প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে যেখানে হাসপাতাল চিকিৎসক ইত্যাদি শব্দ নিতান্তই অপরিচিত সেখানে প্রসূতি মহিলাদের একমাত্র ভরসা শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত—এমনকী অশিক্ষিত ধাত্রীরা। সন্তানের জন্ম দিতে মাকে সাহায্য করা থেকে শুরু করে সদ্যোজাত শিশুর রক্ষণাবেক্ষণ সব কাজই তারা করে থাকেন। এটা তাদের পেশাগত কাজ বা পরিচয় হলেও সদ্যোজাত শিশুর কাছে মা যেমন আপন, তেমনই আপন তার ধাইমাও। এই প্রসঙ্গে আমাদের সকলেরই একটা কথা মনে পড়বে। উপনয়নের সময় শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসতার ধাইমার কাছ থেকে প্রথম ভিক্ষে নিয়েছিলেন। এই একটি ঘটনা দেখিয়ে দেয় গ্রামাঞ্চলে ধাইমাদের গুরুত্ব কতখানি।
সুলাগত্তি নরসাম্মা এমনিই একজন ধাইমা। সংক্ষেপে আম্মা। পদ্মশ্রী সম্মানে সম্মানিত আম্মা সম্প্রতি পরলোক গমন করেছেন। রেখে গেছেন পনেরো হাজারেরও বেশি মানবশিশুকে। যাদের তিনি নিজের হাতে লালন-পালন করেছেন। সেইসব সৌভাগ্যবান আজ প্রাপ্তবয়স্ক, স্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত এবং অন্যরকম এক মাতৃবিয়োগের যন্ত্রণায় কাতর।
মাত্র কুড়ি বছর বয়েসে আম্মা ধাইয়ের কাজ শুরু করেন। সেটা ১৯৪০ সাল। তারপর সাত দশক ধরে তিনি ক্রমাগত কাজ করে গেছেন। পনেরো হাজারেরও বেশি শিশুর জন্ম হয়েছে তার হাতে। কিন্তু এই কাজের জন্য তিনি কারো কাছ থেকে কোনও পারিশ্রমিক নেননি। পার্থিব প্রয়োজনকে তুচ্ছ করে এভাবে নিজেকে জনসেবায় বিলিয়ে দিতে সবাই পারে না। এই জন্যেই স্থানীয় মানুষজন শ্রদ্ধায় এবং আদরে তাকে সুলাগত্তি বলে ডাকতেন। কন্নড় ভাষায় সুলাগত্তি কথাটির অর্থ, সেবিকা।
আম্মা সেবাকাজের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার ঠাকুমা মারগাম্মার কাছ থেকে। মারণাগাম্মাও ছিলেন ধাত্রী। একটি ইংরেজি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আম্মা একবার বলেছিলেন, ধাত্রীর কাজ আমি শিখেছি ঠাকুমার কাছ থেকে। আমার পাঁচ সন্তানের জন্মও হয়েছিল ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে।
অসম্ভব জনপ্রিয় ছিলেন আম্মা। ২০০৭ সালের মধ্যে তার নাম কৃষ্ণপুরার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। ওই বছরেই দুই লেখিকা অন্নপূর্ণা বেঙ্কাটানানজাপ্পা এবং বা হা রামকুমারী তার সন্ধান পান। তাদের লেখার সূত্র ধরে একটি জেলাস্তরের পুরস্কারের জন্য আম্মার নাম বিবেচিত হয়। এরপর জেলা ও রাজ্যস্তরের আরও অনেক পুরস্কার তিনি পেয়েছেন। কিন্তু ২০১৪ সালে এবং তারপর যা হলো তা ইতিহাস। ২০১৪ সালে তুমকুর বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডি. লিট প্রদান করে। গ্রামের সহজ সরল আম্মা হয়ে গেলেন ড. সুলাগত্তি নরসাম্মা। এরপর ২০১৮ সাল। কর্ণাটকের পাভাগাদা তালুকের কৃষ্ণপুরার আম্মাকে পদ্ম-সম্মানে সম্মানিত করল দেশ। নিতান্ত আটপৌরে জীবনের খড়ির দাগ মুছে তিনি এসে দাঁড়ালেন রাষ্ট্রপতি ভবনের উজ্জ্বল আলোর নীচে। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের হাত থেকে হুইলচেয়ারে বসা আম্মা যখন পুরস্কার নিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী-সহ উপস্থিত সকলেই হাততালি দিয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। সাধারণ মানুষের মধ্যেও মহামানবের সংখ্যা কম নয়। এতদিন তাদের হিসেবের বাইরে রাখা হয়েছিল। তাদের পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল দেশ এটাই চেয়েছিল, দেশ এটাই চায়।
ঠাকুমা তাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। স্থানীয় পারিপার্শ্বিক তাকে সাহায্য করেছিল। আম্মার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, আশেপাশের পাহাড় ও জঙ্গল থেকে বনবাসী গিরিবাসী মানুষ তাদের গ্রামে আশ্রয় নেবার জন্য আসতেন। আম্মা তাদের নানাভাবে সাহায্য করতেন। কৃতজ্ঞ মানুষগুলি আম্মাকে ভেষজবিদ্যা শিখিয়েছিল। এই শিক্ষা হয়ে উঠেছিল আম্মার সাফল্যের মস্ত বড়ো হাতিয়ার। আম্মা গর্ভস্থ শিশুর নাড়ি পরীক্ষা করতে পারতেন। এছাড়া শিশুর স্বাস্থ্য এবং কোনদিকে তার মাথা—সে বিষয়ে তার সম্যক জ্ঞান ছিল। এ বছর ২৫ ডিসেম্বর আম্মা মারা গেছেন। দেশ হারিয়েছে এক নিবেদিত প্রাণ সেবিকাকে। আম্মার অভাব সম্ভবত কোনওদিনই পূরণ করা যাবে না। কারণ ধাই থেকে ধাইমা হতে সবাই পারবেন না। ঠিক যেমনটা আম্মা পেরেছিলেন।