পশ্চিমবঙ্গে বি জে পির দু’শোর বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় আসার উত্তুঙ্গ প্রচারে দলের নেতা,কর্মী, সাধারন সমর্থক সহ সংবাদমাধ্যম ও জনসাধারণের এক বিশাল অংশ এতটাই বিশ্বাস করেছিল যে একশোর কম আসনে বি জে পি- র জেতাটাই বর্তমানে চর্চার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু ধামাধরা সংবাদমাধ্যম বি জে পি-র নাকি ভরাডুবি হয়েছে এই অপপ্রচারে ব্যস্ত। এসবের আড়ালে চাপা পড়ে গিয়েছে আসল সত্য, এই নির্বাচনের সব থেকে বড় প্রাপ্তি- স্বাধীনতার পর প্রথম কমিউনিস্ট মুক্ত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা এবং সেই স্থানে তিন থেকে সাতাত্তর আসনে জয়ী বি জে পি -র বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ। এই ঘটনা মমতা ব্যানার্জির টানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।
তাৎপর্যপূর্ণ হল নকশাল নেতা দীপঙ্করবাবুর আহবানে বি জে পিকে প্রধান শত্রু মনে করে ‘আরবান নকশালরা’ ” নো ভোট টু বি জে পি” প্রচার চালায়। কিন্তু নকশাল আন্দোলনের উৎসভূমি নকশালবাড়িতেই বি জে পি প্রার্থী বঞ্চিত, অবহেলিত , তপশিলি সমাজ ও চা বাগান শ্রমিকদের ভোট পেয়ে প্রায় সত্তর হাজার ভোটে জয়ী হয়েছেন। পার্শ্ববর্তী ফাঁসিদেওয়া আসনেও বি জে পি বিজয়ী হয়েছে। সেখানে সি পি আই(এম এল)- এর প্রার্থী মাত্র তিন হাজারের মতো ভোট পেয়ে জামানত হারিয়েছেন। এছাড়াও সারা রাজ্যে ৮৪ টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে ৩৯ টিতে জয়ী হয়েছে বি জে পি। নকশাল আন্দোলনের জনক চারু মজুমদারের পুত্র শ্রী অভিজিৎ মজুমদার বলেছেন যে এই জয় থেকে বোঝা যায় যে তপশিলি জাতি ও জনজাতিদের মধ্যে বামপন্থীদের প্রভাব দুর্বল হয়েছে ও বিজেপির প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে। “নো ভোট টু বি জে পি” প্রচারের গালে এর থেকে জোরালো চর আর হতে পারে না। তাই এসব রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ফলে বামপন্থীদের করোনা না হয়েও তীব্র শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে।( অবশ্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তাদের যেন করোনা না হয়) আবার ঠুনকো বাঙালিয়ানার আত্মরতিতে মগ্ন বামপন্থী ও ছদ্ম সেক্যুলাররা তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের বাঙালি বলেই মনে করেন না। তাই বিজেপির এই জয়কে অবাঙালির সমর্থন বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছেন ।
বর্তমানে অধিকাংশ সংবাদপত্র ও চ্যানেল কর্পোরেট সংস্থার মালিকানাধীন। কমিউনিস্টদের ভাষায় বুর্জোয়া। অথচ এসব বুর্জোয়া পোষিত সংবাদপত্রে বামপন্থীদের উত্তর সম্পাদকীয় প্রবন্ধ ও মতামত গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। ভাবটা এমন যেন তারাই বাঙালি সমাজের মূল স্রোত। রামমোহন, রবীন্দ্র, বিদ্যাসাগরের ভাবনার সার্থক উত্তরসূরী এবং তাদের কথাই সমাজের কাছে বেদবাক্য। আসলে এরা এক নতুন প্রজাতি – ” বুর্জোয়া কমিউনিস্ট”। আর্থিক ভাবনায় এরা বুর্জোয়া এবং রাজনৈতিক ভাবনায় গণতন্ত্রবিরোধী, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও একনায়কতন্ত্রের সমর্থক। কবিগুরুর ভাষায় এরা সেই ‘পরাসক্ত কীট’ যাদের নিজেদের জনসমর্থন নেই, সংগঠন নেই। সারাদেশে এরা তথাকথিত আঞ্চলিক দলের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে অথবা তাদেরকে বৌদ্ধিক পরামর্শ জুগিয়ে তাদের অর্থ, প্রতিষ্ঠা ও শাসকীয় ক্ষমতা ইত্যাদি ব্যবহার করে নিজেদের এজেন্ডাকে পূরণ করার চেষ্টা করে। চীনের শি জিনপিং, আমেরিকার বাইডেন, জর্জ সোরেস এদের আদর্শ। তাই চীনের তৈরি ‘ জৈব অস্ত্র ‘ করোনা ভাইরাস নিয়ে তাদের কলম বন্ধ্যা, মুখে কুলুপ। আশা করা যায় তাদের এই গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল গোছের মাতব্বরি এবার জোর ধাক্কা খাবে কারণ, জনমত তাদেরকে ব্রাত্য করেছে।
কিন্তু হর্ষে-বিষাদ! ভোটের রাজনীতিতে কমিউনিস্টরা পরাজিত হলেও তারা ৩৫ বছরের শাসনে বাংলায় এক অপসংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে – রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, সন্ত্রাস ও অস্পৃশ্যতা। বিরোধীদের ভিটেমাটি ছাড়া, একঘরে করা; পুকুরের মাছ, খেতের ফসল লুট; খুন, শ্লীলতাহানি, ধর্ষণ; সালিশি সভার নামে অকথ্য অত্যাচার, আর্থিক জরিমানা; সাইবাড়ি ও আনন্দমার্গী হত্যার মতো অন্যান্য বহু বর্বরোচিত হত্যা; গলায় জ্যান্ত কই মাছ ঢুকিয়ে হত্যা ইত্যাদি বৈচিত্র্যময় অত্যাচার !
আবার সন্ত্রাস সবসময় রক্তাক্ত হয় না। শ্মশানের শান্তিও নিরব সন্ত্রাসের জলন্ত নমুনা । যখন নির্বাচনের আগে বাড়িতে বাড়িতে সাদা থান পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পঞ্চায়েত ও পৌর নির্বাচনে অধিকাংশ স্থানে বিরোধী প্রার্থী পাওয়া যায় না। বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় শাসকদল জিতে যায়।
এই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা যেন বাঙালির ডি এন এ- তে ঢুকে গিয়েছে। তাই সরকার বদল হলেও সেই হিংস্র বাতাবরণ একই রকম। নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাস সেই কথাই মনে করায়। এরপর পৌর ও পঞ্চায়েত নির্বাচনের কথা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়। আসলে কমিউনিস্ট সন্ত্রাসের সঙ্গে প্রাণ ও সম্পত্তি বাজি রেখে সংঘর্ষ করতে করতে ক্ষমতাসীন হয়ে বর্তমান শাসক দলের অধিকাংশ নেতা,কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে এই বিষ সংক্রামিত হয়েছে। কবিগুরুর ভাষায় ” বিরোধ যার বীজ, বিরোধ-ই তার ফল।” এদের সন্ত্রাসের সঙ্গে সংঘর্ষ করতে করতে যে দল আগামী দিনে ক্ষমতাসীন হবে তাদের মধ্যেও যে সেই বিষ সংক্রামিত হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
বামপন্থী ও সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা দিনরাত সারাদেশে ফ্যাসিস্ট হিন্দুত্ববাদী শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে এই ভিত্তিহীন অপপ্রচারের মাধ্যমে সাধারণ বাঙালির মগজ ধোলাইয়ের ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে ( যদিও দু চারজন আঁতেল ছাড়া সাধারণ বাঙালিরা জানেনা যে ফ্যাসিবাদ খায় না মাথায় দেয়।) কিন্তু তারা বিগত প্রায় ত্রিশ বছর ধরে চলা বাংলার এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও অস্পৃশ্যতা নিয়ে নিরব। এবং কে না জানে নিরবতাই সম্মতির লক্ষণ। আখলাক হত্যা নিয়ে এরা সরব। কিন্তু প্রকাশ্য দিবালোকে এক নিরীহ বি জে পি কর্মীর গলায় কেবলের তার জড়িয়ে ও ইট দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যার ক্ষেত্রে তাদের প্রগতিশীল কলম অতি রক্ষণশীল হয়ে বোরখার আড়ালে চলে যায়। নিজেদের পরিশীলিত, সংস্কৃতিবান ও প্রগতিশীল বাঙালি ভদ্রলোক বলে দেখাতে চাইলেও আসলে এরা এই সেমিটিক রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও অস্পৃশ্যতার প্রচ্ছন্ন বিকৃত রুচির সমর্থক যা সর্বসমাবেশক ও পারস্পরিক সহাবস্থানেে বিশ্বাসী হিন্দু চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিপরীত। এরা শুধু নিজেদের বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও আদব কায়দায় অভ্যস্ত শহুরে আত্মকেন্দ্রিক এলিটদের স্বাধীনতা ও বৌদ্ধিক মাতব্বরির অধিকার নিয়েই মাতামাতি করে। সাধারণ মানুষ যখন পঞ্চায়েত ও পৌরসভা ভোটে স্বাধীনভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করতে পারে না তখন তাদের কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। উত্তরপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোটে যোগী বা বিজেপির পরাজয় নিয়ে এদের উল্লাসের শেষ নেই। কিন্তু আসল সত্যটি তারা বাঙালীর সামনে তুলে ধরেন না যে সেখানে গ্রামের সাধারণ মানুষ পঞ্চায়েত ভোটে তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পেরেছেন বলেই এই ফলাফল।না হলে তো সেখানে মাত্রাাছড়া সন্ত্রাসের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের মতো বিজেপিও অধিকাংশ স্থানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়ে যেত। এস পি, বি এস পি সেখানে প্রার্থী দিতেই পারত না। যাই হোক এর থেকে মুক্তি কী ভাবে ?
” তমসো মা জ্যোতির্গময়”- এর মতো একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে। তলিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে কমিউনিস্ট প্রভাবমুক্ত বাংলার রাজনীতি আমাদের সামনে এক সুযোগ এনে দিয়েছে। বর্তমান শাসকদল মূলত কংগ্রেসী ঘরানার। অন্য রাজ্যে কংগ্রেস, বিজেপি বা অন্য রাজনৈতিক দল পালাবদলের মধ্য দিয়ে সরকারে আসে যায় কিন্তু রক্ত ঝরে না। গুজরাতে ২২বছর বি জে পি ক্ষমতায় কিন্তু কংগ্রেস কর্মীদের সন্ত্রাসের শিকার হতে হয় না। রাজস্থানে কংগ্রেস ক্ষমতায়। সেখানে বি জে পি কর্মীদের সন্ত্রাসের শিকার হতে হয় না। দক্ষিণের অন্য রাজ্যগুলিতে আঞ্চলিক দল পালা করে ক্ষমতায় আসে। সেখানেও এরকম বীভৎস সন্ত্রাস দেখা যায় না। একমাত্র ব্যতিক্রম কমিউনিস্ট শাসিত কেরালা। রাজনৈতিক সন্ত্রাস ও হিংস্রতার উৎস যে কমিউনিস্ট ভাবনা তা এ থেকেই বোঝা যায়।
সুস্থ গণতন্ত্রে রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতার কোনও স্থান নেই।নির্বাচনী খেলা যেন প্রকৃতই ইস্টবেঙ্গল- মোহনবাগান ম্যাচের মতো হয় যেখানে উভয় দলের সমর্থক পাশাপাশি বসে চা খেতে খেতে জয়- পরাজয় আত্মস্থ করতে পারে। তাই এই বাংলার শাসক-বিরোধী উভয় পক্ষই যদি সেমিটিক কমিউনিস্ট হিংসা মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের উদার মনভাব বুথস্তর পর্যন্ত কর্মী সমর্থকদের মনে সঞ্চার করতে পারে তবেই এর থেকে মুক্তি সম্ভব। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন উভয় পক্ষের শুভ বোধসম্পন্ন নেতৃত্বের আন্তরিক সদিচ্ছা, নিরন্তর মত বিনিময় ও পারস্পরিক সহযোগিতা। মনে রাখতে হবে নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবে। কিন্তু প্রত্যেকটি দলই আমাদের দেশের। তারা পরস্পর শত্রু নয়। আমরা চীন, পাকিস্তানের সঙ্গেও আলোচনা করি। তাই একই দেশের বা রাজ্যের দুটি দল আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বাতাবরণ তৈরি করতে পারে।
এটা একান্তই অসম্ভব নয় যদি না এই প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা হয়। না হলে হয়তো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তখন বঙ্গবাসীকে আবার অসহায় ভাবে শাসন, নানুর, সূচপুর, কেশপুর, খেজুরি, পারুই এর মতো অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী হতে হবে। নির্বাচনোত্তর সন্ত্রাস যেন সেই অশনি সংকেত। এক্ষেত্রে শাসকদলকেই প্রকৃত সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে শাসক দলের হাতে ক্রমাগত অত্যাচারিত ও লাঞ্ছিত এবং তাদের হাতের পুতুল পুলিশ প্রশাসনের অবিচারের শিকার হতে হতে বিরোধীরাও আত্মরক্ষার জন্য একই পথের পথিক হয়।
আবার শান্তিস্থাপনও অনেক সময় লোকদেখানো হয়। যেমন প্রথমে মার ও হুমকি দিয়ে বিরোধী দলের সমর্থকদের এলাকা ছাড়া করা, তারপর তাদের কাছ থেকে গোপন মুচলেকা বা আর্থিক জরিমানা নেওয়া যে তারা ভবিষ্যতে আর সেই দল করবে না এবং ক্যামেরার সামনে হাসি হাসি মুখ করে তাদেরকে ঘরে ফিরিয়ে নেওয়া। এসব আর কিছুই না কমিউনিস্ট ধূর্তামির নির্লজ্জ নমুনার অনুকরণ মাত্র। চিরস্থায়ী ও যথার্থ শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে অবশ্যই এসব বর্জন করতে হবে।
এবং এই শান্তি স্থাপন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের উপর প্রভাব রয়েছে এমন মঠ মিশনের প্রধানরাও উদ্যোগী হলে বিষয়টি দ্রুত বাস্তবায়িত হতে পারে।
কমিউনিস্ট মুক্ত বিধানসভার মতো যদি সেমিটিক কমিউনিস্ট ভাবনা জাত হিংসা ও সন্ত্রাস মুক্ত বাংলা গড়ে তোলা যায় তবেই এই নতুন অধ্যায়টি সম্পূর্ণ হবে। করোনার বিষাদময় আবহে সেই আশাতেই দিন গোনা ……
সর্বে ভবন্তু সুখীন:
সর্বে সন্তু নিরাময়া:।
সর্বে ভদ্রানি পশ্যন্তু
মা কশ্চিদ দুঃখ ভাগ্ভবেৎ ।।
।। ও শান্তি শান্তি শান্তি: ।।
বোধিসত্ত্ব সমাজপতি