াতে হবে। এই সব কাজ পশ্চিমবঙ্গের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে হাত মেলাতে হবে।
পশ্চিমবঙ্গের কি নতুন করে পূর্বে তাকাও নীতির প্রবর্তন করা উচিত?
উত্তর—কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে মিলে একটা নতুন কিছু করতে পারলে ভালো। ইউরোপিয় ইউনিয়নে যেমন হয়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন মনীষীরা পূর্বের দেশের সাথে যোগাযোগ বাড়ানোর কথা বলেগেছেন এবং কাজেও করে দেখিয়েছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ওনার জাভা যাত্রীর পত্র সম্পূর্ণভাবে ওনার দক্ষিনপূর্ব এশিয়ার যাত্রার উপর লেখা। স্বামী বিবেকানন্দ দুবার জাপান গিয়েছেন আমেরিকা যাবার পথে। একবার তো এক মাসের উপর ছিলেন। নেতাজির সাথে জাপানের সম্পর্কের গভীরতা মাপা যাবে না। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাসবিহারী বসু থেকে অমর্ত্য সেন, ইত্যাদি গুণী মানুষদের সাথে পূর্ব ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার যোগাযোগ খুবই ঘনিষ্ঠ। সেই সম্পর্ক আজও মধুর। তবে তাতে একটু ধার দিতে হবে যা এই হালের বাংলার নেতা নেত্রীরা পারবে না। আমাদের ভালো ভালো নেতা নেত্রীরা সব দেশের জন্য বলিদান দিলেন। তারপর শুন্যতা। পশ্চিমবঙ্গের নতুন নীতি তৈরি হলেই যে কাজে আসবে তা নয়। তবে নতুন যাত্রা শুরু করা যেতে পারে।
বামেদের ৩৪ বছরে পশ্চিমবঙ্গের বৈদেশিক বানিজ্যে কতটা জোর দেওয়া গিয়েছিল? বিজেপি যদি আদৌ পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসত, এদিক থেকে রাজ্যের উপকার হত?
উত্তর— বাম আমলে কাজ বেশ কিছুটা এগিয়েছিল। জ্যোতিবাবু, প্রণববাবু ও সোমনাথবাবু এনারা ভারতীয় রাজনীতির প্রথম সারির নেতা। সবাই এনাদের সম্মান করেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৯০ দশকের শেষের দিকে রাজ্যের বৈদেশিক যোগাযোগ বাড়াতে খুব ভালো কিছু উদ্যোগ নিয়ে ছিলো। আমার নিজের কিছু অভিজ্ঞতা ও স্মৃতি রয়েছে এই ব্যাপারে। আজকের তৃনমূল সরকারের কোনো গঠন মূলক উদ্যোগ চোখে পড়েনি। হতে পারে আমার চোখে ছানি পড়েছে। এটা ঠিকই বিজেপি সরকার এলে এই সব জায়গাতেই ডাবল ইঞ্জিনের সরকার কাজ করতো। তাই বলে সব কিছু শেষ হয়ে গেছে তা নয়। বর্তমান সরকার চেষ্টা করলে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু কে দেবে জল আর কে দেবে আলো?
————————————————
অধ্যাপক প্রবীর দে ভারত সরকারের রিসার্চ এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম ফর ডেভেলপিং কোনট্রিজ (রিস) সত্যে যুক্ত। বৈদেশিক বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়া উনি দিল্লির ন্যাশনাল মেরিটাইম ফাউন্ডেশনের ভিজিটিং প্রফেসর। মতামত প্রবীরবাবুর নিজস্ব।