বাংলার সমাজে ভদ্রতাবোধ, শালীনতা দেশের মধ্যে গর্ব করার মতন। তাই নবান্ন থেকে করোনা মোকাবিলার বৈঠক সংবাদ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার পরে সোশ্যাল মিডিয়াতে সে সব কথা উঠে এসেছে সেগুলো বাংলার সংস্কৃতিতে মেনে নেওয়া য়ায় না। এর মধ্যে সবথেকে বেশি পোস্ট হওয়া বাক্যটি হল “কোভিড -১৯ নিয়ে নবান্নের মিটিং এর বদলে ভেলোর মিটিং চ্যানেল সরাসরি দেখালে অনেক গরিব মানুষ বেঁচে যেতন।” অনেক মানুষকে আত্মহত্যা করতে হত না। এই ধরনের কথা আজ এই বিপদের সময়ে বলা, কোন রাজনৈতিক দলের দুর্বলতম জায়গায় আঘাত দেওয়া বাংলার রুচিতে বাধে। কিন্তু একইসঙ্গে করোনা মোকাবিলাতে যে রাজনৈতিক নোংরামি হচ্ছে সেটাও ভয়াবহ। নবান্নের বৈঠক সরাসরি সম্প্রচারের কী প্রয়োজন ছিল? কোন ব্যক্তি, কোন নেত্রীর গলার স্বর সারা রাজ্যবাসীকে শোনানোর জন্য? সাধারণ মানুষকে নির্দেশ দেওয়া, সাবধানতার বার্তা দেওয়া বা চিকিৎসা সংক্রান্ত পরামর্শ দেওয়া কেবল এই বিপদের সময় প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে হতে পারে। বাকি সবটাই রাজনৈতিক স্বার্থ আর ব্যবসায়িক ধান্দা চরিতার্থ করতে।
এই ভয়ঙ্কর সময়ে যে সব ডাক্তার বাবু ও স্বাস্থ্য কর্মী করোনা মোকাবিলাতে লড়াই করছেন, এ রাজ্যে তারা পারসোনাল প্রটেকশন ইক্যুপমেন্ট (পি.পি.ই) পাচ্ছেন না। এটা শুরু থেকেই ডাক্তারবাবুরা বলছেন। কিন্তু যাঁদের বন্ধ ঘরে বসে, দিন রাত এক করে, যত্নসহকারে এইসব জোগাড় করার রাজধর্ম পালন করার কথা তাঁরা নির্বাচনের সময়ের মতো রোড শো করে বেরিয়েছেন। এক একটা বাজারে গেছেন সঙ্গে একশো জন ভক্ত সমর্থক আরও পঞ্চাশ জন মিডিয়ার কর্মী। ১৪৪ জনের দল নিয়ে দাপিয়ে বেড়িয়েছেন, যাঁদের বসে ঠান্ডা মাথায় রাজধর্ম পালন করার প্রয়োজন ছিল তাই স্বাভাবিক ভাবেই বিশেষ অ্যাপ্রনের বদলে সরবরাহ হয়েছে “রেনকোট”। কুর্নিশ করতে হয় সেই ডাক্তারবাবুকে যিনি কোন ভয় না করে বৈঠকে রেনকোটের কথা বলেছেন। কিন্তু যেসব সাধারণ মানুষ এই সরাসরি সম্প্রচার শুনছিলেন, তাঁরা তো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেলেন । ডাক্তারবাবু, নার্স বা অন্য কর্মীদের পিপিই এখনো পর্যন্ত দিতে পারেননি রাজ্য সরকার! তবে কীভাবে চিকিৎসা চলছে?
ঠিক এই কথাটাই সোশ্যাল মিডিয়াতে বলে রোগের শিকার হয়েছেন ওয়েস্ট বেঙ্গল হেলথ সার্ভিসের (West Bengal Health Service) ডাক্তারবাবু ইন্দ্রনীল খান (Indranil Khan)। ঠিক যে কথাটি নবান্নের বৈঠকে আলোচনা হয়েছে সেটি তুলে ধরে ছিলেন ডঃ খান যথাযোগ্য অ্যাপ্রনের বদলে রেনকোট দেওয়ার কথা। সেই অপরাধে গত ২৯ মার্চ মহেশতলা থানা তাঁকে ডেকে পাঠায়। তাঁর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৫০৫, ৫০৬ ও ১৪৩এ ধারায় এফআইআর করা হয়েছে। সেই পুরাতন পদ্ধতিতে সত্যি কথা ঢাকার চেষ্টা।
‘দ্য হিন্দু পত্রিকায় পশ্চিমবঙ্গের এই দিশেহারা ছবিটি উঠে এসেছে। পশ্চিমবঙ্গে গত ২২ মার্চ পর্যন্ত প্রতি এক লক্ষ মানুষে কেবল ০.১৩ জন মানুষের করোনা পরীক্ষা হয়েছে। সেখানে মহারাষ্ট্রে ১.৬২ জন, কেরলাতে ১২.১ জন, তেলেঙ্গানায় ১.২৮ জন, হরিয়ানাতে ১.১২ জনকে কোভিড-১৯ পরীক্ষা সম্ভব হয়েছে। তার মানে কেরলে পশ্চিমবঙ্গের থেকে প্রায় ১০০ গুণ (৯৩.০৭) বেশী মানুষ পরীক্ষার আওতায় এসেছে। দেশের সবচেয়ে নিচে স্থান পশ্চিমবঙ্গের। (Data kerala leads states in testing for corona virus Maharashtra in infections, The Hindu, March 24,2020)। এ রাজ্যে যাঁর কাজ করার কথা তিনি টিভিতে মুখ দেখাতে ব্যস্ত ছিলেন।
উত্তরবঙ্গের (North Bengal) কালিম্পং (Kalimpong) শহরে যে ভদ্রমহিলা করোনা আক্রন্ত হয়ে প্রাণ হারালেন, তাঁর পরিবারের অভিজ্ঞতা আরও ভয়াবহ। গত শনিবার ২৪ মার্চ তারিখে, নর্থ বেঙ্গল মেডিকেল কলেজে চুয়াল্লিশ বছরের ওই ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়েছে। সেই ভদ্রমহিলা শিলিগুড়িতে যে বাড়িতে তাঁর মেয়েকে নিয়ে উঠেছিলেন, সেই বাড়ির এক সদস্যা সৃষ্টি সিতরিয়া সিং। সম্পর্কে মৃতার বোনের মেয়ে। এই ভদ্রমহিলার একটি ভিডিও বার্তা উত্তরবঙ্গের মানুষকে কুঁকড়ে দিয়েছে। এ রাজ্যে ‘দুধ দেওয়া গরু‘ লাথি মারলেও সেবা পায়। উত্তরবঙ্গে বোধ হয় এখন আর সেভাবে দুধ দিচ্ছে না। তাই করোনা (Corona) মোকাবিলার প্রায় কোন ব্যবস্থাই উত্তরবঙ্গে করা হয়নি। একান্ত বাধ্য হয়ে দার্জিলিং লোকসভার সাংসদ রাজু বিস্ত রাজ্যের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ড. হর্ষবর্ধনকে (Dr. Harshvardhan) উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা মোকাবিলার অপ্রতুল ব্যবস্থার কথা জানিয়েছেন। প্রশ্ন হল রাজ্যটা তো একটাই। সারাদিন টেলিভিশনে ব্যস্ত না থেকে রাজ্যের মন্ত্রীদের এক একটি বিষয় বাংলার প্রতিটি জেলাতে পাঠানো ব্যবস্থা করা উচিত। এই সমদর্শিতাই বাংলার গর্ব ছিল। আজ যা চলছে সেটা বাংলার লজ্জা।
বাংলার আর এক নতুন লজ্জা আত্মপ্রচারলোভী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। করোনা (Corona) প্রকোপের এই ভয়াবহ সময়ে প্রয়োজনীয় সরকারী বিজ্ঞাপনে কি কারো অনুপ্রেরণা লাগে? কোন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখ এই ভয়াবহ সময়েও রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের মতো দেখতে হবে? এই কদর্যতাই কি বাংলার গর্ব ? পক্ষান্তরে মহারাষ্ট্রে, কর্ণাটকে বা দিল্লিতে ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের সরকার আছে। একবার মুম্বাই, বেঙ্গালুরু বা দিল্লির আত্মীয় বন্ধুদের ফোন করে খোঁজ নিন তো, করোনা সতর্কতামূলক কোন বিজ্ঞাপনে কোন নেতা বা নেত্রীর ছবি আছে কিনা? সত্যি সত্যি বাংলা ভারতবর্ষের সামনে গর্বের বিষয় ছিল। আজ মাথা হেঁট হয়ে যায়। এই আত্মপ্রচার বাংলার লজ্জা!
বাংলার গর্ব ছিলেন ‘হিন্দু পেট্রিয়টে‘র হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (Harishchandra Mukhopadhyay)। নিজের জীবন দিয়েও নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন। আজ এই চাটুকার সংবাদ মাধ্যমের ক্ষমতা নেই যে বলার, “আমরা জন সচেতনতার বিজ্ঞাপন দেখাব, কিন্তু কারো ছবি দেখিয়ে রাজনৈতিক প্রচার করব না।” এই বিজ্ঞাপনের টাকা তো সাধারণ মানুষের, কেউ তো হরিশ মুখার্জী রোডের রাজপ্রসাদ বিক্রি করে বা বিদেশ থেকে আনা সোনা ভাঙ্গিয়ে এই টাকা দিচ্ছেন না। এঁরা বাংলার লজ্জা।
আরেকটি নির্লজ্জ ঘটনা দেখা যাচ্ছে ত্রাণ বিলি করার বিষয়ে। এক একজন শাসক দলের নেতা চাল ডাল দিচ্ছেন আর এগিয়ে থাকা সংবাদমাধ্যম মোচ্ছবের মতো করে তা প্রচার করেছে। বিধানগর করোনা রেশনের মাননীয় মেয়র যিনি ছিলেন এখন আর তিনি কিছু গরীব মানুষকে ত্রাণ বিলি করেছিলেন স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে। অভিযোগ পুলিশ ফোন করে তাঁকে হুমকি দিয়েছে। প্রাক্তন মেয়র সংবাদ মাধ্যমেকে তা বিস্তারিত ভাবে বলেছেন।
সেই ট্র্যাডিশন সামনে চলছে। পঞ্চায়েত ভোটের থেকে করোনার ত্রাণ বিল করা পর্যন্ত। কেবল একটি মাত্র দলের সব আইন ভঙ্গ করার অধিকার থাকবে। ঐ তো বড় বড় কথা বলা প্রচার মাধ্যম, গান্ধীজীর তিনটি বাঁদরের মতো ভূমিকা পালন করেছে। করোর সাহস নেই এই প্রশ্নগুলি তুলে ধরার। পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় যে রাজনৈতিক স্বার্থপরতা দেখা দিয়েছিল, যে মধ্যযুগীয় বর্বরতা পরিলক্ষিত হয়েছিল, গার্ডেনরিচে করোনার (Corona) ভয়াবহতার মধ্যে ত্রাণ বিলির সময় একই দৃশ্য দেখা গেল। এটা বাংলার গর্ব নয়, বাংলার লজ্জা!
সত্যান্বেষী