শেষ কয়েক সপ্তাহ যাবত রাজ্যের মানুষের মধ্যে এক বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জঙ্গলমহল হোক, উত্তরবঙ্গ হোক, সুন্দরবন হোক বা রাঢ় বাংলা– সর্বত্রই সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রাপ্য না পাওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ্যে উগড়ে দিচ্ছেন। তাও একেবারে শাসক দলের নেতা, মন্ত্রীদের সামনে। মুখ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক সকলকেই এই বিক্ষোভ মুখে পড়তে হয়েছে। বাঙলার আমআদমি প্রকাশ্যে নিজের অধিকারের জন্য সরব। ভিন্ন ভিন্ন ভাবে এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটলেও তার উদ্দেশ্য কিন্তু একসুত্রে বাধা। ছোট ছোট আকারের এই প্রতিবাদ কি কোনো গণ আন্দোলনে রূপ নেবে? নাকি বড় পরিসরে কোনও পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে?
কথায় বলে আমেরিকার রাষ্ট্রপতিকে গালাগালি করা অনেক সহজ, পাড়ার নেতার সামনে মুখ খোলা কঠিন। কিন্তু সম্প্রতি সেই ঘটনার উদাহরণ প্রতিদিন দেখা যাচ্ছে রাজ্যের আনাচে কানাচে। নিজের পাড়ায় শাসক দলের তাবড় তাবড় নেতা, মন্ত্রীদের সামনে বাড়ি, রাস্তা, জল, চিকিৎসা ইত্যাদির মতো প্রাথমিক চাহিদা পূরণ না হওয়ায় ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ নির্ভয়ে। এমনকী তারা কৈফিয়ত চাইছে। বছর খানেক আগেও এভাবে নিজেদের না পাওয়ার জন্য প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি রাজ্যর মানুষকে। কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিণ আজ সর্বত্র সাধারণ মানুষ তাদের প্রাপ্য আদায়ে কোমর বেঁধে নেমেছেন। বুকের ভেতরে সাহস জুগিয়ে শাসকদলের সামনাসামনি হয়ে দাবির কথা বলছেন তারা। এহেন বাঙালিকে বহু বছর দেখা যায়নি। কী হলো হঠাৎ পশ্চিমবঙ্গের আমজনতার ?
বাঙালি মানেই প্রতিবাদী জাতি। এমনটাই ধারণা রাজ্যের বাইরে। বহু সাহিত্য উপন্যাসেও একথা বার বার উঠে এসেছে। যে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস বার বার দেখিয়েছে পশ্চিমবঙ্গের আমজনতা। সেই কারণেই হয়তো ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে সবচেয়ে বেশি বিপ্লবী উঠে এসেছিল এই বাংলা থেকেই। দেশের রাজনৈতিক ইতিহাস পরিবর্তনেও বড় ভূমিকা থেকেছে বাংলার মানুষের। স্বাধীনতা আন্দোলনের পরেও দেশের অভ্যন্তরে বা রাজ্যের ভিতরে অন্যায়কে কখনো মাথা পেতে মেনে নেয়নি বাঙালি। বড় বড় পট পরিবর্তনের অন্যতম পুরোধা এই বাঙলার মানুষ। কয়েকদিন যাবত ফের সেই প্রতিবাদী বাঙালিকেই দেখা যাচ্ছে রাজ্যের আনাচে কানাচে। প্রতিবাদে সরব তারা।
জঙ্গলে মহলে গিয়ে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও সাধারণ মানুষের না পাওয়ার কথা শুনতে হয়েছে। একেবারে হত দরিদ্র মানুষগুলো মুখ্যমন্ত্রী বা সাংসদ ভেবে কিন্তু থমকে যাননি। বরং সমস্বরে নিজেদের অধিকারের কথা বলেছেন। সেই একই প্রতিফলন দেখা গেছে দত্তপুকুরে, নদীয়া, বীরভূম, দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া সহ রাজ্যের সব জেলায়।
পাড়ায় পাড়ায়, মোড়ে মোড়ে, রাস্তার বাঁকে কখনো সাংসদকে, কখনো শাসকদলের তাবড় নেতাদের সামনে নিজেদের ন্যায্য পাওনা না পাওয়ায় কথা সমস্বরে বলেছেন তারা। ভারতের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে তাদের প্রাপ্য আদায়ে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন। তবে সবথেকে বড় বিষয় এই ছোট ছোট প্রতিবাদের পেছনে কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কোনো রাজনৈতিক ইন্ধন প্রমানিত হয়নি। অর্থাৎ এই প্রতিবাদ একেবারে মানুষের নিজের আকুতি থেকে উঠে আসা প্রতিবাদ।
তাই, প্রশ্ন উঠেছে এই ছোট ছোট আকারে নির্ভিক হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা কি আগামী দিনে কোনো বড় ঘটনার ইঙ্গিত বহন করছে? মানুষের এই প্রতিবাদ কি গণআন্দোলনের রূপ নিতে চলেছে? আবার কি বড় পরিবর্তন হবে রাজ্যে? হলে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবে কারা? কাদের উপর মানুষ নির্ভর করবে?
এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভ বিক্ষোভকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে পরিকল্পিত আকারে একটি গণআন্দোলনের রূপ দেওয়ার মতো শক্ত বিরোধী দল রাজ্যে এখনো দেখা যায়নি। সাংগঠনিকভাবে শক্ত ভীতের উপর শিঁড়দাড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ভূমিকায় কাউকে এপর্যন্ত দেখা যায়নি। তবে নেতা না থাকলেও আন্দোলনকারী জনতা কিন্তু রয়েছে। মানুষ কিন্তু নিজের অধিকারের লড়াই লড়তে ময়দানে নেমেছে। তাই এখন দেখার মানুষের এই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কোন দিকে যায়।