সহাবস্থান নয় টেক ওভার

দীর্ঘদিন ধরে সাম্যবাদ ও ধর্মান্ধতা এই দুই বিপরীত মেরুর যে অশুভ আঁতাত চলেছিল, তাতে বহুদিন পর্যন্ত একটা ধর্মনিরপক্ষেতার পর্দা ও মুখোশ ছিল। মুখোশটি ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে ভয়াল মুখটা বহুদিন ধরেই উঁকি মারছিল। কিন্তু ব্রিগেডে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তথাকথিত সাম্যবাদী ধর্মনিরপক্ষেতার রেকর্ড বাজানো শিবির নিজেই নিজের বস্ত্রহরণ করে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াল।
সাম্যবাদের বিপরীতে চরম বৈষম্যবাদ, নারীমুক্তির বিপরীতে চরম নারী অবদমন, ধর্মকে আফিম বলে পরিত্যাগের নীতির বিপরীতে শুধু একটিমাত্র ধর্মীয় মতবাদে বিশ্বাসী ছাড়া বাকিদের বাঁচার অধিকার কেড়ে নেওয়ার প্রবণতা — এতগুলো বিরুদ্ধ আদর্শের কখনও সহাবস্থান হতে পারে না, যেটা হয়, তা হল একটির দ্বারা অন্যটির সম্পূর্ণ গ্রাস। বিগ্রেডের মহাজোট সেই টেক ওভারের সাক্ষী হয়ে রইল।
পীরজাদা বাংলার ‘স্বাধীনতা’ ও ‘ভাগ বুঝে নেওয়া’র কথা ঘোষণা করল হুংকার দিয়ে। বলা বাহুল্য ভারতবর্ষ থেকে বিচ্ছিন্নতার ইঙ্গিত। স্বাধীন বাংলাদেশও প্রথমে ধর্মনিরপেক্ষ নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল। কিন্তু করেছিল মুসলিম নেতৃত্বে মুসলিম প্রাধান্যে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ যে আসলে হিন্দু রক্ত ভস্ম নারী সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া মুসলিম বাংলাভাষীর স্বাধীনতা, তা কিছুদিন পর এরশাদের আমলে সে দেশ ইসলামিক হয়ে যাওয়ার মধ্যে প্রমাণিত। গত সত্তর বছরে নৃশংস ও ব্যাপক সংখ্যালঘু হত্যার যা নজির রেখেছে, গায়ে মানুষের চামড়া থাকলে শিউরে উঠতে হয়। অবশ্য সেই সত্য সদর্পে অস্বীকার করা লোকগুলোই তো ব্রিগেডে ভিড় করেছিল, এখন সাফাইও দিচ্ছে।
এরপরে কোনও কোনও বামপন্থীর ভাবের ঘরে চুরির শেষ চেষ্টা টুকু ব্যর্থ হল। কিন্তু তারপরেও কিছু তথাকথিত বাম যখন পীজজাদাকে ধর্মনিরপেক্ষ গরীবদরদী হিসেবে খাড়া করতে চাইছে, তখন তাতে একটাই বিভাজন পরিষ্কার হয়ে যায়– বামপন্থীদের মধ্যেও খুব নগণ্য সংখ্যক ছিল যারা প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের দিবাস্বপ্ন দেখে সম্ভাব্য পরিণতি বুঝতে পেরেও হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধতে রাজি ছিল। কিন্তু বাকি সংখ্যা গরিষ্ঠ বামেরা সেসব এজেন্ডা জাহান্নমে পাঠিয়ে যারা শুধু হিন্দুদের খুন ধর্ষণ বাস্তুচ্যুতি, এককথায় সমূহ বিনাশ চাইছে। তারা আর ক্ষমতাতেও আসতে চাইছে না। শুধু হিন্দুদের সর্বনাশ করে দেশ এবং হয়তো বা বিশ্বজুড়ে চরম অরাজকতা মাৎসন্যায় চাইছে।

এই সঙ্কটের মুহূর্তে প্রকৃত ভারতীয়দের কাছে একটি প্রশ্ন রাখছি। হিন্দু পুরুষদের একটা বিষয় ঠিক করতে হবে। তারা হিন্দু মেয়েদের শৃঙ্খলিত করতে চায়, নাকি তাদের নিয়ে বাঁচার লড়াই করতে চায়? প্রথমটা শত শত ধরে বছর করেও কোনও লাভ হয়নি– সতীদাহ করে, বাল্যবিধবাদের বিয়ে করতে না দিয়ে গোপনে নিষিদ্ধ পল্লী চালান করে, পণের জন্য বধূহত্যা করে, কন্যাভ্রূণ হত্যা করে শুধু নিজেদের নৈতিকতা ও জনসংখ্যা কমানো গেছে এবং সারা বিশ্বে নিন্দিত হতে হয়েছে। আর দ্বিতীয়টির দ্বারা অগ্নিযুগে নবজাগরণকে বরণ করে নারী সহযোদ্ধাদের নিয়েই ইংরেজকে তাড়ানো গেছে আর পরে ক্ষমতার হস্তান্তর মূলত হিন্দুদের হাতেই হয়েছে। ধান্দাবাজ রাজনীতিকরা তোষণের রাজনীতি না করলে ভারত সামরিক শক্তি ও সামাজিক কল্যাণ দুটোতেই সুপার পাওয়ার হত, মৌলবাদীদের হুংকার শুনতে হত না।
পৃথিবীতে সর্বত্র নারীবাদীরাই ইসলামিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি লড়েছে এবং এখনও লড়ছে। এ দেশেও সেটাই হতে দেওয়া মঙ্গল, খামোখা হিন্দুত্ববাদকে ইসলামের সমতুল্য পর্যায়ে নীচে নামিয়ে আনা মানে আত্মহত্যা। মেয়েদের ওপর খবরদারি করার বদলে তাদের যোদ্ধা করে তুলুন। লাভ সমগ্র প্রজাতির। যারা জন্ম দেয় তারা সেই জীবন রক্ষা করতেও মরিয়া। কোটি কোটি ধর্ষণ খুনের পাশে এক আধটা ব্যতিক্রমী অপরাধী নারীর উদাহরণ দিয়ে সত্যকে অস্বীকার করলে সমস্যার সমাধান হয় না, বেড়ে যায়। আর লাগাতার অসম্মানেই অভিশম্পাত বেরিয়ে আসে।
বামপন্থীদের কবল থেকে নারীবাদকে মুক্ত না করে নারীবাদকে বামপন্থা হিসাবে ব্রাত্য করে রাখলে যে কজন মুক্তমনা নারী জেহাদের বিরুদ্ধে লিখে হোক বা সংগঠন করে হোক লড়ছে, তারাও বসে যাবে। একটা কথা সবার বোঝা উচিত, যেসব মেয়েরা পুরুষদের তোষণ করে বৈমষ্যে রায় দিয়ে ক্ষমতা ভোগ করতে চায়, তারা কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই কাজ করে, সমাজের কাজ করাটা তাদের কাছে নাম কেনার ক্ষমতা ভোগ করার রাস্তা মাত্র। একজন জ্বলন্ত উদাহরণকে দশ বছর ধরে রাজ্যে দেখছি। নিবেদিতপ্রাণ সৎ মেয়েদের সঙ্গে পেতে পুরুষতান্ত্রিক অন্ধত্ব ত্যাগ করেই একজোট হতে হবে। আজ এই মহা সন্ধিক্ষণেও যদি এটা উপলব্ধি করতে ও মেনে নিতে অসুবিধা হয়, তাহলে দুই পক্ষেরই জন্মদাত্রী ও ধাত্রীরা তো বিনষ্ট হবেই, নারীবিদ্বেষী মৌলবাদীরাও একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে প্রকৃতির প্রতিশোধে।

প্রসীদ জগন্মাতা

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.