এরকম হাহাকার এই প্রথম নয় , মাঝে মাঝেই শোনা যায় । বলা উচিত বিশ্বভারতী একটি প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে গড়ে ওঠার শুরু থেকেই শোনা যায় – ‘বিশ্বভারতীর আশ্রমের ঐতিহ্য বিপন্ন’ ।
বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যটা কি ? আশ্রমটাই বা কিসের ? আশ্রমিকই বা কে ? ১২৫০ বঙ্গাব্দের ৭ ই পৌষ [ ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে ডিসেম্বর] মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হন । ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘শান্তিনিকেতন’ বাড়ি ও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । যে বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা থাকার কথা নয় তা হল নিরাকার এক ব্রহ্ম-উপাসনা করার জন্যই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ এই আশ্রমের স্থাপনা করেছিলেন । অর্থাৎ পরিস্কার ভাবে এটির সুত্রপাত একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবেই ।মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুধর্মের অঙ্গ হিসাবেই মনে করতেন। ১৩১২ বঙ্গাব্দের ১ লা অগ্রাহায়ন বোলপুরে বসে লেখা এক চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন – ‘কেশববাবুরা যখন ব্রাহ্মসমাজে প্রবেশ করিয়া ব্রাহ্মধর্মের সহিত হিন্দুসমাজের বিচ্ছেদ সাধনের উপক্রম করিলেন তখন দেবেন্দ্রনাথ হিন্দু সমাজকে ত্যাগ করিলেন না – ব্রাহ্মধর্মকে হিন্দুসমাজেরই অঙ্গ বলিয়া গণ্য করিলেন’।সেদিক দিয়ে শান্তিনিকেতনের বহু উচ্চারিত আশ্রমটি মূলত একটি হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান । রবীন্দ্রনাথ যে বিদ্যালয়ের শুরু করেন সেটিও ছিল – ব্রহ্মচর্যাশ্রম । সেখান থেকেই আজকের বিশ্বভারতী । মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতন আশ্রমের নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করে দিয়ে গেছেন । আর রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ এর কার্য -প্রণালী কেমন হবে তা বলে গেছেন । ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ ই মার্চ মহর্ষি ন্যাস-পত্র বা ট্রাষ্ট ডিড রচনা করে সর্বসাধারণের ব্যবহারের জন্য শান্তিনিকেতন আশ্রম উৎসর্গ করেন । ট্রাষ্ট ডিড অনুসারে এই আশ্রমে ধর্মচর্চা করা যাবে এবং ধর্ম ভাব জাগ্রত করার জন্যেই একটি মেলার আয়োজন করা হবে – যা পরবর্তীকালে পৌষমেলা নামে পরিচিতি পেয়েছে । একটি হিন্দু ধর্মীয় আশ্রমের গর্ভে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্ম তাও মূলত একটি আশ্রমভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান । অতএব বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য একটি ধর্মীয় আশ্রমের ঐতিহ্য । ইদানীং ‘বিশ্বভারতী’ নামটির ভুল ব্যখ্যা করে বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে ‘ জাতীয়’ নয় , জাতীয়তা নয় – এটির মুল ভাবনা তথাকথিত ‘ আন্তর্জাতিকটা’।কি বলেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ? ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ –প্রতিষ্ঠাদিবসের উপদেশে তিনি বলেছেন – ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়ের ছাত্রগণকে স্বদেশের প্রতি বিশেষরূপে ভক্তিশ্রদ্ধাবান করিতে চাই। …স্বদেশকে লঘু চিত্তে অবজ্ঞা , উপহাস , ঘৃণা – এমনকি অন্যান্য দেশের তুলনায় ছাত্ররা যাতে খর্ব করিতে না শেখে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখিতে চাই । আমাদের স্বদেশীয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে চলিয়া আমরা কখনো সার্থকতা লাভ করিতে পারিব না। আমাদের দেশের যে মহত্ত্ব ছিল সেই মহত্ত্বের মধ্যে নিজের প্রকৃতিকে পূর্ণতা দান করিতে পারিলেই আমরা যথার্থভাবে বিশ্বজনীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হইতে পারিব – নিজেকে ধ্বংস করিয়া অন্যের সহিত মিলাইয়া দিয়া কিছুই হইতে পারিব না – অতএব বরঞ্চ অতিরিক্তমাত্রায় স্বদেশাচারের অনুগত হওয়া ভালো তথাপি মুগ্ধভাবে বিদেশীর অনুকরণ করিয়া নিজেকে কৃতার্থ মনে করা কিছু নহে’। কি আদর্শ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ এই আশ্রম বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন , কিভাবে তিনি এটিকে পরিচালনা করতে চান সেসব জানতে চেয়েছিলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন , অমর্ত্য সেনের মাতামহ । তার উত্তরে রবীন্দ্রনাথ নিজে হাতে কুড়ি পাতার দীর্ঘ চিঠি লিখে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য , আদর্শ ও দৈনন্দিন পরিচালনা বিষয়ে খুঁটিনাটি নির্দেশ দিয়ে গেছেন। এটাই বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ।
শুধুই গাছপালা , ফাঁকামাঠ, খোলা আকাশ কে আশ্রমের ঐতিহ্য , বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য বলে যারা প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন তারা খুব কৌশলে শান্তিনিকেতন আশ্রম ও বিশ্বভারতীর প্রকৃত ঐতিহ্য ভুলিয়ে দিতে চাইছেন ।শান্তিনিকেতন মানে রবীন্দ্রনাথের তৈরি একটা ‘ইকো পার্ক’ নয় — যেটির শুধুমাত্র দৃশ্যমান সৌন্দর্য বা পরিবেশ দূষণ নিয়ে আমরা এত উদ্বিগ্ন । যারা ‘বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য বিপন্ন’ বলে হাহাকার করছেন তারা কি এই প্রতিষ্ঠানের ভাবগত ঐতিহ্যকে স্বীকার করেন ? অনুসরণ করেন ? বিশ্বভারতী কে একটি আশ্রম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মেনে নিতে তাদের ‘সেকুলার’ হৃদয় পারবে? সেই ব্রহ্মচর্যাশ্রম এর ঐতিহ্য অবশ্যই বিপন্ন কারণ নিরাকার এক ব্রহ্ম-উপাসনায় যারা বিশ্বাস করেন না তাদের প্রভাব ক্রমবর্ধমান , তাদের নিয়ন্ত্রণেই মহর্ষির আশ্রম । যদি ঐতিহ্য রক্ষা করার সদিচ্ছা থাকে তবে মহর্ষির প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের ঐতিহ্যকে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং বিশ্বভারতীকে একটি আশ্রম ভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসাবে মেনে নিতে হবে। রবীন্দ্রনাথ ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ এর কার্য –প্রণালী রচনা করে গেছেন । সময়ের প্রেক্ষিতে ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক শিক্ষিকা অন্যান্য কর্মী সকলকেই সেই অনুসারে চলতে হবে।আর তিনিই নিজেকে আশ্রমিক বলে দাবী করতে পারেন যিনি শান্তিনিকেতন ব্রাহ্মআশ্রমের ঐতিহ্য মেনে চলেন , সেখানকার রীতি-নীতি মেনে চলেন , মন্দিরের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন , নিজের জীবনচর্যায় তা রুপায়নের চেষ্টা করেন।শুধুমাত্র বিশ্বভারতীর আশে পাশে বেশ কয়েক কাঠা জায়গার ওপর তৈরি বিলাসবহুল একটা পেল্লাই বাড়ির মালিক হলেই কি নিজেকে আশ্রমিক বলে দাবী করা যায় ?
শান্তিনিকেতনের যেমন একটি আশ্রমিক ঐতিহ্য আছে বিশ্বভারতীর তেমনি একটি অশান্তির ‘ঐতিহ্য’ আছে । রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্র রথীন্দ্রনাথ [ ১৯৫১-৫৩] থেকে ধরলে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী কে নিয়ে ১৯ জন উপাচার্য হয়েছেন ।এযাবৎ আট জন উপাচার্য পূর্ণ সময় উপাচার্য হিসাবে ছিলেন বা বলা ভালো থাকতে পেরেছিলেন । আর কতজন উপাচার্য কে বিক্ষোভের সম্মুখীন হতে হয়নি বা ‘ঐতিহ্য বিরোধী’ হিসাবে সমালোচিত হতে হয়নি ? সে সংখ্যা হাতে গুণে বলা যায়। তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেলো বিদ্যুৎ চক্রবর্তী ‘আর এস এসের বসানো লোক’ , রবীন্দ্রনাথের র জানেন না এবং খুব একগুঁয়ে । তাঁর আগের আঠেরো জনের মধ্যে যারা শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়েছিলেন, চূড়ান্ত অপমানিত হয়েছিলেন , বিশ্বভারতী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন সবাই কি ‘আর এস এসের বসানো লোক’ ছিলেন ? কাউকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় রথীন্দ্রনাথ থেকে কতজন শান্তিতে উপাচার্য পদে থাকতে পেরেছিলেন ? অতিবড় বিশ্বভারতী বিশেষজ্ঞকেও খানিকক্ষণ মাথা চুলকাতে হবে ।অনেকেই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা কোথাও লেখেননি , কারণ অত বড় মাপের মানুষেরা ছোট খাটো বিষয় মনে রাখেন না কিন্তু বরেণ্য বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উপাচার্য পদে কি তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিলো তা শান্তিনিকেতনের ছাতিম গাছেরাও জানে । সংসদে বিশ্বভারতী সংশোধন বিল পাশ হয়েছিলো – তার জেরে হেনস্থা হতে হয় অম্লান দত্ত কে । ‘বিশ্বভারতী ও তার ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে অম্লান দত্ত লিখেছেন – ‘সাধারনভাবে একথা স্বীকৃত যে বাধাবন্ধনহীন ‘স্থানিক সংকীর্ণতা’ বিশ্বভারতীর অবনতির জন্য দায়ী। বিশ্ব ভারতী ২০০৫ সালে উন্নয়নের জন্য যে সার্বিক পরিকল্পনা পেশ করে তাতে বলা হয়েছে , ‘ দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বভারতী চাকরি এবং ভর্তির ব্যপারে অত্যধিক স্থানীয় চাপের মুখে পড়ে’। ওই প্রবন্ধেই অম্লান বাবু কম্যুনিস্ট পার্টির সাংসদ ও তাত্ত্বিক নেতা অধ্যাপক হীরেন মুখোপাধ্যায় বিশ্বভারতী সংশোধন বিধেয়ক ১৯৭১ নিয়ে সংসদে বিতর্ক কি বলেছিলেন তা উল্লেখ করেছেন । সংসদে দাঁড়িয়ে হীরেনবাবু অভিযোগ করেছিলেন , ‘রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানটি শান্তিনিকেতনের তথাকথিত প্রাক্তন ছাত্রদের একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে’। ভদ্রলোক কমুনিস্ট হীরেনবাবু যা বলেননি তা হল – এই গোষ্ঠী সবসময় ‘যে সাপের সিং নেই, চোখ নেই , করেনাকো ফোঁসফাঁস’ – এমন উপাচার্য চায় যিনি তার ‘পাণ্ডিত্য’ আর ‘রবীন্দ্রঅনুরাগ’ নিয়ে সেন্ট্রাল অফিসের দোতলায় বসে থাকবেন , মাঝে মাঝে ওপর থেকে দেখবেন কিন্তু বারান্দা থেকে নামবেন না !!!
বিশ্বভারতীর অন্যতম ‘সফল’ উপাচার্য নিমাই সাধন বসুর লেখা ‘ভগ্ননীড় শান্তিনিকেতন’ এ তিনি ভাল মন্দ সব দিক নিয়েই লিখেছেন কিন্তু উপাচার্যের কি অসহায়তা সেটি বেশ তাড়িয়ে লিখেছেন । ওই বইয়ে একজায়গায় তিনি লিখছেন –‘বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে এক বড় অভিযোগ হল যে , এই বিশ্ববিদ্যালয়ে রবীন্দ্র – শিক্ষাচিন্তা ও আদর্শ বর্জিত হচ্ছে । শিক্ষার মান নেমে যাচ্ছে । ছাত্র শিক্ষক ও কর্মীদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা ও আনুগত্য লুপ্তপ্রায় । ‘আগেকার বিশ্বভারতী’ আর নেই । এই সবকিছুর জন্যই শেষপর্যন্ত দায়ী করা হয় প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও ঔদাসীন্যকে । আর ‘প্রশাসন’ বলতেই শেষপর্যন্ত বোঝায় একজনকে – উপাচার্য । আমার পূর্ববর্তী উপাচার্যরা এবং আমি কেউই এই সমালোচনা , নিন্দা থেকে মুক্তি পাইনি । …।…শান্তিনিকেতনের বাইরে ও ভিতরে বহুলোকের দৃঢ় ধারণা হয়েছিলো যে , আমি কংগ্রেসি লোক । খোদ দিল্লীর মনোনীত উপাচার্য , যার কাজ হবে বিশ্বভারতীতে সব বিরোধীদের ঠাণ্ডা বা শায়েস্তা করে এটিকে পুরোপুরি কংগ্রেস নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব বিদ্যালয়ে পরিণত করা । প্রকৃতপক্ষে এই ধারণা বা আশঙ্কা ছিল সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন’।১৯৮৬ সালের মে মাসে রবীন্দ্রনাথের ১২৫ তম জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উদ্যোগে কবির জন্মস্থান জোড়াসাঁকো থেকে কর্মস্থান শান্তিনিকেতন পর্যন্ত এক পদযাত্রার আয়োজন করা হয় । সেই কর্মসূচিতে সহযোগিতা করার তাকে কঠোর সমালোচনা করা হয়েছিলো । তিনি লিখেছিলেন – ‘সমালোচনার ইন্ধন তাঁরা সবচেয়ে বেশি পেয়েছিলেন একটি দৈনিক বাংলা কাগজের রিপোর্ট থেকে’ ।
সুজিত বসুর সময় নোবেল পদক চুরি গেছিলো । আজ যারা ফেন্সিং এর কথা বলছেন তারা জেনে রাখুন ওই ফেন্সিং কেটেই নাকি চোর ঢুকেছিল রবীন্দ্রভবনে । তখন থেকেই প্রাচীর দেওয়া , ফেন্সিং দেওয়ার কাজ গতি পায় । কেন্দ্রীয় অফিস খুব নান্দনিক ভাবে ঘেরার পর সুজিত বসু কে ‘ পাঁচিল কাকু’ নামে অভিহিত করা হয় । তিনি যেদিন অবসর নিলেন সেদিন ঢাক বাজিয়ে অপমান করে তাকে বিদায় করা হয় । ঐতিহাসিক রজতকান্ত রায় আর যাই হন আর এস এসের লোক ছিলেন না । অথচ সীমানা ঘেরার উদ্যোগ নেওয়ায় সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় বোলপুরের এক প্রকাশ্য সভায় তীব্র ভাষায় তার সমালোচনা করেন


একটা অদ্ভুত বিষয় দেখা যায় শান্তিনিকেতনে । যারা মনে করেন বিশ্বভারতী এখনো একটি প্রাচীন তপোবনের মত থাকবে তারা বিশ্বভারতী ঘিরে যে কংক্রিটের জঙ্গল তা নিয়ে মুখ খোলেন না – কারণ বিপদ আছে। স্বঘোষিত আশ্রমিকরা যখন বাড়ি করেছিলেন তখন কি জানতেন না যে তাদের বাড়ির সামনে চিরকাল বিস্তীর্ণ উন্মুক্ত প্রান্তর থাকবে না ? ওই জায়গা যদি ব্যক্তি মালিকানার হতো তাহলে তারা কি করতেন? মেলার মাঠ উপলক্ষ মাত্র । লক্ষ্য নিজেদের বাড়ির সামনেটা চিরকাল ফাঁকা রাখা। খোয়াই আন্দোলনের পরিণতি সবার জানা। কিভাবে কয়েকটি গ্রামের মানুষের ব্যবহারের জলাশয় আর বিস্তীর্ণ জমি একরকম গায়ের জোরে নিয়ে সেখানে বিনোদন পার্ক করা হয়েছে তাও সবাই জানেন। মহাশ্বেতা দেবী আজ না থাকলেও শুভাপ্রসন্ন বা যোগেন চৌধুরী নিশ্চয় জানেন কেন তারা বিনোদন পার্ক নির্মাণ বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।কিভাবে নদীর ধারে বিশাল নির্মাণ করা হচ্ছে তাও বোলপুর শান্তিনিকেতনের ‘সবুজ যোদ্ধারা’ জানেন । কেমন আছে সোনাঝুরি ? কিন্তু সেখানে কিছু বলা হবে না বা যাবে না বরং বিশ্বভারতীর বিরুদ্ধে কিছু করলে বেশ ‘মাইলেজ’ পাওয়া যায় ।একটা ছবির চারপাশের বাঁধাইটাও সুন্দর হতে হয় । সুতরাং বিশ্বভারতী কে চির সুন্দর রাখতে হলে তার চারপাশের নির্বিচারে নির্মাণ বন্ধ করা দরকার এমনকি বোলপুর শহরের নির্মাণকাজ নিয়েও ভাবা উচিত।
বিশ্বভারতী যখনই ক্যাম্পাসের দখলদারী তুলতে যায় তখনই কেউ না কেউ প্রতিবাদী হয়ে ওঠে । যত্র তত্র দোকান কিমবা রেস্তরাঁ কোন ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করে ? কেন সঙ্গীত ভবনের মাঠ পাশের রেস্তরাঁয় যাবার রাস্তা হিসাবে ব্যবহৃত হবে ? ২০০৫ সালে যোগেন চৌধুরী লিখেছিলেন – ‘বিশ্বভারতী ( তথা শান্তিনিকেতন – শ্রীনিকেতনকে বুঝে নিতে হবে যে বিশ্বভারতী মূলত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং পর্যটন কেন্দ্র নয় । ……ক্রমশ দোকানপাট বাড়ছে । রতনপল্লী বাজার থেকে কোঅপারেটিভ এর দিকে যাবার সময় রাস্তার পাশে বিশ্বভারতীর জমি ঘেঁষে দোকানপাট রেস্তোরাঁ ছিল না – এখন সেখানে বহু দোকান । কে বা কারা এর পিছনে আছে জানি না’ ।সেই ট্র্যাডিশন ভাঙতে গেলেই উপাচার্য খারাপ !
সুতরাং ‘নির্বাচিত হাহাকার’ করে নিজেদের কোন ‘হিডেন এজেন্ডা’র পূরণ হতে পারে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর কোন ভাল হবে না । ঐতিহ্য মানতে চাইলে সবটা মানতে হবে না হলে মেনে নেওয়াই ভাল আর পাঁচটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের মত এটি একটা । শঙ্খ ঘোষের (স্বপ্নভঙ্গের চিহ্ন) কথায় – ‘অন্য যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মতোই আরেকটা বিশ্ববিদ্যালয় বলে ভাবতে হবে আজকের বিশ্বভারতীকে , পালটে নিতে হবে আমাদের বিলাপের পুরনো মুদ্রাগুলোকে ।…………… এখানে আজ ভাল কিছু ঘটলেও তা অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের মতো ভালো , মন্দ হলেও তা অন্য যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতোই মন্দ’
তথ্য সহায়তা –
১। ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ – প্রতিষ্ঠা দিবসের উপদেশ – বিশ্বভারতী
২। ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথ – প্রবোধ চন্দ্র সেন
৩। ভগ্ননীড় শান্তিনিকেতন – নিমাইসাধন বসু
৪। বিশ্বভারতী ও তার ভবিষ্যৎ – রজতশুভ্র মজুমদার সম্পাদিত
৫। বিশ্বভারতী – এইচ এল সি রিপোর্ট – ২০০৬

সোমেশ্বর বড়াল (Someshwar Baral)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.