রাজনৈতিক স্বার্থে দেশের মানুষকে ভুল বোঝানো কিংবা বিভ্রান্ত করা এদেশের রাজনীতিকদের প্রধান প্রবণতা। এই সস্তা ও চটকদারি প্রবণতা সাময়িক কাজ দিলেও আখেরে দেশ ও দশের কোনও মঙ্গল হয় না। একথা যে চতুর রাজনীতিকরা বোঝেন না, তা নয়। কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ দেশের স্বার্থের থেকেও তাদের কাছে বড়ো। ফলে মাছি যেমন পচা ঘায়ের দিকে ভন ভন করে, তেমনি রাজনীতিকেরাও মিথ্যে ও ভুল বিষয়গুলি নিয়ে আম-জনতাকে বিভ্রান্ত করতে বরাবর তৎপর।
এর জ্বলন্ত উদাহরণ জিএসটি বা গুডস অ্যান্ড সার্ভিস ট্যাক্স। বাংলায় যাকে পণ্য ও পরিষেবা কর বলা হয়। অনেকেই জানেন, এটি ভাজপা নিয়ন্ত্রিত এনডিএ সরকার লাগু করলেও এর পরিকল্পনা করা হয় কংগ্রেস পরিচালিত ইউপিএ আমলে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মনমোহন সিংহ তখন দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী শ্রীপ্রণব মুখোপাধ্যায়ও (পরে রাষ্ট্রপতি) এর সমর্থনে সওয়াল করেছিলেন। এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এসে বিষয়টি ফেলে না রেখে তড়িঘড়ি বাস্তবায়িত করেন।
জিএসটি লাগু হয়েছে বছর ঘুরতে চললো। যখন এটি সারা দেশে লাগু হয়, সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত থেকেই বিরোধীদের সম্মিলিত প্রতিবাদে মুখর ভারতের রাজনীতি। তাদের প্রচারের সারমর্ম হলো জিএসটি দেশের সর্বনাশ ডেকে এনেছে। এর বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে হবে। শুরু থেকেই তারা একযোগে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লাগাতার বিষোদগার করে চলেছেন। জিএসটি দেশের সাধারণ ক্রেতাদের জীবনে সর্বনাশ ডেকে এনেছে—এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী প্রচার গড়ে তুলেছেন বিরোধীরা।
যাঁরা জিএসটি-র বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সরব, তাঁদের অন্যতম পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সরকারের অর্থমন্ত্রী ড. অমিত মিত্র। জিএসটি কমিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যও ড. মিত্র। যাঁদের সুপারিশ জিএসটি বলবৎ হয়েছে, তিনি তাঁদের অন্যতম অংশীদার। দিল্লিতে জিএসটি-র বৈঠকে সায় দিয়ে কলকাতা বিমানবন্দরে নেমেই নেত্রীর নির্দেশে ড. অমিত মিত্র জিএসটি-র বিরুদ্ধে সরব। এই রাজনৈতিক ভণ্ডামী ও সীমাহীন দ্বিচারিতা মানুষ কতোদিন মেনে নেবেন?
দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি রাজ্য জিএসটি আইন প্রণয়নে সায় দিয়েছে। এজন্য, সংবিধান সংশোধন করতে হয়েছে। এটি হলো একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে দেশের প্রথম পরীক্ষা। ফলে শুরুতে সামান্য পরিকাঠামোগত ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতেই পারে। কিন্তু সেটাকেই বড়ো করে তুলে ধরে বিরোধিতা করাটা ঠিক নয়। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, দেশের তামাম বিরোধীপক্ষ নিজেদের গঠনমূলক ভূমিকা ভুলে জিএসটি বিরোধিতায় নেমেছেন। দেশের মানুষকে অত্যন্ত সচেতনভাবে বিভ্রান্ত করে চলেছেন।
অথচ জিএসটি চালু হওয়ায় রাজ্যের লাভ। ক্রেতা-সাধারণেরও লাভ। কীভাবে? ‘নুন আনতে পান্তা ফুরনো’ রাজ্যগুলির রাজস্ব আদায়ও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পাবে। ফলে লাভবান হবেন রাজ্য সরকারও। রাজ্যের শূন্য রাজকোষে অর্থের জোগান বাড়বে। এর ফলে পরিকল্পিত উন্নয়নের কাজ আরও ত্বরান্বিত হবে। অর্থের অভাবে আটকে থাকা প্রয়োজনীয় সরকারি প্রকল্পগুলি জনস্বার্থে বাস্তবায়িত হবে। উপকৃত হবেন রাজ্যের সাধারণ মানুষ। কারণ রাজস্ব ঘাটতি হলে উন্নয়ন ব্যহত হয় একথা আমরা সবাই জানি।
যাঁরা জিএসটি-র জন্মদাতা, সেই কংগ্রেসের জিএসটি-বিরোধিতা আমাদের অবাক করে। তাদের অভিযোগ, উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি না করেই জিএসটি লাগু করা উচিত হয়নি। অভিযোগের আংশিক যৌক্তিকতা অস্বীকার করা যায় না। কারণ উপযুক্ত পরিকাঠামো যে তৈরি হয়নি, তা প্রথমদিকে টের পাচ্ছিলেন জিএসটি প্রদানকারী অপেক্ষাকৃত ছোটো মাপের ব্যবসায়ী মহল। সরকারও মেনে নিয়েছেন তা। কিন্তু বছর ঘুরতেই পরিস্থিতি মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে। প্রথমদিকের জট-জটিলতা প্রথম অনেকটাই উধাও।
আমাদের অবাক করে জিএসটি নিয়ে দেশের প্রধান বিরোধীদল জাতীয় কংগ্রেসের অযৌক্তিক দাবি। কী সেই অযৌক্তিক দাবি? রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস মনে করে জিএসটি-তে একটিই মাত্র করের হার রাখা উচিত। এমন অযৌক্তিক দাবিতে তাজ্জব সবাই। কারণ বিলাস-দ্রব্যে চাপানো করের হারের সঙ্গে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের করের হার কখনও এক হতে পারে না। দামী গাড়ির করের হার কি কখনও নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যের চাপানো করের হারের সমান করা উচিত?
কংগ্রেসের বিরোধিতা কোনও যুক্তিতেই মানা যায় না। তারাই বা কেন উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে পারেননি দশ বছরের শাসনে? আর ‘উপযুক্ত পরিকাঠামো’র অভাব দেখিয়ে জিএসটি-র মতো কোনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বছরের পর বছর ফেলে রাখা কোনও দায়িত্বশীল সরকারের কাজ হতে পারে না। তারা কি নাকে তেল দিয়ে গোটা একটি দশক ঘুমুচ্ছিলেন? ক্রেতাস্বার্থে তাদেরই পরিকল্পিত কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যদি অন্য সরকার বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে তো অকারণ বিরোধিতা করতে হবে?
এ কোন ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন নােংরা রাজনীতি? দলের স্বার্থ দেশ ও দশের স্বার্থ কোনটা প্রাধান্য পাবে রাজনৈতিক দলের কাছে? আর কবে কংগ্রেস এবং অন্যান্য বিরোধী দলের নেতারা সাবালক হবেন? সংকীর্ণতা, নীচতা, দীনতা, ভণ্ডামীকে দূরে সরিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের ন্যূনতম স্বার্থের কথা চিন্তাভাবনায় আনবেন? যাঁদের নিয়ে ভোটের রাজনীতি করেন, প্রাধান্য দেবেন তাঁদের স্বার্থকে? তারা কি লক্ষ্য করেছেন, কেন প্রতি ভোটের সময় ইভিএম মেশিনে নোটার দিকে পাল্লা ভারী হচ্ছে?
জিএসটি নিয়ে দেশের মানুষকে ভুল বোঝানোর কাজ এখনও চলছে! ব্যবসায়ী মহলও এতে সচেতনভাবেই ইন্ধন দিচ্ছেন। তারা ইচ্ছে মতো বিক্রিত পণ্যের দাম বাড়িয়ে তার দায় ঠেলে দিচ্ছেন জিএসটি-র ঘাড়ে। অর্থাৎ জিএসটি-র জন্যেই এতো দাম দিতে হচ্ছে ক্রেতাকে! একদিকে বিরোধীদলের সুচতুর প্রচার, অন্যদিকে ধুরন্ধর ব্যবসায়ী মহলের বিষোদ্গার। দুয়ে মিলে সাধারণ ক্রেতারা বিভ্রান্ত, বুঝি বা দিশেহারাও! কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা এই সুযোগটাই অনৈতিকভাবে নিচ্ছেন এ দেশের সুবিধাবাদী বিরোধীপক্ষ।
উল্লেখ্য, যাঁরা কর-সংক্রান্ত সামান্য খোঁজ খবর রাখেন কিংবা শিক্ষিত ও সচেতন ক্রেতা, তারা সবাই কমবেশি জানেন, জিএসটি লাগুর আগে বহু পণ্যের ওপরই অত্যধিক হারে কর নেওয়া হতো। রাজস্ব সংক্রান্ত সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, পরোক্ষ করের গড় হার ছিল ৩১ শতাংশ। জিএসটি শুরু হবার পর সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকার প্রথমে কিছু পণ্যপরিষেবাকে ২৮ শতাংশ ও ১৮ শতাংশ বন্ধনীতে রাখলেও কর আদায় বৃদ্ধি পাওয়ার পর পরই ওই কর (২৮ ও ১৮ শতাংশ) কমানো হয়েছে।
ফলে জিএসটির পর বেশির ভাগ পণ্যের কর অনেকটাই কমেছে। এবং ক্রেতা-সাধারণ আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে পণ্যপরিষেবা পাচ্ছেন। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, জিএসটি আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে তা আশাতিরিক্ত। দেখা গেছে, দেশে ২০১৭ সালের পয়লা জুলাই থেকে জিএসটি শুরু হলেও ২০১৫-১৬ সালে রাজ্যগুলির প্রকৃত কর আদায়ের ওপর বার্ষিক ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি হিসেব করে ওই লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছে। ফলে রাজ্যগুলির কর আদায় প্রতি বছর ১৪ শতাংশ বৃদ্ধি নিশ্চিত।
৬টি রাজ্য ওই লক্ষ্যমাত্রা পার করেছে; ৭টি রাজ্য তাদের লক্ষ্যমাত্রার খুব কাছাকাছি এবং কেবল ১৮টি রাজ্য তাদের লক্ষ্যমাত্রার থেকে ১০ শতাংশের বেশি দূরে। ফলে রাজ্যগুলিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার প্রয়োজন গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক কম হবে। আর ২০১৮-র প্রথম ৬ মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের জিএসটি আদায় গত বছরের তুলনায় অনেকটাই বেড়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭-তে জিএসটি আদায় হয়েছে প্রতিমাসে গড়ে ৮৯,৭০০ কোটি টাকা। ২০১৮-এর সেই অঙ্ক বেড়ে হয়েছে ৯৭,১০০ কোটি টাকা।
একমাত্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থেই বিরোধীরা জেনে শুনেও ডাহা মিথ্যেকথা প্রচার করে চলেছেন। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সত্যি কথা বলার সৎসাহস এদের নেই। যদিও মিথ্যে বলার অনৈতিক অধিকার এঁরা কায়েম করে নিয়েছেন। অথচ কেন্দ্র ও প্রতিটি রাজ্যের প্রতিনিধিত্বে নতুন পরোক্ষ কর ব্যবস্থার নীতি-নির্ধারক সংস্থা জিএসটি কাউন্সিল গঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা ভাবে এটি লাগু করেননি। যদিও বিরোধীরা জিএসটি-র যাবতীয় দায়-দায়িত্ব কেন্দ্রের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত।
জিএসটি আইনের খসড়া রচনা থেকে শুরু করে যাবতীয় বিধি তৈরি, বিজ্ঞপ্তি জারি, প্রাথমিক কর হার চূড়ান্ত করা, পরবর্তীকালে সেই কর হার সরল করা— এমন হাজারও সিদ্ধান্ত ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কাউন্সিলের এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জানান, ‘জিএসটি কাউন্সিলের বাইরে যতোটা রাজনৈতিক মতবিরোধ দেখা যায়, কাউন্সিলের মধ্যে ঐকমত্য ততোটাই।’ বুঝুন ঠ্যালা। কতোটা ভণ্ডামি আর দ্বিচারিতা নিয়ে এরা রাজনীতি করছে দলগুলি।
জিএসটি-র কাঠামোতে দেখা গেছে, ১৮৩টি পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রে করের হার শূন্য। ৩০৮টির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ। ১৭৮টির ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ। ৫১৭টির ক্ষেত্রে ১৮ শতাংশ। আর মাত্র ২৭টি বিলাসদ্রব্য ও নেশার পণ্যের ক্ষেত্রে ২৮ শতাংশ। সিমেন্ট ও গাড়ির যন্ত্রাংশ এই কর বন্ধনীতে থাকলেও তা তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এবার পাঠক আপনিই বিচার করুন, জিএসটি লাগু হওয়ায় কার লাভ হয়েছে। উল্লেখ্য, ১২ ও ১৮ শতাংশ এই দুই পৃথক হারের পরিবর্তে একটি কর হার প্রণয়ন করার সিদ্ধান্তও পাকা।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মহলও ক্রমশ অভ্যস্থ হয়ে উঠেছেন জিএসটি নামক এই নতুন কর প্রদান ব্যবস্থায়। আধুনিক ও সহজ ধরনের সফটওয়ারও এসেছে বাজারে। যার ফলে কর প্রদানের ডিজিটাল হিসেবের পদ্ধতিতে জট-জটিলতা অনেকটাই কমেছে। আগামী দিনে আরও সহজ হবে এমন আশা করাই যায়। আধুনিক ও উন্নত পদ্ধতি আবিষ্কার হচ্ছে। একদিন বিরোধীদের মিথ্যে প্রচারও ভোঁতা হয়ে যাবে। সাধারণ মানুষও বুঝতে পারবেন বিরোধীদের প্রচারের অসারতা। সেদিন কিন্তু আর খুব বেশি দূরে নয়।
বরুণ দাস