যৌবন বয়সে দত্তপন্থ ঠেংড়ীজী গাঁয়ের কয়েক বন্ধু মিলে এক কৃতবিদ্য গুরুজির কাছে কুস্তি, লড়াই আর লাঠিখেলা শিখতে যেতেন। আখড়াটি পারিপার্শ্বিক অঞ্চলে খুবই বিখ্যাত ছিল। অতি দ্রুত তারা খুবই পারদর্শী হয়ে উঠেছিলেন শরীরচর্চার নানান আঙ্গিকে। কিন্তু প্রতিদিন ফেরার সময় তারা লড়াইয়ের পোষাক পরে, ঢিণ্ডোরা পেটাতে পেটাতে, সোজা পথের বদলে আশেপাশের গ্রাম ঘুরে, নিজেদের জাহির করে তবে সদলবলে ফিরতেন। একদিন পাশের গাঁয়ের এক দোকানদার তাদের ডেকে বললেন, বাবা, তোমরা সোজা পথ ধরেই তো ফিরতে পারো, শুধু শুধু আমাদের গ্রাম ঘুরে যাও কেন? রোজ কি তোমরা বীরত্ব দেখাতে চাও? কিন্তু তোমাদের গুরু, যিনি এলাকায় সবচেয়ে বিখ্যাত কুস্তিগির, তিনি তো তোমাদের শিখিয়ে-পড়িয়ে চুপচাপ মাথা নিচু করে চলে যান; তারপর তাড়াতাড়ি স্নান সেরে আখড়ার লালপোষাকটিও ছেড়ে ফেলেন। আসলে জ্ঞানের গভীরতা তোমাদের কম বলেই তোমাদের ব্যক্তিগত গর্ব তৈরি হচ্ছে! তোমাদের গুরুজীর জ্ঞানের গভীরতা বেশি বলে, তার মধ্যে কোনো গর্ব নেই, বরং সকলের প্রতি নিষ্কাম কর্ম আছে। সম্পূর্ণ শিক্ষা হয়ে গেলে, তার ভেতরে গর্ব থাকে না, দেখনদারি থাকে না। তোমাদের প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা ভাবে গর্ব আছে। ব্যক্তিগত গর্ব ভালো নয়।
নিজের জীবন থেকে ঘটনাটি বিবৃত করে ঠেংড়ীজী বলছেন, কোনো ব্যক্তির নিজস্ব গর্ব তার জ্ঞানের দীনতাকে প্রকাশ করে; যার জ্ঞান ও অভ্যাস যত গভীর, তার গর্ব ততই কম হবে। গর্ব যখন একের থেকে বহুর মধ্যে চলে যাবে, তখনই তৈরি হবে সংগঠন। আমি নই, আমরা। যখন আমার দর্শন আমার গর্ব, তখন তাতে কোথাও একটা দম্ভের ব্যাপার আছে। যখন আমার গর্ব আমাদের দর্শন হয়ে দাঁড়ায়, তখনই তৈরি হয় সংগঠন। গর্ব ভালো, সেটা হল সমষ্টির গর্ব। ‘ম্যাঁয়’ না বলে ‘হাম’ বলার গর্ব, ওটাই সংগঠন তৈরির চাবিকাঠি। যখন আমি আমাদের কোনো বিষয় নিয়ে গর্ব করি, তখন তা হয়ে ওঠে সুন্দর একটি সংগঠন। সংগঠনে We feeling বড় কথা। এভাবে দত্তপন্থজী সংগঠনের সংজ্ঞা দিয়েছেন।
আরেকটি ঘটনা। একজন ঠেংড়ীজীকে খানিকটা ঠাট্টা করেই জিজ্ঞেস করছেন, আরএসএস-এর কত ক্ষমতা?
উনি বললেন, কী করে বলবো?
প্রশ্নকর্তা অবাক হলেন– মানে? সদস্য সংখ্যা বলবেন! সব সদস্য যোগ করলেই পেয়ে যাবো, আপনাদের শক্তি কত!
ঠেংড়ীজী বললেন, সংগঠনের ক্ষমতা বলার ব্যাপারে A+B — একথা তো ঠিক নয়। আমি এভাবে সংগঠনকে দেখি না। যখন A একটা মানুষ, B আরেকটি মানুষ; A-র ক্ষমতা আলাদা, B-র ক্ষমতা আলাদা। যদি ক্রমান্বয়ে তাদের সক্ষমতা বাড়ে, তবে আপনার মতানুসারে দুজনের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে তা হওয়া উচিত A2+B2 (A square plus B square); কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় A এবং B মিলিত সংগঠনের সমষ্টিগত শক্তি বেড়ে হচ্ছে (A+B)2 (A plus B whole square); এখন (A+B)2 = A2+ 2AB+ B2, চলে এলো আরও একটা 2AB-র মতো অতিরিক্ত কিছু! এটা কোথা থেকে এলো?
ঠেংড়ীজী বলছেন, এটাই হল সাংগঠনিক ক্ষমতা। সংগঠনের শক্তি সংগঠনের মোট সদস্যের ব্যক্তিগত শক্তির যোগফলের সমান হবে, এমন কোনো কথা নেই। সংগঠনের একটা নিজস্ব ক্ষমতা থাকে, নিজস্ব শক্তি থাকে। যখন আমি আমাদের নিয়ে গর্ব করছি, তখন আমাদের একটি সাংগঠনিক ক্ষমতা তৈরি হয়, তার মাপনি অত সহজ ব্যাপার নয়।
সংগঠনের একজন সদস্যের কতটা ক্ষমতা, সেটা কখনও পরিমাপ করা যায় না। বিশেষ সময়ে ব্যক্তি বিশেষের ক্ষমতা, বিশেষ রকমের হয়। কোনো কোনো পরিস্থিতিতে কোনো ব্যক্তির ক্ষমতা অনেকগুণ বেড়ে যেতে পারে। কী শর্তে, কী মনোভাব নিয়ে, কী পরিস্থিতিতে কোনো সদস্য কাজ করছেন, তার উপর তার ক্ষমতা কমতে বা বাড়তে পারে। এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে ঠেংড়ীজী তাঁর পরিবারের একটি ঘটনা বললেন।
তাঁর এক নিকটাত্মীয় খুব ধনী পরিবারের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। নববধূ একেবারেই রান্নাবান্নার কাজে পটু ছিলেন না। তখনকার দিনে উনুন জালিয়ে রুটি করতে হত। তা করতে গিয়ে সামান্য একটু গরম রুটির ছেঁকা লাগলে তিনি ‘উফ্-আফ্’ করতেন। এই নিয়ে বাড়ির সবাই রীতিমতো মজা করতেন তার সঙ্গে। একদিন তাদের বাড়িতে আগুন লেগে গেলো, তখন গভীর রাত। পাড়ার লোকেরা তাদের ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুললেন। ঘুম ভেঙ্গে পড়ি কি মরি করে সেই বধূ ছুটে বেরিয়ে এলেন। এসেই মনে পড়লো বাড়ির দোলনায় ছোট্ট শিশু ঘুমোচ্ছে। তৎক্ষণাৎ তিনি ওই আগুনের মধ্যে ফের বাড়িতে ঢুকে পরপর দু’টো ঘর অতিক্রম করে তৃতীয় ঘরে গিয়ে দোলনা থেকে শিশুটিকে কোলে করে ফিরলেন। শিশুটি প্রাণ পেলো। তবে তিনি ফিরে আসার পর জ্ঞান হারালেন, অগ্নিদগ্ধতার চিকিৎসায় পরে সুস্থও হয়ে উঠলেন। দত্তপন্থজী বলছেন, যে মানুষটা আগুনের তাপে সামান্য ছেঁকা লাগার জন্য এত ব্যথা পেতেন, তিনিই কিনা অগ্নিকাণ্ডের বিশেষ পরিস্থিতিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, আপন সন্তানের প্রাণ বাঁচাতে। অর্থাৎ পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়ে বা কমে যায়।
প্রত্যেক সদস্যের একটা নির্দিষ্ট স্টাইল থাকে। সবাইকে দিয়ে সব কাজ হয় না। যে যে কাজটি করতে সবচাইতে সক্ষম, তাকে দিয়ে সেই কাজটিই করাতে হবে। সেটি সংগঠনের কার্যকর্তাকে বুঝতে হবে; এটাই নেতৃত্বের বড় গুণ।
একবার দত্তপন্থজী লক্ষ্নৌ গেছেন, সঙ্গে একজন সহকারী। সেটাই তাঁর প্রথম লক্ষ্নৌ যাওয়া! ফলে লক্ষ্মৌর ভাষার স্টাইল সম্পর্কে তিনি কিছু জানতেন না; তাঁর সহকারী জানতেন সে সব। সেখানে একজন স্বয়ংসেবক তাঁকে বললেন, গরীবের বাড়িতে একবার যেতে হবে। দত্তপন্থজী সম্মতি দিলেন; কিন্তু পৌঁছে দেখলেন প্রাসাদোপম গৃহ। সহকারী ভদ্রলোক আস্তে করে তাঁকে বললেন, এটাই লক্ষ্নৌর কথার স্টাইল। অতঃপর সেই স্বয়ংসেবক বারবার তাঁকে বলতে লাগলেন, এটি আপনার ঘর, এটি আপনার বাগান, এটি আপনার রান্নাঘর ইত্যাদি; এসবই আপনার জন্য। অবশেষে ভদ্রলোকের চারটি ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে ফিরলে, উনি তাদের ডেকে দত্তপন্থজীকে প্রণাম করতে বললেন এবং আরও বললেন, এরা আপনারই ছেলেমেয়ে। দত্তপন্থজীর ধৈর্যের বাঁধ এবার ভেঙ্গে গেলো। বলে উঠলেন, আমি ব্রহ্মচারী মানুষ, আমার কীভাবে ছেলেমেয়ে হবে? সহকারী পাশ থেকে বলে উঠলেন, এইভাবেই এখানে বলা হয়, এটাই এখানকার স্টাইল।
এই ঘটনার অবতারণা করে দত্তপন্থজী বোঝাতে চাইলেন, সংগঠক বা নেতার বুঝতে হবে সদস্যের স্টাইল কোনটা? তার সেই স্টাইলের মধ্যে দিয়েই তার সর্বাধিক কুশলতার প্রকাশ কীভাবে হতে পারে, তা ভাবতে হবে। যে স্টাইলের কথাবার্তা নিমেষে মানুষকে আপন করে নেয়, তার একটি সদর্থক দিক থাকে, তার আকর্ষণী ক্ষমতাও হতে পারে অনন্য, অভূতপূর্ব। কে ভালো বক্তৃতা দেবে, কে ভালো বই লিখবে, কে সেবার কাজ ভালো করবে – সেটি নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই দলের সামগ্রিক কর্মকুশলতা নির্ভরশীল। কার্যকর্তার উচিত হবে, তারাই সুলুকসন্ধান করে বেড়ানো; যোগ্য কাজের জন্য যোগ্যকে চয়ন করা।
(সংকলক ও অনুলেখক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক)
চিত্রঋণ : ড. গোপী ঘোষ (Dr. Gopi Ghosh)।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)।