২০১২ সালে শি জিংপিং চীনের কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি তথা রাষ্ট্রপতির ভার নেবার পর ( প্রসঙ্গতঃ পাঠকেরা নিশ্চয়ই সকলে জানেন যে চীনের জনগণের নিজস্ব মতামত অর্থাৎ ভোটদানের মাধ্যমে কাউকে নির্বাচিত করার সৌভাগ্য নেই ) শি জিংপিং দেশের জনগণের সামনে “চাইনিজ ড্রিম” এক নতুন স্বপ্ন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন। “কিয়াং ঝংগুও মেং” অর্থাৎ পরাক্রমী এক দেশ। আসলে এর আড়ালে তিনি নিজের এক ইচ্ছাকে দেশের জনগণের ইচ্ছে হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন – সমগ্র বিশ্বকে সামরিক বা অর্থনৈতিক জোর দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা যার মুকুটহীন সম্রাট তিনি নিজে। কমিউনিস্ট ভাবধারায় সুড়সুড়ি দিয়ে মাও জে দং এর কমিউনিস্ট একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার শতবার্ষিকী অর্থাৎ ২০৪৯ সালের মধ্যে আমেরিকাকে সরিয়ে অবিসংবাদিত শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মোহে তিনি প্রায় উন্মাদ মস্তিস্ক হয়ে গেছেন। নাহলে সমগ্র বিশ্বের গণতান্ত্রিক শক্তিকে একসাথে প্রতিদ্বতায় আহবান করার মতন মূর্খামি কেই বা আবার দেখাতে পারে! বস্তুত অধুনা যুগের অন্যতম কুখ্যাত এক স্বৈরশাসক – মাও এর ছায়াই আবার প্রতিফলিত হচ্ছে শি জিংপিং এর মধ্যে দিয়ে। বলা ভালো এবারের স্বৈরতান্ত্রিক করাল ছায়া সমগ্র বিশ্বকে এক ধ্বংসাত্মক বিপদের দিকে ঠেলে নিয়ে চলেছে যার মূল কান্ডারি হলেন শি জিংপিং এর মতো ঠান্ডা মাথার এক নিষ্ঠূর ক্ষমতালোভী ভদ্র মুখোশধারী এক উন্মাদ যিনি আজও মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যবাদ তথা বিস্তারবাদ নীতিতে প্রবলভাবে বিশ্বাসী।
অবশ্য এই প্রসঙ্গে কৈশোরে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপরে অত্যাচারের অভিজ্ঞতা উল্লেখযোগ্য। শি জিংপিং এর বাবা ছিলেন মাও জে দং এর অত্যন্ত আস্থাভাজন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির এক বরিষ্ঠ নেতৃত্ব স্থানীয় ব্যক্তি। শৈশবে তাই শি এলিট কমিউনিস্টদের জন্য সংরক্ষিত বিখ্যাত স্কুলে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু দশ বছর বয়সে তার বাবার সাথে মাও জে দং এর মতবিরোধের জেরে তাঁর বাবাকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে শ্রমিক হিসেবে কঠোর পরিশ্রমের সাজা দেওয়া হয়। শি নিজেও বেজিং থেকে নির্বাসিত হন। তাঁদের বাড়ি ভাংচুর করাহয় এবং তাঁর এক বোন তো আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পড়াশোনা শেষ করার পর ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে অবশেষে দশম বারের চেষ্টায় ১৯৭৪ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন এবং ক্রমান্বয়ে চীনের ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হন। তাঁর বাবার উদারমনস্কতার জন্য তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে যে কমিউনিস্ট পার্টির এতো অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল সেই দলেরই শীর্ষকর্তা হয়ে তিনি নিজের দেশের সাধারণ জনগণ তথা সমগ্র বিশ্বের ওপরে এক স্বৈরাচারী দমন নীতির বর্ষণ আরম্ভ করলেন। তাঁর পরিবারের ওপরে অত্যাচার তাঁকে করে তুলেছে আরো ক্ষমতালোভী এবং সংশয়ী। তাঁর কাছে সুরক্ষা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হলো সবকিছুর ওপরে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা। ক্ষমতা হাতছাড়া হবার আতঙ্কে আরো ক্ষমতা দখলের নেশা তাঁর নিজের দেশের সাথে সাথে সারা বিশ্বকে সঙ্কটজনক দিশায় নিয়ে চলেছে।
ক্ষমতার আসার সাথে সাথেই তিনি প্রথম যে কাজটি করেছিলেন তা ছিল ২০১৩ সালে ডকুমেন্ট ৯ নাম এক আদেশনামা বের করা যার মাধ্যমে সমস্ত গণতান্ত্রিক, উদার বা পশ্চিমি মনোভাবা সম্পন্ন ব্যক্তিদের হুঁশিয়ারি দেওয়া যাতে তাঁরা তথাকথিত চৈনিক সভ্যতা সংস্কৃতি বিরোধী চিন্তাভাবনা থেকে দূরে থাকেন। খুব শীঘ্র এই সমস্ত ব্যক্তিদের নাম পার্টির ওয়েবসাইটে রাষ্ট্রশত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং তাদের পেছনে নিষ্ঠুর রাষ্ট্রশক্তিকে লেলিয়ে দেওয়া হয়। তখন থেকেই বোঝা গিয়েছিলো যে দেশটিতে মাও -এর সময়ের কুখ্যাত দিনগুলো আবার ফিরে আসছে।
এরপর চীনের সামরিক ক্ষেত্রে শি প্রভূত সংস্কার শুরু করেন। নিজেই বিভিন্ন শান্তিপ্রিয় দেশকে কাল্পনিক শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে এক কৃত্রিম বিপদ দেশের সামনে তুলে ধরলেন দেশের জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত জাতীয়তাবাদকে জাগ্রত করতে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে সামরিক দিক থেকে বিশেষ করে চীনের নৌবাহিনীকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনার রূপরেখা প্রকাশ করেন। দক্ষিণ চীন সাগরের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা এই প্রক্রিয়ারই একটি অঙ্গ মাত্র।
বাবার অভিজ্ঞতা থেকে তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে তাঁর নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে শক্ত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে গেলে সবার আগে দরকার পিপলস লিবারেশন আর্মি তথা চীনের সেনাবাহিনীর উপর তাঁর শক্ত কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তিনি জিনজিয়াং এবং তিব্বতি সামরিক কমান্ডকে একত্রিভূত করে ২০১৬ সালে ওয়েস্টার্ন থিয়েটার নামক এক ছাতার তলায় নিয়ে আসেন যাতে পিএলএ এর ওপরে তাঁর নিয়ন্ত্রণ আরো দৃঢ় হয়। এই কাজে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য মাথা হিসেবে তিনি বাছাই করেছিলেন তিব্বতের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঝাও জংকি নামের এক উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং বিশ্বস্ত জেনারেলকে । গুরুত্বপূর্ণ এই ওয়েস্টার্ন থিয়েটারে তাঁর বিশ্বস্ত ও আজ্ঞাবহ জেনারেল ঝাওকে বসিয়ে তিনি পিপলস রিপাবলিক আর্মিতে তাঁর দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করেছিলেন। ভারত-চীন সীমানার দায়িত্বে রয়েছে এই ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ডই। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো এই জেনারেল ঝাও ই ২০১৭ সালের ডোকলান কাণ্ডের সময় ভারতের বিপক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন।
ধীরে ধীরে দেশের সমস্ত ক্ষমতা তিনি কেন্দ্রীভূত করে নিজের একধ্যিপত্য প্রতিষ্ঠিত মনোনিবেশ করেন । দেশবাসীর সামনে তিনি নিজেকে তুলে ধরেন এক অবিসংবাদিত নেতা যিনি দুর্নীতিকে সমূলে বিনষ্ট করে চীনের অতীত গৌরব ফিরিয়ে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে চান। এই অছিলায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত বরিষ্ঠ নেতৃত্ব যারা ভবিষ্যতে ক্ষমতার লড়াই এ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে তাদের সকলকে বিভিন্ন দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে তাঁর পথ থেকে সরিয়ে দেন। দেশের সংবিধানে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভানাকেও অন্তর্ভুক্ত করে ফেলেন। এখানেই থেমে না থেকে ২০১৮ সালের পলিটব্যুরো সমাবেশে রাষ্ট্রপতি থাকার আট বছরের যে সর্বোচ্চ সীমা ছিল তাকে অবলুপ্ত করে আজীবন রাষ্ট্রপতি থাকার সংশোধনী পাশ করিয়ে নেন। সবই চলছিল তাঁর মর্জি মতোই। তাল কাটলো ২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে গিয়ে গিয়ে যখন মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনের সাথে সরাসরি বাণিজ্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন।
বিভিন্ন ভুল নীতি বিশেষত শি’র মস্তিষ্ক প্রসূত “বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ” এর মত ব্যয়বহুল ও ব্যর্থ প্রজেক্টে বিশাল বিনিয়োগ, শ্রমিক অসন্তোষকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা, এক সন্তানের নীতির ব্যর্থ প্রণয়নের ফলে দেশের গড় কর্মক্ষমতা হ্রাস পাওয়া,সর্বোপরি বিকল্প উৎপাদন করি দেশ হিসেবে ভারত, ভিয়েতনাম ইত্যাদি দেশের উঠে আসা ইত্যাদির প্রভাবে চীনের অর্থনীতি ইতিমধ্যেই ঝিমিয়ে পড়েছিল। এর সাথে আমেরিকার সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ সরাসরি চীনের অর্থনীতিকে আঘাত করে বসলো। তারপরের আঘাত এলো কোভিড ১৯ করোনা ভাইরাস যাতে চীন সরকারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত সন্দেহজনক। সারা বিশ্ব চীনকে সন্দেহের চোখে দেখা আরম্ভ করলো। যত চীনের প্রতি লোকের অবিশ্বাস বাড়তে লাগলো তত শি’র নেতৃত্বাধীন চীনের কমিউনিস্ট সরকার আরো গোপনীয়তা অবলম্বন করতে আরম্ভ করে যা যথেষ্ট ইঙ্গিতপূর্ণ ।
২০২০ সালের গোড়ার দিকে, তাইওয়ানে স্বাধীনতাপন্থী ডেমোক্র্যাটিক প্রগ্রেসিভ পার্টি (ডিপিপি) এবং হংকংয়ে গণতন্ত্র রক্ষার বিক্ষোভ চীনকে বেশ বেগ দিতে শুরু করে। এ ছাড়া করোনভাইরাস সঙ্কট সামাল দিতে শি ‘র অক্ষমতা নিয়ে দলের মধ্যে আওয়াজ উঠে যায়। শি ‘র জন্য পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল হয়ে ওঠে যে প্রবীণ ক্যাডাররা শি’র পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা করতে পলিটব্যুরোর একটি জরুরি সভা এক জরুরি সভা পর্যন্ত ডেকে ফেলেছিলেন । ক্ষমতা ধরে রাখতে মরিয়া শি তখন ইং পাইস নামক তার অনুগত সামরিক-রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে এই সমস্ত নেতাদের ওপরে হিংস্র ভাবে লেলিয়ে দিয়েছিলেন এবং অচিরেই সমস্ত বিরোধী আওয়াজকে দমিয়ে দিতে আংশিক ভাবে সক্ষম হন।
কিন্তু পার্টি, ক্রমবর্ধমান বিরোধীদের তথা দেশের জনগণের মনোযোগ ঘোরাতে এবং ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করার জন্য তাঁর একটিই মাত্র অস্ত্র বাকি ছিল – দেশে জাতীয়তাবাদের উত্থান । তাঁর পরিকল্পনার একটি অঙ্গ বাস্তবায়নের জন্য শি’র অনুগত জেনারেল ঝাও ফিরে এসেছিলেন ভারত চীন সীমান্তে । মে মাসে পাঙ্গং তসো এবং সিকিমের ভারতীয় ও চীনা সেনাদের মধ্যে সংঘর্ষের পরে গ্যালওয়ানে ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সিকিম ও লাদাখ উভয়ই পশ্চিমা থিয়েটার কমান্ডারের অধীন এবং পিএলএর আগ্রাসন পর্যালোচনা করলেই জেনারেল ঝাওয়ের ভূমিকা স্পষ্ট বোঝা যায় এবং এর পেছনে যে শি’র অনুমোদন আছে তা আর বলে দেবার অপেক্ষা রাখেনা । ভারতের প্রতি ঝাঁকুনি দেওয়া অভ্যন্তরীণ কোন্দল থেকে বেরিয়ে আসার জন্য শি’র মরিয়া প্রচেষ্টা হতে পারে, তবে ফলাফল তাঁর জন্য প্রায় আত্মঘাতী হওয়ার সামিল।
চীন সীমান্তে অবস্থিত লাদাখে ভারতীয় পোস্ট দৌলত বেগ ওল্ডী কে ভারতের মূল লাইন থেকে কেটে ফেলার জন্য ঝাও তথা পিএলএ এই আগ্রাসন দেখিয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় সেনার ওপরে অতর্কিতে নৃশংস বর্বরোচিত আঘাত করে মনোবল ভেঙে দেওয়া ও ভারতকে চাপ নিয়ে নত করানো। একই সাথে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের গিলগিট বাল্টিস্থান নিয়ে ভারতের প্রতিবাদকে দমিয়ে রাখা। এতে মাঝখান থেকে চীন-ভারতের সীমান্তে দু পক্ষই এখন সামরিক ভাবে যুদ্ধংদেহী হয়ে পড়েছে যা সহজে শান্ত হবার নয় এবং চীনের নিজের জন্যও যথেষ্ট মাথাব্যথার। কারণ চীনের সীমান্ত বিবাদ প্রায় সকল প্রতিবেশী দেশের সাথেই।
চীন সম্ভবত ভুলে গিয়েছিল যে ১৯৬২ সালের মতন অপ্রস্তুত ভারতীয় সেনাবাহিনী বা দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্ব দুটোর কোনোটাই অধুনা ভারতবর্ষে দুর্লভ। এই ভারত চোখে চোখ রেখে জবাব দিতে জানে এবং চীনকে বিদ্রোহ হয়ে যাওয়ার ভয়ে নিহত সেনার সংখ্যাও গোপন করতে হয়। খালি হাতে ভারতীয় সেনার মার খেয়ে মার্শাল আর্ট ডিরেক্টর দের নিয়োগ করতে হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর হুমকিতে চীনা সেনা সংঘর্ষ স্থল থেকে ১.৫ কিলোমিটার দূরে পিছিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
শি’র দৃষ্টিভঙ্গির অবিমৃষ্যকারীতা একজন আধুনিক নেতার পক্ষে সত্যিই অত্যন্ত আশ্চর্যজনক। ১৯৬৯ সালে যখন চীনে অভ্যন্তরীণ কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আর অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে বৈরিতা তুঙ্গে, মাও আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিকসনের সাথে বন্ধুত্ব করে নিয়েয়েছিলেন। আর এখন চীন যখন ২০২০ সালে যখন ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি , তখন একটি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা শি চীনের বিভিন্ন প্রতিবেশীর সাথে সাথে বৃহত্তর সামরিক দিক থেকে যথেষ্ট শক্তিধর অথচ শান্তিপ্রিয় ভারতের সাথেও সংঘর্ষের পরিস্থিতি তৈরি করাকেই বেছে নিয়েছেন। তার জেনারেলরা এতে উপকৃত হতে পারে, তবে শি’র সুনিশ্চিত ভাবে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হয়ে যাবে।
প্রথমত, তিনি ২৪ বছর ধরে ধীরে ধীরে সাবধানতার সাথে গড়ে তোলা শান্তি চুক্তিকে তিনি ভঙ্গ করে ফেললেন যা ভারতীয়রা পেছন থেকে ছুরি মারা হিসেবেই দেখছে এবং আর সহজে এই সম্পর্কের মেরামতি অসম্ভব, অন্তত শি’র শাসনকালে। দ্বিতীয়ত, ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখলে তিনি সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি সম্ভাব্য মিত্রকে সরাসরি চীনের বিরুদ্ধচারণ করা থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারতেন এবং একইসাথে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধে ভারতের মতো একটি বিশাল বাজার তাঁর দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা হলেও অক্সিজেন যোগাতে পারতো । তিনি উভয় ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। এই অ্যাডভেঞ্চারিজমের পরিণতিতে চীনের কি জুটলো ?
এক ক্রুদ্ধ ভারত, যার এতদিন ধরে ভারসাম্যের নীতিতে বিশ্বাসী নীতি ত্যাগ করে আপন সুরক্ষা সুনিশ্চিত করতে স্বেচ্ছায় এবারে চীনের মতন সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একত্রিভূত জোটে যোগ দিতে ইচ্ছুক না হওয়ার আর কোনো কারণ রইলনা, এমন একটি ভারতীয় বাজার যা এখন আর চীনা দ্রব্যের জন্য স্বাগত নয় এবং ১৯৯৬ এবং ২০০৫ এলওএসি বরাবর স্থানীয়ভাবে সংঘর্ষে ‘অস্ত্রের ব্যবহার নয়’ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বেরিয়ে আসা যার কোনও টাই এই মুহূর্তে শি’র জন্য স্বস্তিদায়ক নয়।
প্রথমে করোনা মোকাবিলার জন্য একঘরে হওয়া, তারপর এই ইস্যুতে ইংল্যান্ড , ফ্রান্স, জানির সাথে সম্পর্কের অবনতি, অস্ট্রেলিয়ার সাথে তিক্ততা, হংকং ইস্যুতেও আমেরিকা ও কানাডার সাথে বৈরিতা,তাইওয়ান দখলের জন্য পেশী প্রদর্শন, আমেরিকার সাথে বাণিজ্য শুল্ক যুদ্ধ, দক্ষিণ চীন সাগরে আধিপত্য দেখতে গিয়ে জাপান, ভিয়েতনাম, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ইন্দোনেশিয়ার সাথে মতবিরোধ এগুলোর সাথে যুগপৎ ভারতের সাথে সীমানায় সংঘর্ষে জড়িয়ে শি নিজেই কোয়াডপ্লাস এবং ডি১০ এর মতো মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের উত্থান ত্বরান্বিত করে ফেলেছে। ক্ষমতা দখলে রাখতে গিয়ে শি নিজেই এমন এক চক্রবুহ্যে প্রবেশ করে গেছেন যেখান থেকে বেরোবার ক্ষমতা তাঁর আছে কিনা সন্দেহ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে চীনকে যে ধাক্কা দিতে চেয়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি শি জিংপিং নিজেই দায়িত্ব নিয়ে ঘটিয়েছেন। আজ চীন সারা বিশ্বে একঘরে। স্বৈরাতান্ত্রিক কমিউনিস্ট শাসনের প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষের উত্থানে চীন আজ প্রচন্ড শঙ্কিত। ভারতের পেছনে লেলিয়ে দিতে গিয়ে যে পরিমান অর্থনৈতিক অনুদান পাকিস্তানের পেছনে চীন ঢেলেছে তাতে তাঁর দেশের অর্থনীতির ওপরে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। গালওয়ান উপত্যকায় আগ্রাসন দেখতে গিয়ে যে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে তাতে আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া সহ তাবড় বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র সমূহ আজ খোলাখুলি যুদ্ধ হলে ভারতের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করছে। এদিকে সংকুচিত অর্থিনীতির প্রভাবে দেশের জনগণ সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন। ক্ষমতা দখলে রাখতে গিয়ে অবিবেচকের মতো নেওয়া হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে যে “চাইনিজ ড্রিম” তিনি দেশবাসীকে দেখিয়েছিলেন তা আজ তাসের ঘরের মতন ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়।