যখন আমি এই ব্যাপারে গবেষণা করি তখন দেখলাম যে মেরী লুই বার্থ নামের একজন মহিলা স্বামী বিবেকানন্দের বিদেশ যাত্রার উপর “স্বামী বিবেকানন্দ ইন দ্য বেস্ট: নিউ ডিসকভারি” শীর্ষক ছ’খানা বই লিখেছেন।
মেরী লুই শিকাগো সম্মেলনে উপস্থিত থাকা প্রত্যেক শ্রোতাদের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন আর যারা জীবিত ছিলেন না তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি সম্মেলনের প্রতিটি মুহূর্তের বার্তা মন দিয়ে শুনেছিলেন এবং পরিশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে স্বামী বিবেকানন্দ চতুর্থ ব্যক্তি ছিলেন যিনি ঐ ধর্মসভায় “আমার সকল ভাই-বোন” বলে সম্বোধন করেছিলেন। তাঁর আগে শ্রীলঙ্কার থেকে আসা ধর্মপাল আঙ্গীকারা নামক একজন বৌদ্ধ সাধু, জাপান থেকে আসা এক বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং ভারতের থিওসোফিক্যাল সোসাইটির প্রতিনিধি প্রতাপ চন্দ্র মজুমদারও এই একইভাবে “ভাই-বোন” বলে উপস্থিত শ্রোতাদের সম্বোধন করেছিলেন। তারপরও স্বামীজির ঐ সম্বোধনের পর আড়াই মিনিট ধরে হাততালি শুধু শুধু পড়েনি কারন এর আগেও তো ঐ একইভাবে আরও তিনজনের সম্বোধন করেছিলেন। বরং হাততালির কারন এটাই ছিল যে স্বামীজির বার্তা উপস্থিত শ্রোতাদের মনে সেই ভ্রাতৃত্ববোধ, সেই বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব, সেই আত্মীয়তা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল যা এর আগে কেউ পারেনি। সুভাষচন্দ্র বসু ভীষণ ভালো এবং বলিষ্ঠ বক্তা ছিলেন। মৃতপ্রায় ব্যক্তিকেও তাঁর ভাষনের মাধ্যমে জাগানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর মধ্যে। নিজের নেতৃত্বে হেরে যাওয়া যুদ্ধ বন্দীদের নিয়ে তিনি গড়ে তুলেছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং যাঁর বলিষ্ঠ ভাষনে পুরো দল উজ্জিবিত হয়ে থাকতো। সেই সুভাষচন্দ্র বোস বলেছিলেন যে আজ যদি স্বামী বিবেকানন্দ বেঁচে থাকতেন তাহলে আমি তাঁর চরণে আশ্রয় নিতাম। নেতাজীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে স্বামী বিবেকানন্দ কিভাবে তাঁকে এতোটা প্রভাবিত করলো? তার উত্তরে তিনি কাব্যিকভাবে জানিয়েছিলেন যে — যে কথা ঠোঁট দিয়ে বলা হয় সেটা ঠোঁট পর্যন্ত পৌঁছোয়, যে কথা কন্ঠ নিঃসৃত হয় তা কন্ঠ পর্যন্ত পৌঁছোয় কিন্তু যে কথা হৃদয় নিঃসৃত হয় তা সরাসরি হৃদয়কে স্পর্শ করে আর স্বামীজি হৃদয় থেকেই কথা বলেন।
পুরো দেড় মাস ধরে আমেরিকাতে স্বামীজিকে নানান অপমান সহ্য করতে হয়েছিল। খাদ্য, বাসস্থানের জন্য দরজায় দরজায় ঘোরার সাথে সাথেই “ই্যুউ ব্ল্যাক গেট আউট”- এর মতো অপমানজনক গরল যিনি অনায়াসে পান করে দাঁতে দাঁত চেপে পড়েছিলেন অতগুলো দিন, তারপরও ধর্মসম্মেলনে দাঁড়িয়ে ঐ আমেরিকাবাসীদের “আমার ভাই ও বোন” বলে সম্বোধন করেছিলেন। উনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে হিন্দুত্বের প্রতিনিধি। ১৮৮৩ সালের ১১সেপ্টেম্বর শিকাগো সম্মেলনে যিনি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে আমি গর্বিত যে আমি হিন্দু এবং তিনি সেই হিন্দুত্বের প্রতিনিধি। যিনি পুরো আমেরিকাবাসীদের নিজের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারেন তিনি তো প্রকৃত অর্থেই তো হিন্দু আর এটাই তো আসল ভারতীয় সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতির কথাই তো বলা হয়েছে আমাদের “বসুদেব কুটুম্বকম” গ্ৰন্থতেও।
আমাদের ভারতের মূল আদর্শ হলো পরিবার। জীবনের কোন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়ার সময় যদি পুরো দলটিকে নিজের পরিবার বলে আপনি মনে না করেন তাহলে সেই দলকে নেতৃত্ব দানের কোন অধিকার নেই আপনার, আর এটাই হল ভারতীয় সংস্কৃতি। আমি বলছি আমাদের সমাজের কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না কারণ আমাদের সমাজ হল সচল,জীবন্ত। একদিন যেসব কারণের জন্য পুরো বিশ্ব ভারতীয়দের উপহাস করতো আজ সারা বিশ্ব সেইসকল কারনগুলোই মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
২০০০ সালে অংলস মেডিসিন নামে একজন অর্থশাস্ত্রীকে কাজ দেওয়া হয়েছিল। যে কাল গননার কথা আপনারা বলেন সেই কাল গননায় ১০০০ বছর হল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কারন বাইবেল অনুযায়ী ১০০০ বছর পূর্ণ হলে মিলেনিয়াম পূর্ন হবে এবং যীশু খ্রিস্ট জন্মগ্ৰহন করবে আর সেদিনই বিচারসভা বসবে। সবাই নিজের নিজের কর্মফল অনুযায়ী ভালো/খারাপের ভাগীদার হবে। কিন্তু ১০০০ বছর পর কিছুই হলো না তো সবাই ভাবলো হয়তো ২০০০ বছর পর হবে। এই ২০০০ বছরটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল, অনেক ধর্ম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সারা বিশ্বব্যাপী। এরমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সংগঠন ছিল ওইসিডি- অরগানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট। তারা ২০০০ সালে অ্যাঙ্গাস মেডিসিন নামে একজন অর্থশাস্ত্রীকে কাজ দিয়েছিলেন গোটা বিশ্বের আর্থিক ইতিহাস রচনা করার জন্য। যেহেতু তাদের গননা শূন্য খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু হয় তাই এই অ্যাঙ্গাস মেডিসিনকে কাজ দেওয়া হল শূন্য খ্রীষ্টাব্দ থেকে ২০০০খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ২০০০ বছরের আর্থিক ইতিহাস রচনা করে দেওয়ার। সেই বইটির নাম ছিল “ইকোনোমিক হিস্ট্রি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড মিলেনিয়াল পার্সপেক্টিভ”(অ্যাঙ্গাস মেডিসিন), বইটি ওইসিডি.ওআরজি ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোডও করার ব্যবস্থা আছে। অ্যাঙ্গাস মেডিসিনের মত অনুযায়ী ০ থেকে শুরু করে ১৪৯০-৯৯ বছর পর্যন্ত প্রথম ১৫০০ বছর সারা বিশ্বের মধ্যে ৬৬% জিডিপির দেশ ছিল একমাত্র ভারতবর্ষ।
আমেরিকার ঐতিহাসিক বিল ডুরান্ড তাঁর “হিস্ট্রি অফ সিভিলাইজেশন” নামক বইয়ে লিখেছেন যে সারা পৃথিবীকে সম্পদ বিতরণকারী দেশ হল ভারতবর্ষ। তিনি অত্যন্ত সুচারুভাবে “বিতরন” শব্দটির ব্যবহার করেছেন এই বিষয়ে। আবার খুব আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো যে ভাস্কো-ডা-গামার ভারতে আসার পেছনেও অবদান ছিল এক ভারতীয় ব্যবসায়ীর। উনি ছিলেন গুজরাতী ব্যবসায়ী এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় জলপথে ভাস্কো ডা গা মার সাথে পরিচয় সূত্রে তিনি ১৪৯৮ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের কালিকট বন্দরে এসে উপস্থিত হন। তবে দুঃখের বিষয় এটাই যে ভাস্কো ডা গামার ভারতে আসার ব্যাপারে এই ভারতীয় ব্যবসায়ীর অবদান যা ভাস্কো ডা গামা নিজে তাঁর ডাইরিতে কৃতজ্ঞতা স্বরূপ লিখে গেছেন কিন্তু সেকথা উদ্দেশ্যেপূর্নভাবে চেপে যাওয়া হয়। যারফলে পরবর্তী প্রজন্ম এই তথ্য জানবার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এমনকি তিনি এই কথাও জানিয়ে গেছেন যে তাঁর জাহাজের থেকেও ভারতের এই গুজরাটী ব্যবসায়ী কানহাভাই-এর জাহাজ প্রযুক্তি এবং কার্যক্ষমতার দিক থেকে বেশী উন্নত ছিল। তাই যারা দাবি করেন যে ইংরেজরা ভারতে এসেছিল বলেই ভারত প্রযুক্তি এবং সভ্যতার দিক থেকে উন্নত হয়েছে তাদের এই দাবিটি সম্পূর্ণভাবে ভুল। আজ যদি ইংরেজরা ভারতে নাও আসতো তবুও ভারত প্রগতি, প্রযুক্তি,সভ্যতা এবং অন্যান্য সমস্ত দিক থেকে এর থেকেও বেশী উন্নত হতো এমনকি এতোটাই উন্নত হতো যে পৃথিবীর বাকি সমস্ত দেশকে ভারতীয় সভ্যতা, প্রযুক্তি, শিক্ষা তথা পুরো ভারতীয় সংস্কৃতিকেই ধার নিতে হতো।
বক্তা—— শ্রী মুকুল কানিটকর