” স্বামীজী ! আপনি এত হাসেন কেন ? আপনি না আধ‍্যাত্মিক মানুষ ? “

” আরে আধ‍্যাত্মিক বলেই তো হাসি ! আমরা তো আর পাপী নই – আমরা আনন্দের অমৃতের সন্তান। …. তুমি যে ধার্মিক হচ্ছ , তার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে, তুমি হাসিখুশি হতে থাকবে। যদি কেউ গোমড়া মুখে থাকে — তবে তা বদহজমের জন‍্যে হতে পারে, কিন্তু তা ধর্ম নয়।”

স্বামীজীর গুরু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ” আমায় শুঁটকো সাধু করিসনি মা, আমায় রসে বশে রাখিস।”

এমন রসে বশে থাকা গুরুজির হাতে গড়া চ‍্যালাও ছিলেন হাসি তামাশার মানুষ।

” Lecture ফেকচার (বক্তৃতা ) তো কিছু লিখে দিই না, একটা লিখে দিয়েছিলুম, যা ছাপিয়েছ। বাকিসব দাঁড়ঝাপ, যা মুখে আসে গুরুদেব জুটিয়ে দেন। কাগজপত্রের সঙ্গে কোন সম্বন্ধই নাই। একবার ডেট্রয়েটে তিন ঘন্টা ঝাড়া বুলি ঝেড়েছিলুম। আমি নিজে অবাক হয়ে যাই সময়ে সময়ে ; ‘মধো, তোর পেটে পেটে এতও ছিল !!” ( স্বামীজী লিখছেন ; ১৩৯৬, উদ্বোধন কার্যালয় )

এই হাসিখুশি মানুষটি জীবনের শেষ চার বছর বাংলা ভাষার সার্থক লেখক হিসাবে প্রবলভাবে আত্মপ্রকাশ করছিলেন।

শঙ্করীপ্রসাদ বসু বলেছেন “স্বামীজী বাংলাসাহিত্যের জন্য কতখানি করে গেছেন, তার বিষয়ে সচেতনতা সবে দেখা যাচ্ছে। সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি কিছুদিন আগেও পদাতিকদের দলভুক্ত হয়ে কেবল নামোল্লেখের মহাগৌরব পাচ্ছিলেন!! কিন্তু এখন বড় জাতের সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা বলতে শুরু করেছেন —- না, আর পাঁচজনের মতো তিনি কিছু ধর্মসাহিত্য লিখেছেন, এটাই সব কথা নয় ( বস্তুতঃ সাধারণভাবে ধর্মসাহিত্য বলতে যা বোঝা যায়, বিবেকানন্দ বাংলায় তা প্রায় লেখেননি), বাংলা চলিত গদ্যের যে রীতি-নমুনা তিনি মাত্র কয়েক শো পৃষ্ঠা মধ্যে রেখে গেছেন, তাই হল বাংলাসাহিত্যে চলিত রীতির প্রথম আদর্শ রূপ। সাধুরীতির গদ্যও তিনি লিখেছেন —- সেখানেও তাঁর রচনার গুরুত্ব অল্প নয়। …..”

স্বামী বিবেকানন্দ সাহিত্যজগতের মানুষ নন। কিন্তু বক্তৃতা, চিঠিপত্র এবং সমসাময়িক মানুষদের স্মৃতিচারণাকে কেন্দ্র করে স্বামীজি সংক্রান্ত বইপত্রের জগত গড়ে উঠেছে। ১৮৯৬ সালে মাদ্রাজে ব্রহ্মবাদীন পত্রিকার সম্পাদক ও সহযোগী আলাসিঙ্গাকে এক পত্রে লিখছেন, ” সাঙ্কেতিক প্রণালীতে আমার বক্তৃতাগুলি লিখে নেবার ফলে অনেকটা সাহিত্য গড়ে উঠছে দেখে আমি খুশি।”

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তভাগে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, ” বাংলা ভাষাটাকে নূতন ছাঁচে গড়ার চেষ্টা করব।”
ভাষা নিয়ে তাঁর সুচিন্তিত মতামত ও পরিকল্পনা ছিল। সেই পরিকল্পনা অনুসরণ করেই তিনি কলম ধরেছিলেন।

চিঠিপত্র বাদ দিলে স্বামীজীর মৌলিক রচনা তিনটি। বর্তমান ভারত,পরিব্রাজক, প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত‍্য। তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত ভাববার কথা মূলতঃ রচনাসঙ্কলন। লেখাগুলি উদ্বোধন পত্রিকায় ১৮৯৯ থেকে ১৯০২ এর মধ‍্যে প্রকাশিত হয়েছিল।

অনেকেই মনে করেন “ভারতে বিবেকানন্দ”, “কর্মযোগ” , “ভক্তিযোগ” প্রভৃতি গ্রন্থ স্বামীজী বাংলাতেই লিখেছেন। তা কিন্তু নয়। এ বইগুলি স্বামী শুদ্ধানন্দ অনুবাদ করেছিলেন।
স্বামীজীর মূল বাংলা রচনার পরিমাণ — এ পর্যন্ত যা পাওয়া গিয়েছে, পত্রাবলীসুদ্ধ — ডিমাই সাইজের স্মল পাইকার ছাপলে শ-ছয়েক পৃষ্ঠার বেশি হবে না। এই হিসেবের মধ্যে বাণী ও রচনার অন্তর্ভুক্ত হয় নি এমন দুটি লেখাকে ধরেই নিচ্ছি — হারবার্ট স্পেনসারের ‘এডুকেশন’ গ্রন্থের অনুবাদ এবং ‘সঙ্গীত কল্পতরু’ গ্রন্থের ভূমিকা।

স্বামীজী বলতেন যেমন লিখতেনও ঠিক তেমন করেই।

তাঁর বাক‍্যগুলি ছিল সরস, প্রাণস্পন্দিত, গতিশীল, ওজস্বী , আধুনিক এবং হৃদয় থেকে উঠে আসা অভিব‍্যক্তি !!!

“সরলতাই রহস্য। আমার গুরুদেবের কথ‍্য অথচ গভীর ভাব- প্রকাশক ভাষাই আমার আদর্শ। যে ভাব প্রকাশের অভিপ্রায় থাকে, সেই ভাবই প্রকাশ
করবে।” ( চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ ; সম্পাদনা ; স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, আশ্বিন ১৩৯৭, রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার, পৃঃ ১১ )

“আমার মনে হয়,সকল জিনিসের মত ভাষা ও ভাবও কালে একঘেয়ে হয়ে যায়। এখন এদেশে ঐরূপ হয়েছে বলে বোধ হয়। ঠাকুরের আগমনে ভাব ও ভাষায় আবার নূতন স্রোত এসেছে। এখন সব নূতন ছাঁচে গড়তে হবে।” ( স্বামী শিষ‍্য সংবাদ, পৃঃ ৯৩ )

” এরপর বাংলা ভাষায় প্রবন্ধ লিখব মনে করছি। সাহিত‍্যসেবীগণ হয়ত তা দেখে গালমন্দ করবে।
তা করুক, তবু বাংলা ভাষাটাকে নূতন ছাঁচে গড়ার চেষ্টা করব। এখনকার বাংলা লেখকরা লিখতে গেলেই বেশি verbs ( ক্রিয়াপদ ) use করে ; তাতে ভাষায় জোর হয় না। …. এইরূপ করলে মনে হয়, যেন ভাষার দম নেই। সেইজন‍্য বাংলা ভাষায় ভাল লেকচার দেওয়া যায় না। … তোদের ডালভাত খেয়ে খেয়ে শরীর যেমন ভেতো হয়ে গেছে, ভাষাও ঠিক সেইরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আহার চালচলন ভাব ভাষাতে তেজস্বিতা আনতে হবে, সব দিকে প্রাণের বিস্তার করতে হবে — সব ধমনীতে রক্তপ্রবাহ প্রেরণ করতে হবে, যাতে সকল বিষয়েই একটা প্রাণস্পন্দন অনুভূত হয়।” ( স্বামী শিষ‍্য সংবাদ, শরৎচন্দ্র চক্রবর্তী, চৈত্র ১৩৮৯, উদ্বোধন কার্যালয় )

এই Cylonic Hindu Monk বাংলা গদ‍্য গঠনে সঞ্চার করলেন অভূতপূর্ব প্রাণশক্তি।

তাঁর লেখার কায়দা ছিল সমকালীন বাংলা রচনাশৈলী থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। তৎসম তদ্ভব দেশজ শব্দের সহাবস্থান, চলিত জীবনের ইডিয়ম, বাগ্ – বৈশিষ্ট্য, বাক‍্য গঠনের নূতন রীতি, শব্দবিন‍্যাসের রূপান্তর ঘটিয়ে বাংলা ভাষাকে স্বামীজী করে তুলেছিলেন বেগবান, অভিঘাতময়।
বিবেকানন্দের বহুমুখী গদ‍্যরীতি অনেক স্থলে সংলাপধর্মী। পড়তে পড়তে মনে হয় তিনি যেন সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের সাথে কথা বলছেন।

লেখার মধ‍্যে লেখকের এই প্রাণবন্ত উপস্থিতি তাঁর পূর্বে পা পরে ক’ জন লেখকের লেখায় পাওয়া যায় ?

“ভাষা ভাবের বাহক। ভাবই প্রধান। ভাষা পরে। হীরেমতির সাজ পরানো ঘোড়ার ওপর বাঁদর বসালে কি ভাল দেখায় ? …….

কি প‍্যাঁচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস,কি শ্লেষ !! ওসব মড়ার লক্ষণ। যখন দেশটা উৎসন্নে যেতে আরম্ভ করল, তখন এইসব চিহ্ন উদয় হল। …. দুটো চলিত কথায় যে ভাবরাশি আসবে, তা দুহাজার ছাঁদি বিশেষণেও নেই।” ( ভাববার কথা )

রবীন্দ্রনাথও তাঁর সাহিত‍্যিক জীবনের প্রথমদিকে নিজের রচনায় চলিত ভাষার প্রয়োগে কুন্ঠিত ছিলেন।
ফোর্ট উইলিয়ম, উইলিয়ম কেরী, মৃত‍্যুঞ্জয় বিদ‍্যালঙ্কার হয়ে প‍্যারিচাঁদ ও কালীপ্রসন্ন —শেষে বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে পড়ে লিখিত বাংলার প্রভূত উন্নত হলেও সংস্কৃত ঘেঁষা দুরূহ খটমট বিদ‍্যাসাগরী বাংলার দিন তখনও শেষ হয়নি।

“বর্তমান ভারত” সাধুগদ‍্যে রচিত হলেও বিবেকানন্দ দ্বিধাহীনভাবে চলিত ভাষাকেই জাতীয় ভাবপ্রকাশের মাধ‍্যম হিসাবে বেছে নেবার আহ্বান জানিয়েছেন।

” চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ‍্য হয় না ? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তৈয়ার করে কি হবে ? যে ভাষায় ঘরে কথা কও, তাতেই তো সমস্ত পান্ডিত‍্য গবেষণা মনে মনে কর ; তবে লেখবার বেলা ও একটা কি কিম্ভুতকিমাকার উপস্থিত কর ? ……

ভাষাকে করতে হবে যেন সাফ্ ইস্পাৎ, মুচড়ে মুচড়ে যা ইচ্ছে কর, —– আবার যে কে সেই, এক চোটে পাথর কেটে দেয়, দাঁত পড়ে না। আমাদের ভাষা, সংস্কৃতর গদাই- লস্করি চাল — ঐ এক তাল — নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। ভাষা হচ্ছে উন্নতির প্রধান উপায় লক্ষণ।

যদি বল ওকথা বেশ, বাংলাদেশের স্থানে স্থানে রকমারি ভাষা, কোনটি গ্ৰহণ করব ? প্রাকৃতিক নিয়মে যেটি বলবান হচ্ছে এবং ছড়িয়ে পড়ছে, সেইটিই নিতে হবে। অর্থাৎ কলকেতার ভাষা। …. যখন দেখতে পাচ্ছি কলকেতার ভাষাই অল্পদিনে সমস্ত বাঙ্গালা দেশের ভাষা হয়ে যাবে, তখন যদি পুস্তকের ভাষা এবং ঘরে কথা কওয়া ভাষা এক করতে হয়, তো বুদ্ধিমান অবশ‍্যই কলকেতার ভাষাকে ভিত্তিরূপে গ্ৰহণ করবেন।” ( ভাববার কথা; ১৪২১ উদ্বোধন কার্যালয় )

স্বামীজীর সঙ্গে সমুদ্রযাত্রা কালে নিবেদিতা লক্ষ করলেন স্বামীজি “উদ্বোধন” পত্রিকার জন‍্য সমুদ্রযাত্রার বিবরণ লিখতে খুব ব‍্যস্ত।

“স্বামীজীর কাছ থেকেই জেনে গিয়েছিলাম ওই লেখায় ( যা পরবর্তীকালে পরিব্রাজক নামে গ্ৰন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল) তিনি বাংলা ভাষাকে ইচ্ছা করে অভূতপূর্বরূপে ব‍্যবহার করেছেন, যেভাবে বাংলা ভাষা আগে কখনও সাহিত‍্যক্ষেত্রে ব‍্যবহৃত হয়নি। তাতে আছে ব‍্যঙ্গকৌতুক,তীক্ষ্ম বীক্ষণ, ভবিষ‍্যদ্বানী, ইংরেজ ভাবাপন্ন বাঙালি, ব্রাহ্ম প্রমুখ সম্পর্কে ক্রোধ,জনগণের প্রতি ভালবাসা আর আশা, গুরুর ( শ্রীরামকৃষ্ণের ) প্রতি জ্বলন্ত প্রেম, চারিদিকের জনজীবন সম্পর্কে তীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ ও মন্তব্য আর সর্বোপরি ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলা ভাষার এমন ব‍্যবহার যা তখনকার দিনে অমার্জনীয় অপরাধ। স্বামীজী জানতেন তিনি সে ভাষার নবরূপ দিচ্ছেন যা পরবর্তীকালে প্রশংসিত ও অনুকরণীয় হয়ে উঠবে। ( স্বামীজীর সঙ্গে নিবেদিতার সমুদ্রযাত্রা ; নিবোধত ; শ্রী সারদা মঠ, দক্ষিনেশ্বর, জুলাই – আগষ্ট, ২০১৭ )

” প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত‍্য” পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তাঁর মনে হয়েছিল, ” এ গ্ৰন্থ প্রত‍্যেকের কাছেই এক নতুন আবিস্কার।”

…………………………………………………………….

সহাস‍্য পরিহাসপ্রিয় পরিব্রাজকের সাথে চলতে চলতে প্রায়শই আমরা নিখাদ হাস‍্যরসে আপ্লুত হই।

১৯৯৪ সালের ১৯ শে মার্চ শিকাগো থেকে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে একটি চিঠিতে প্রতাপচন্দ্র মজুমদার।সম্পর্কে লিখছেন,

“দাদা আমি দেখেশুনে অবাক। বল্ বাবা, আমি কি তোর অন্নে আঘাত করেছি ? তোর খাতির তো যথেষ্ট এদেশে। তবে আমার মত তোমাদের হল না, তা আমার কি দোষ ?

” আমাকে বেটারা যমের মত দেখে। বলে, কোথা থেকে এ বেটা এল, রাজ‍্যির মেয়ে মদ্দ ওর পিছু পিছু ফেরে — গোঁড়ামির জড় মারবার যোগাড়ে আছে। আগুন ধরে গেছে বাবা ! গুরুর কৃপায় যে আগুন ধরে গেছে, তা নিববার নয় ! কালে গোঁড়াদের দম নিকলে যাবে। কি বাঘ ঘরে ঢুকিয়েছেন, তা বাছাধনরা টের পাচ্ছেন !!”

” ওহে বাপু, যীশুও আসেননি, যিহোবাও আসেননি, আসবেনও না। তাঁরা এখন আপনাদের ঘর সামলাচ্ছেন, আমাদের দেশে আসবার সময় নাই।
এদেশে সেই বুড়ো শিব বসে আছেন, মা কালী পাঁঠা খাচ্ছেন, আর বংশীধারী বাঁশী বাজাচ্ছেন। ঐ বুড়ো শিব ষাঁড় চড়ে ভারতবর্ষ থেকে একদিকে সুমাত্রা, বোর্নিও, সেলিবিস, মায় অষ্ট্রেলিয়া, আমেরিকার কিনারা পর্যন্ত ডমরু বাজিয়ে এককালে বেড়িয়েছেন, আর একদিকে তিব্বত, চীন, জাপান সাইবেরিয়া পর্যন্ত বুড়ো শিব ষাঁড় চরিয়েছেন, এখনও চরাচ্ছেন; ঐ যে মা কালী—উনি চীন, জাপান পর্যন্ত পূজা খাচ্ছেন, ওঁকেই যীশুর-মা মেরী করে ক্রিশ্চানরা পূজা করছে। ঐ যে হিমালয় পাহাড় দেখছ, ওরই উত্তরে কৈলাস, সেথা বুড়ো শিবের প্রধান আড্ডা। ও কৈলাস দশমুণ্ড-কুড়িহাত রাবণ নাড়াতে পারেননি, ও কি এখন পাদ্রী-ফাদ্রীর কর্ম!! ঐ বুড়ো শিব ডমরু বাজাবেন, মা কালী পাঁঠা খাবেন, আর কৃষ্ণ বাঁশী বাজাবেন—এ দেশে চিরকাল। যদি না পছন্দ হয়, সরে পড় না কেন? তোমাদের দু-চারজনের জন্য দেশসুদ্ধ লোককে হাড়-জ্বালাতন হতে হবে বুঝি? চরে খাওগে না কেন? এত বড় দুনিয়াটা পড়ে তো রয়েছে। তা নয়। মুরদ কোথায়? “

পড়তে পড়তে মনে হয় লেখক যেন কোন এক অদৃশ‍্য গোষ্ঠীর সাথে ঝগড়া করছেন।

” ঐ যে ইউরোপী পন্ডিত বলছেন আর্যেরা কোথা হতে উড়ে এসে বুনোদের মেরে কেটে জমি ছিনিয়ে বাস করলেন — ওসব আহাম্মকের কথা। …. আমি মূর্খ মানুষ, যা বুঝি তাই নিয়েই এ পারি সভায় বিশেষ প্রতিবাদ করেছি। … একথা তোমাদেরও বলি — তোমরা পন্ডিত মনিষ‍্যি, পুঁথি পাতড়া খুঁজে দেখ। …. কোন বেদে, কোন সূক্তে , কোথায় দেখেছ যে আর্যরা কোন বিদেশ থেকে এসেছে ? কোথায় পাচ্ছ যে, তারা বুনোদের মেরে কেটে ফেলেছেন ?”

” সাধ করে শিখেছিনু সাহেবানি কত, গোরার বুটের তলে সব হৈল হত। ধন‍্য ইংরেজ সরকার !”

” তোমরা উচ্চবর্ণরা কি বেঁচে আছ ? তোমরা হচ্চ দশ হাজার বছরের মমি !”

” আমাদের মত দুনিয়ায় কেউ নেই, আর্যবংশ !!
কোথায় বংশ তা জানি না …. এক লাখ লোকের দাবানিতে ৩০০ মিলিয়ন ( ত্রিশ কোটি) কুকুরের মত ঘোরে, আর তারা আর্যবংশ !!!

” গোলাম কীটগুলো, এক পা নড়বার ক্ষমতা নাই —স্ত্রীর আঁচল ধরে তাস খেলে গুড়ুক ফুঁকে জীবনযাপন করে, আর যদি কেউ ঐগুলোর মধ‍্যে এক পা এগোয়,সবগুলো কেঁউ কেঁউ করে তার পিছু লাগে “

” বলি হ‍্যাঁগা,সমুদ্র পার হতে হনুমানের “সী সিকনেস ‘ হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে পুঁথিতে কিছু পেয়েছ ? তোমরা পোড়ো পন্ডিত মানুষ, বাল্মিকী- অল্মিকী কত জান, আমাদের ‘গোঁসাইজী’ তো কিছুই বলছেন না।”

” এখন মিশনারীর ঘরে বাঘ সেঁধিয়েছে। এখানকার দিগগজ দিগগজ পাদ্রীতে ঢের চেষ্টাবেষ্টা করলে — এ গিরিগোবর্ধন টলাবার জো কি।”

” ও সকল কেষ্ট বিষ্টু বেশ ঠাকুর ছিলেন; কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণে একাধারে সব ঢুকে গেছেন। শিক্ষা দাও যে অন‍্য সকল দেবকে নমস্কার, কিন্তু পূজা রামকৃষ্ণের।”

” কোন একটা স্বাধীন চিন্তা কাহারও মাথায় আসে না — সেই ছেঁড়া কাঁথা, সকলে পড়ে টানাটানি — রামকৃষ্ণ পরমহংস এমন ছিলেন, তেমন ছিলেন; আষাঢ়ে গপ্পি — গপ্পির আর সীমা – সীমান্ত নাই। “
“ওদের মত চিত্র বা ভাস্কর্য বিদ‍্যা হতে আমাদের এখনও ঢের দেরী ! ও দুটো কাজে আমরা চিরকালই অপটু। আমাদের ঠাকুর দেবতা সব দেখ না,জগন্নাথেই মালুম!!”

” যেই পোড়া আরঙ্গজেব আবার ঐখানটায় ঘা দিলে, অমনি এতবড় মোগল রাজ‍্য স্বপ্নের ন‍্যায় উড়ে গেল।”

” ক্রোর টাকা খরচ করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুরঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর কাপড় ছাড়ছেন, তো এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন তো, এই ঠাকুর আঁটকুঁড়ির বেটাদের গুষ্টির পিন্ডি করছেন ; এদিকে জ‍্যান্ত ঠাকুর অন্ন বিনা, বিনা বিদ‍্যা মরে যাচ্ছে। বোম্বায়ের বেনেগুলো ছারপোকার হাসপাতাল বানাচ্ছে — মানুষগুলো মরে যাক। ….. আমাদের দেশে মহা ব‍্যারাম — পাগলা গারদ দেশময়। “

রয়েছে হাঙ্গর শিকারের প্রাঞ্জল বর্ণনা,

ঐ —- টোপটা মুখে নিয়েছে, এইবার — ঐ ঐ চিতিয়ে পড়ল ; হয়েছে ; টোপ খেয়েছে —- টান্ টান্ টান্ ৪০৷৫০ জনে টান, প্রাণপণে টান। কি জোর মাছের ! কি ঝটাপট — কি হাঁ। টান্ টান্। জল থেকে এই উঠল, ঐ যে জলে ঘুরছে, আবার চিতুচ্ছে, টান্ টান্। যাঃ টোপ খুলে গেল ! হাঙ্গর পালালো। ……. আবার সেটা ছিল ‘বাঘা’ —- বাঘের মতো কালো কালো ডোরা কাটা। ….. কিন্তু নেহাত হতাশ হবার প্রয়োজন নেই —— ঐ যে পলায়মান ‘বাঘা’-র গা ঘেঁষে আর একটা প্রকাণ্ড ‘থ্যাবরামুখো’ চলে আসছে ! আহা হাঙ্গরদের ভাষা নেই ! নইলে ‘বাঘা’ নিশ্চিত পেটের খবর তাকে দিয়ে সাবধান করে দিত। নিশ্চিত বলত, ‘দেখ হে সাবধান, ওখানে একটা নূতন জানোয়ার এসেছে, বড় সুস্বাদু সুগন্ধ মাংস তার, কিন্তু কি শক্ত হাড়! এতকাল হাঙ্গর-গিরি করছি, কত রকম জানোয়ার —- জ্যান্ত, মরা, আধমরা —– উদরস্থ করেছি, কতরকম হাড়-গোড়, ইট-পাথর, কাঠ-টুকরো পেটে পুরেছি, কিন্তু এ হাড়ের কাছে আর সব মাখম হে —- মাখম !! এই দেখ না —– আমার দাঁতের দশা, চোয়ালের দশা কি হয়েছে’ —— বলে একবার সেই আকটিদেশ-বিস্তৃত মুখ ব্যাদান করে আগন্তুক হাঙ্গরকে অবশ্যই দেখাত। সেও প্রাচীনবয়স-সুলভ অভিজ্ঞতা সহকারে — চ্যাঙ-মাছের পিত্তি, কুঁজো-ভেটকির ফিলে, ঝিনুকের ঠাণ্ডা সুরুয়া ইত্যাদি সমুদ্রজ মহৌষধির কোন-না-কোনটা ব্যবহারের উপদেশ দিতই দিত। ( পরিব্রাজক )

“ফরাসী বড় সাবধান, বাজে খরচ করে না। এই ঘোর বিলাস, এই হোটেল কাফে, যাতে একবার খেলে সর্বস্বান্ত হতে হয়, এসব আহাম্মক বিদেশী ধনীদের জন‍্য। ফরাসীরা বড় সুসভ‍্য, আদব কায়দা বাজায়, খাতির খুব করে, পয়সাগুলি সব বার করে নেয়, আর মুচকে মুচকে হাসে।” ( প্রাচ‍্য ও পাশ্চাত‍্য )

” বলি রামচরণ ! তুমি লেখাপড়া শিখিলে না, ব‍্যবসা বানিজ‍্যেও সঙ্গতি নাই, শারীরিক শ্রমও তোমার দ্বারা সম্ভব নয়, তার ওপর নেশাভাঙ্ এবং দুষ্টামিগুলাও ছাড়তে পার না, কি করে জীবিকা কর বল দেখি ?

রামচরণ — সে সোজা কথা মশায়, আমি সকলকে উপদেশ করি।”

…………………………………………………………………..

” সে মোসলমানি সভ‍্যতা,কাফগাফের বিশুদ্ধ উচ্চারণ সমেত লস্করী জবানের পুষ্পবৃষ্টি, আবা কাবা চুস্ত পায়জামা, তাজ মোড়াসার রঙ্গ বেরঙ্গ শহরপসন্দ ঢঙ্গ অতদূর গ্ৰামে গিয়ে ঠাকুর সাহেবদের স্পর্শ করতে আজও পারেনি। কাজেই ঠাকুররা সরল সিধে, সর্বদা শিকার করে , জমামরদ কড়াজান আর বেজায় মজবুত দিল।”

স্বামীজীর লেখা নকশাগুলিতে কথ‍্য বাংলা আর উর্দু, ফার্সি মেশানো যে স্টাইলটি দেখতে পাওয়া যায়, পরবর্তী কালে সৈয়দ মুজতবা আলীর অসাধারণ রচনা পড়তে পড়তে কোথাও কোথাও যেন স্বামীজিকে খুঁজে পাওয়া যায়।
অগাধ পান্ডিত‍্য সত্ত্বেও লেখার সময় দুজনেই মঞ্চ থেকে পাঠকের সমভূমিতে নেমে আসেন।
…………………………………………………………….

স্বামীজীর গদ‍্য সর্বাঙ্গসুন্দর, তা বলা যায় না।

মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত শিক্ষকমানুষ হওয়া সত্ত্বেও “শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত” গুরুচন্ডালী দোষে দুষ্ট, কারণ সাধু ও চলিত ভাষা মিশিয়ে লেখার ত্রুটিপূর্ণ প্রবণতা সেসময় খুব সহজভাবেই গ্ৰাহ‍্য হত।

স্বামীজির লেখা চিঠিগুলিতে সাধু ও চলিত ভাষার সহাবস্থান চোখে পড়ে।

অসিতকুমার বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের মতে ” ভাষার এই ব‍্যাধিটি উনিশ শতক ধরেই বর্তমান ছিল, রবীন্দ্রনাথের আগে অপরিহার্য বলে সকলেই মেনে নিয়েছিলেন, অনেকটা দুধ ও জলের সংমিশ্রণের মতো। “
…………………………………………………………………

এত আলোচনার সূত্রপাত একটি সদ‍্যপ্রকাশিত বইয়ের সূত্রে।

এবছর রামকৃষ্ণদেবের পূত জন্মতিথিতে ( ১ চৈত্র, ১৪২৭ ) প্রকাশিত হয়েছে ” সাহিত্যে ও রসসাহিত‍্যে বিবেকানন্দ “।

শ্রীমতি কুমকুম সমাদ্দারের দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের ফসল এই বইটি।

ইতিপূর্বে তাঁর বেশ কিছু বই প্রকাশিত হয়েছে দেজ, পত্র ভারতী প্রভৃতি সংস্থা থেকে।
কুমকুমদেবীর আরেকটি উল্লেখযোগ্য বই ” মা সারদার অষ্টোত্তর শতনাম ” প্রকাশিত হয়েছিল উদ্বোধন কার্যালয় থেকে ( ২০১০)।

বিবেকানন্দ নামের prismটি থেকে আলোকরশ্মির নানা বর্ণের যে বিচ্ছুরণ, তার একেকটি কিরণ নিয়ে বিদগ্ধজন এযাবৎ অনেক আলোচনা, গবেষণা, বিচার বিশ্লেষণ করেছেন এবং করছেন। তাঁর অনন‍্যসাধারণ সাহিত‍্যপ্রতিভা নিয়ে চর্চা তুলনায় কমই হয়েছে।

“সাহিত্যে ও রসসাহিত‍্যে বিবেকানন্দ” নামে বইটি সেই অভাব পূরণ করেছে।

সূত্রধর প্রকাশনা সংস্থা শ্রীরামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ ও ভগিনী নিবেদিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে অসাধারণ সব বই করেছেন। এটি সেই ধারায় নবতম সংযোজন।

সাহিত‍্যিক এবং রসসাহিত‍্যিক স্বামীজিকে আরেকটু কাছ থেকে দেখা, আরও গভীরভাবে জানার প্রচেষ্টাই এই বইয়ের মূল উদ্দ‍্যেশ‍্য।

বইতে বিষয়ানুগ পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা তো আছেই, এছাড়াও কয়েকটি বিষয়ে লেখিকার পর্যবেক্ষণ অত‍্যন্ত মৌলিক।

যেমন বিবেকানন্দের লেখায় কয়েকটি নূতন শব্দ বা coinage , দেবভাষার প্রয়োগ, বিবেক সাহিত‍্যে প্রবাদের ব‍্যবহার, সমাজতান্ত্রিক বা Socialistic দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেকানন্দের কিছু রচনা, কুন্ঠাহীন সত‍্য কথন, ব‍্যঙ্গ রসাত্মক নকশা ইত্যাদি নানা খুঁটিনাটি বিষয় নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা রয়েছে এই বইটিতে।

গভীর প্রজ্ঞাময় প্রাবন্ধিক, অতুলনীয় বক্তা, উৎকৃষ্ট ভ্রমণ সাহিত‍্য রচয়িতা, ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, সমাজতাত্ত্বিক, স‍্যাটায়ারিস্ট, সংগীতজ্ঞ বিবেকানন্দের লেখকসত্ত্বার বিভিন্ন দিক কুমকুম দেবী সঠিকভাবে চিনিয়ে দিয়েছেন।

গবেষণাধর্মী হলেও বিষয়বস্তু ও লেখার গুণে অত‍্যন্ত সুখপাঠ্য হয়েছে বইটি।

কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত সুন্দর প্রচ্ছদ করেছেন। শক্ত মলাটের বইটির ছাপার মান চমৎকার। দাম ২৭৫।

আমি লেখিকার স্নেহভাজন হওয়ার সূত্রে তাঁর নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের প্রতি অটুট বিশ্বাসের প্রত‍্যক্ষ পরিচয় পেয়েছি।

আন্তরিকভাবে চেয়েছি বইটি সর্বসমক্ষে আসুক। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ভীষন প্রয়োজনীয় উপাদান হয়ে উঠবে এই নতুন প্রকাশিত বইটি বিবেকানন্দ চর্চার ক্ষেত্রে।
বইটি পাওয়া যাবে কলেজ স্ট্রীটের দে বুক স্টোরে।

তথ‍্যসূত্র ; ” সাহিত্যে ও রসসাহিত‍্যে বিবেকানন্দ ; কুমকুম সমাদ্দার, সূত্রধর, ১৪২৭

সহাস‍্য বিবেকানন্দ ; শঙ্করীপ্রসাদ বসু, ১৯৮৩

স্বামীজি লিখছেন ; উদ্বোধন কার্যালয়, ১৩৯৮

অমৃতবাণী ; রামকৃষ্ণ মিশন ইন্সটিটিউট অফ কালচার, ১৯৯০

পোস্ট ; ঋতুপর্ণ বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.