শনিবার হরেক বিশেষণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভূষিত করেছেন প্রয়াত সিপিএম নেতা অনিল বিশ্বাসের মেয়ে অজন্তা বিশ্বাস। তৃণমূলের মুখপত্র জাগো বাংলায় তাঁর উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভের চতুর্থ তথা শেষ কিস্তি প্রকাশিত হয়েছে শনিবার। বিষয়টি রীতিমত সাপের ছুঁচোগেলা হয়ে উঠেছে বাম নেতাদের কাছে।

তৃণমূলের মুখপত্রে তাঁর উত্তর সম্পাদকীয় স্তম্ভে অজন্তা লিখেছেন, কী ভাবে বার বার কঠিন লড়াই জিতে ‘অগ্নিকন্যা’, ‘দিদি’, ‘ঘরের মেয়ে’ হয়ে উঠেছেন মমতা। সক্রিয় রাজনীতিতে তাঁর উত্থান বাংলার রাজনৈতিক পরিসরে মহিলাদের সামগ্রিক অবস্থানে পরিবর্তন এনেছে বলেই মনে করেন তিনি।

অজন্তার লেখায় উঠে এসেছে সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রসঙ্গও। জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে তৈরি গণবিক্ষোভে নেতৃত্ব দিয়ে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে সরিয়ে তৃণমূলকে ক্ষমতায় এনেছিলেন মমতা। সেই থেকেই ধাপে ধাপে ক্ষমতা কমতে কমতে ‘২১-এর বিধানসভায় একটিও আসন পায়নি বামেরা।

অজন্তা বামেদের এই নজরে দেখার বিষয়টিকে সিপিএম নেতৃত্বকে বিবেচনা করতে বলেছেন সিপিআইয়ের রাজ্য সম্পাদক তথা প্রবীন বাম নেতা স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে স্বপনবাবু বলেন, “অজন্তাকে আমি চিনি না। উনি আমার দলের কেউ নন। যে দলের সঙ্গে যুক্ত তাঁরাই বিবেচনা করুন। তবে, অজন্তা যদি আদৌ বামপন্থী হয়ে থাকেন, তাহলে মানুষ বা পাঠক কীভাবে বিষয়টা নিচ্ছেন তা ভাবা উচিত ছিল।” ‘দিন ধরেই বিষয়টি নিয়ে চলছে বিতর্ক। সিপিএম-এর রাজ্যকমিটির বৈঠকে এই নিয়ে দলের কোনও নেতা কোনও মন্তব্য করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তা সত্বেও ‘হিন্দুস্থান সমাচার’-কে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে সিপিএম-এর প্রবীন শিক্ষক নেতা তথা অল বেঙ্গল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এবিটিএ) রাজ্য সভাপতি কৃষ্ণপ্রসন্ন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, “কে, কোথায়, কী লিখবেন, সেই স্বাধীনতা সবার আছে। লেখক তাঁর নিজস্ব ভাবনা ও সামাজিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে লেখেন। আমি চার দশক আগে শিক্ষকতায় ঢুকেছিলাম। কিন্তু আমরা যারা নিজেদের বামপন্থী বলে ভাবি, তাঁদের একটা একটা আদর্শ আছে। সেই বিশ্বাস নিয়েই বাঁচি। সেরকম কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখবেন, এটা ভাবতে পারি না। উনি যে সব নিদর্শন তৈরি করেছেন, তা বাংলা সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছে। ওপরে নিজের ছবি, পায়ের তলায় রবীন্দ্রনাথ- এ জিনিস তিনিই আমদানি করেছেন। তা ছাড়া, বাম ভাবধারায় সত্যিকারের বিশ্বাসী কারও ‘গনশক্তি’, ‘দেশহিতৈষি’-র মত জায়গায় লিখলেই তো ভাল।”

বরিষ্ঠ বাম শ্রমিক নেতা ইউটিইউসি-র রাজ্য সম্পাদক অশোক ঘোষ এই মন্তব্যের বিরোধিতা করেছেন। শনিবার এই প্রতিবেদককে তাঁর ব্যাখ্যা, “কোন কাগজে লিখবো সেটা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই কিন্তু তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী লিখছি। এক্ষেত্রে অজন্তা বিশ্বাস কী লিখেছেন তা বিচার্য হচ্ছেনা। অনেকেই লেখাটা না পড়েই মন্তব্য করছেন। জাগো বাংলায় কেন লিখেছেন সেটাই বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠেছে। অশোকবাবুর ব্যখ্যা, “এমন কি হয়েছে গণশক্তি চেয়েছিল লেখাটা। অজন্তা গণশক্তিকে না দিয়ে জাগো বাংলাকে দিয়েছে? আর, পুরনো ধ্যানধারণা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। আগে দাদাদের কাছে শুনতাম আনন্দবাজার বুর্জোয়া কাগজ। ওই গোষ্ঠীর ‘এবেলা’-তে লেখার জন্য আমাকে খোঁচা দিয়েছিলেন রবীন দেব। সেই ‘এবেলা’-তে যখন বৃন্দা কারাত লিখলেন, রবীনদাকে প্রশ্ন করেছিলাম। উনি মানে, মানে, মানে, মানে করছিলেন। কারণ, এর উত্তর নেই! আলোচ্য হোক লেখার বিষয়।”

অজন্তার লেখায় মমতাকে ‘মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী’ ও ‘জননেত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন অজন্তা। বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে মমতাকে ‘অন্যতম সেরা বাঙালি নারী’ বলে উল্লেখ করেছেন অজন্তা। ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে পরবর্তীতে মমতার মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার বিষয়ে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। সিঙ্গুর আন্দোলন ঘিরে রাজনৈতিক বিতর্কের প্রসঙ্গও উল্লেখ করেছেন অজন্তা। ‘কন্যাশ্রী’, ‘রূপশ্রী’, ‘সবলা’র মতো মহিলাদের জন্য তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মমতা বাংলার মেয়েদের আরও কাছের হয়ে উঠেছেন বলেও মত অনিল-কন্যার।

শনিবার প্রশ্ন করেছিলাম সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজ্য কমিটির সম্পাদকমন্ডলীর দীর্ঘদিনের সদস্য, ১৪ বছরের প্রাক্তন বিধায়ক, বিধানসভার প্রাক্তন মুখ্য সচেতক রবীন দেবকে। ৭২ বছরের এই নেতার ব্যাখ্যা, “কুণালের সঙ্গে অজন্তার পরিচয় ছিল। কুণাল নানা কাগজের সঙ্গে যুক্ত। অজন্তা বুঝতে পারেনি লেখাটা জাগো বাংলায় বার হবে।” কিন্তু আগে তো লেখাটার তিন কিস্তি বার হয়েছে? রবীনবাবুর জবাব, “পুরো লেখাটা তো অজন্তা আগে দিয়ে দিয়েছে!” দু’দিন ধরে শোনা যাচ্ছিল, দলীয় স্তরে অজন্তার কৈফিয়ত্‍ চাওয়া সতে পারে। শনিবার রবীনবাবুকে এই প্রশ্ন করলে কোনও জবাব দিতে পারেননি।

শনিবার বিষয়টি নিয়ে এই প্রতিবেদক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী তথা প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ পবিত্র সরকারের প্রতিক্রিয়া চাইলে তিনি বলেন, “আমি রোজ চারটি সংবাদপত্র পড়ি। জাগো বাংলা পড়ি না। বিষয়টা নিয়ে আগ্রহ নেই।” দুদিন আগে জল মাপার সেই নীতিতেই বহাল থেকে সিপিএম নেতা তথা প্রাঈ্তন বিরোধী দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, “অজন্তা ভাল মেয়ে। ওর লেখা অল্প একটু পড়তে পেরেছি। শুনেছি ও কিস্তি লিখছে। সময় করে বাকিটা পড়তে হবে।” তবে তৃণমূলের মুখপাত্রকে সুজনবাবুর কটাক্ষ, “জাগো বাংলা নতুন করে জেগে উঠেছে।”

গত ২১ জুলাই জাগো বাংলা দৈনিক অনলাইন পত্রিকা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তার পর সেখানে সম্পাদকীয় পাতায় লেখা শুরু করেন প্রয়াত সিপিআইএম নেতা তথা গণশক্তির প্রাক্তন সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের কন্যা অজন্তা। ইতিহাসের অধ্যাপিকা অজন্তার লেখার বিষয় ‘পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নারীর অবদান’। এর পরই শুরু হয়েছে শোরগোল। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠছে, তবে কি তৃণমূলে নাম লেখাচ্ছেন অনিল বিশ্বাসের কন্যা? নাকি দ্রুত এগোচ্ছেন কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার পথে?

রাখঢাক না করেই বাম শ্রমিক নেতা অশোক ঘোষ এই প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, “আজকের জাতীয় রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রাসঙ্গিকতা গড়ে উঠেছে। এই রাজ্যের নারীসমাজের এক বড় অংশ মমতাকে তাঁদের মুখপাত্র মনে করেন। মমতাও তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে নারী অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হয়েছেন। যদিও অনেক প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি। তা সত্ত্বেও তার জনপ্রিয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এক্ষেত্রে তাঁকে নিয়ে আলোচনা চলতে থাকবে। সব থেকে ভালহতো গণশক্তি এই লেখা ছাপলে। তাহলে প্রয়োজনীয় সম্পাদনা করে ছাপা হতো। আর লেখিকা অজন্তা কার কন্যা সেই দৃষ্টিভঙ্গিতে লেখার বিষয়বস্তুর মূল্যায়ণ চলে না। একজন গবেষকের লেখার স্বাধীনতা অবশ্যই থাকবে। পার্টি সর্বশক্তিমান নয়- মাঝে মধ্যে কথাটা স্মরণে রাখতে হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.