২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে দিদি বারবার জয় বাংলা (বাংলার বিজয়) স্লোগান ব্যবহার করে চলেছেন। একজন অবাঙালি হিসাবে আমার এই স্লোগান প্রথমে অস্বাভাবিক কিছুই মনে হয়নি এবং ভেবেছিলাম যে এটা একটি আঞ্চলিক স্লোগান। কিন্তু এটা আমি আমার প্রবীণ বাঙালি বন্ধু রিমা’র সাথে কথা বলার আগে পর্যন্ত ভাবতাম।
রিমা বলেছিলেন, “১৯৭০- এর দশকে জয় বাংলা সত্যিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের সরকারী স্লোগান ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও সরকার যারা উর্দুকে সরকারি ভাষা হিসাবে জোর চাপিয়ে দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতি, ভাষা ইত্যাদি দমন করতে চেয়েছিল, তার বিপরীতে জাতিগত / ভাষাতাত্ত্বিক পরিচয়ের উপর জোর দেওয়ার জন্য এই স্লোগান তৈরি হয়েছিল। জয় বাংলা স্লোগান হ’ল এই দৃষ্টিভঙ্গির প্রতীক”।
“এই স্লোগানটির ব্যবহার বিজেপি শাসিত দিল্লির অবাঙালীদের সংস্কৃতি এবং তাদের আধিপত্যের থেকে বাংলাকে বাঁচানো তথা হাইলাইট করার জন্য হুবহু নকল করা হয়েছে”।
এই স্লোগানের মর্মার্থ এটাই যে বিজেপি হ’ল বহিরাগত (দিল্লি থেকে আসা) ঠিক যেমন পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ববাংলায় এসেছিল, যারা তাদের ভাষা (হিন্দি) বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি দমন করতে চেয়েছিল। বিজেপিকে বর্ণনা করতে দিদি যে শব্দটি ব্যবহার করছেন তা হ’ল “বহিরাগত”। রাজনৈতিক ভাষ্যকার সন্দীপ ঘোষের একটি টুইট অনুসারে ‘বহির মানে বাইরের, আগত মানে এসেছেন’।
রিমা আরও বলেছেন, “বহিরাগত তত্বের ক্রমাগত পুনরাবৃত্তি হওয়ার মাধ্যমে এই উদ্দেশ্যটি প্রকাশিত হয়েছে যে বহিরাগতদের কোনোভাবেই আমাদের ভূমি দখল করতে দেব না এবং আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির অবমাননা করতে দেব না। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অত্যাচারের সাথে সামঞ্জস্য রেখেই ঠিক এই কারণেই জয় শ্রী রাম স্লোগানটির বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশের পাশাপাশি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটানো হচ্ছে”, যদিও মনিদীপা বোসের এই নিবন্ধ অনুসারে জানা যায় যে পশ্চিমবঙ্গে শ্রী রামচন্দ্রের উপাসনা করা হয়।
প্রচার চলাকালীন বিজেপি নেতাদের বিরুদ্ধে নানান অসম্মানজনক শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে। তাদের মিথ্যাবাদী, দানব এবং ভারত বিক্রি করতে চাওয়া দালাল ইত্যাদি বলা হচ্ছে। “জনসমক্ষে এই দৃষ্টিভঙ্গি স্থাপন করার চেষ্টা চলছে যে পশ্চিম পাকিস্তান যেমন পূর্ব পাকিস্তানীদের উপর আধিপত্য বিস্তার করতে চেয়েছিল ঠিক একইভাবে বিজেপি’ও বাংলাকে দখল এবং শাসন করতে চাইছে”।
তৃনমূল কি ভুলে যাচ্ছে যে কলকাতা একটি অসাম্প্রদায়িক শহর। একসময় ব্রিটিশ শাসিত ভারতের রাজধানী হওয়ায় এই শহর সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। রিমা আরও জানান যে, “লেক মার্কেট অঞ্চলটিতে বেশিরভাগ দক্ষিণ ভারতীয়রাই বাস করেন। ভবানীপুর গুজরাটি, পাঞ্জাবি এবং শিখ জনসংখ্যার জন্য পরিচিত। চাইনাটাউন হ’ল এমন একটা জায়গা যেখানে বেশিরভাগ চীনা’রা বাস করেন। ইহুদি, আর্মেনিয়ান এবং অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরাও কলকাতায় বাস করেন। আবার মারোয়ারীদের কথাও ভুলে গেলে চলবে না।
একজন আবাসিক ভারতীয় কিন্তু অনাবাসী বাঙালি বলেছেন যে, এই সম্প্রদায়গুলি তাঁর চেয়ে বেশি বাঙালি হয়ে উঠেছে। রাজ্যের সংস্কৃতি ও ভাষার সমৃদ্ধির সাথে একাত্ম হয়ে তাঁরা বাঙালি হয়ে উঠেছেন এবং বাংলার এক স্বতন্ত্র, অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছেন।
বাঙালি সংস্কৃতি মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনকালে যখন টিকে থাকতে পেরেছিল তাহলে এখন কেন পারবে না? তারা কি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়লো যে পশ্চিমবঙ্গকে যদি কোনও জ্যোতি বসু বা দিদি পরিচালনা না করে তাহলে তারা মারা যাবে? স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, দিল্লিতে বিজেপি শাসন কি কোনও ভারতীয় রাজ্যের সংস্কৃতিকে হত্যা করেছে? বরং অর্থনৈতিক সুস্থতা থাকলে সব সংস্কৃতিই সসম্মানে টিকে থাকতে পারে। এই নির্বাচনী প্রচারে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বসবাস করা সম্প্রদায়গুলি পশ্চিমবঙ্গে হঠাৎ করেই বহিরাগত হয়ে উঠল, যা নগরীর সামাজিক স্থিতিশীলতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। ২৯ শে মার্চের এএনআই-র প্রতিবেদন অনুসারে “দিদি অভিযোগ করেছেন যে বিজেপি জিতলে বাংলা থেকে বাঙালিদের বিতাড়িত করা হবে।” এই জাতীয় বিবৃতি কি বাকী মানুষের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মনে বিদ্বেষের সৃষ্টি করবে না?
অন্যদিকে, টিএমসি নিউ টাউন এলাকায় বসবাসকারী অবৈধ রোহিঙ্গা অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বা অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসীদের বিরুদ্ধে বহিরাগত হওয়ার অভিযোগ আনেননি। সম্ভবত, তারা বাঙালি।
কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে অবৈধ অনুপ্রবেশের ফলে মালদা, মুর্শিদাবাদ ও পশ্চিম দিনাজপুর এই তিনটি জেলায় মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু এই বহিরাগতদের সম্পর্কে কখনো একটি শব্দও খরচ করা হয়নি। এই সম্পর্কে পরে আরও জানাবো।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় স্থানীয় পুলিশ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করেছিল।এই একই ধরনের ঘটনা আজও দেখা যায় যদিও তা পরিমাণে কম, উদাহরণস্বরূপ বলা যায়— যখন সারদা চিট ফান্ড মামলায় সিনিয়র পুলিশ অফিসার রাজীব কুমারের বিরুদ্ধে অভিযোগের জন্য তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হয়, তখন তিনি নিজ বাসভবনের পুলিশের পাহারার মধ্য থেকেই পলাতক হয়ে যান— ইত্যাদি। এই ঘটনা একটি সাংবিধানিক সংকট তৈরি করে এবং সৌভাগ্যবশত আদালত এতে হস্তক্ষেপ করেছিল।
এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রধানমন্ত্রীর কিসান এবং আয়ুষ্মান ভারত যোজনার মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বাস্তবায়নে পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, এর প্রধান কারণ হ’ল কেন্দ্রীয় সরকারের কৃতিত্ব অস্বীকার করা। বর্তমান সরকারের “গোপন উদ্দেশ্য হ’ল বাংলাকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং একটি নতুন রাজ্য তৈরি করা যেখানে তিনি কোনো চ্যালেঞ্জ ছাড়াই স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে পারবেন।”
এই সব ঘটনাগুলিকে একসাথে সাজালে এটাই দাঁড়ায় যে, ক্ষমতাসীন সরকার বাংলাকে কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণহীন এমন একটি রাজ্যে পরিনত করতে চাইছে যেখানে পশ্চিমবঙ্গ (আংশিক বা পূর্ণরূপে) একটি নিরঙ্কুশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্য হিসাবে গড়ে উঠবে। যদি এই পরিকল্পনা সফল হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশ বৃহত্তর বাংলাদেশের অংশ হয়ে যাবে।
পশ্চিমবঙ্গের বাইরের মানুষ, যাঁরা ১৯৭৫-এর পরে জন্মগ্রহণ করেছেন তারা হয়ত জানেন না যে নির্বাচনের কিছু স্লোগান বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিত তাই এই নিবন্ধটি।
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশ নিয়ে আমার প্রবন্ধের কিছু অংশ তুলে ধরলাম—
“যে রাজনীতিবিদ এটা শুরু করেছিলেন তিনি ছিলেন কংগ্রেসের এক বলিষ্ঠ নেতা। ২০০৬ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত টানা তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি ছিলেন মালদহের মুকুটহীন রাজা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, তিনি হলেন এবিএ গণিখান চৌধুরী। কোনও নির্বাচনে তাকে কেউই হারাতে পারেনি, এবং সত্যি কথা বলতে তিনি নিজের নির্বাচনকেন্দ্রের হয়ে অনেক কাজ করেছিলেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই সকলের ভালোবাসা পেয়েছিলেন। সিপিআই (এম) তাঁর কাছ থেকে এই জয়ী হওয়ার কিছু ফর্মুলা শিখেছিল এবং অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে সেই কৌশল ব্যবহার করেছিল।
পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যায় ভারতীয় ধর্ম বনাম মুসলমানরা(%)—
১৯৭১,১৯৮১,১৯৯১,২০০১,২০১১— উক্ত বছরগুলোতে ভারতীয় ধর্ম ছিল যথাক্রমে— ৭৮.৯৮%, ৭৭.৯০%, ৭৫.৮%, ৭৪.১১%, ৭০.৫৪% আর সেখানে মুসলিমরা ছিল— ২০.৪৫%, ২১.৫%, ২৩.৬১%, ২৫.২৫%, ২৭.০১%।
একটু ভালোভাবে দেখলেই বোঝা যাবে যে পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তেই থেকেছে। ১৯৭১ সালে যে সংখ্যা ছিল ২০.৪৫% তা চোখের আড়ালেই বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ২৭.০১%।
সীমান্ত এলাকার জনসংখ্যা বা বলা ভালো যে মুসলিম জনসংখ্যার দিকে যদি একটু নজর দেওয়া যায় তাহলেই বুঝতে পারা যাবে কিভাবে ১৯৭১-২০১১ সালের মধ্যে এই অঞ্চলগুলোতে উদ্বেগজনক হারে মুসলিমদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
তবে উত্তর ২৪ পরগনা এবং দক্ষিণ ২৪-পরগনা বিভক্ত থাকলেও সেখানের পরিসংখ্যান অন্যান্য সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলির সাথে তুলনীয় নয়।
পশ্চিমবঙ্গে যদি কোনও বাংলাদেশী নাই থাকে তাহলে তৃণমূল কংগ্রেস কিভাবে বাংলাদেশি অভিনেতা ফিরদৌসকে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে উত্তর দিনাজপুর জেলার রায়গঞ্জ থেকে দাঁড়ানো লোকসভা প্রার্থীর হয়ে প্রচারে সামিল করেছিল? সূত্র
আসুন এবার আমরা বাংলাদেশে চলে আসি। সেখানে ভারতীয় ধর্মাবলম্বীদের জনসংখ্যা ক্রমাগত হ্রাস পেয়েছে। ১৯৫১ সালে এটি ২৩%, ১৯৭৪ সালে ১৪%, ১৯৯১ সালে ১১%, ২০০১ সালে ১০% এবং ২০১১ সালে ৯.৩% ছিল। বৈষম্য ও হয়রানির ধারা অব্যাহত থাকার দরুণ, প্রচুর সংখ্যক বাঙালি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভারতে পালিয়ে আসেন।
আর ঠিক এইভাবেই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনগুলি ভারতের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখানে একটি জাতীয় সুরক্ষা বলয় রয়েছে এবং আরেকটি প্রধান কারণ হ’ল যে, ১৮-১৯ শতকে বহু মহান নেতা এই বাংলার মাটিতে জন্মগ্ৰহন করেছিলেন, যাঁদের চিন্তাভাবনা আজও সমগ্র ভারত তথা ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত এবং পথ নির্দেশন করে চলেছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বর্তমানে সেধরনের নেতা এবং নেতৃত্বের জন্ম আর হয়নি।
সঞ্জীব নায়ার